মু. সাইফুল ইসলাম |
উসমানি খিলাফত তখন একশো উননব্বই বছর অতিক্রম করছে। সুলতান দ্বিতীয় বাইজিদ বিন মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ-এর শাসন আমল। ৮ই রজব, ৮৯৫ হিজরি, ১৫ এপ্রিল, ১৪৮৯ সাল। তুরস্কের কায়সেরি প্রদেশের প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ১৫ মাইল দূরে আয়িরনাস এলাকায় আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত তুর্কি প্রকৌশলী সৈনিক নওমুসলিম আব্দুল মান্নানের কুঁড়েঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করে এক ফুটফুটে শিশু। নাম রাখা হয় সিনান।
কে জানতো, এই ছোট্ট সিনান একদিন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থপতি হিসেবে পরিগণিত হবে। পাঁচশত বত্রিশ বছর পরে এসেও থাকে নিয়ে কলম ধরবো। কে জানতো এই ফুটফুটে শিশুটি দিনশেষে এমন একজন ব্যক্তি হবেন, যার কর্মযজ্ঞ দেখে পাশ্চাত্যের স্থপতি মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, প্রাচ্যবিদ বার্নাড লুইস পর্যন্ত বিস্মিত হবে, ঈর্ষা করবে। আমাদের তাজমহল নির্মাণেও যার পরোক্ষ প্রভাব থাকবে।
আজ এমন একজনকে নিয়ে আলাপ করতে বসেছি, যিনি উসমানি খিলাফতের সেরা চারজন খলিফার রাজত্বকাল পেয়েছেন। সুলতান প্রথম সেলিম, সুলতান সুলাইমান কানুনি, সুলতান দ্বিতীয় সেলিম ও তৃতীয় মুরাদ। যাদের বদান্যতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সেই ছোট্ট সিনান হয়ে উঠেন একজন মিমার সিনান। হ্যাঁ, পৃথিবী বিখ্যাত স্থপতিবিদ কোজা মিমার সিনান আগা।
মিমার সিনান কর্মজীবন শুরু করেছিলেন মিলিটারি প্রকৌশলী হিসেবে। পাথর শিল্পে বিশেষজ্ঞ পিতার কাছে হাতেকলমে কারিগরি শিক্ষাগ্রহণ শেষে সিনান ১৫১২ সালে অটোমান সেনাবাহিনীর এক বিশেষ অভিজাত সৈন্যদল “ইয়েনিসারি (Yeniçeri)” (ইংরেজিতে-Janissary) দলে যোগদান করেন। ইয়েনিসারি হল এমন একটি সামরিক দল যারা খলিফা কোনো অভিযানে গেলে তাঁকে বেষ্টনী দিয়ে রাখত।
এই বাহিনীর সাথে থেকে সিনান তিনি বিভিন্ন সামরিক অভিযানে যোগ দেন। অল্পদিনেই ইয়েনিসারিতে একজন প্রকৌশলী হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন এবং একের পর এক মর্যাদাক্রম (Rank) পাড়ি দিয়ে অফিসার পদে উন্নীত হন। অফিসার হিসেবে তিনি ইয়াভুজ সুলতান প্রথম সেলিম ও সুলতান সুলেয়মান কানুনির অধীনে অনেক সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
বিশেষ করে উসমানী সেনাবাহিনীর ইউরোপ, আফ্রিকা এবং পারস্যজুড়ে নতুন নতুন বিজয়াভিজানগুলোতে মিমার সিনান সেনাবাহিনীর প্রকৌশল সংক্রান্ত বিষয়াদির দেখাশোনা করতেন এবং একইসাথে নতুন বিজিত শহরগুলোতে মসজিদ ও আবাসিক এলাকা তৈরীর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থাকতেন। যুদ্ধাভিযান পরিচালনার জন্য নির্মাণ করতেন রাস্তা, ব্রিজ ও দুর্গ।
