হাফেজ মুহাম্মাদ রাশেদুল ইসলাম |
حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، حَدَّثَنَا زَكَرِيَّاءُ، عَنْ عَامِرٍ، قَالَ سَمِعْتُهُ يَقُولُ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ، يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى ”۞
সরল অনুবাদ
হজরত নু’মান ইবনু বাশির রা. বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদের একটি দেহের মত দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ নেয়। (সহিহ বুখারি : আধুনিক প্রকাশনী-৫৫৭৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৭৩, তাওহিদ-৬০১১)
গুরুত্বপূর্ণ শব্দসমূহের অর্থ
تَرَى (দেখবে), تَرَاحُمِهِمْ (পারস্পরিক দয়া), تَوَادِّهِمْ (পারস্পরিক ভালোবাসা), تَعَاطُفِهِمْ (পারস্পরিক সহানুভূতি), الْجَسَدِ (শরীরের একটি অঙ্গ), عُضْوًا (রোগাক্রান্ত হওয়া), السَّهَر (রাত জাগা), الْحُمَّى (জ্বর হওয়া)।
মৌলিক ৩টি শব্দ
১. تَرَاحُمِهِمْ (পারস্পরিক দয়া)।
২. تَوَادِّهِمْ (পারস্পরিক ভালোবাসা)।
৩. تَعَاطُفِهِمْ (পারস্পরিক সহানুভূতি)।
হাদিসটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
মূল কিতাব : সহিহ আল বুখারি
অনুবাদ : আধুনিক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তাওহিদ
অধ্যায় : আচার-ব্যবহার
বিষয় : মানুষ ও জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন
হাদিসের মান : সহিহ
বর্ণনাকারী : নু’মান ইবনু বাশির রা.
হাদিস নং : আধুনিক প্রকাশনী-৫৫৭৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪৭৩, তাওহিদ-৬০১১
গ্রন্থ পরিচিতি : সহিহ আল বুখারি
হাদিস বিশারদগণ হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্ত হাদিসসমূহ সনদ আকারে লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ তা যাচাই-বাছাই করে কিছু হাদিসকে বিশুদ্ধ বলে বাছাই করেন। যার ফলস্বরূপ সিহাহ সিত্তাহ রচিত হয়। বিশুদ্ধ এই ছয়টি কিতাবের অন্যতম হলো الجامع المسند الصحيح المختصر من أمور رسول اللّٰه صلى اللّٰه عليه و سلم وسننه وأيامه সংক্ষেপে সহিহ আল বুখারি।
মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম ইবনে মুগিরা ইবনে বারদিযবাহ আল যুফি আল বুখারি (সংক্ষেপে ইমাম বুখারি) এ গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি ১৯৪ হিজরিতে বুখারা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কিছু বিশেষ গুণাবলি হলো-
– প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী।
– হাফিজে কুরআন।
– হাফিজে হাদিস (৩ লক্ষ হাদিস মুখস্থ করেন)।
– প্রতিটি হাদিস সঙ্কলনের পূর্বে তিনি ২ রাকাত নামাজ আদায় করে ইসতিখারা করেছেন।
– ১৬ বছর ধরে গ্রন্থটি সঙ্কলন করেছেন।
ইমাম বুখারি ১ শাওয়াল ২৫৬ হিজরি তথা ঈদুল ফিতরের দিন ভোরে ইনতিকাল করেন।
সহিহ আল বুখারি গ্রন্থের অনন্য বৈশিষ্ট্য
– ৬ লক্ষ হাদিস থেকে বাছাইকৃত।
– এ গ্রন্থে সহিহ হাদিসের বাইরে কোনো হাদিস নেই।
– মোট ৭৩৯৭টি হাদিস তাকরারসহ এবং তাকরার ছাড়া ২৫১৩টি হাদিস সঙ্কলন করা হয়েছে।
– এই গ্রন্থটিকে কুরআনের পর সবচাইতে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে ধরা হয় (মুকাদ্দামা ফতহুল বারী ওয়া উমদাতুল কারী)।
(ফাতহুল বারী, সহিহ বুখারি-আধুনিক প্রকাশনী, Wikipedia)
রাবী পরিচিতি : নু’মান ইবনু বাশীর
নাম : নু’মান
কুনিয়াত : আব্দিল্লাহ, আবু মুহাম্মদ
পিতার নাম : বাশীর ইবনু সা’দ রা.
