প্রফেসর মো. শফিকুল ইসলাম |
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَّا تُشْرِكْ بِيْ شَيْئًا وَّطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَالْقَآئِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ. وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَّعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَّأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ. لِّيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْم بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِج فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَآئِسَ الْفَقِيرَ.
অনুবাদ
২৬. আর (স্মরণ কর) যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লাহর স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়ে (বলেছিলাম) যে, আমার সাথে কাউকে শরিক করো না এবং তাওয়াফকারী, নামাজে দ-ায়মান ও রুকু সেজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখো। ২৭. এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা করে দাও। তারা প্রত্যেকটি দুই পাহাড়ের মধ্যকার চওড়া পথ মাড়িয়ে দূর-দূরান্ত থেকে তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার দুর্বল উটের পিঠে সওয়ার হয়ে। ২৮. যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত হাজির হতে পারে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে রিজিক হিসেবে তাঁর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহ্র নাম স্মরণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।” (সূরা হজ : ২৬-২৮)
সূরার নামকরণ এবং হজ শব্দের অর্থ
রাসূলুল্লাহ সা. মহান আল্লাহর ইশারায় অধিকাংশ সূরার ক্ষেত্রে শিরোনাম ব্যতীত নিছক আলামতভিত্তিক নাম রেখেছেন, যা সূরার প্রতীকী বা নিদর্শন। অত্র সূরার ২৭তম আয়াতে (وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ) উল্লিখিত ‘বিল হাজ’ (بِالْحَجِّ) শব্দ থেকেই অত্র সূরার নামকরণ ‘আল-হাজ’ করা হয়েছে। ‘আল-হাজ’ (الحج) শব্দের আভিধানিক অর্থ, ইচ্ছা করা, দৃঢ় সঙ্কল্প করা, নিয়ত করা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের লক্ষ্যে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট কার্যাবলি সম্পাদনের মাধ্যমে বায়তুল্লাহ ও নির্দিষ্ট কিছু স্থান জিয়ারাত করাকে ‘হজ’ বলে। মোটকথা নির্দিষ্ট হজের মাসসমূহে অর্থাৎ শাওয়াল, জিলকাদ ও জিলহজ মাসে হজের নিয়্যতে ‘বায়তুল্লাহ’ ও নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বিশেষ কিছু ‘আমল করাকে ‘হজ’ বলা হয়।
নাজিলের সময়কাল
এ সূরার প্রথম অংশ অর্থাৎ প্রথম থেকে ২৪তম আয়াত পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা.-এর মাক্কি যুগের শেষদিকে অর্থাৎ হিজরতের কিছুদিন আগে মুসলমানদের ওপর যখন চরম জুলুম নির্যাতন চলছিল ঠিক সেই সময় নাজিল হয়েছে। ২৫তম থেকে ৪১তম আয়াত পর্যন্ত মাদানি জীবনে নাজিল হয়েছে। অধিকাংশ তাফসীরকারকের মতে এটি একটি মিশ্র সূরা। অর্থাৎ মক্কায় কিছু আয়াত নাজিল হয়েছে, আবার মদীনায়ও এর অধিকাংশ আয়াত নাজিল হয়েছে। ইমাম কুরতুবী এ মতকে অধিক বিশুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
আলোচ্য বিষয়
সূরা আল হজ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এ সূরায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- মানবজাতির সৃষ্টি, জীবন-মৃত্যু, সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিধান, সমরনীতি, আল্লাহর ভয়, কিয়ামতের ভয়াবহতা, আখিরাতের চিন্তা, শয়তানের ফাঁদ ও তার থেকে হেফাজত থাকা, বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের আলোচনা, জান্নাতের সুখ-সমৃদ্ধি ও জাহান্নামের আজাব, জিহাদের অনুমতি ও তার বিধান, হজ, কুরবানি, ইসলামী রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কর্তব্য, ধ্বংসপ্রাপ্ত সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের চূড়ান্ত ফায়সালা, মুশরিকদের অবস্থা এবং সর্বশেষ কাফিরদের নিকৃষ্টতম ঠিকানার উল্লেখ সূরাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে ফুটিয়ে তুলেছে।
নির্বাচিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা
২৬তম আয়াত : কাবাগৃহ নির্মাণ এবং তার পবিত্রতা রক্ষাকরণ
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ.