মূলত সুলতান সুলেয়মান এর শাসন আমলে স্থপতি হিসেবে বিকাশ হয় মিমার সিনানের। সুলতান সুলাইমানের শাসনামলে সিনান ‘কারা বুউদান’ অভিযানের সময় প্রুট নদীর উপরে মাত্র তের দিনে ব্রীজ নির্মাণ করে সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একজন সাধারণ সৈনিক থেকে প্রতিভাগুণে কম সময়ে সেনাপতি হয়েও সেখানে স্থায়ী হতে পারেননি। কীভাবেইবা পারবেন, যিনি সেনাপতি হবেন স্থাপত্যবিদ্যার, তিনি কীভাবে সৈন্যদলের সেনাপতি হয়ে লড়াই করবেন! তার আসল লড়াই তো পাথর-কনক্রিট নিয়ে। তার প্রকৃত গুণ সুনিপুণ নির্মাণশৈলীই তাকে সেনাপতি থেকে স্থপতিতে পরিণত করেন।
তাঁর এই প্রতিভার খ্যাতি দিন দিন আরো ছড়িয়ে পড়তে থাকলে ১৫৩৮ সালে তাকে ইস্তানবুলে খিলাফতের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ দেন সুলতান সু্লেয়মান। দায়িত্ব গ্রহণের পরই সিনান এমন অসাধারণ সব স্থাপনাসমূহ নির্মাণ করেন যা চিরকালের জন্যে বদলে দেয় ইস্তানবুলের আকাশের দিগন্তরেখা।
১৫৪৩ সালে সুলতান সুলেয়মানের ছেলে শাহজাদা মেহমেদ ২১ বছর বয়সে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে, সুলতান ইস্তানবুলে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য বৃহৎ একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সিনানের জন্য এটি ছিলো বড় স্মরণীয় কোনো মসজিদ নির্মাণ করার প্রথম সুযোগ। পরবর্তী ৪ বছর ধরে সিনান ইস্তানবুল শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই শেহজাদে জামি (şehzade camii – শাহজাদা মসজিদ) তৈরি করেন। সুলতান সুলেয়মান সিনানের এই কাজে খুব সন্তুষ্ট হলেও, সিনান এটিকে নিজের সেরা কর্ম হিসেবে ভাবতে পারেননি। তিনি মনে করতেন এরচেয়েও তাঁক লাগানো কিছু নির্মাণ করার ক্ষমতা তাঁর আছে।
এর কয়েক বছর পরেই সুলতান সুলেয়মান নিজের নামে ইস্তানবুলে আরেকটি বৃহদাকৃতির মসজিদ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা করেন। স্বাভাবিকভাবেই এর দায়িত্ব খেলাফতের প্রধান প্রকৌশলীর উপর বর্তায়। সুলতান মসজিদটিকে এমন এক জায়গায় নির্মাণ করতে চাইলে যেন অনেকদূর থেকে মসজিদটিকে দেখা যায়। সিনান তাই পরিকল্পনা মাফিক গোল্ডেন হর্ন (Golden Horn) এর কাছে একটা পাহাড়ের উপরে মসজিদের স্থান নির্ধারণ করেন; ফলে বহুদূর থেকেও এই স্থানটিকে সহজে সনাক্ত করা সম্ভব ছিলো। মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হতে প্রায় ৭ বছর সময় লাগে। এটি ছিলো মিমার সিনানের দ্বিতীয় বড় কোনো কাজ।
কথিত আছে, মসজিদটির ভিত্তিস্থাপনের পর সিনান হঠাৎ ৫ বছরের জন্য গায়েব হয়ে যান। ক্ষুব্ধ সুলতান সুলেয়মান জানতে চান, তার প্রিয় স্থপতির কি হয়েছে! কোথায় তিনি? পাঁচ বছর পর ফিরে এসে সিনান ব্যাখ্যা দেন যে, মসজিদটির ব্যাপকতা এতই বিশাল হবে যে নির্মাণ কাজ শুরু করার আগে এর ভিত্তি মাটিতে স্থায়ী হওয়ার জন্য পাঁচ বছর সময় দরকার ছিলো!
১৫৫৭ সালে যখন মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়, তখন এটি সত্যিকারের ‘মাস্টারপিস’ হিসেবেই বিবেচিত হয়। যা নির্মার্ণের পাঁচশত বছর পর ইউনেস্কু ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা দেয় ১৯৮৫ সালে। যার উপর গবেষণা করে গত শতকে জাপানি প্রকৌশলীগণ ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা আবিস্কার করেছে।
এই মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে তিনি ‘লাউড স্পিকারবিহীন’ বিশাল মসজিদে প্রত্যেক মুসল্লির কানে ইমামের ধ্বনি পৌঁছানোর পদ্ধতি আবিস্কার করেছিলেন মিমার সিনান। ছাদ, গম্বুজ ও পিলারগুলো এমনভাবে স্থাপন করেছিলেন যেন ইমামের ধ্বনি সমানে মসজিদের শেষ কাতারের মুসল্লিও শুনতে পায়। তাঁর কাজ ছিল সাশ্রয়ী। হ্যাঁ, জাপানি প্রকৌশলীগণ এই পদ্ধতিকেই গবেষণা করেই ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা আবিস্কার করে। ভাবতে পারেন, সে যুগে আগুনের আলোতে বসে বৈদ্যুতিক সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে দূরে আওয়াজ পৌঁছানোর কথা চিন্তা করেছিলেন কীভাবে? আমার আল্লাহ এই ক্ষমতা মিমার সিনানকে দিয়েছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছিলো।
তিনি সুলেয়মানি মসজিদে আলোর জন্য ব্যবহৃত বাতিগুলোর ধোঁয়া বা গলিত মোমকে কাজে লাগিয়ে কালি বানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সুলেমানি মসজিদের দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফিগুলো সেই কালিতেই আঁকা। এর সরু-উঁচু চারটি মিনার এবং ৫০ মিটার উঁচু গম্বুজ, স্থাপত্য ও প্রকৌশলের বিবেচনায় একে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলো। মসজিদটির সংলগ্ন কমপ্লেক্সে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র, হাম্মামখানা, গ্রন্থাগার (যেটি আজও ব্যবহৃত হয়), লঙ্গরখানা, অনেকগুলো কুরআন শিক্ষার মক্তব, একটি হাদিস শিক্ষার বিদ্যালয় এবং শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নির্মাণ করা হয়েছিলো। কমপ্লেক্সটির একাংশে একটি সমাধিস্থলও ছিলো, যেখানে সুলতান সুলেয়মান ও তাঁর পরিবারবর্গকে মৃত্যুর পর দাফন করা হয়।
মসজিদের ভেতরের পর্যায়ক্রমিক লাল ও সাদা রঙের খিলানগুলো আল-আন্দালুস (মুসলিম স্পেন) এর কথা মনে করিয়ে দিতো, যা ছিলো তখন শুধুই স্মৃতি। মসজিদের কেন্দ্রে নামাযের কাতারগুলোর উপরে ছিলো একটি বৃহদাকার ঝাড়বাতি। পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে সিনান এই মসজিদে বিশেষ ধরনের জানালা ব্যাবহার করেন। জানালাগুলোতে একটি বিশেষ স্তর থাকতো, যেখানে মসজিদে ব্যবহৃত মোমবাতি থেকে নির্গত ঝুল জমা হতো। এইভাবে ঝুল দ্বারা বাহিরের বাতাসকে দূষণ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো; এমনকি এই ঝুলকে ক্যালিগ্রাফারদের ব্যবহৃত কালিতে রুপান্তরিত করা যেতো।
মসজিদটির অভ্যন্তরে ইস্তানবুলের অন্যান্য মসজিদের মত সূক্ষ্ম কারুকার্য ছিলো না; বরং এর সৌন্দর্য ছিলো এর সরলতায় এবং আভিজাত্যে। মসজিদের আঙ্গিনা ছিলো ইজনিক টাইলস (Iznik tiles) দ্বারা আবৃত, যাতে আয়াতুল কুরসী অঙ্কিত ছিলো। আভ্যন্তরীণ প্রশস্ততা, উচ্চতা এবং সুক্ষ্ম কারুকার্যের বিবেচনায় সুলেয়মানিয়ে মসজিদের সমতুল্য অন্যকোনো মসজিদ (তখনো) ইস্তানবুলে ছিলো না।
এই মসজিদের সৌন্দর্য এবং বিশালতা সত্ত্বেও, সিনান তখনো মনে করতেন যে, তিনি এরচেয়েও ভাল কিছু করার যোগ্যতা রাখেন, তাঁর মন তবুও ভরছিলো না। তখনকার সময়ে ভবন নির্মাণে আয়াসোফিয়াকে আদর্শ মানা হতো। সিনান এমন একটি ভবন নির্মাণের প্রতিজ্ঞা করেন যা আয়াসোফিয়ার বিশালতাকেও ছাড়িয়ে যাবে। তুরস্কের এদ্রিনের সেলিমিয়ে মসজিদ (Selimiye Mosque) নির্মাণের মাধ্যমে তিনি সেটি পূর্ণ করেন। তিনি এটিকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি মনে করতেন। এর প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ছিলো ৮০ মিটারেরও বেশি যা আয়াসোফিয়াকে টপকে দিয়েছিল।
১৫৬৬ সালে সুলেয়মানের মৃত্যুর পর তার পুত্র খলীফা দ্বিতীয় সেলিমও নিজের নামে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তবে এবার ইস্তানবুলে নয়; বরং ইস্তানবুল থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে Edirne শহরে এই মসজিদের নির্মাণের স্থান নির্ধারত হয়। এর নির্মাণকাজ শুরুর সময়ে সিনান সত্তরোর্ধ এক প্রৌঢ় হওয়া সত্ত্বেও, তিনি আয়াসোফিয়ার শ্রেষ্ঠত্বকে পিছনে ফেলার জন্য লক্ষ্যে ছিলেন অটল। অবশেষে ১৫৭৪ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে উনি এ লক্ষ্য অর্জনে সফল হন।
মিমার সিনানের আরেকটি ঐতিহাসিক কীর্তি হলো মেহরিমা সুলতান জামে নামে দুটি মসজিদ। এ দুটি মসজিদ ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। মেহরিমা ছিলেন সুলতান সুলায়মানের মেয়ে। যিনি ১৫২২ সালের ২১ শে মার্চ তোপকাপি প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। মেহরিমা শব্দের অর্থ হলো, সূর্যের সঙ্গে চাঁদের যৌগিক আলো।
সিনান এই মসজিদদ্বয় নির্মাণে মেহেরিমার নামের মহিমা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সিনানকে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা জানানো হলে, তিনি ইস্তানবুলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান বসফরাসের তীরে উসকুদার (Üsküdar) নামক স্থানে দীর্ঘ ৮ বছরের সাধনায় প্রথম মসজিদটি নির্মাণ করেন। এরপর ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে উঁচু জায়গা এদিরনেকাপিতে (Edirnekapı) অন্যটি নির্মাণ করেন।
এই দুই মসজিদের মধ্যে লুকায়িত রহস্যটা হলো মেহরিমার জন্ম মাসে তথা মার্চ-এপ্রিলের কয়েক দিন সূর্য একটি মসজিদের মিনারে অস্ত যায়। আর অন্য মসজিদের মিনার থেকে চাঁদ উদিত হয়। ঐতিহাসিকরা নির্মাণশৈলীর ইতিহাসে একটি অপূর্ব স্থাপনা বলে মেহরিমা জামে সুলতানকে উল্লেখ করে থাকেন।
