মো. রফিকুল ইসলাম |
ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বকালে সর্বব্যাপী এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। কুরআন-হাদিসের মধ্যে ব্যবসা ও সৎ ব্যবসায়ী সম্পর্কে অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যেই রয়েছে জাগতিক আর্থিক উন্নতি-অগ্রগতি। উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে রয়েছে বরকত ও সমৃদ্ধি। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ সা. নিজেই ব্যবসা করেছেন, অন্যদেরকেও ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। হালাল জীবিকা উপার্জন করা ফরজ। জীবিকা উপার্জনের যে সকল বৈধ পন্থা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য অন্যতম। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, “তোমরা তেজারাত কর অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য কর। কেননা জীবিকার ১০ (দশ) ভাগের ৯ (নয়) ভাগই রয়েছে ব্যবসা ব্যাণিজ্যের মধ্যে।” তিনি আরোও বলেছেন, “সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী পরকালে নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথে থাকবে।” অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা ইসলামী পদ্ধতিতে ব্যবসা বাণিজ্য করে হালাল জীবিকা উপার্জন করতে আগ্রহী। কিন্তু ব্যবসার ইসলামী পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান সীমিত। ফলে অনেকাংশে অনিচ্ছাকৃতভাবে সুদি লেনদেনে জড়িয়ে পড়তে হয়। আবার কেউ কেউ এমন আছে যারা অজ্ঞতার কারণে এ কথাও বলেন যে, ব্যবসা করতে হলে সুদ তো হবেই।
অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল বলেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। এই অজ্ঞতার কারণে বা কৌশলে আমাদের সমাজে ব্যবসাকে ধর্ম থেকে আলাদা করা হয়েছে। আমরা একদিকে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত আদায় করছি আবার অন্য দিকে ব্যবসায় পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশ্রিত করে ব্যবসা করছি। অর্থাৎ নামাজ, রোজা হচ্ছে ধর্মীয় বিষয় এবং পণ্য হচ্ছে ব্যবসায়িক বিষয়। এই দ্বৈতনীতির কারণে আল্লাহর নিকট কোনো ইবাদত গণ্য হবে না। কারণ আল্লাহর নিকটে ইবাদতের পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন। অর্থাৎ মানবদেহের যে অংশ হারাম দ্বারা গঠিত হবে তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
সুতরাং পরকালীন মুক্তির জন্য দ্বৈতনীতি পরিহার করে হালাল উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত করে অর্থ উপার্জন করাই হচ্ছে ঈমানের দাবি।
ব্যবসার সংজ্ঞা
সহজ অর্থে ক্রয়-বিক্রয় অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে কম মূল্যে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে মুনাফা অর্জনের আশায় তা অধিক মূল্যে বিক্রয় করাকে বুঝায়। কিন্তু ফুকাহায়ে কিরামগণ ক্রয়-বিক্রয় এর বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন- (১) একটি মালের বিনিময়ে কাউকে অন্য মালের মালিক বানিয়ে দেয়া, (২) পরস্পরের সম্মতিক্রমে একটি মালকে অন্য মালের সহিত বিনিময় করা, (৩) বিনিময় পেয়ে কোনো জিনিস নিজ মালিকানা হতে বের করে দেয়াকে ক্রয়-বিক্রয় বলে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা)কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।” বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন ধরনের উপার্জন সবচেয়ে পবিত্র ও পছন্দনীয়? তিনি বললেন, “মানুষের স্বীয় হাত দিয়ে পরিশ্রম উপার্জন এবং সকল প্রকার বৈধ ক্রয়-বিক্রয় লব্ধ উপার্জন। সুতরাং ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক বিনিময় যা ইজাব (প্রস্তাব) এবং কবুল (সম্মতি) এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
হালাল ব্যবসা ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা সম্পদ বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা এবং সংরক্ষণের স্বার্থে তা কোন নির্বোধ মানুষের হাতে অর্পণ করতে নিষেধ করেছেন এবং সম্পদকে মানুষের জীবন ধারণের মাধ্যম বানিয়েছেন।