“আর (স্মরণ কর) যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে (বলেছিলাম) যে, আমার সাথে কাউকে শরিক করো না। এবং তাওয়াফকারী, নামাজে দ-ায়মান ও রুকু সেজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখ।”
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ তিনটি বিষয়ে নির্দেশ করেছেন। ১. ইবরাহিম (আ)-কে কাবাগৃহ নির্মাণের নির্দেশনা সংক্রান্ত ২. আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক না করার নির্দেশনা এবং ৩. কাবাগৃহের পবিত্রতা রক্ষার নির্দেশনা।
১. কাবাগৃহ নির্মাণের ইতিহাস
কাবা পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ইবাদতখানা, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষ সৃষ্টির পূর্বে ফিরিশতাদের জন্য নির্ধারণ করেন। মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে ফিরিশতারা সর্বপ্রথম কাবাঘর নির্মাণ করে সেখানে ইবাদত বন্দেগি করতে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ.
‘নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম ঘর মক্কায় অবস্থিত। তাকে বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল।’
(সূরা আলে-ইমরান : ৯৬)
মুসলিম মিল্লাতের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল নিয়ামত হলো পবিত্র কাবাগৃহ। এটি বিশ্ব মুসলিমের একমাত্র মিলনকেন্দ্র। এটি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রিয় বান্দাদের ইবাদতের জন্য নির্ধারিত। মসজিদে হারামে সালাত আদায় করলে এক লক্ষগুণ সাওয়াব লাভ করা যায়। জাবির রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘অন্যত্র সালাত আদায়ের চেয়ে আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) সালাত আদায় করা এক হাজার গুণ উত্তম এবং মসজিদুল হারামে সালাত আদায় করা অন্য মসজিদে সালাত অপেক্ষা এক লক্ষ গুণ উত্তম।’ (সুনানু নাসায়ী)
একাধিক হাদীসে এসেছে আদম (আ) পৃথিবীতে প্রেরিত হওয়ার পর তিনি এ কাবাগৃহটি তৈরি করেন। এমন জায়গায় তৈরি করেন যার ঠিক উপরে সপ্তম আসমানে বায়তুল মামুর অবস্থিত। আদম (আ) নির্মিত এ কাবা নূহ (আ)-এর প্লাবনের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু কাবাগৃহের চিহ্নটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়নি।
আদম (আ)-এর পরবর্তী নবীদের উপর ওহী নাজিলের মাধ্যমে কাবার সুনির্দিষ্ট স্থান এবং পুনঃনির্মাণের বিষয়টি জানিয়েছেন। নূহ (আ)-এর মহা প্লাবনের সময় কাবা শরীফ ধ্বংস হয়ে গেলে পরবর্তীতে ইবরাহিম (আ)-কে কাবাঘর পুনঃনির্মাণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহিম বায়তুল্লাহর ভিত্তিকে উপরের দিকে উঠান।’
(সূরা আল-বাকারা : ১২৭)
সুতরাং এই আয়াত থেকে বুঝা যায় ইবরাহিম (আ) নিজে কাবার ভিত্তি স্থাপন করেননি। বরং পূর্ব প্রতিষ্ঠিত ভিত্তির উপর তিনি উপরের দিকে দেয়াল উঠান। তাঁর মাধ্যমেই মূলত কাবাঘর পূর্ণতা লাভ করে।
ইবরাহিম (আ) কাবা নির্মাণের জন্য পাঁচটি পাহাড়ের পাথর ব্যবহার করেছেন। ফিরিশতারা এ সকল পাহাড় হতে পাথর এনে দিতেন। ইবরাহিম (আ) সেই পাথরগুলো একত্র করে দেয়াল নির্মাণ করেন। আর তাঁর সাথে সহযোগিতা করতেন পুত্র ইসমাইল (আ)। তিনি পাথরগুলো তুলে দিতেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, কাবাঘর পর্যায়ক্রমে এগারো বার নির্মাণ হয়েছে। যথা- ১. ফিরিশতা ২. আদম (আ) ৩. শীষ (আ) ৪. ইবরাহিম (আ) ৫. আমালেকা সম্প্রদায় ৬. জুরহাম গোত্র ৭. কুসাই বিন কিলাব ৮. কুরাইশ ৯. আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রা. ১০. হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এবং ১১. সুলতান মুরাদ। (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ১১৯)
২. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করা
