ড. মুহা. রফিকুল ইসলাম |
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَن تَكُونَ تِجَارَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ ۚ وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا – وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا.
অনুবাদ :
২৯) হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলো না। লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক রেজামন্দির ভিত্তিতে। আর নিজেকে হত্যা করো না। নিশ্চিত জানো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি মেহেরবান। ৩০) যে ব্যক্তি জুলুম ও অন্যায় বাড়াবাড়ি করে এমনটি করবে তাকে আমি অবশ্যই আগুনে নিক্ষেপ করবো। আর আল্লাহর জন্য এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। (সূরা আন নিসা)
নামকরণ ও সূরা আন নিসার সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান
(আরবি ভাষায় : سورة النساء, অর্থ “মহিলা”) আল-কুরআনের চতুর্থ সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ১৭৬টি এবং এর রুকুর সংখ্যা ২৪টি। আন নিসা সূরাটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। ২৪ নং আয়াতে উল্লিখিত ‘আন নিসা’ শব্দ থেকে এ সূরা নামকরণ হয়েছে। এ সূরাতে মুসলিমদের জীবন পরিচালনা ও কিভাবে একতাবদ্ধ থাকতে হবে সে সম্পর্কে বলা আছে।
নাজিল হওয়ার সময়কাল ও বিষয়বস্তু
এ সূরাটি কয়েকটি ভাষণের সমষ্টি। সম্ভবত তৃতীয় হিজরির শেষের দিক থেকে নিয়ে চতুর্থ হিজরির শেষের দিকে অথবা পঞ্চম হিজরির প্রথম দিকের সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন অংশ নাজিল হয়। (তাফহীমুল কুরআন)
সূরা নিসার আলোচ্য বিষয়
এই সূরাটির মধ্যে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে মৌলিক আলোচ্য বিষয় দুটি। ক. নারী, এতিম, উত্তরাধিকার, বিবাহ ও পারিবারিক অধিকার সংক্রান্ত। খ. বৃহৎ পরিবার, মদিনার বিভিন্ন সম্প্রদায় যেমন মুনাফিক, কাফির ও মুশরিক এবং তাদের সঙ্গীদের বিভিন্ন আলোচনা।
আলোচ্য আয়াতদ্বয়ের বিষয়বস্তু
এখানে মহান আল্লাহ অনেক ব্যাপারে মু’মিনদের নসিহত করেছেন।
ক. তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলো না।
খ. লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক রেজামন্দির ভিত্তিতে।
গ. আর নিজেকে হত্যা করো না।
ঘ. জুলুম ও বাড়াবাড়ি করা যাবে না।
ঙ. জুলুম ও বাড়াবাড়ি করলে অবশ্যি আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।
এ আয়াতসমূহে মৌলিকভাবে যে সকল ব্যাপারে বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যা করা এ পরিসরে সম্ভব নয়। এ জন্য وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ‘আর নিজেকে হত্যা করো না’ এ নির্দেশ দ্বারা কী বুঝানো হচ্ছে তা নিয়েই আলোচনা করা হলো।
আয়াতের তাফসির
وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ‘আর তোমরা নিজেকে হত্যা করো না’ এ বাক্যটি আয়াতের আগের বাক্যের পরিশিষ্ট হতে পারে আবার একটি স্বতন্ত্র বাক্যও হতে পারে। একে যদি আগের বাক্যের পরিশিষ্ট মনে করা হয় তাহলে এর অর্থ হয় অন্যের অর্থ-সম্পদ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা আসলে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করার নামান্তর। এর ফলে সমাজব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। এর অনিষ্টকর পরিণতি থেকে হারামখোর ব্যক্তি নিজেও রক্ষা পেতে পারে না এবং আখেরাতে এর কারণে মানুষ কঠিন শাস্তির অধিকারী হয়। আর যদি একে একটি স্বতন্ত্র বাক্য মনে করা হয় তাহলে এর দু’টি অর্থ হয়।
এক. পরস্পরকে হত্যা করো না।
দুই. আত্মহত্যা করো না।
মহান আল্লাহ এ ক্ষেত্রে এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার রেখেছেন এবং বাক্য এমনভাবে গঠন করেছেন যারা ফলে এই তিনটি অর্থই এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে এবং তিনটি অর্থই সত্য। (তাফহীমুল কুরআন) আয়াতের এ অংশের তাফসির আল মাওয়ারদিতে (Abū al-Hasan ‘Alī Ibn Muḥammad Ibn Habīb al-Māwardī 972-1058) বলা হয়েছে-
১. ولا يقتل بعضكم بعضا ‘তোমরা একে অপরকে হত্যা করো না।’
২. نهى أن يقتل الرجل نفسه في حال الغضب و الضجر ‘ব্যক্তি নিজেকে রাগ অথবা উত্তেজনার সময় হত্যা না করা।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল কায়্যিম আল জাওযি (রহ) বলেন এখানে পাঁচটি কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- و أن الله حرم على العبد قتل نفسه ‘আল্লাহ তাআলা ব্যক্তিকর্তৃক নিজেকে হত্যা করা হারাম করেছেন।’ প্রাগুক্ত কয়েকটি তাফসিরের ভাষ্য অনুযায়ী আত্মহত্যা করা হারাম প্রমাণিত হয়।
আত্মহত্যা কাকে বলে?
আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম কষ্ট ও যন্ত্রণা দেওয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের যাবতীয় কাষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটানো।
ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা
আত্মহত্যা সম্পর্কে ইসলামী শরিয়ত কী বলে? ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা কবিরা গুনাহ। শিরকের পর সবচে বড় গুনাহ। সকল ফিকহবিদ এবং চার মাজহাবেই আত্মহত্যা হারাম। কারণ, আল্লাহ তাআলা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। ধনী-গরিব, বিদ্বান-মূর্খ, রাজা-প্রজা সবাইকে মরতেই হবে। সেটা অবশ্যই মহান আল্লাহর প্রদত্ত সময়ের আলোকে। আমরা নিজেরা নিজেদের জীবন শেষ করার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। কারণ জীবনটা আমি দেইনি। এ জন্য মহান আল্লাহ বলেন- وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ
‘আর তোমরা নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
রাসূলুল্লাহ সা. এ কাজ থেকে বিরত থাকতে মানুষকে নানাভাবে সতর্ক করেছেন। যেমন- সাবিত বিন যিহাক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَىْءٍ فِى الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে।’ (বুখারি : ৫৭০০; মুসলিম : ১১০) অন্য এক হাদিসে রয়েছে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
্র مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَهْوَ فِى نَارِ جَهَنَّمَ ، يَتَرَدَّى فِيهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ، وَمَنْ تَحَسَّى سَمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ ، فَسَمُّهُ فِى يَدِهِ ، يَتَحَسَّاهُ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا ، وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ ، فَحَدِيدَتُهُ فِى يَدِهِ ، يَجَأُ بِهَا فِى بَطْنِهِ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا.
‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে। (সহিহ বুখারি : ৫৪৪২; মুসলিম : ১০৯)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে- দোজখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে। আর যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন সে নিজেকে উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।’ (সহিহ ইবন হিব্বান : ৫৯৮৭; তাবরানি : ৬২১)
জুনদুব ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
্র كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ بِهِ جُرْحٌ فَجَزِعَ فَأَخَذَ سِكِّينًا فَحَزَّ بِهَا يَدَهُ فَمَا رَقَأَ الدَّمُ حَتَّى مَاتَ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى بَادَرَنِي عَبْدِي بِنَفْسِهِ حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ.
‘তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারি : ৩২৭৬; মুসলিম : ১১৩)
রাসূল সা. আত্মহত্যাকারীর জানাজায় অংশগ্রহণ করেননি
আত্মহত্যা এতই গর্হিত কাজ যে এর প্রতি ধিক্কার জানিয়ে অন্যদেরকে এ থেকে সতর্ক করতে রাসূলুল্লাহ সা. আত্মহত্যাকারীর জানাজা ত্যাগ করেন। জাবের বিন সামুরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أُتِىَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- بِرَجُلٍ قَتَلَ نَفْسَهُ بِمَشَاقِصَ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ.