নবী করীম সা. পরিবার পরিজনের উদ্দেশ্যে সম্পদ সংরক্ষণ ও সঞ্চয় করা নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা বিনষ্ট করতে নিষেধ করেছেন। অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পদ সঞ্চয়কারীদের জন্য সম্পদকে ফিতনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কোনো সৎ লোক যদি ভালো নিয়তে সম্পদ সঞ্চয় করে, তাহলে অধিক প্রাচুর্যের অধিকারী হওয়া তার জন্য কোন ক্ষতি বা ফেতনার কারণ হবে না। এ কারণে মহা মর্যাদাশীল নবীগণও সম্পদ উপার্জন করেছেন। সাহাবিগণ, তাবেয়িগণ এবং আলেম ফেকাহবেত্তাদের মধ্যে অনেকই সৎ উদ্দেশ্যে বৈধ পন্থায় শুধু সম্পদ সঞ্চয় করেননি, বরং নিজের ওয়ারিশগণের জন্য ধনভাণ্ডার উত্তরাধিকার স্বরূপ রেখে গিয়েছেন। যেমন উপমাস্বরূপ বলা যায়-
হযরত দাউদ (আ) এবং হযরত সুলাইমান (আ) কে আল্লাহ্ তায়ালা বিপুল ঐশ্বর্য দান করেছিলেন।
হযরত আইয়ুব (আ) এর উপর আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে স্বর্ণ বর্ষণ করা হলে তিনি সেগুলো নিজ আঁচলে অধিক হারে জমা করতে লাগলেন।
নবী করীম সা.সহ সকল নবীগণ মেষ ও ছাগল চরিয়েছেন।
প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ রা. মৃত্যুর সময় উত্তরাধিকারস্বরূপ অনেক সম্পদ রেখে যান।
হযরত আলহা রা. তিনশত উটের বোঝা পরিমাণ সম্পদ উত্তরাধিকার স্বরূপ রেখে গেছেন।
হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. তৎকালীন প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার সমপরিমাণ বিভিন্ন সামগ্রী রেখে গিয়ে ছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা. রেখে যান নব্বই হাজার সমমূল্যের প্রচুর সম্পদ।
হযরত সুফিয়ান সাত্তরি (রহ.)ও দু’শত স্বর্ণমুদ্রা উত্তরাধিকার স্বরূপ রেখে যান। তিনি বলতেন- “বর্তমান যুগে সম্পদ হলো হাতিয়ার স্বরূপ। মোট কথা, উপরোক্ত ঘটনাবলি, দৃষ্টান্তসমূহ এবং দলিলাদির আলোকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে সহিহ নিয়তে সম্পদ সংরক্ষণ করা সঞ্চয় ও ব্যবসা বাণিজ্য করা বৈধই নয়, বরং পুণ্যও বটে।
ব্যবসা যেহেতু জীবিকা নির্বাহের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, ব্যবসা বাণিজ্য শুধু অর্থনীতির অংশই নয়, বরং ব্যক্তিগত পর্যায়েও এটি একটি সম্মানজনক পেশা। ব্যবসার মর্যাদা প্রমাণের জন্য ইহাই যথেষ্ট যে, স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ সা. দীর্ঘ বার বৎসর যাবৎ ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন এবং আদর্শ মডেল হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন।
ইসলামে ব্যবসায়ীদের মর্যাদা
পৃথিবীতে জীবন যাপনের জন্য প্রতিটি মানুষেরই জীবিকার প্রয়োজন। আর আল্লাহপাক নিজেই সে জীবিকা পৃথিবীতে তৈরি করে রেখেছেন। সুতরাং আল্লাহও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় সে জীবিকা সংগ্রহ করাও ইবাদত হিসেবে গণ্য। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন- “তোমরা সালাত আদায়ের পর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর দেয়া জীবিকা অন্বেষণ কর।” (সূরা জুমআ : ১০)
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “হালাল জীবিকা অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ওয়াজিব।” (তাবারানী)
রিজিক অথাৎ জীবিকা উপার্জনের বিভিন্ন পন্থা বা পেশার কাজ রয়েছে। তার মধ্যে ব্যবসা হচ্ছে জীবিকা উপার্জনের সর্বোত্তম পেশা। বিশ্বনবী সা. খোলাফায়ে রাশেদীন এবং অধিকাংশ সাহাবী ব্যবসা করে জীবিকা উপার্জন করতেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)ও ছিলেন একজন সুপ্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী।
সুতরাং মুসলিম জাতির ঐতিহ্য পেশা হচ্ছে ব্যবসা। ব্যবসার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। ফলে ব্যবসার সাথে ব্যবসায়ীগণ ধর্মীয় শিক্ষা, ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং মানবতার সেবায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।
তাই বিশ্বনবী সা. নিজে ব্যবসা করে উম্মাতগণকে ব্যবসার কাজে উৎসাহ প্রদান করেছেন। নি¤েœ এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো :
– হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত আছে, মহানবী সা. বলেছেন সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবীগণের, সিদ্দিকগণের এবং শহীদগণের সাথে থাকবে।” (তিরমিজি)
– হযরত আনাস রা. বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- সত্যবাদী ব্যবসায়ী কিয়াতের দিন আরশের ছায়ায় থাকবে।
– মহানবী সা. বলেছেন, “তোমরা ব্যবসা কর। কেননা রিজিকের ১০ (দশ) ভাগের ৯ (নয়) ভাগই রয়েছে ব্যবসার মধ্যে আর ১ (এক) ভাগ রয়েছে পশু পালনের মধ্যে।”
– হাদিসে কুদসিতে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, অংশীদারি কারবার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “দুইজনে শরিক হয়ে কোন অংশীদারি কারবার শুরু করলে আমি তাদের তৃতীয়জন হই, অর্থাৎ আমি তাদের কারবারে রহমত নাজিল করতে থাকি, যাবৎ তারা একজন অন্যজনের প্রতি আমানতের খেয়ানত না করে। পরে যদি শরিকদের মধ্যে কোন একজন আমানতের খেয়ানত করে তবে আমি তাদের মধ্যে হতে বের হয়ে যাই, অর্থাৎ আমার রহমত আমি সরিয়ে নেই।” (আবু দাউদ)
– হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “তোমাদেরকে আমি ব্যবসায়ীদের সহিত উত্তম ব্যবহার করার অসিয়ত করছি, কেননা তারা দুনিয়ার বুকে আল্লাহর আমানতদার স্বরূপ। (আল হাদিস)
– হযরত উমর রা. বলেন, “তোমরা ব্যবসা বাণিজ্যকে জরুরি মনে করবে, মনে রাখবে দুনিয়ার লাল রঙের লোকেরা (ইউরোপের লোক) তোমাদের উপর যেন প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে।” (আল হাদিস)
সুতরাং উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম ব্যবসাকে কত পবিত্র পেশা এবং ব্যবসায়ীকে কত মর্যাদা দিয়েছেন।
আদর্শ ব্যবসায়ীর গুণাবলি
যে সকল ব্যবসায়ী ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেন তারাই হচ্ছেন আদর্শবান ব্যবসায়ী। তাই আদর্শ ব্যবসায়ী কারা, তাদের পরিচয় কী তা আমাদের জানা দরকার। নি¤েœ আদর্শ ব্যবসায়ীদের কিছু গুণাবলি উল্লেখ করা হলো:
– আদর্শ ব্যবসায়ী মিথ্যা কথা বলে না।
– আমানতের খেয়ানত করে না।
– ওয়াদা ভঙ্গ করে না।
– পণ্যের দোষ লুকিয়ে রাখে না।
– ত্রুটিপূর্ণ দ্রব্য অধিক দামে বিক্রয় করার জন্য বেশি বেশি প্রশংসা করে না।
– অন্যের পাওনা টাকা পরিশোধে টালবাহানা করে না।
– নিজের পাওনা আদায়ে কর্কশ বা অমানবিক ব্যবহার করে না।
– মিথ্যা কসম করে না।
– মালে দোষ-ত্রুটি থাকলে তা গোপন রাখে না।
– মালের যেসব গুণাগুণ নেই তা বর্ণনা করে না।
– কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে না।
– বেশি দামের আশায় মাল মজুদ রাখে না।
– উত্তম মালের সাথে নিম্ন মানের মাল মিশ্রিত করে না।
– ক্রেতাকে ধোঁকা দেয় না।
– মাপে ও ওজনে কম দেয় না।
– সঠিকভাবে মালের যাকাত আদায় করে।
– অধীনস্থ কর্মচারীদের উপর জুলুম করে না।
– ব্যবসায়ে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করে।
– ব্যবসায় প্রচুর পরিশ্রম করে।
– রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন না দেখা।
– অবৈধ মালের ব্যবসা করে না।
– মেয়াদোত্তীর্ণ মাল বিক্রয় করে না।
– ব্যবসায় কর্ম ব্যস্ততা দেখিয়ে ধর্ম কর্ম না করা।
– অধিক লাভের আশায় মাল দীর্ঘদিন আটকে না রাখা।
– অধিক লাভের আশায় পণ্যের অতিরিক্ত দাম না নেয়া।
– সর্বাবস্থায় সুদি লেনদেন পরিহার করা।
– ক্রেতাদের সাথে উত্তম আচরণ করা।
– ব্যবসায় ছলচাতুরী ও প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া।
– ব্যবসা ভালো হলে শুকরিয়া হিসেবে আল্লাহর পথে দান করা।
– বিপদে ধৈর্য ধারণ করা।
– মালের গুণাগুণ যা আছে তার বেশি, কম না বলা।
– সব সময় বিনয়ী হওয়া।
– ব্যবসায় সকল প্রকার কুসংস্কার বন্ধ করা। যেমন- ক্যাশ বাক্সকে সেজদা করা, এখনও বিক্রি হয়নি বলে বাকি না দেয়া, কোন মাল নতুন আনা হলে এখনও যাত্রা হয়নি বলা। বাকি না দেয়া সিদ্ধান্ত থাকতে পারে তাই বলে কুসংস্কার চালু করা যাবে না।
– সর্বদা হালাল জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করা।
– ব্যবসায় অসুস্থ বা অসম প্রতিযোগিতা না করা।
– আল্লাহর সাথে শিরক না করা।
– ত্রুটিপূর্ণ মাল ভুলে বিক্রি হলে তা ফেরত নেয়া।
– কাউকে কুপরামর্শ না দেওয়া।