আল্লাহ এক অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই। এ পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন, সকলেরই আহবান ছিল তাওহীদের প্রতি। যখন কোনো জাতি একত্ববাদ ছেড়ে দিয়ে শিরকে লিপ্ত হয়েছে, তখনই নেমে এসেছে আজাব। আল্লাহ ব্যতীত বা আল্লাহর সঙ্গে অন্যের ইবাদত করাই সর্ববৃহৎ পাপ, যা শিরক বলে গণ্য। ইবন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুলাহ সা. বলেছেন, “যখন তুমি কিছু প্রার্থনা কর, তখন শুধুমাত্র আল্লাহর নিকটেই কর; আর যখন তুমি কোনো সাহায্য প্রার্থনা কর, তখন একমাত্র আল্লাহর নিকটেই কর।”
(জামি আত-তিরমিযি)
কোনো প্রকার মধ্যস্থতা ছাড়াই মানুষের প্রতি আল্লাহর নৈকট্যের বিষয়টি আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত। (সূরা বাকারা : ১৬৫; ১৮৬; আনআম : ৪০; তাওবা : ৩১; আম্বিয়া : ৬৬; আরাফ : ১৯৪; যুমার : ০৩ ইত্যাদি)।
শিরক ইসলামের পরিপন্থী স্বতন্ত্র এক জীবনব্যবস্থা এবং বিধানের নাম। মানুষ তার বিশ্বাস, চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে একে লালন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিপথগামী মানুষ নানাভাবে শিরক লালন করে আসছে। এমনকি ইবরাহিম (আ) যখন কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণ করবেন সে সময়ও জুরহাম ও আমালিকা গোত্র এখানে কিছু মূর্তি স্থাপন করে রেখেছিল। তারা এসব মূর্তির পূজা করতো।
শিরক অবৈধ ও নিষিদ্ধ। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক মনে করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের যোগ্য মনে করা, আল্লাহর মতোই অন্যকে ডাকা, তার কাছে কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা করা, আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য প্রাপ্তির জন্য মাধ্যম অবলম্বন করা এগুলো সবই শিরক। যেমন- রোগ মুক্তির জন্য বা কোন কাজ উদ্ধারের জন্য মাজারে বা পীরের নামে মান্নত করা, পীরের কবরে সিজদা করা ইত্যাদি এ সবই শিরক।
শিরক প্রথমত দুই প্রকার। ১. শিরকে আকবার ও ২. শিরকে আসগার। শিরকে আকবর বলা হয়, কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহ তায়ালার মতো সিফাতের অধিকারী বা সমমর্যাদা সম্পন্ন মনে করা। আল্লাহর কাছে কিছু পাওয়ার জন্য মধ্যস্থতা অবলম্বন করা। আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর বিধানাবলিতে অংশীদার স্থাপন করা ইত্যাদি। শিরকে আসগর বলা হয়, ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তের সাথে সাথে অন্য কোনো উদ্দেশ্য শামিল রাখা। যেমন- লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা, সুনাম অর্জনের জন্য দান-সাদকা করা ইত্যাদি।
শিরকের নিষিদ্ধতা
মহান আল্লাহ আল-কুরআনে শিরককে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং মানুষকে তা হতে নিবৃত্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।” (সূরা কাহাফ : ১১০)। “তুমি আল্লাহর সাথে অন্যকে ইলাহ রূপে ডেকো না। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল। বিধান তাঁরই এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।”
(সূরা কাসাস : ৮৮)
“স্মরণ কর, যখন লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোনো শরিক করো না, নিশ্চয় শিরক চরম যুলুম।” (সূরা লুকমান : ১৫)। “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুতে তাঁর শরিক করবে না।” (সূরা নিসা : ৩৬)
শিরকের পরিণাম
শিরকের ভয়াবহ পরিণাম বহুবিদ। যেমন- ১. শিরকের মাধ্যমে ঈমান বিনষ্ট হয়। ২. শিরককারীর সকল নেক আমল বিনষ্ট হয়। ৩. শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম। ইত্যাদি। শিরক এমন জঘন্যতম অপরাধ যা পরিপূর্ণরূপে তাওবা ছাড়া ক্ষমার কোনো পথ নেই। শিরকের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন, আর তার পরিণতি হবে জাহান্নাম এবং এ রকম জালিমের কোনো সাহায্যকারী নেই।” (সূরা মায়িদা : ৭২)। “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করা ক্ষমা করেন না। ইহা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যে কেউ আল্লাহর শরিক করে সে এক মহাপাপ করে।” (সূরা নিসা : ৪৮)। “তুমি আল্লাহর সাথে অপর ইলাহ স্থির করো না, করলে তুমি নিন্দিত ও বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৯)। “আর যদি তারা শিরক করত, তাহলে অবশ্যই তাদের আমল বিনষ্ট হয়ে যেত।” (সূরা আনআম : ৮৮)