‘নবী সা. সমীপে এক ব্যক্তিকে আনা হলো যিনি নিজেকে তরবারির ফলা দিয়ে মেরে ফেলেছে। ফলে তিনি তার জানাজা পড়লেন না।’ (মুসলিম : ২৩০৯)
অপর বর্ণনায় রয়েছে, জাবের বিন সামুরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَجُلا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَصَابَتْهُ جِرَاحٌ ، فَآلَمَتْ بِهِ ، فَدَبَّ إِلَى قَرْنٍ لَهُ فِي سَيْفِهِ فَأَخَذَ مِشْقَصًا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সাহাবি আহত হন। এটি তাকে প্রচ- যন্ত্রণা দেয়। তখন তিনি হামাগুড়ি দিয়ে একটি শিংয়ের দিকে এগিয়ে যান, যা তার এক তরবারির মধ্যে ছিল। এরপর তিনি এর ফলা নেন এবং আত্মহত্যা করেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সা. তার জানাজা পড়াননি। (তাবরানি : ১৯২৩)
আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়া বৈধ
সমাজে অনেকে মনে করেন কেউ আত্মহত্যা করলে তার বুঝি জানাজা পড়া যাবে না। ওপরের হাদিসটিও কেউ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত হাদিস-ব্যাখ্যাকারী ইমাম নাববী (রহ) বলেন,
وفي هذا الحديث دليل لمن يقول : لا يصلى على قاتل نفسه لعصيانه , وهذا مذهب عمر بن عبد العزيز والأوزاعي , وقال الحسن والنخعي وقتادة ومالك وأبو حنيفة والشافعي وجماهير العلماء : يصلى عليه , وأجابوا عن هذا الحديث بأن النبي صلى الله عليه وسلم لم يصل عليه بنفسه زجرا للناس عن مثل فعله , وصلت عليه الصحابة ” انتهى.
‘এ হাদিসকে তাঁরা প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, মানুষকে সতর্ক করার জন্য যারা আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়া হবে না বলে মত দেন। এটি উমর বিন আবদুল আজীজ ও আওজায়ী (রহ)-এর মত। তবে হাসান বসরি, ইবরাহিম নখঈ, কাতাদা, মালেক, আবু হানিফা, শাফেয়ি ও সকল আলিমের মতামত হলো, তার জানাজা পড়া হবে। উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. মূলত অন্যদেরকে এ ধরনের মন্দ কাজ থেকে সতর্ক করার জন্যই আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়ানো থেকে বিরত থেকেছেন। আর সাহাবিগণ তাঁর স্থলে এমন ব্যক্তির জানাজা পড়েছেন। (শারহু মুসলিম : ৭/৪৭)
তাই গণ্যমান্য আলেম ও বিশেষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের জন্য করণীয় হলো আত্মহত্যাকারীর জানাজা না পড়ানো। বরং সাধারণ কাউকে দিয়ে তাদের জানাজা পড়িয়ে দেয়া। এ সূত্র ধরেই আমাদের সমাজে উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেমের স্থলে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেম দ্বারা আত্মহত্যাকারীর জানাজার সালাত পড়ানো হয়।
আত্মহত্যাকারী কি চিরস্থায়ী জাহান্নামি হবে?
কেউ যখন নিজেকে হত্যা করে তখন সে নিজেকে মূলত আল্লাহর গজব ও ক্রোধের শিকারে পরিণত করে। সে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কারণ, তা কোনো শিরকি কাজ নয়। একমাত্র শিরকই এমন গুনাহ আল্লাহ যা ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلَۢا بَعِيدًا
‘নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরিক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরিক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হলো।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৪৮)
শিরক ছাড়া যা আছে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আর আত্মহত্যা শিরক নয়। তেমনি যিনা, চুরি, মদ্যপান; সবকিছুই গুনাহ বটে। তবে তা শিরক নয়। এসবে লিপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। কেউ যখন এসব গুনাহে লিপ্ত হয়ে মারা যাবে আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন- তার নেক কাজগুলোর বদৌলতে কিংবা ইসলামে বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আর তিনি চাইলে তাকে তার অপরাধ অনুপাতে শাস্তি দেবেন। অতঃপর সে গুনাহ থেকে পবিত্র হবার পর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিশ্বাস মতে সে চির জাহান্নামি হবে না। কোনো গুনাহগারই অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। খুনি, মদ্যপ কিংবা অন্য কোনো অপরাধীও নয়। কিন্তু