মাতা : উমরাহ বিনতে রাওয়াহা রা.
জন্ম : রাসূলুল্লাহ সা.-এর হিজরতের ১৪ মাস পর রবিউস সানি মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তবে কেউ কেউ মনে করেন হিজরতের পর মদিনায় প্রথম জন্মলাভকারী শিশু হচ্ছে নু’মান ইবনু বাশীর রা.। তিনি শিশু সাহাবি ছিলেন।
বেড়ে ওঠা : নু’মান ইবনু বাশীর রা. দ্বীনি পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। পিতা-মাতা উভয় সাহাবা হওয়ার কারণে তাঁদের সাথে নিয়মিত রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে যেতেন। বিশেষ করে মসজিদের সাথে ছোট থেকেই সম্পর্ক ছিলো। মসজিদে মিম্বরের কাছে বসে নিয়মিত বক্তৃতা শুনতেন। একবার তিনি দাবি করে বলেন- ‘রাসূলুল্লাহ সা.-এর রাত্রিকালীন ইবাদত সম্পর্কে আমি অধিকাংশ সাহাবির চেয়ে বেশি জানি।’ শবেকদরে তিনি রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে জেগে নামাজ পড়তেন।
বিশেষত্ব : তিনি একজন সাহিত্য ও কাব্যরসিক মানুষ ছিলেন। দানশীলতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
হাদিস বর্ণনা : হাদিস গ্রহণ ও বর্ণনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন দারুণ সতর্ক ও রক্ষণশীল। তা সত্ত্বেও তাঁর সনদে মোট ১২৪টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে ৫টি হাদিস বুখারি ও মুসলিম মুত্তাফাকুন আলাইহি এবং আলাদাভাবে বুখারি একটি ও মুসলিম ৪টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বিচার ফায়সালার সময় হাদিসের উদ্ধৃতি দিতেন।
ইন্তেকাল : হিজরি ৬৪ সালে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর নু’মান রা. শামের অধিবাসীদের আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা.-এর প্রতি আনুগত্যের আহবান জানালে মারওয়ান তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় হিমসের অদূরে ‘বিরিন’ নামক এক পল্লীতে উভয় পক্ষের সংঘর্ষ হলে নু’মান ইবনু বাশীর রা. শহীদ হন। মস্তক কেটে তাঁর স্ত্রীর নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়। উক্ত ঘটনাটি হিজরি ৬৪ সালের শেষ দিকের, মতান্তরে ৬৫ সালের প্রথম দিকে। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৪ বছর। (সিরাতে ইবনে হিশাম, হায়াতুস সাহাবা, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, Wikipedia)
আলোচ্য বিষয় এবং এর গুরুত্ব
ইসলামী শরিয়ত হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবনপদ্ধতি যা সকল দিক থেকে সার্বিকভাবে মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবনকে গঠন করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে এসব দিকের মধ্যে গুণাবলি শিষ্টাচার ও চরিত্রের দিকটি অন্যতম। ইসলাম এদিকে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে।
وَعَن عَبدِ اللهِ بنِ عَمرِو بنِ العَاصِ رَضِيَ اللهُ عَنهُمَا، قَالَ: لَمْ يَكُن رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم فَاحِشاً وَلاَ مُتَفَحِّشاً، وَكَانَ يَقُولُ: ্র إنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أحْسَنَكُمْ أخْلاَقاً গ্ধ. متفقٌ عَلَيْهِ۞
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা. থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সা. (প্রকৃতিগতভাবে কথা ও কাজে) অশ্লীল ছিলেন না এবং (ইচ্ছাকৃতভাবেও) অশ্লীল ছিলেন না। আর তিনি বলতেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে তোমাদের মধ্যে সুন্দরতম চরিত্রের অধিকারী।’ (রিয়াদুস সালেহিন : তাওহিদ-৬৩০, বুখারি : তাওহিদ-৩৭৫৮)
মানুষের মাঝে সেরা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অন্যতম বিশেষ গুণাবলি হচ্ছে, চারিত্রিকভাবে পরিচ্ছন্নতা। একজন মুমিনকে জীবনের প্রকৃত আকাক্সক্ষা হিসেবে আচরণ বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই বিশেষভাবে বেছে নেওয়া সুন্নাহ। পারস্পরিক ভালোবাসার মাধ্যমে তা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। এ দিক থেকে হাদিসটির গুরুত্ব অপরিসীম।
হাদিসের ব্যাখ্যা