শিরক থেকে বাঁচার উপায়
শিরক থেকে বাঁচতে হলে কুরআন ও হাদীসের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। রাসূল সা. এবং সাহাবীগণ কিভাবে শিরকমুক্ত জীবন যাপন করেছেন তার সঠিক ইতিহাস জেনে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। তাওহীদ বিষয়ক ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে। সর্বোপরি শিরক থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।
৩. কাবাগৃহের পবিত্রতা রক্ষার নির্দেশনা
মহান আল্লাহ বলেন, (وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ) ‘এবং তাওয়াফকারী, নামাজে দ-ায়মান ও রুকু সিজদাকারীদের জন্যে আমার গৃহকে পবিত্র রাখ।’
আমরা সবাই জানি, কাবাগৃহ ইবাদতের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ স্থান। মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ)-কে কাবাঘর নির্মাণ ও তা পবিত্র করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর পবিত্র স্থান ছাড়া ইবাদত শুদ্ধ হয় না। ইবাদত কবুলের জন্য জায়গা পবিত্র থাকা শর্ত। যেমন সালাত শুদ্ধ হওয়ার জন্য শরীর পবিত্র থাকার পাশাপাশি জায়াগা পবিত্র থাকা জরুরি। আর কাবাঘরের এ পবিত্রকরণ হলো বাহ্যিক অভ্যন্তরীণ সকল অপবিত্রতা থেকে। মুফাসসিরগণ এ আয়াতাংশের কয়েকটি ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
আবুল হাসান আল-মাওয়ারদী (রহ.) বলেন, (وَطَهِّرْ بَيْتِيَ) অর্থাৎ ‘আমার গৃহকে পবিত্র রাখ’ বাক্যে তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে।
১. শিরক ও মূর্তি পূজা থেকে বায়তুল্লাহ পবিত্রকরণ। এটি কাতাদাহ্ (রহ.)-এর মত।
২. কাবার আশপাশে ময়লা, গোবর, রক্ত ফেলা হতো, এ থেকে পবিত্রকরণ। ইবন ‘ঈসা এ মত উল্লেখ করেন।
৩. বাজে কথা থেকে বায়তুল্লাহ পবিত্রকরণ।’
আবু লাইস সমরকন্দী (রহ.) বলেন, (وَطَهِّرْ بَيْتِيَ) অর্থ হলো ‘আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম (আ)-এর প্রতি এ মর্মে ওহী করেছেন যে, তুমি আমার ঘরকে নাপাকি থেকে এবং মূর্তিপূজা থেকে পবিত্র করো।’ (বাহরুল ‘উলুম, ২য় খ-, পৃ. ৪৫৬)
ইবন আব্বাস রা. বলেন, (وَطَهِّرْ بَيْتِيَ) অর্থ হলো-‘আমার মসজিদকে পবিত্র করো মূর্তি থেকে।’ (তানবীরুল মিকবাস, পৃ. ২৭৯)। মুজাহিদ ও কাতাদার (রহ.) মতে, ‘এটি হলো শিরক থেকে পবিত্র করা।’ (তাফসীরু ইবন কাসীর, ৫ম খ-, পৃ. ৪১৩)। ইমাম বায়যাবী (রহ.) বলেন, (وَطَهِّرْ بَيْتِيَ) অর্থ হলো ‘সকল প্রকার মূর্তি এবং সকল প্রকার ময়লা থেকে পবিত্রতার কথা বলা হয়েছে।’ (তাফসীরু বায়যাবী)
২৭তম আয়াত : ইবরাহিম (আ)-এর মাধ্যমে হজের প্রবর্তন
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ
“এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা করে দাও। তারা প্রত্যেকটি দুই পাহাড়ের মধ্যকার চওড়া পথ মাড়িয়ে দূর-দূরান্ত থেকে তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার দুর্বল উটের পিঠে সওয়ার হয়ে।”
সাম্য-মৈত্রী, ঐক্যবোধ প্রতিষ্ঠায় হজের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মুসলিম উম্মাহর বিশ^ সম্মেলন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় মহান আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবার পানে যার সূচনা হয় ইবরাহিম (আ)-এর ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে। এর ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি মুসলিম বিশ^ হজ পালন করে চলছে। ইবরাহিম (আ) যখন কাবা নির্মাণ শেষ করলেন। তাঁকে বলা হলো, (وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ) ‘(হে ইবরাহিম!) তুমি মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার কর।’ তখন ইবরাহিম (আ) আল্লাহ তায়ালার নিকট আরজ করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের সকলের কাছে আমার আওয়াজ কী করে পৌঁছাবে? উত্তরে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বলেন, ‘তোমার দায়িত্ব শুধু ডাক দেয়া। আওয়াজ পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। সুতরাং ইবরাহিম (আ) মাকামে ইবরাহিমের উপর বা সাফা পাহাড়ের উপর অথবা আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে ডাক দেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক তাঁর একটা ঘর বানিয়েছেন। অতএব, তোমরা ঐ ঘরের হজ কর। তখন পাহাড় ঝুঁকে পড়ে এবং তাঁর শব্দ সারা দুনিয়ায় গুঞ্জরিত হয়। এমনকি যে বাপের পিঠে ও মায়ের পেটে ছিল তার কানেও এ শব্দ পৌঁছে যায়। প্রত্যেক পাথর, গাছ এবং যার ভাগ্যে আল্লাহ হজ লিখে দিয়েছেন কিয়ামত পর্যন্ত তাদের প্রত্যেকে এ আওয়াজের জবাবে বলেন, لبيك اللهم لبيك (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক) (তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৫ম খ-, পৃ. ৪১৪)।
হজের গুরুত্ব ও ফজিলত
হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি অন্যতম স্তম্ভ। যা শারীরিক ও আর্থিক ইবাদাতের শামিল। এর গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি ফজিলতও সীমাহীন। রাসূল সা. অন্য সকল আমলের উপর হজের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ পালনকারীকে গুনাহমুক্ত নবজাতকের ন্যায় বলা হয়েছে। কবুল হজের পুরস্কার জান্নাত। হজের প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের জন্য রয়েছে পৃথক ফজিলত ও মর্যাদা। এই ইবাদতের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম একত্রিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের উপর হজ সারা জীবনে একবারই ফরজ হয়। আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে হজের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
এক. হজ সম্পর্কিত আল-কুরআনের নির্দেশনা : মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরজ করা হলো, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে) আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে মুখাপেক্ষীহীন। (সূরা আলে ইমরান : ৯৭) সূরা আল-বাকারার ১৯৬তম আয়াতেও অনুরূপ নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও উমরাহ পূর্ণ কর।’
দুই. হজের গুরুত্ব সম্পর্কিত হাদীস : হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ইবাদত হিসাবে হজ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় রাসূল সা. তা দ্রুত সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। উমার রা. বলেন, যাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ সম্পাদন করবে না তারা ইহুদি ও নাছারা অবস্থায় মারা যাবে।’ ইবন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজের সঙ্কল্প করে সে যেন অবিলম্বে তা আদায় করে। কারণ মানুষ কখন অসুস্থ হয়ে যায়, কখন প্রয়োজনীয় জিনিস বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং কখন অপরিহার্য প্রয়োজন সামনে এসে যায়। (সুনানু ইবন মাজাহ) সুনানু আবি দাউদ ও ইবন মাজাহ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, একদা আকরা বিন হাবেস রা. নবী করীম সা.-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ কি প্রতি বছর ফরজ না জীবনে একবারই ফরজ? তিনি বললেন, “না বরং হজ জীবনে একবার ফরজ। যে অধিক করবে তা তার জন্য নফল হবে।”
তিন. হজ পালন উত্তম ইবাদত : আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সা.-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনা। বলা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, কবুল হজ। (সহীহুল বুখারী)
চার. হজ জিহাদতুল্য ইবাদত : হাসান ইবন আলী রা. বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট এসে আরজ করল আমি একজন ভিতু ও দুর্বল ব্যক্তি। তখন নবী সা. তাকে বললেন, ‘তুমি এমন একটি জিহাদে চলো যা কণ্টকাকীর্ণ নয়।’ অর্থাৎ হজ পালন করতে চলো। রাসূলুল্লাহ সা. অন্যত্রে বলেছেন, ‘বৃদ্ধ, দুর্বল ও নারীর জিহাদ হলো হজ ও উমরা। (মুসনাদু আহমাদ)