– সবসময় হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা ।
– ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলা।
– সবসময় আল্লাহর উপর ভরসা করা।
– ঋণ থাকলে যথাসময়ে পরিশোধ করে ঋণ মুক্ত হওয়া।
আলোচ্য গুণাবলিসম্পন্ন ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে। সুতরাং বিষয়টি একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করে ব্যবসা পরিচালনা করলে দুনিয়াতে শান্তি এবং পরকালে আল্লাহর দিদার ও রহমতের আশা করা যাবে।
সম্পদ উপার্জনের বৈধ পন্থা সমূহ
অর্থসম্পদ উপার্জন করা ইসলামে অবৈধ নয়। ইসলাম মানুষের এ অধিকারকে স্বীকার করে যে, সে নিজের সামর্থ্য ও যোগ্যতানুযায়ী নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রীর সন্ধান করবে। তবে ইসলাম মানুষকে এ অধিকার দেয়নি যে, সে অর্থ সম্পদ উপার্জনের জন্য স্বীয় খেয়াল খুশিমত যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারবে।
ইসলাম মানুষকে অর্থসম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু কিছু পন্থা অর্থ উপার্জন ইসলমে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং হালাল পন্থাগুলোকে ইসলামে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। হালাল পন্থায় মানুষ যত ধন সম্পদই অর্জন করুক না কেন এতে ইসলামে কোন বাধা নেই।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন- “আর যখন তোমাদের নামায সমাপ্ত হয় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকা অন্বেষন কর।”
তবে জীবিকা অবশ্যই হালাল উপায়ে অর্জন করতে হবে, হারাম উপায়ে নয়। মহান আল্লাহপাকের নির্দেশ- “তোমরা নিজেদের পরস্পরের অর্থসম্পদ অবৈধ পন্থায় ভক্ষণ করো না।”
সুতরাং অর্থ সম্পদ উপার্জনের বৈধ পন্থাসমূহ আমাদের জানা দরকার। ইসলামে মানুষের অর্থ সম্পদ লাভের তিনটি মৌলিক পন্থা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে-
– নিজস্ব পরিশ্রম : পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ অর্থ সম্পদ উপার্জন করতে পারে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, “আল্লাহর নিকট ঐ জীবিকাই উত্তম যা মানুষ নিজ হাতে উপার্জন করে।”
– উত্তরাধিকার : উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ অর্থসম্পদ লাভ করে থাকে। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীগণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী মৃতের পরিত্যক্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি হতে যে সম্পদ লাভ করে থাকে তা হালাল।
হেবা বা দান
কোন বিনিময়মূল্য বা প্রতিদান ব্যতিরেকে কাউকে নিজের সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর বা দান করা এবং যার অনুকূলে হস্তান্তর বা দান করা হয় সে ব্যক্তি কর্তৃক তা গ্রহণ করাকে হেবা বলে। হেবার মাধ্যমে অর্জিত অর্থসম্পদ হালাল।
সম্পদ উপার্জনের অবৈধ পন্থাসমূহ
হালাল পন্থায় অর্থসম্পদ উপার্জন করতে হলে অবৈধ পন্থাগুলোও জানা থাকা দরকার। নতুবা হালাল ও হারামের মাধ্যমে পার্থক্য করা ও হারাম থেকে পরহেজ থাকা সম্ভব হবে না। মহান আল্লাহপাক মানুষের কল্যাণে অর্থসম্পদ উপার্জনে অবৈধ পন্থাগুলোকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যা নিন্মে উল্লেখ করা হলো:
– অন্যায়ভাবে সম্পদ লুণ্ঠন, আত্মসাৎ, খিয়ানত, দখল বা ভোগ করা অবৈধ।
– চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা।
– ইয়াতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা।
– পতিতাবৃত্তি ও ব্যভিচারের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন।
– মাদক উৎপাদন ও বিপণন করা।
– মূর্তি তৈরি ও ক্রয়-বিক্রয় করা।
– জুয়া ও লটারির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা।
– প্রতারণা করে অর্থ উপার্জন করা।
– সুদের লেনদেনের মাধ্যমে অর্জিত অর্থসম্পদ লাভ করা।
– ঘুষের মাধ্যমে উপার্জন করা।
– রাশি ও ভাগ্য গণনা করে অর্থ লাভ করা।
– নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন।
– অশ্লীল গান, বাজনা, নৃত্য ও সিনেমা ইত্যাদির ব্যবসা করা।
– নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে রাখা।