সিনানের জাদুকরী হাতের ছোঁয়া রয়েছে তৎকালীন অটোমান সাম্রাজভুক্ত সিরিয়াতেও। সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে ১৫৪৭ সালে খসরুবিয়া মসজিদ (Khusruwiyah Mosque) নির্মাণ করেন, যা আজও শহরটির একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও তিনি বাগদাদ এর ইমাম আবু হানিফা মসজিদ, কোনিয়ার জালালউদ্দিন রুমি মসজিদকে সংস্কার করেন এবং অটোমান সাম্রাজের বলকান অঞ্চলের বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় বন্যা বাশি মসজিদ (Banya Bashi Mosque) ও দামেস্কের বারাদার নদীর তীরে আল-তাকিয়া মসজিদ বা সুলেমানিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। সিনানের প্রতিটি নির্মাণই একেকটি উপাখ্যান ও রহস্যেঘেরা।
সিনানের নির্মাণ রহস্যের প্রমাণ পাওয়া যায় শেহজাদা মসজিদের সংস্কারকালে। নির্মাণের প্রায় পাঁচ শত বছর পরে সেই ভবনের সংস্কারের কাজ শুরু করলে আধুনিক স্থপতিগণ সংস্কার কাজ পরিচালায় খুব হিমশিম খাচ্ছিলেন। এমনই এক সময় তারা মসজিদের দেয়ালের ভিতরে একস্থানে শিশির ভেতর একটি চিঠির সন্ধান পান, যা তাদেরকে সংস্কারের পথ দেখিয়েছিল। একটা মানুষ কতটা দৃঢ়চেতা হলে এ ধরনের কাজ করতে পারেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল হাজার বছর পরে হলেও কেউ এটি সংস্কার করতে চাইবে। আর তাই তিনি তখনই দিকনির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন।
সিনানের সমসাময়িক একজন বিখ্যাত ইতালিয়ান স্থপতি ছিলেন আন্দ্রেয়া পাল্লাদিও (Andrea Palladio)। আন্দ্রেয়ার পৃষ্ঠপোষক এবং গুণগ্রাহী মার্কান্তনিও বারবারো (Marcantonio Barbaro) অটোমান দরবারে ভেনিসের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তার মাধ্যমে সিনান এবং আন্দ্রেয়ার নিয়মিত যোগাযোগ হত। আন্দ্রেয়ার বিখ্যাত কীর্তি সান জর্জো মাগিওরে চার্চ (Church of San Giorgio Maggiore)। ধারণা করা হয় এই স্থাপত্যেও সিনানের প্রভাব রয়েছে।
সিনানের সময়কার আরেকজন বিখ্যাত স্থপতি মাইকেল এঞ্জেলো। দুইজনই নিজেদের কাজ দ্বারা পরস্পর প্রভাবিত হয়েছেন। মুসলিম স্থাপত্যবিদরা মনে করেন মি মাইকেল এঞ্জেলোর অসামান্য কীর্তি সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার (St. Peter’s Basilica) স্থাপত্যে মিমার সিনানের প্রভাব রয়েছে। ব্যাসিলিকার ডোমের ডিজাইন নিঃসন্দেহে সিনানের সুলায়মানিয়া মসজিদ থেকে অনুপ্রাণিত।
তাজমহল নির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্ট্রা মুঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে এসে অটোমানদের সাথে মুঘলদের একটা সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সম্পর্কের একটা উল্লেখযোগ্য দিকই ছিল সাংস্কৃতিক বিনিময়। এই সময় কয়েকজন অটোমান আর্কিটেক্ট এসেছিলেন শাহজাহানের দরবারে। এরা ছিলেন বিখ্যাত মিমার সিনানের ছাত্র। যারা কিছুদিন পর তাজমহলের নির্মাণ শুরু করেন! এতে বলা হয়ে থাকে, মিমার সিনান তাজমহল নির্মাণের শিক্ষক।