পাঁচ. হজ ও উমরাকারীর দোয়া কবুল করা হয় : আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা হাজীদের গুনাহ ক্ষমা করেন এবং হাজী যাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তাদেরকেও ক্ষমা করেন।’
(মুসনাদু বাযযার)
ছয়. হাজীগণ আল্লাহর মেহমান : ইবন উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং হজ ও উমরা পালনকারী আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ তাদের আহ্বান করেছেন, তারা সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। তারা আল্লাহর কাছে যা চাইছে আল্লাহ তাই তাদের দিয়ে দিচ্ছেন।’ (ইবনু মাজাহ)
সাত. হজে খরচ জিহাদে খরচের সমতুল্য : বুরায়দা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘হজে খরচ করা আল্লাহর পথে (জিহাদে) খরচ করার সমতুল্য সাওয়াব। হজে খরচকৃত সম্পদকে সাতশত গুণ বাড়িয়ে এর প্রতিদান দেয়া হবে।’ (মুসনাদু আহমাদ)
আট. তালবিয়া পাঠ ও উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠের ফজিলত : ইবন আব্বাস রা. এর অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সা.-এর সঙ্গে আরাফাতে অবস্থানকালে অকস্মাৎ সে তার সওয়ারি হতে পড়ে যান। এতে তাঁর ঘাড় মটকে গেল অথবা রাবী বলেন, ঘাড় মটকে দিল। (যাতে তিনি মারা গেলেন)। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাঁকে বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল দাও এবং দু’কাপড়ে তাঁকে কাফন দাও; তাঁকে সুগন্ধি লাগাবে না এবং তার মস্তক আবৃত করবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাঁকে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উত্থিত করবেন।’
(সহীহুল বুখারী; সহীহ মুসলিম)
নয়. বায়তুল্লাহ তাওয়াফের ফজিলত : ইবন উমার রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে সাতবার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে তার একটি গোলাম আযাদ করার সমান সওয়াব হয়। তাওয়াফের প্রতি কদমে আল্লাহ তার একটি করে গুনাহ মাফ করেন, একটি করে নেকি লেখেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।’ (মুসনাদু আহমাদ) ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বায়তুল্লাহর হজকারীদের উপর প্রতিদিন একশত বিশটি রহমত নাজিল করেন, তার ষাটটি তাওয়াফকারীদের জন্য, চল্লিশটি মুসল্লিদের জন্য এবং বিশটি দর্শকদের জন্য।’
(শুআবুল ঈমান)
দশ. হজ ও উমরা পালনকালে মৃত্যুবরণকারীর ফজিলত : আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশ্যে বের হলো, অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, কিয়ামত পর্যন্ত তার হজের সওয়াব লেখা হবে। আর যে ব্যক্তি উমরার উদ্দেশ্যে বের হলো, আর সে অবস্থায় তার মৃত্যু হলো কিয়ামত পর্যন্ত তার জন্য উমরার সওয়াব, লেখা হবে। যে ব্যক্তি জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হলো এবং তাতে তার মৃত্যু হলো, কিয়ামত পর্যন্ত তার জন্য মুজাহিদের সওয়াব লেখা হবে।’
(মুসনাদু আবু ইয়ালা)
এগারো. হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানি স্পর্শ করার ফজিলত : ইবন উমার রা. বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানির স্পর্শ পাপসমূহকে মুছে দেয়।’ (সুনানে তিরমিযী; মুসনাদে আহমাদ)।
বারো. ইয়াওমে আরাফার ফজিলত : আয়িশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আরাফার দিন অপেক্ষা এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তায়ালা অত্যধিক পরিমাণে মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন এবং তিনি নিকটবর্তী হন। আর ফিরিশতাদের নিকট তাদেরকে গর্ব নিয়ে করে বলেন, এরা কী চায় ? (সহীহ মুসলিম)
তেরো. জমজমের পানি পান করার ফজিলত : রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হলো জমজমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ মুক্তি।’ (মুজামুল আওসাত)
২৮তম আয়াত : কুরবানির নির্দেশনা
لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِج فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ .
“যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত হাজির হতে পারে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে রিজিক হিসেবে তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহ্র নাম স্মরণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।”
অত্র আয়াতে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ১. হজের মাধ্যমে নানাবিধ কল্যাণের ইঙ্গিত প্রদান ২. নির্দিষ্ট দিনগুলোতে কুরবানি করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ এবং ৩. কুরবানির গোশ্ত নিজে ভক্ষণ এবং অপরকে তা প্রদান সংক্রান্ত।
১. হজের মাধ্যমে নানাবিধ কল্যাণ
অত্র আয়াতে ‘মানাফি‘ই (مَنَافِعَ) শব্দটি ‘নাকিরাহ’ বা অনির্দিষ্টবাচক ব্যবহার করে ব্যাপক অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ হজ আদায়ের মাধ্যমে দ্বীনি ও দুনিয়াবি উভয় কল্যাণ রয়েছে। দ্বীনি কল্যাণ সম্পর্কে হাদীসে আছে যে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, (مَنْ حَجَّ للهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّه) ‘যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্য হজ করল এবং হজকালে যৌন সম্ভোগ ও কোনো প্রকার পাপাচারে লিপ্ত হলো না, সে যেন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতই নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরল।’ (সহীহুল বুখারী)।
হজের দুনিয়াবি কল্যাণও অনেক। যেমন- হজের বরকতেই সেই জাহেলি যুগ থেকেই হজের চার মাসে সন্ত্রাস, যুদ্ধ-বিগ্রহ স্থগিত হয়ে যায়। অর্থনৈতিক কল্যাণ বেড়ে যায় ইত্যাদি।
২. নির্দিষ্ট দিনগুলোতে কুরবানি করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ
ইবরাহিম (আ) ও ইসমাইল (আ)-এর স্মৃতি বিজড়িত ইসলামের অন্যতম একটি বিধান হলো কুরবানি। কুরবানি শুধু উম্মতে মুহাম্মাদির জন্যই ওয়াজিব নয়, পূর্ববর্তী উম্মাতদের জন্যও এই কুরবানি ওয়াজিব ছিলো। কুরবানি সংক্রান্ত বিষয়ে অত্র সূরার ২৮, ৩৪, ৩৬ ও ৩৭তম আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
কুরবানির পশু যেমন- উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে যবেহ করতে হবে। এখানে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নাম না নিয়ে অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবেহ করা কাফির ও মুশরিকদের পদ্ধতি। মুসলমানেরা কুরবানি করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
আর আয়াতে ‘কয়েকটি নির্দিষ্ট দিন’ (أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ) দ্বারা কোন্ দিন বুঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে মতবিরোধ আছে। হানাফি আলিমগণের মতে ১০ জিলহজ ও তার পরের তিন দিন বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে অপর একটি মত হলো জিলহজের প্রথম দশ দিন। এ মতের স্বপক্ষেও বেশকিছু ইমাম ও মুফাসসিরগণের সমর্থন আছে।
হজের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো কুরবানি। হজের সময়কে কেন্দ্র করেই বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা এ কুরবানি সম্পন্ন করে থাকে। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় কুরবানির দিনসমূহে (জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২) যেই পশু জবাই করা হয় তাকে কুরবানি বলা হয়। আরবীতে এর বিভিন্ন নাম রয়েছে। কুরআন-হাদীসের কোথাও ‘উযহিয়া’ বলা হয়েছে, কোথাও ‘নাহর’ বলা হয়েছে। আবার কোথাও ‘নুসুক’ বলা হয়েছে। এ ছাড়া কুরআনে তিন জায়গায় ‘কুরবান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সবগুলোর অর্থ ও মর্মও অভিন্ন।