– অবৈধ জিনিস ভক্ষণ ও ব্যবসা করে অর্থ লাভ করা
– দেশ ও জাতির স্বার্থের পরিপন্থী ব্যবসা করা।
ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার শর্তাবলি
ব্যবসায়িক প্রয়োজনে চুক্তিপত্র হতে পারে। সেক্ষেত্রে নিম্নোক্ত শর্তাবলি থাকতে হবে:
– ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিতে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে জ্ঞান বুদ্ধি সম্মান হতে হবে।
– ক্রয়-বিক্রয়ে দু’টি পক্ষ থাকতে হবে। অর্থাৎ ক্রেতা ও বিক্রেতা।
– ইজাব (প্রস্তাব) ও কবুলের (সম্মতির) মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
– ক্রয়-বিক্রয়ে ইজাব ও কবুল একই মজলিসে হতে হবে।
– বিক্রেতার নিকট মাল বিদ্যমান থাকতে হবে।
– ক্রয়-বিক্রয়ে ইজাব ও কবুলের (সম্মতির) মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
– মালের উপর বিক্রেতার পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে।
– মালের উপর বিক্রেতা ব্যতীত অন্য কারো অধিকার থাকবে না।
– মালামাল অগ্রিম বা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় হলে তা উল্লেখ করতে হবে।
ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিতে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি বাতিলের কোনরূপ শর্ত না থাকলে ক্রয় বিক্রয় চুক্তি সম্পাদিত ও কার্যকরী হবার পর কোন পক্ষই ক্রয় বিক্রয় চুক্তি বাতিল করতে পারবে না। ক্রেতা চুক্তিপত্র অনুযায়ী মালের মূল্য বিক্রেতাকে প্রদান করতে এবং বিক্রেতা ক্রেতার নিকট মাল সরবরাহ দিতে বাধ্য থাকবে।
ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিতে শর্তারোপ
ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হওয়ার জন্য স্থানীয় ভাবে প্রচলিত এবং ইসলামী শরিয়ার পরিপন্থী নহে এরূপ যে কোন প্রয়োজনীয় শর্তারোপ করা বৈধ এবং তা কার্যকর হবে।
– যে শর্তের দ্বারা ক্রেতা বিক্রেতার কোনো পক্ষই ক্ষতি হবে না, এরূপ যে কোন শর্ত আরোপ করা বৈধ।
– চুক্তিপত্রে এমন কোন শর্ত আরোপ করা যাবে না, যা ইসলামী শরিয়ার পরিপন্থী এবং যা দ্বারা এক পক্ষ লাভবান হবে এবং অপর পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরূপ শর্তারূপ করা অবৈধ।
– কোন পক্ষ চুক্তি পত্রের শর্তাবলি মেনে নিতে অস্বীকার করলে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
চুক্তিপত্র লিখিত এবং সাক্ষী রাখার বিধান
ক্রয়-বিক্রয় ও ঋণের ক্ষেত্রে দলিল বা চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করা এবং সাক্ষী রাখা উচিত যাতে ভবিষ্যতে ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি হলে কিংবা কোন পক্ষ থেকে অস্বীকৃতির কোন অবস্থার উদ্ভব হলে তা কাজে লাগে।
তাই ক্রয় বিক্রয় ও ঋণের ক্ষেত্রে দলিল লেখা এবং সাক্ষী রাখার ব্যাপারে যে মৌলিক বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ-
– ক্রয়-বিক্রয় ও ঋণের ক্ষেত্রে চুক্তিপত্র লিখে রাখা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কোন পক্ষ থেকে অস্বীকৃতির কোনরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলো লিখিত চুক্তি বা দলিল কাজে লাগে এবং সমস্যার সমাধান করা যায়।
– ঋণ ও বাকিতে ক্রয়- বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ ও বিক্রয়মূল্য পরিশোধের সময়সীমা তথা নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করে লিখে রাখা।
– নগদ ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দলিল লিপিবদ্ধ করে না রাখলে কোনো ক্ষতি নেই। তবে ভবিষ্যতে উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্রীত মাল অথবা সংশ্লিষ্ট কোন কিছু বুঝে পাওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকলে নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কমপক্ষে সাক্ষী রাখা উচিত।
– লেখকের উচিত চুক্তিপত্র ন্যায়সঙ্গতভাবে লিপিবদ্ধ করে দেওয়া এবং লেখার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। শরিয়সম্মত কারণ ব্যতীত অপারগতা প্রকাশ করা ঠিক নয়।
– যে ব্যক্তি ঋণগ্রহীতা বা দেনাদার তার পক্ষ থেকে দলিল লিপিবদ্ধ হবে। কারণ এটা হচ্ছে তার অঙ্গীকারপত্র। সুতরাং ঋণগ্রহীতা বা দেনাদার হবে দলিলদাতা।
