উমাইমা শেইখ |
আব্বাসীয় রাজপ্রাসাদের শাহজাদী তিনি। যার দাদা খলিফা আল মানসুর। নাহ! শুধুই শাহজাদী বললে কি চলে? তিনি যে রাজ-প্রাসাদের রাণী। রাণীও কি আর যার তাঁর? তিনি জগদ্বিখ্যাত খলিফা হারুন-আর-রশীদের রাণী। রাণী জুবাইদা। জ্বী,ইনিই আমাতুল আজীজ। যার শরীর জুড়ে মিশে আছে আব্বাসীয় রাজ-বংশের রক্ত।
আমাতুল আজিজ আসল নাম হলেও দাদার দেয়া পছন্দের নাম জুবাইদা বিনতে জাফর নামেই পৃথিবীর বুকে পরিচিত লাভ করেন। আব্বাসীয় কন্যাগণের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিতজন ছিলেন জুবাইদা।
নহরে জুবাইদা কি?
“নহরে জুবাইদা ” অর্থাৎ জুবাইদার খাল। “নহর” শব্দের অর্থ স্রোতস্বিনী, জলধারা, খাল ইত্যাদি।
হিজরী ১৯৩ সনে খলীফা হারুন আর রশীদের মৃত্যুর পর পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনকালে হাজীদের তীব্র পানির সংকট দেখে জুবাইদা বিনতে জাফর অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং তাৎক্ষণিক ভাবে খাল খননের সিদ্ধান্ত নেন। খাল খননের ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কথা বলেন তিনি। কিন্ত তারা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের কথা হলো,এ তো অনেক দিনারের বাজেট। এত এত দিনার ব্যয় করে কিভাবে এ খাল খনন করা সম্ভব?
কিন্তু জুবাইদা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যত ব্যয়ই হোক না কেন? তিনি এ খাল খনন করবেনই করবেন। মানুষের এ দুর্দশা যেভাবেই হোক দূর করা চাই।
হাজারো বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে অবশেষে ইরাকের বিখ্যাত শহর বাগদাদ হতে মক্কা ও মদীনা যাওয়ার পথে মুসলিম হাজীদের জন্য আরাফাত, মুযদালিফা এবং মিনার পাশ দিয়ে কূপ খনন করে ইসলামের ইতিহাসে তিনি অমরত্ব লাভ করেন।
রাণী জুবাইদা খাল খননের সময় জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন –
” খাল খননের নিমিত্তে আমি সব হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছি। যাদের কাছে আমি টাকা পাব সে টাকা পরিশোধ করতে হবে না এবং আমি যাদের কাছে ঋণী, তাদের ঋণ অতিসত্বর দ্বিগুণ হারে পরিশোধ করা হবে।”
নহরে জুবাইদা খননে ব্যয় হয়েছিল তৎকালীন সময়ে প্রায় ১৭ লাখ দিরহাম।
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা জুবাইদার কথা উল্লেখ করে বলেছেন –
“মক্কা থেকে বাগদাদে যাওয়া এই রাস্তার প্রতিটি জলাশয়, পুল বা কূপ তার অবদানের কারণে হয়েছিল। যদি এই রাস্তার জন্য তার উদ্বেগ না থাকত তবে তা হত না! যে কেউ দ্বারা ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। “
জুবাইদা বিনতে জাফরের প্রাসাদে প্রায় একশ জন কুরআনে হাফেজা কে নিয়োগ করেছিলেন। যারা সর্বদা পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে মগ্ন থাকত। একদলের কুরআন তিলাওয়াত শেষ করা হলে অপর দল পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করত।
জুবাইদার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল তৎকালীন সময়ে অত্যাধিক। চারিত্রিক গুণাবলি, ধর্মীয় গুণাবলির পাশাপাশি কুরআন, হাদীস সম্পর্কে অগাধ পারদর্শীতা, শরীয়তের মাসয়ালা মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে তৎকালীন সময়ে তিনি প্রসিদ্ধ লাভ করেন। ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি ইতিহাস – সাহিত্য চিকিৎসায় ও তার পাণ্ডিত্য কম ছিল না।
জুবাইদা বিনতে জাফর অত্যন্ত দানশীল এং ইবাদত গুজারী ছিলেন। তাঁর দানশীলতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইতিহাসবেত্তা খতীব আল বাগদাদী লিখেছেন –
কোনো এক হজ্জের মৌসুমে মাত্র ৬০ দিনে তিনি হাজীদেরকে প্রায় ৫ কোটি ৪০ লাখ দিনার দান করেন।
সঙ্গিন মুহূর্তে মহান আল্লাহ এবং প্রিয় নবীর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তিনি যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বীরল। এই জগৎবিখ্যাত নারী ২১৬ হিজরীর ২৩ ই জমাদিউল উখরা প্রিয় প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানান। পৃথিবীর সকল নারী পুরুষের জন্য জুবাইদা বিনতে জাফর ত্যাগের যে নমুনা এবং বীরত্বের মহিমা প্রকাশ করেছেন তা চিরকাল মুসলিম সমাজকে পথ দেখাবে ইনশা আল্লাহ।
পূর্ণ নাম : জুবাইদা বিনতে জাফর ইবনে মনসুর ইবনে মাহমুদ ইবনে আলী ইবনে আব্দুল্লাহ।
পিতা : জাফর ইবনে আল – মনসুর।
মাতা : সালসাল (আল মাহদীর স্ত্রী)।