সিনান বসফরাসের তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণের কথা চিন্তা করেছিলেন, যা এখনকার আধুনিক তুরস্কে দেখা যায়। সিনান তাঁর ৫০ বছরের স্থাপত্য জীবনে চার শতাধিক কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন। যার মধ্যে ৯৪টি বড় মসজিদ, ৫২টি ছোট মসজিদ, ৫৭টি মাদ্রাসা, ১৭টি মক্তব, ২২টি (গম্বুজের) বড় কবরস্থান, ৩টি চিকিৎসাকেন্দ্র, ৬টি ঝুলন্ত সেতু, ৯টি পানির বড় লাইন, ৮টি সেতু, ২০টি মেহমানখানা, ৩টি ব্যাংক, ১৮টি বিশ্রামাগার, ৩৫টি প্রাসাদ, ১৭টি লঙ্গরখানা, ৩টি বৃদ্ধাশ্রম, ৮টি গুদাম এবং ৪৮টি হাম্মাম ছাড়াও নানাবিদ স্থাপত্য রয়েছে।
এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেন রুস্তম পাশা মসজিদ, খুররাম (হুররেম) সুলতান হাম্মামখানা, মেহমেদ পাশা যাকোলভি ব্রীজ, কিলিচ আলী পাশা কমপ্লেক্স, হাসেকি সুলতান কমপ্লেক্স, মোল্লা সেলেবি মসজিদসহ আরও অনেক বিস্ময়কর সব ভবন যা বর্তমান যুগের স্থাপত্য প্রকৌশলীদের পথিকৃৎ হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এবং তাঁর পরবর্তীকালে তুরস্কের লক্ষ লক্ষ মসজিদ নির্মাণ হয়েছে তাঁরই স্থাপত্যশিল্পের উপর ভর করে। তাঁর শিষ্যগণ সমগ্র বিশ্বজুড়েই নির্মাণকাজের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছিলেন, যার অন্যতম উদাহরণ হলো ইস্তানবুলের সুলতান আহমেদ মসজিদ (Blue Mosque) এবং ভারতের আগ্রার তাজমহল। এমনকি তুরস্কে গত বছর নির্মিত কোনো মসজিদের দিকে তাকালেও দেখবেন এটা মিমার সিনানের নকশা উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে।
আধুনিক তুরস্ক এখনো তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। আর তাই তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়, সড়ক, মসজিদ, গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি রয়েছে। তাঁর নিজ হাতের সজ্জা পর্যটকদের বিস্মিত করে, পা বাড়াতে সাহায্য করে ভাবনার নতুন জগতে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যবিদ বললে অত্যুক্তি হবে না।
অটোমান স্থাপত্য রেনেসাঁর মূল কারিগর মিমার সিনান ১৭ জুলাই, ১৫৮৮ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে শতাব্দীব্যাপী জীবনের ইতি টানেন। সুলেমানি মসজিদে তাঁর সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক সুলতান সুলেয়মানের সমাধির অদূরে তাঁকে কবরস্থ করা হয়।
রেফারেন্স :
১. Gülru Necipoğlu: The Age of Sinan: Architectural Culture in the Ottoman Empire, Published by Reaktion Press, 2005, pp. 592
২. Deborah Howard: Venice & the East: The Impact of the Islamic World on Venetian Architecture 1100–1500, Published by Yale University Press, September 10, 2000, pp. 300
৩. Godfrey Goodwin: A History of Ottoman Architecture, Published by Thames & Hudson; Reissue edition (May 1, 2003), pp. 512
৪. John Freely, Augusto Romano Burelli, Ara Guler: Sinan: Architect of Suleyman the Magnificent and the Ottoman Golden Age, Published by Thames & Hudson; 1st Am. ed. edition (September 1, 1992), pp. 144
৫. Aptullah Kuran: Sinan: the grand old master of Ottoman architecture, Published by Institute of Turkish Studies, 1987