– চুক্তিপত্রে দেনার পরিমাণ বিন্দুমাত্রও কম বা বেশি লিখাতে পারবে না এবং পরিশোধের সময় সীমার ব্যাপারেও কোনরূপ
কারচুপি করতে পারবে না।
– দেনাদার যদি অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা প্রতিবন্ধী হয় তাহলে তার পক্ষ হতে তার উকিল বা অভিভাবকগণ চুক্তিপত্র লিখাতে পারবে।
– লিখিত চুক্তিপত্রে অবশ্যই সাক্ষী রাখতে হবে।
– সাক্ষী কমপক্ষে দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা হতে হবে।
– সত্য সাক্ষ্য গোপন রাখা বৈধ নয়। আবার মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও অবৈধ।
– দলিল লেখক ও সাক্ষীদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রর্দশন করা বৈধ নয়।
ব্যবসা বাণিজ্যের ইসলামী পদ্ধতি
ইসলামী ব্যবসা বাণিজ্য এমন ধরনের যার লক্ষ্য ও কার্যক্রমের কোথাও এমন কোন উপাদান নেই যা ইসলাম অনুমোদন করেনি।
ইসলামী শরিয়াহর আলোকে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো:
– বাইমুরাবাহা (চুক্তির ভিত্তিতে লাভে বিক্রয়): কোনো পণ্যের ক্রয় মূল্যের উপর ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারিত লাভে বিক্রয় করাকে বাইমুরাবাহা বলে।
– বাইমুয়াজ্জাল (বাকিতে বিক্রয়): বাইমুয়াজ্জাল হলো মুনাফার উদ্দ্যেশ্য বাকিতে মাল বিক্রয়ের চুক্তিকে বোঝায়।
– হায়ারপারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক (মালিকানায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভাড়ায়
– ক্রয়): এই পদ্ধতিতে চুক্তির ভিত্তিতে যৌথভাবে ফ্ল্যাট, বাড়ি, যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি
– ক্রয় করে ভাড়ার ভিত্তিতে তা ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমে মালিকানা অর্জন করা।
– মুদারাবা (উদ্যোক্তার মাধ্যমে ব্যবসা করা): মুদারাবা বলতে এমন এক ব্যবসায়িক চুক্তি বোঝায় যার শর্তানুসারে এক পক্ষ মূলধন জোগান দেয় এবং অন্য পক্ষ তার দক্ষতা, প্রচেষ্টা, শ্রম ও প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা নিয়োজিত করেন। এ ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুঁজিদাতাকে বলা হয় ‘সাহিব-আল-মাল’ ও পুঁজিগ্রহীতা বলা হয় ‘মুদারিব’। এ পদ্ধতির বিশেষ দিক হলো এ ব্যবসায় চুক্তি অনুসারে মুনাফা ভাগাভাগি হবে এবং প্রকৃত লোকসান বলে তা পুঁজিদাতাকে বহন করতে হবে।
– মুশারাকা (অংশীদারিত্ব ভিত্তিক ব্যবসা): মুশরাকা বলতে এমন ব্যবসায়িক চুক্তি বোঝায় যার অধীনে একাধিক ব্যক্তি যৌথভাবে মূলধনের জোগান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। উভয়ের পুঁজি সমান সমান হতে পারে অথবা কম-বেশিও হতে পারে। ব্যবসায় লাভ হলে অংশীদারগণ চুক্তি মোতাবেক তা ভাগ করে নেয় এবং লোকসান হলে পুঁজির আনুপাতিক হারে তা বহন করে ।
– বাইসালাম (অগ্রিম ক্রয়): বাইসালাম হলো এমন একটি চুক্তি যার আওতায় ভবিষ্যতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মালামাল সরবরাহের শর্তে ক্রেতা-বিক্রেতাকে মালের ক্রয়মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করে।
– ইস্তিস্না: ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পাদিত এমন চুক্তিকে ইস্তিস্না বলে যাতে ক্রেতা কর্তৃক নির্দেশিত পণ্য বিক্রেতা কর্তৃক তৈরি করে দেয়ার অঙ্গীকার থাকে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো কারিগর বা কারখানা মালিকের নিকট তার উদ্দিষ্ট দ্রব্য নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে প্রস্তুত করে দেয়ার প্রস্তাব করলে এবং কারিগর বা মালিক ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে ইস্তিস্না চুক্তি সম্পাদিত হয়।
– ইজারা বা ভাড়া : মুনাফা অর্জনের জন্য কোন নিদিষ্ট পরিমাণ স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি স্বত্বত্যাগ ব্যতীত নির্ধারিত সময়ের জন্য ব্যবহার ক্ষমতা হস্তান্তর করাকে ‘ইজারা’ বলে। যেমন: বাসা বাড়ি, জায়গা জমি, যানবাহন ইত্যাদি নির্ধারিত সময় বা কাজের জন্য নির্ধারিত মুনাফার ভিত্তিতে ইজারা (LEASE) বা ভাড়া (RENT) দেয়া ইসলামী শরিয়ায় বৈধ।
ইসলামে ঋণ ও তার বিধান