মানুষ জন্মগত স্বভাবেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে; নিজেকে ভালোবাসে। পাশাপাশি মহান আল্লাহর প্রতিও ভালোবাসা সৃষ্টিগতই। আত্মার ভুবনে মূলত ভালোবাসা দুটি পর্যায়ে বিভক্ত: একটি হলো স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম, অন্যটি হলো সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির প্রেম। নিজের প্রতি ভালোবাসার মূল সূত্র ধরেই মানুষ তার বাবা-মা, ভাইবোন, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে ভালোবাসে। স্রষ্টা নিজেও তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন এবং সৃষ্টির সেরা জীবের জন্য পৃথিবীকে সুশোভিত করেছেন।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا مَنۡ يَّرۡتَدَّ مِنۡكُمۡ عَنۡ دِيۡنِهٖ فَسَوۡفَ يَاۡتِىۡ اللّٰهُ بِقَوۡمٍ يُّحِبُّهُمۡ وَيُحِبُّوۡنَهٗۤۙ اَذِلَّةٍ عَلَى الۡمُؤۡمِنِيۡنَ اَعِزَّةٍ عَلَى الۡكٰفِرِيۡنَ۞
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি দ্বীন থেকে ফিরে যায়, (তাহলে ফিরে যাক), আল্লাহ এমনিতর আরো বহু লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারা আল্লাহকে ভালোবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হবে। (সূরা মায়িদা : ৫৪)
সৃষ্টিকে না ভালোবাসলে স্রষ্টাকেও ভালোবাসা যায় না। মানুষ প্রকৃতিপ্রেমে নিমগ্ন হয়, অনেকে আপনজনহীন হয়েও একদল অনাত্মীয়ের ভিড়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কেউ অসহায় কোনো মানুষ, শিশু বা জীবজন্তুকেও নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এরকম ভালোবাসা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمِنۡ اٰيٰتِهٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَكُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِكُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡكُنُوۡۤا اِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُمۡ مَّوَدَّةً وَّرَحۡمَةًؕ اِنَّ فِىۡ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّقَوۡمٍ يَّتَفَكَّرُوۡنَ۞
আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই জাতি থেকে সৃষ্টি করেছেন স্ত্রীগণকে, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করো এবং তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। অবশ্যই এর মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা রুম : ২১)
জাগতিক সব কাজকর্ম ও নেক আমল আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সুদৃঢ় করার উপলক্ষ মাত্র। সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভই ধর্মপ্রাণ মানুষের সর্বোচ্চ মর্যাদার সম্বল। স্রষ্টাপ্রেম অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে তাঁর প্রতি গভীর ধ্যানমগ্নতা, আত্মসমর্পণ ও মনোনিবেশ করা। সমগ্র সৃষ্টি তার স্রষ্টাকে ভালোবাসে, আর স্রষ্টা নিজে তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে ভালোবাসেন। মানবীয় গুণাবলির বিকাশসাধন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং পরপারে পরিত্রাণ লাভ রাসূলুল্লাহ সা.-এর আদর্শ বাস্তবায়নে ও তাঁর ভালোবাসা অন্তরে স্থান দেওয়া ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঘোষিত হয়েছে,
قُلۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰهَ فَاتَّبِعُوۡنِىۡ يُحۡبِبۡكُمُ اللّٰهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوۡبَكُمۡؕ وَاللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِيۡمٌ۞
“হে নবী! লোকদের বলে দাও: যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” তাদেরকে বলো : আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো। (সূরা আলে ইমরান : ৩১)
মানবশ্রেণীতে সর্বাধিক ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম পাত্র হচ্ছেন নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ সা.। উম্মতে মুহাম্মদির প্রতি তাঁর অনুগ্রহ ও অবদান সবচেয়ে বেশি। নবী করিম সা.-এর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা একটি অপরিহার্য কর্তব্য, যার অবর্তমানে ঈমানই পরিশুদ্ধ হয় না।