ওপরে যেমন বলা হলো, আল্লাহ চাইলে তাকে শাস্তি দেবেন, তার অপরাধ অনুযায়ী তাকে আজাব দেবেন তারপর তাকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। একমাত্র কাফেররাই শুধু জাহান্নামে অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহতে অবিশ্বাসী মুশরিক কাফেররাই শুধু জাহান্নামে চিরকাল থাকবে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। রাসূলুল্লাহ সা. আনীত দ্বীনকে যারা অস্বীকার করেছে। তবে শুধু খারেজি ও মুতাজিলা সম্প্রদায় মনে করে আত্মহত্যাকারী চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। তাদের মতে গুনাহগার ব্যক্তিরাও চির জাহান্নামি। এ দু’টি দলই ভ্রান্ত ফিরকা। এটি তাদের ভ্রান্ত মত। কেননা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিবৃন্দ এবং তাঁর আদর্শ অনুসারীদের মত হলো, গুনাহগার ব্যক্তিরা চির জাহান্নামি হবে না। কারণ গুনাহগার মাত্রেই সে নিজেকে অপরাধী ভাবে। বরং শয়তানের প্ররোচনায় বা প্রবৃত্তির তাড়নায় সে গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। তাই সে অনন্তকাল জাহান্নামি হবে না। বরং আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে তার ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অন্যথায় তাকে তার সাজা ভোগ করার পর জাহান্নাম থেকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর এ ব্যাপারে হাদিসের কোনো অভাব নেই যে মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করবে অতঃপর সাজা খেটে সেখান থেকে জান্নাতে দাখিল হবে। অবশ্য কেউ যদি নিজের গুনাহকে বৈধ মনে করে বা আল্লাহর বিধানের সঙ্গে কুফরিবশত গুনাহ করে বা আত্মহত্যা করে তবে সবার মতে সে জাহান্নামি। জাহান্নামই তার স্থায়ী ঠিকানা।
আত্মহত্যাকারীর জন্য দোয়া করার বিধান
কেউ আত্মহত্যা করলে তার জন্য ক্ষমা ও রহমতের দোয়া করা যাবে না যেমনটি আমাদের সমাজের অনেকে মনে করেন। বরং অধিক পাপী হওয়ার কারণে ওই ব্যক্তির জন্য আরো বেশি বেশি দোয়া করা উচিত। আত্মহত্যা কোনো কুফরি কাজ নয়, যার মাধ্যমে মানুষ ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যায়। দোয়া করা যাবে না কেবল ওই ব্যক্তির জন্য যে ঈমানহীন অবস্থায় মারা যায়।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?
মানুষ কখন আত্মহত্যা করে? যখন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজেকে সে অসহায় ও ভরসাহীন ভাবে, তখনই সে আত্মহত্যা করে। নানা সমস্যায় পড়ে মানুষ আত্মহত্যার এ নিন্দিত পথ বেছে নেয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ এবং যৌতুক নিয়ে ঝগড়া-বিবাদকে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা।
২. অভিভাবক তথা পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে অভিমানজনিত আত্মহত্যা।
৩. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহত্যা।
৪. আরোগ্য থেকে হতাশ হয়ে জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত যন্ত্রণাকাতর ব্যক্তির আত্মহত্যা।
৫. প্রেমে বা ভালোবাসায় ব্যর্থ বা প্রতারিত ও মিথ্যা অভিনয়ে ফাঁদে পড়া নারী বা পুরুষের আত্মহত্যা।
৬. ব্যবসা-বাণিজ্যে বা শেয়ারবাজারে বারবার ব্যর্থ হওয়া ব্যক্তির আত্মহত্যা।
৭. শত্রুর হাতে ধরা পড়া থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা।
৮. জীবনবোধ, নিজ মূল্য ও কর্তব্য বুঝতে না পেরে আত্মহত্যা। এ ছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে আত্মহত্যার আরও অনেক কারণ ঘটতে পারে।
আত্মহত্যা থেকে বাঁচার উপায়
মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন এক রকম কাটে না। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্রই পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো দিন কাটে সুখে, কখনো কাটে দুঃখে। কখনো আসে সচ্ছলতা। আবার কখনো দেখা দেয় দরিদ্রতা। কখনো থাকে প্রাচুর্য কখনো আবার অভাব-অনটন। কখনো ভোগ করে সুস্থতা কখনো আক্রান্ত হয়ে পড়ে রোগ শোকে। কখনো দেখা দেয় সুদিন, আবার কখনো আসে দুর্ভিক্ষ। কখনো আসে বিজয়, আবার কখনো আসে পরাজয়। কখনো আসে সম্মান আবার কখনো দেখা দেয় লাঞ্ছনা। এ অবস্থা শুধু বর্তমান আমাদের সময়েই হয়ে থাকে, তা নয়। এটা যুগ যুগ ধরে এভাবেই আবর্তিত হয়ে আসছে। যেহেতু বিপদ-আপদ, কষ্ট-শোক আমাদের নিত্যসঙ্গী তাই সমাজ থেকে আত্মহত্যা নির্মূলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন-