ঋণ ও তার আরবি হচ্ছে কর্জ অর্থাৎ ধার বা হাওলাদ। টাকা পয়সা স্বর্ণ রৌপা এবং ওজন ও পরিমাণ যোগ্য জিনিসের ধার দেয় নেয়াকে বলা হয় ঋণ। কাউকে বিপদে আপদে ঋণ (কর্জে হাসানা) দেয়া অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
ইসলামে কর্জ বা ঋণ দেয়ার বিধানগুলো নি¤েœ তুলে ধরা হলো:
– ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার পরস্পরের ইজাব ও কবুল এবং তদনুযায়ী দেয়া নেয়ার মাধ্যমে ঋণ শুদ্ধ হবে।
– ঋণদাতা দেয় ঋণের অতিরিক্ত কোনো অর্থ আদায় করতে পারবে না কিংবা আদায় করার শর্তও করতে পারবে না।
– শর্তেও মাধ্যমে দেয় ঋণের অতিরিক্ত কিছু আদায় করা হলে ইসলামী শরিয়ায় তা সুদ বলে গণ্য হবে।
– শর্তহীনভাবে ঋণগ্রহীতা স্বীয় ইচ্ছায় ঋণদাতাকে গৃহীত ঋণের কিছু অতিরিক্ত দিলে তা
– বৈধ হবে।
– নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
– ঋণগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ও ঋণের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবে না।
– ঋণগ্রহীতা ঋণপরিশোধের পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি হতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। যদি সম্পত্তি না থাকে তাহলে উত্তরাধিকারীগণ সে অর্থের হকদার হবে। তারা অসামর্থ্য হলে ইসলামী সরকার ঋণ পরিশোধের দায় দায়িত্ব বহন করবে।
কতিপয় অবৈধ (হারাম) ব্যবসা
নবী করীম সা. যখন প্রেরিত হলেন তখন আরব সমাজে নানা প্রকারের ক্রয়-বিক্রয় ও পারস্পরিক লেনদেন চলছিল। তখন ইসলামী শরিয়তের অনুকূল ব্যবস্থা ও কার্যবিধি চালু রাখা হলো। তা জায়েয বলে ঘোষিত হল এবং যা যা শরিয়াতের পরিপন্থী ছিল তা সবই হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। যা নি¤েœ আলোচনা করা হলো-
– হারাম জিনিস বিক্রয় করাও হারাম : নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষিত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা ও তা থেকে উপকার গ্রহণ ও হারাম এবং গুনাহ পর্যায়ের কাজ। এ কারণে তা ক্রয় বা বিক্রয় করা কিংবা তার ব্যবসা করাও হারাম। শূকর, মদ্য, হারাম খাদ্য-পানীয়, মুর্তি, ক্রুশ প্রতিকৃতি প্রভৃতি এ পর্যায়ে গণ্য। এসব জিনিসের সংস্পর্শে থেকেই মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাওয়া হয়েছে। এ জন্যই নবী করীম সা. বলেছেন: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল মদ্য, মৃতজীব, শূকর ও মূর্তি বিক্রয় করা হারাম করে দিয়েছেন।
– ধোঁকাপূর্ণ বিক্রয় হারাম : যে ধরনের বিক্রয়ে পণ্য অজ্ঞাত বা ধোঁকা হওয়ার কিংবা এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে ক্ষতি সাধনের সুযোগের কারণে পারস্পরিক ঝগড়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে তা শরিয়াহ নীতি অনুযায়ী নিষিদ্ধ। যেমন- উড়ন্ত পাখি বা পানির মধ্যে অবস্থিত মাছ অথবা এ ধরনের অজানা পণ্য ক্রয় ও বিক্রয় করা।
– দ্রব্যমূল্য নিয়ে খেলা করা : ইসলাম বাজার ও দ্রব্যমূল্যে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে ইচ্ছুক। হাট-বাজার স্বাভাবিকভাবে চলতে পারলেই দ্রব্যমূল্য ও আপনা থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। বাজারে পণ্য আমদানি ও তার চাহিদা অনুপাতে দ্রব্যমূল্যেও উত্থান-পতন হতে থাকে। সুতরাং মজুদদাররা দ্রব্যমূল্য নিয়ে খেলা করতে শুরু করলে তা অবশ্যই হস্তক্ষেপ বা বন্ধ থাকতে হবে। শরিয়ার দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ে এরূপ খেলা করা নিষিদ্ধ।
– পণ্য মজুদদারি করা : ইসলাম ক্রয়-বিক্রয় ও স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা এর পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও লোকেরা স্বার্থপর। তারা এ লোভের বশবর্তী হয়ে পরের উপর টেক্কা দিয়ে নিজের ধনসম্পদের পরিমাণ স্ফীত করতে থাকবে, তা কিছুতেই বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। খাদ্যপণ্য এ জনগণের সাধারণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ইত্যাদি সব ব্যাপারেই ইসলামের এ কঠোরতা। এ জন্যই নবী করীম সা. পণ্য মজুদকরণের ব্যাপারে নানাভাবে কঠোর ও কঠিন ভাষায় নিষেধবাণী উচ্চারণ করেছেন। এ বিষয়ে বলেছেন: যে লোক চল্লিশ রাত্রি কাল খাদ্যপণ্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল তার থেকে। নবী করীম সা. আরও বলেছেন : অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখার কাজ করে না।