কুরবানির উদ্দেশ্য : শুধু গোশ্ত খাওয়া নয় বরং সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করা, কেননা কুরবানির পশুর রক্ত, গোশ্ত, পশম কিছুই আল্লাহর নিকট যায় না। আল্লাহ বলেন, ‘এগুলোর গোশ্ত ও রক্ত আল্লাহ্র কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পেঁৗঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’
(সূরা হজ : ৩৭)।
৩. কুরবানির গোশ্ত নিজে ভক্ষণ এবং অপরকে তা প্রদান
অত্র আয়াতাংশে কুরবানির গোশ্ত খাওয়া বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, (فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ) ‘অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।’ এখানে ‘ফাকুলু’ (فَكُلُوا) অর্থাৎ ‘খাও’ শব্দটি আদেশসূচক পদ হলেও অর্থ ওয়াজিব করে না। বরং অনুমতি দান ও বৈধতা প্রকাশ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে উলামায়ে কিরাম একমতপোষণ করেছেন।
কুরবানি কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন- হজে ইহরাম অবস্থায় ত্রুটি ও অপরাধের শাস্তি হিসেবে ‘দমে জিনায়াত’ (ত্রুটিজনিত কুরবানি) যা ওয়াজিব কুরবানি। ত্রুটি ও অপরাধের শাস্তি হিসেবে যে কুরবানি ওয়াজিব হয়, তার গোশ্ত খাওয়া বৈধ নয়; বরং এটা শুধু ফকির-মিসকিনদের হক। এ ব্যাপারে সব ফিকাহবিদ একমত। অবশিষ্ট প্রকার কুরবানি ওয়াজিব হোক কিংবা নফল সেগুলো কুরবানির গোশ্ত কুরবানিকারী নিজে, তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ধনী হলেও খেতে পারে। হানাফি, মালেকি ও শাফেয়িদের মতে ‘তামাত্তু’ ও ‘কেরানে’র কুরবানিও ওয়াজিব কুরবানির অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ কুরবানি এবং হজের কুরবানিসমূহের গোশ্ত তিন ভাগের একভাগ ফকির-মিসকিনকে দান করা মুস্তাহাব। এই মুস্তাহাব আদেশই আয়াতের পরবর্তী বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, (وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ) ‘এবং দুুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।’
নির্বাচিত আয়াতসমূহের শিক্ষা
১. বায়তুল্লাহর তথা কাবাঘরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইবাদত হিসেবে গণ্য। এটি সর্বপ্রথম আদম (আ) অথবা তাঁর দুনিয়াতে আসার সময় বা তার আগে ফেরেশতারা নির্মাণ করেছেন। আর ইবরাহিম (আ) আল্লাহর নির্দেশে এটি উক্ত স্থানেই পুনরায় নির্মাণ করেন। এজন্যই এটাকে ‘প্রাচীন ঘর’ বলা হয়েছে। পৃথিবীর সকল অঞ্চলের মানুষের জন্য এ ঘরের সমান অধিকার রয়েছে।
২. হজরত ইবরাহিম (আ) কর্তৃক কাবা নির্মাণের পর আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হজ পালনের নির্দেশ দেয়া হয়। এ ঘোষণার মাধ্যমে তখন থেকেই প্রত্যেক সামর্থ্যবানের উপর হজ পালন করা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে।
৩. হজের আনুষ্ঠানিকতায় শিরক করা যাবে না। আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ) কাবা নির্মাণ করার পর আল্লাহর প্রথম আদেশ হলো, ‘আমার সাথে কাউকে শরিক করো না।’ অর্থাৎ এই কাবা নির্মাণ করা হয়েছে আল্লাহর জন্য। এর সাথে জড়িত আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক সকল ইবাদত হবে আল্লাহর জন্য। আল্লাহর ইবাদতে অন্য কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা যাবে না।
৪. ইবরাহিম (আ)-এর কুরবানির স্মরণ হিসেবে কুরবানির বিধানও তখন থেকেই চালু রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক সামর্থ্যবানের উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। কুরবানি পশুর গোশ্ত নিজেরা খেতে পারে, আত্মীয়স্বজনকে দিতে পারে এবং গরিব-মিসকিন ও অভাবীদেরকেও দিতে পারে।
৫. ইসলামের নিদর্শনগুলোর প্রতি প্রত্যেক মুসলমানের সম্মান দেখানো কর্তব্য। কেননা এর মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানের কল্যাণ রয়েছে।
লেখক : প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়