– প্রথমত দরকার পুরো সমাজব্যবস্থায় ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব অনুশীলন। কারণ, মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় হতাশার চরম মুহূর্তে। আর অনুশীলনরত মুসলিম জীবনে হতাশার কোনো স্থান নেই। আল্লাহ বলেন,
يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ
‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আয-যুমার, আয়াত : ৫২)
– মহান আল্লাহ জীবন দিয়েছেন, একমাত্র তিনিই জীবন গ্রহণ করবেন এ বিষয়টা জানা থাকা।
– জীবনে যত বড় গুনাহ হোক না কেন মহান আল্লাহর সাথে শেয়ার করা এবং তাওবা করা।
– সালাত আদায় করা, রোজা রাখা, দান সাদাকা করা। অন্যের অভাব ও অসুবিধার সাথে নিজেরটা তুলনা করা। এবং অন্যের থেকে কতটা ভালো আছি বুঝতে চেষ্টা করা।
– দ্বীনদার অফলাইন মেন্টর এর সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখা।
– আত্মহত্যার কথা মনে আসলে এ বিপদ থেকে রক্ষাকল্পে নফল নামাযে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং সিজদায় গিয়ে বিনীতভাবে আল্লাহর অনুগ্রহ-দয়া ও সাহায্য কামনা করা। প্রতি মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করা। মোট কথা যখনই নিজেকে অসহায় ও আশাহত মনে হয় এবং আত্মহত্যার চিন্তা আসে তখনই মনে করতে হবে এখন শয়তান এসেছে। ইসলামে আত্মহত্যা নাজায়েজ এবং এর পরিণতি জাহান্নাম। তাই এ থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয় ।
– মানুষ অভাব অনটনের জন্য এবং নান সঙ্কটের জন্য আত্মহত্যা করে। সে অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য নিম্নোক্ত দোয়াটি আমলে আনা। উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর এই দোয়াটি পড়তেন
اللَّهُمَّ ، إِنِّي أَسْأَلُكَ رِزْقًا طَيِّبًا ، وَعِلْمًا نَافِعًا ، وَعَمَلا مُتَقَبَّلا
হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে হালাল রিজিক, উপকারী ইলম এবং মাকবুল আমল প্রার্থনা করছি।’ (মুসান্নাফ, আবদুর রাযযাক : ৩১৯১; তাবরানি : ১৯১৬৮)
ফাতিমা রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে একজন খাদেম চাইতে আসলে তিনি তাঁকে সকল রকম সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য এ দোয়া শিখিয়ে দেন-
্রاللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ ، وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ ، رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ ، مُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ الْعَظِيمِ ، أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ
‘হে আল্লাহ, সপ্তাকাশের রব, আরশে আযিমের অধিপতি, আমাদের রব এবং প্রতিটি জিনিসের রব, তাওরাত, ইঞ্জিল ও মহা কুরআনের অবতরণকারী, আপনিই সর্বপ্রথম; অতএব আপনার আগে কোনো জিনিস নেই। আপনিই সর্বশেষ; অতএব আপনার পরে কোনো জিনিস নেই। আপনিই যাহের; অতএব ওপর কিছু নেই। আপনিই বাতেন; অতএব আপনার অজ্ঞাত কিছুই নেই। আপনি আমাদের ঋণ পরিশোধ করুন এবং অভাব ও দারিদ্র্য থেকে আমাদের মুক্তি দিন।’ (তিরমিযি : ৩৪৮১; মুসলিম : ৭০৬৪)
সর্বোপরি জানতে হবে, ব্যক্তি যে কারণে আত্মহত্যা করে বা করার চেষ্টা করে তার কোনোটাই সফল বা বাস্তবায়ন হবে না। বরং এর জন্য মহান আল্লাহর ক্রোধের মুখে পড়তে হবে। অনিবার্যভাবে জাহান্নামে যেতে হবে। আর জাহান্নামে গেলে এই পাপের সাজা শেষ না হওয়া অবধি আর জান্নাতে ফেরা হবে না। সুতরাং মহান আল্লাহ আত্মহত্যার মতো মহাপাপ থেকে বাঁচার মতো জ্ঞান, বুদ্ধি দান আমাদেরকে করুন; সবসময় ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার শক্তি দান করুন। আমিন।
(বি: দ্র: এ দারসের জন্য আল-কুরআন, আল-হাদিস ও তাফসিরের পাশাপাশি ইসলামী বাতায়নসহ অনলাইনের কিছু সাইট ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আরবি ও বাংলা নিবন্ধের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়