حَدَّثَنَا أَبُو الْيَمَانِ، قَالَ أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ، قَالَ حَدَّثَنَا أَبُو الزِّنَادِ، عَنِ الأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ۞
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, সেই আল্লাহর শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র হই। (বুখারি : আধুনিক-১৩, ইসলামী ফাউন্ডেশন-১৩)
মুমিনের সবচে বড় দৌলত ঈমান। এই মহা দৌলতের স্বাদ যার নসিব হয়, সমস্ত দুঃখ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। মহব্বতের কারণে সকল তিক্ত মিষ্টে পরিণত হয়। আর এই স্বাদ সে-ই পায়, যার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থাকে।
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، قَالَ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ الثَّقَفِيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا أَيُّوبُ، عَنْ أَبِي قِلاَبَةَ، عَنْ أَنَسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ۞
আনাস রা. থেকে বর্ণিত : নবী সা. বলেছেন, তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে-
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার নিকট অন্য সকল কিছু হতে অধিক প্রিয় হওয়া;
২. কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা;
৩. কুফরিতে প্রত্যাবর্তনকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার মতো অপছন্দ করা। (বুখারি : আধুনিক-১৫, ইসলামী ফাউন্ডেশন-১৫)
মানুষ যে উৎসের পরিপ্রেক্ষিতে একে অন্যকে ভালোবাসে, এ নিয়ে গভীরভাবে বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলতে বাধ্য হবে আমার প্রেম-ভালোবাসা, জীবন-মৃত্যু, আমার সর্বস্ব সেই মহান সত্তার জন্য নিবেদিত, যিনি আমার সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা; যেমনিভাবে বলেছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ)। পবিত্র কুরআনের ভাষায়-
قُلۡ اِنَّ صَلَاتِىۡ وَنُسُكِىۡ وَمَحۡيَاىَ وَمَمَاتِىۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَۙ۞
বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদাতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। (সূরা আনআম : ১৬২)
তাই মুমিন মুসলমান হতে হলে অবশ্যই প্রত্যেক মানুষকে তার জীবন, সম্পদ, সন্তান-সন্ততি সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বাধিক ভালোবাসতে হবে। তাঁর বিধি-বিধানগুলো স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার জন্য পালন করতে হবে।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের স্বভাব-চরিত্রে যে প্রেমবোধ দিয়েছেন, তা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সর্বব্যাপী। তাই মানুষ আপনজনের গ-ি ছাড়িয়ে তার ভালোবাসা আশপাশের সুবিস্তৃত পরিবেশম-লীতে ছড়িয়ে দেয়। ফলে দয়া-মায়া, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও হৃদয়ের টান একজন মানুষের পক্ষ থেকে অন্য মানুষ অবশ্যই পেতে পারে। ভালোবাসার পাত্র হতে পারেন সন্তান-সন্ততির জন্য তাদের মা-বাবা, মা-বাবার জন্য তাঁদের ছেলেমেয়ে, ভাইয়ের জন্য বোন, বোনের জন্য ভাই এবং অপরাপর আত্মীয়-অনাত্মীয় যেকোনো আপনজন। ভালোবাসা পোষণ ও প্রকাশের বৈধ কোনো সম্পর্ক ছাড়া ইসলামে একজন মানব-মানবীর মধ্যে হৃদয়ের কোনো টান থাকা এবং প্রেমকে আরও গভীর করার কোনো সুযোগ নেই।
দয়া, ক্ষমা, সবর, বিনয়, সৎ স্বভাব, সুন্দর আচরণ মানব চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই উত্তম চরিত্রবানই উত্তম ঈমানদার।দারসের শিক্ষা
– কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা।
– মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আল্লাহকে ভালোবাসা।
– মুমিনদের পরস্পরের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
লেখক : সাবেক সম্পাদক, প্রেরণা