এ অপরাধী কথাটি খুব সহজ অর্থে নয়, যেই পণ্যমজুদ রাখার কাজ করে সেই ‘অপরাধী’ কথাটি যথার্থ।
– বাজারে কৃত্রিম হস্তক্ষেপ করা : বাজারে পণ্য স্বাভাবিক পন্থায় বিনিময় প্রণালীকে নিজস্বভাবে কাজ করার অবাধ সুযোগ অব্যাহত থাকবে। কৃত্রিমভাবে হস্তক্ষেপ বা সঙ্কট সৃষ্টি করা যাবে না।
– মুনাফাখোরি ও ধোঁকাবাজি করা : বাজার বা স্বাভাবিক দ্রব্যমূল্যের উপর কৃত্রিমভাবে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করার সাথে সাথে নবী করীম সা. মুনাফাখোরি ও ধোঁকাবাজি করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন।
– বারবার কিরা-কসম করা : নবী করীম সা. ব্যবসায়ীদের কিরা-কসম করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন : কিরা-কসম দ্বারা পণ্য তো বিক্রয় করা যায়, কিন্তু বরকত পাওয়া যায় না। বিক্রয়ে বেশি বেশি কিরা-কসম করা নবী করীম সা. আদৌ পছন্দ নয়। কেননা তাতে প্রথমত: চুক্তির পক্ষদ্বয়ের ধোঁকাবাজির মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর দ্বিতীয়ত: তাতে আল্লাহর পবিত্র নামের ইজ্জত নষ্ট হওয়ার ও ভয় আছে।
– মাপে ওজনে কম করা : পণ্য বিক্রয়ের পাত্র দ্বারা মাপায় বা পাল্লা দ্বারা ওজন করে কম দেয়াও এক প্রকারের ধোঁকাবাজি। কুরআন মাজিদে এ ব্যাপারটির উপর খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে: তোমরা মাপার পাত্র ও ওজনের পাল্লা সুবিচার সহকারে পূর্ণ ভর্তি করে দাও। মানুষের সাধ্য সামর্থ্যরে অধিক আমরা কোন দায়িত্বই তার উপর চাপিয়ে দিই না। আরও বলা হয়েছে : আর তোমরা মাপার কাজ যখন করবে তখন পুর্ণ করে মাপবে। আর সুদৃঢ়-সঠিক দাঁড়ি-পাল্লার দ্বারা ওজন করবে। এ নীতি অতীব কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে খুবই ভালো ও উত্তম।
– চোরাইমাল ক্রয় করা : ইসলাম অপরাধও অপরাধ প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করেছে। অপরাধীদের সঙ্কীর্ণ পরিধির মধ্যে পরিবেষ্টিত করে দিয়েছে। তাই যে মাল অপহৃত বা চুরি করে আনা হয়েছে কিংবা মালিকের কাছ থেকে অন্যায় ভাবে নিয়ে নেয়া হয়েছে তা জেনে শুনে ক্রয় করা মুসলমানদের জন্য জায়েয নয়, কেননা তা করা হলে অপহরণকারী, চোরও ছিনতাইকারীকে তার কাজে সাহায্য করা হবে। নবী করীম সা. বলেছেন: যে ব্যক্তি জেনে-শুনে চুরির মাল ক্রয় করল, সে তার গুনাহ ও অন্যায় কাজে শরিক হয়ে গেল।
– সুদি ব্যবসা : ব্যবসায়ের মাধ্যমে মূলধনের মুনাফা লাভ ইসলামে সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু সুদের ‘মুনাফা’ লাভ করার সকল পথকে ইসলাম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ও হারাম করে দিয়েছে। তার পরিমাণ কম হোক, কি বেশি, ইসলামে তা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। রাসূলে করীম সা. সুদ ও সুদখোর, সুদি কারবারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, এ সুদের ফলে সমাজজীবনের উপর যে বিপদ ঘনীভূত হয়ে আসে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন: সুদ ও ব্যভিচার কোন দেশে শহরে ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাদের উপর আল্লাহর আজাব আসা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম হারাম পন্থায় অর্থ উর্পাজন যেমন নিষিদ্ধ করেছে, তেমনি অর্থ উপার্জনের হালাল পন্থাও বাতলে দিয়েছে। পৃথিবীতে জীবন যাপনের জন্য প্রতিটি মানুষেরই জীবিকার প্রয়োজন। আর আল্লাহ পাক নিজেই সে জীবিকা পৃথিবীতে তৈরি করে রেখেছেন। সুতরাং আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় সে জীবিকা সংগ্রহ করাও ইবাদত হিসেবে গণ্য।
জীবিকা উপার্জনের বিভিন্ন পন্থা বা পেশার কাজ রয়েছে এসবের মধ্যে ব্যবসা হচ্ছে জীবিকা উপার্জনের সর্বোত্তম পেশা। বিশ্বনবী সা. খোলাফায়ে রাশেদীন এবং অধিকাংশ সাহাবী ব্যবসা করে জীবিকা উপার্জন করতেন। সুতরাং মুসলিম জাতির ঐতিহ্য পেশা হচ্ছে ব্যবসা। জাতি হিসেবে আমাদের সেই ঐতিহ্য ধারণ করতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার