আহমেদ আফগানী |
আজাদি আন্দোলন। বাংলায় স্বাধীনতা আন্দোলন। নামের মধ্যে একটা প্রাণস্পন্দন আছে। সারা পৃথিবীতে এটা খুবই জনপ্রিয় আন্দোলন। কিন্তু মুসলিমদের স্বাধীনতা আর অন্যদের স্বাধীনতা এক বিষয় নয়। বেশিরভাগ মুসলিমই স্বাধীনতার মানে বুঝতে পারেন না। আজাদির মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সৃষ্টির গোলামী থেকে মুক্ত করে স্রষ্টার একনিষ্ঠ গোলাম বানানো। ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ বলতে ও মানতে পারাটাই স্বাধীনতা। মুসলিমদের স্বাধীনতা হলো সৃষ্টির গোলামী থেকে মুক্ত হওয়া। এটাই প্রকৃত স্বাধীনতা।
সাইয়েদ আলী শাহ গিলানী কাশ্মীরের মানুষদের প্রকৃত আজাদি বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। ওনাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হয় অথচ উনি কখনো বিচ্ছিন্নতাকে পছন্দ করেন না। উনি মুসলিমদের বলতেন সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য। তিনি মনে করতেন এই উপমহাদেশে সকল মুসলিমকে পাকিস্তানের সাথে একীভূত থাকতে হবে। তিনি নিজেকে পাকিস্তানী দাবি করতেন এবং কাশ্মীর যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল তাই কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সাথে একীভূত করার জন্যই ছিল তাঁর প্রচেষ্টা, তাঁর আন্দোলন। কাশ্মীরের মুসলিমদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাই সকল সমস্যার মূল এটা তিনি আগেই বুঝতে পেরেছেন ও এর জন্য তিনি জনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন।
১৯৪৭ সালে ইংরেজদের থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে কাশ্মীরের শাসক ছিলেন মহারাজা হরি সিংহ, যিনি হিন্দু ছিলেন। কাশ্মীর প্রধানত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ছিল। ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেয়ার ব্যাপারে হরি সিংহ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ তার ধারণা ছিল তার গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলে তার রাজ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। তিনি ভারতের সাথে যুক্ত হতে চেয়েছেন অন্যদিকে কাশ্মীর ছিলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। তাই সেখানের জনগণ পাকিস্তানের সাথে থাকতে চেয়েছেন।
কাশ্মীরের বৃহৎ রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ ছিলেন মুসলিমদের নেতা। তিনি রাজার চাইতেও বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। শেখ আব্দুল্লাহ শুরুতে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তার মতামত দেন। এমতাবস্থায় রাজা স্বাধীন থাকার ব্যাপারেই মত দেন। এতে সম্মত হয় শেখ আব্দুল্লাহও। জিন্নাহও শেখ আব্দুল্লাহকে জোর করেন নি। রাজা ভারত ও পাকিস্তানের সাথে একটি ডিফেন্স চুক্তি করার প্রস্তাব দেন যাতে তারা তাকে প্রতিবেশী হিসেবে মেনে নেয় এবং সীমান্ত সুরক্ষা পায়। পাকিস্তান সম্মত হয় এবং তার সাথে চুক্তি করে। কিন্তু ঝুলিয়ে রাখে ভারত। তারা কাশ্মীরকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে।
কাশ্মীরের নিষ্ঠাবান মুসলিমরা তাদের নেতাদের (রাজা ও শেখ আব্দুল্লাহ) এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা পাকিস্তানের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। সাইয়েদ আলী শাহ গিলানী ছিলেন তখন যুবক। তিনি এই আন্দোলনে যোগ দেন। তাদের যুক্তি ছিলো যেহেতু ভারত তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি, সুতরাং ভারত যে কোনো সময়েই কাশ্মীর আক্রমণ করবে। কাশ্মীরের মতো মুসলিম অঞ্চল ভারতের দখলের কবলে পড়লে কাশ্মীরের মুসলমানদের দুর্ভাগ্য বরণ করতে হবে। তারা মুসলিম সংহতির ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন করে, শেখ আব্দুল্লাহকে গাদ্দার উপাধি দেয়।
শেখ আব্দুল্লাহ ভেবেছিলো কাশ্মীর স্বাধীন থাকলে দিন কয়েক পরে সে কাশ্মীরের প্রধান শাসক হতে পারবে যেহেতু কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। এসময় রাজার লোকেরা আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ চালায়, হত্যা করতে থাকে মুসলিমদের। যেহেতু মুসলিমরা দু’ভাগে বিভক্ত। তাই রাজা হরি সিংহ মুসলিম নিধনের সুযোগ গ্রহণ করে।
এই ঘটনার জেরে অল্পকিছুকাল পরেই ভারত থেকে পাঠান জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে কাশ্মীরে প্রবেশ করে। মুসলিম শরনার্থীরা শ্রীনগরের দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে। ধারণা করা হয় মুসলিমদের বাঁচাতে জিন্নাহই পাঠানদের কাশ্মীরে পাঠায়। যেহেতু পাকিস্তান কাশ্মীরের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ, তাই সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ করেনি পাকিস্তান। পাঠানদের আগমনে বিচলিত হয়ে কাশ্মীরের রাজা সামরিক সহায়তা চেয়ে ভারতকে চিঠি দেয়।
নেহেরু তখন রাজাকে ভারতের সাথে একীভূতকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করায়। হরি সিংহ ভারতের সাথে একত্র হওয়ার চুক্তি করে। ভারত সেই সাথে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেয়। নেহেরু এখানে চালাকির আশ্রয় নেয়। সে জানে ভারত কাশ্মীর আক্রমণ করলে সব মুসলিম এক হয়ে যাবে। তাই সে ভারত আক্রমণ করার আগে গাদ্দার শেখ আব্দুল্লাহকে কথিত শাসক বানিয়ে নেয়, যাতে মুসলিমরা দ্বিধাগ্রস্থ ও বিভক্ত থাকে। কাশ্মীরের রাজা নিরুপায় হয়ে সব মেনে নেয়।
এর কিছুদিন পরই ভারতীয় সৈন্যরা জম্মু ও শ্রীনগর দখল করে নেয়। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানও তার সীমান্ত অতিক্রম করে কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেল কাশ্মীরে। এই প্রচণ্ড যুদ্ধের ফলে কাশ্মীরের অধিকাংশ স্থান দুর্গম হয়ে পড়ে। নেহেরু এই যুদ্ধের ওপর আন্তর্জাতিক দৃষ্টি কামনা করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং জাতিসংঘের সালিশি কামনা করে। তিনি বলেন, অন্যথায় উপজাতীয় আক্রমণ থামাতে ভারতকে বাধ্য হয়েই পাকিস্তান আক্রমণ করতে হবে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সিদ্ধান্ত হয় গণভোটের মাধ্যমেই কাশ্মীরের ভাগ্য চুড়ান্ত হবে। ভারত সেই গণভোট কখনই অনুষ্ঠিত হতে দেয় নি। আজ পর্যন্ত না।
২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান ৩৭০ ধারা দিয়ে কাশ্মীরকে অধিভুক্ত করে। ভারত কাশ্মীরের পুরোটা দখলে নিতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের উত্তর এবং পশ্চিম অংশদ্বয়ের উপর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং উক্ত স্থানকে বর্তমানে আযাদ কাশ্মীর বলা হয়। ৩৭০ ধারা হলো কাশ্মীর রাষ্ট্র ও ভারত রাষ্ট্র একীভূত হওয়ার দলিল।
এখানে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার লোভ দেখিয়ে কাশ্মীরের মুসলিমদের পরাধীন বানিয়েছে ভারত। ৩৭০ ধারা অনুসারে কাশ্মীর আলাদা জাতীয়তা, আলাদা নাগরিকত্ব, আলাদা বিচার ব্যবস্থা পাওয়ার কথা। সেটা তো পায়ই নি, ভারতীয়রা যে সুযোগগুলো পায় নাগরিক হিসেবে কাশ্মীরের মুসলিমদের জন্য সেগুলো থেকেও বঞ্চিত হয়। মোদি সরকার তো কিছুদিন আগে ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিয়ে একেবারে পুরোপুরি দখল করে নিল কাশ্মীরকে।
সৈয়দ আলী গিলানি ১৯২৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কাশ্মীরের সপোর বারামুল্লা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সপোরে শিক্ষিত হয়েছিলেন এবং লাহোরের বর্তমান পাকিস্তানে ওরিয়েন্টাল কলেজে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন। তিনি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই গিলানী রাজনীতি সচেতন ছিলেন। মুসলিম লীগের সাথে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। কাশ্মীর যাতে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয় এই আন্দোলনও তিনি করেছিলেন।
সৈয়দ আলী শাহ গিলানীর রাজনীতির হাতেখড়ি মুসলিম লীগের মাধ্যমে। এরপর কাশ্মীর যখন পাকিস্তানে যুক্ত হয়নি তখন তিনি ১৯৫০ সালে তেহরিক ই হুররিয়াত গঠন করেছিলেন। এই নামে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করার পর তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। জামায়াতের সাথে যুক্ত থেকে তিনি মুসলিমদের মধ্যে আজাদী সম্পর্কে সচেতন করেন। ১৯৭২, ১৯৭৭ এবং ১৯৮৭ সালে তিনি জামায়াতের পক্ষ থেকে বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জামায়াতের ওপর কঠোর নির্যাতন নেমে আসলে তিনি জামায়াত থেকে সরে আসেন এবং জামায়াতকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখার চেষ্টা করেন।
১৯৯৩ কাশ্মীরের ২৬ টি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন মিলে ‘অল পার্টিস হুররিয়াত কনফারেন্স’ গঠন করা হয়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সাইয়েদ আলী শাহ গিলানী। এরপর এই প্রতিষ্ঠান দিয়েই গিলানী তীব্র আজাদি আন্দোলন শুরু করেন। গত তিরিশ বছরের বেশিরভাগ সময়ই বন্দী অথবা গৃহবন্দী ছিলেন। প্রতারক ভারতীয় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বারবার। ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়েছে গৃহবন্দী অবস্থায়।
সাইয়েদ আলী শাহ গিলানি শ্রীনগরের হায়দারপোরাতে থাকতেন। তাঁর ২ ছেলে, নাঈম ও নাসিম। এবং চার মেয়ে, আনিশা, ফারহাত জাবীন, জামশিদা, এবং চামশিদা। নাঈম এবং তার স্ত্রী দুজনই ডাক্তার, যারা পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে বসবাস করতেন এবং চিকিৎসা করতেন, কিন্তু তারা ২০১০ সালে কাশ্মীরে ফিরে আসেন। গিলানির ছোট ছেলে নাসিম শ্রীনগরের একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
গিলানির ভারতীয় পাসপোর্ট ১৯৮১ সালে “ভারতবিরোধী” কার্যকলাপের অভিযোগে জব্দ করা হয়েছিল। তখন থেকেই তিনি বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন না। ২০০৬ সালে তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে। তার পরিবার বহু চেষ্টা করেও চিকিতসার জন্য বাইরে নিয়ে যেতে পারে নি। অবশেষে মুম্বাইতে তাঁর চিকিৎসা হয়। আল্লাহর রহমতে তিনি ক্যান্সার থেকে মুক্তি পান। গত তিন বছর তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন ও রাজনৈতিক কার্যাবলি থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেন।
গিলানী রাজনৈতিকভাবে জনগণের রায় নিয়ে কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিলেন। সেজন্য সারাজীবন তিনি কাশ্মীরের মানুষকে আযাদির সঠিক রূপরেখা দেখিয়ে এসেছিলেন। এজন্য তিনি গাদ্দার শেখ আব্দুল্লাহ ও তার বংশধরদের শত্রু হিসেবে উপস্থাপিত হন। তাঁর আজাদি আন্দোলন কোনো গোষ্ঠীর জন্য কিংবা কোনো এলাকার জন্য ছিল না। তাঁর আজাদি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মানবতার সত্যিকারের মুক্তি।
২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর এই মহান মানুষ ও আমাদের আজাদি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক সাইয়েদ আলী শাহ গিলানী রহ. ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি তার সম্পত্তির একটি বড় অংশ মানবতার কল্যাণে জামায়াত পরিচালিত ট্রাস্টে দান করেন। ভারত ও কাশ্মিরের দ্বৈত নাগরিক হওয়ার পাশাপাশি গিলানী রহ. পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন। গত বছর পাকিস্তানের ইমরান খান সরকার তাঁকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ পদকে ভূষিত করেন।
মহান রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতের সুমহান মর্যাদা দান করুন।