জিহ্বার ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ

জাফর আহমাদ 

 

রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার কাছে তার দুই চোয়ালের মাঝে যা আছে অর্থাৎ জিহ্বা এবং দু’পায়ের মাঝে যা আছে অর্থাৎ লজ্জাস্থানের জিম্মাদারি দেবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদারি নেবো।’ (বুখারি) জিহ্বা মানুষের অতি মূল্যবান একটি অঙ্গ। ছোট্ট এ অঙ্গটি মানুষের দুনিয়া-আখিরাতকে যেমন সুন্দর করতে পারে তেমনি তার দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনকে বরবাদও করে দিতে পারে। আল্লাহর দান এই অমূল্য নিয়ামতটি মানব জীবনের বহুবিদ উপকারে লাগে। বিভিন্ন বস্তুর স্বাদ গ্রহণ ও মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহারের বিকল্প নেই। অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আপনি আপনার মনের ভাব আংশিক প্রকাশ করতে পারবেন কিন্তু কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ বা বিকল্প উপায়ে খাদ্য গ্রহণ করতে পারবেন না। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা সাময়িক চিকিৎসার স্বার্থে বিকল্প উপায়ে খাদ্য দিতে পারেন। কিন্তু সেটি একেবারেই স্বল্প সময়ের জন্য।

জিহ্বা নিছক খাদ্য গ্রহণ ও কথা বলার যন্ত্র নয়; বরং যে ব্যক্তি কথা বলে এবং ওই যন্ত্রের পেছনে বসে যে ব্যক্তি চিন্তা জোগায় তারপর মনের কথা প্রকাশ করার জন্য তার সাহায্য গ্রহণ করে। তাই জিহ্বার ব্যবহার থেকেই বোঝা যায় সে কতটুকু বুদ্ধিমান বা নির্বোধ, কে কতটা সভ্য বা অসভ্য। জিহ্বার ব্যবহারের ফলে কেউ সম্মানিত হয়, কেউ হয় অপমাণিত। জিহ্বার ব্যবহারে বোঝা যায় কে পরিশীলিত, ভদ্র, মার্জিত ও অধিক আল্লাহভীরু, পক্ষান্তরে একই জিহ্বার ব্যবহার থেকে জানা যায় কে আল্লাহর ব্যাপারে অপরিণামদর্শী নির্ভীক, অভদ্র, জংলি ও কুৎসিত। জিহ্বা মানুষকে জান্নাত অথবা জাহান্নামের উপযোগী করে গড়ে তুলে। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা: জিহ্বার ব্যবহারে সর্বাবস্থায় সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। উপরের হাদিসটি এ ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব বহন করে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি আর তাদের মনে যেসব কুমন্ত্রণা উদিত হয় তা আমি জানি। আমি তার ঘাড়ের রগের চেয়ে তার বেশি কাছে আছি। দু’জন লেখক তার ডান ও বাঁ দিকে বসে সব কিছু লিপিবদ্ধ করছে। এমন কোনো শব্দ তার মুখ থেকে বের হয় না যা সংরক্ষিত করার জন্য একজন সদা প্রস্তুত রক্ষক উপস্থিত থাকে না।’ (সূরা কাফ : ১৬-১৮)

হজরত উকবা ইবনে আমের রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসূল! নাজাত কিসে? তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘তুমি তোমার জবানকে হিফাজত করো, তোমার ঘর যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়, তুমি তোমার ভুলের জন্য কান্না করো।’ (তিরমিজি) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘সে-ই মুসলিম, যার জিহ্বা ও হাত থেকে সবাই নিরাপদ এবং সে-ই প্রকৃত মুহাজির, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা যে ত্যাগ করে।’ (বুখারি-১০, মুসলিম ও আহমাদ) আবু মুসা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, তারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইসলামে কোন জিনিসটি উত্তম? তিনি বললেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি-১১, মুসলিম ও আহমাদ) সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ সাকাফি রা: বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য কোন বিষয়টি সর্বাধিক ভয়ঙ্কর বলে আপনি মনে করেন? তখন রাসূলুল্লাহ সা: নিজের জিহ্বা ধরে বললেন, ‘এটা’ (অর্থাৎ জিহ্বা)। (তিরমিজি)

রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন উত্তম কথা বলে নতুবা চুপ থাকে।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত-৪২৪৩) জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কিন্তু কেউ যদি জিহ্বা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে এই জিহ্বা তাকে সহসাই জাহান্নামে পৌঁছে দেবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ জিহ্বা দিয়ে সঙ্ঘটিত গোনাহের কারণে জাহান্নামে যাবে।’ (তিরমিজি) হজরত বেলাল বিন হারিস রা: বলেন, মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির এমনো কথা বলে যার কল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত পর্যন্ত তার সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। আবার মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টির এমনো কথা বলে যার অকল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত পর্যন্ত তার অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন।’ (তিরমিজি ও মুয়াত্তা)

জিহ্বার নিয়ন্ত্রণের জন্য জিহ্বার পেছনের লোকটির মধ্যে পরিবর্তন আবশ্যক। নেপথ্যের লোকটি যে কালিমার ভিত্তিতে ঈমান নামক সবুজ অরণ্যে প্রবেশ করেছে সেই কালিমা তাকে একটি সুন্দর ও পরিশীলিত জীবন ব্যবস্থা উপহার দেবে। সেই কালিমার নাম তাইয়েবা অর্থাৎ পবিত্র, ভদ্র ও পরিশীলিত। এই কালিমাই তার চিন্তাধারায় পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, চরিত্রে পবিত্রতা, আচরণে মাধুর্যতা, ব্যবহারে নম্রতা, লেনদেনে সততা, কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, ওয়াদা ও অঙ্গীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন যাপনে সদাচার, কথাবার্তায় চিন্তার ছাপ, চেহারায় পবিত্রতার ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য তাগিদ দেবে। যে জীবনধারার কোথাও কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হবে না। সর্বোপরি আল-কুরআন অনুযায়ী কথা বলবে এবং আল-কুরআন অনুযায়ী কথা পরিত্যাগ করবে। আল-কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন চলার পথে কিছু জিনিসকে গ্রহণ করবে আবার কিছু জিনিসকে পরিত্যাগ করবে। তিনিই মুমিন তিনিই মুত্তাকি। আর এ মুমিন ও মুত্তাকির জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে অমূল্য উপহার হচ্ছে আল-কুরআন। কুরআন বলছে- ‘মানুষ খারাপ কথা বলে বেড়াক, তা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম করা হলে তার কথা স্বতন্ত্র। আর আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও জানেন।’ (সূরা নিসা-১৪৮)

মুমিন কখনো অশ্লীল, অশালীন ও গালিগালাজ করতে পারে না। কারণ তিনি এমন এক পূতপবিত্র ও সর্বোত্তম কথা বলে ঈমান এনেছেন যেটিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ‘কালিমাতুত তাইয়েবা’ বা ‘পবিত্র কথা’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই মুমিন ব্যক্তির মুখ থেকে সর্বদা মধু বাক্য ঝরবে এবং অন্যের কান যেটিকে শ্রুতিমধুর বা মধুর বাণী হিসেবে গ্রহণ করবে। মুমিন কখনো অশ্লীল, অশালীন কথা, গালিগালাজ, অভিশাপ, তিরস্কার, ব্যঙ্গোক্তি, অবজ্ঞা, দাম্ভিকতা, গর্ব-অহঙ্কার, কটূক্তি, দম্ভোক্তি, কুৎসা রটনা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, তুচ্ছজ্ঞান করতে পারে না। এগুলো কালিমা তাইয়েবার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ।

হজরত আবু হোরায়রা রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত হারাম।’ (মুসলিম ও তিরমিজি) হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: বলেন, নবী সা: বলেছেন, ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোনো ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্রজ্ঞান করার মতো অপকর্ম আর নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ) রাসূল সা: বলেছেন, ‘মুসলিম সে, যার ভাষা ও কর্ম থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে।’ (সহিহ বুখারি) রাসূল সা: আরো বলেছেন, ‘ভাষার ফসলই মানুষকে জাহান্নামে উপুর করে নিক্ষেপ করবে।’ (তিরমিজি) মনে রাখতে হবে, অনিয়ন্ত্রিত জিহ্বার মাধ্যমেই মানুষ অপদস্ত, অপমাণিত ও হেনস্তা হয়। যা সুস্পষ্ট জুলুম।

সুতরাং জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করুন। সঠিক কথা বলুন। উদ্ভূত অনেক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃৃতি পাবেন। জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাবেন।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট