ওয়াহিদুল হাদী |
তিনি হলেন ‘সাহেবু সিররু রাসূলিল্লাহ’। পিতা জাহিলিয়াত যুগে এক লোককে হত্যা করে মদিনায় চলে গিয়েছিলেন জীবন বাঁচাতে। সেখানে তিনি এক মহিলাকে বিয়ে করেন এবং বসবাস করা শুরু করেন। তখন থেকে তিনি উপাধি পান ‘আল-ইয়ামান’।
এই ‘আল ইয়ামানের’ ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক সন্তান, যিনি কি না পরবর্তীতে হয়ে উঠেন রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোপন খবরের বাহক। তিনি আর কেউ নন আমাদের অন্যতম প্রিয় সাহাবী ‘হুজাইফা ইবনে আল ইয়ামান’ (রাদ্বি আল্লাহু আনহু)।
তার পিতা হিজরতের পূর্বের ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন, সাথে তার পরিবারও। আক্বাবার চুক্তিতেও তিনি সামিল ছিলেন। তিনি রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সাক্ষাৎকালে জিজ্ঞেস করেন যে, তিনি নিজেকে কী হিসেবে ধরে নিবেন, আনসার না মুহাজির? রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন যে, যেকোনো একটি বেছে নিতে পারো। তিনি তখন বলেন যে, ‘আমি আনসারই হবো’।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করার পর তাকে ‘আম্মার ইবনে ইয়াসীরের’ (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন করে দেন। এদিকে তিনি ও তার পিতা ব্যবসায় সূত্রে মক্কায় যাতায়াত করতেন। এমনই একদিন তারা মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন, পথে দেখা কুরাইশদের বিশাল বহরের সাথে, তারা যুদ্ধে যাচ্ছে। আবু জেহেল দলের নেতা, সে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা জবাব দিলেন যে তারা মদিনায় যাচ্ছেন, সেখানে তাদের বাড়ি আছে, তো বাড়িতে যাচ্ছেন।
আবু জেহেল নাছোড়বান্দা, সে তাকে ও তার ছেলে হুজাইফাকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) আটকে রাখলো। তাদেরকে বললো যদি তোমরা মুসলিমদের বাহিনীতে যোগদান না করো তাহলে তোমাদেরকে ছেড়ে দিবো। উপায় না পেয়ে তিনি ও তার ছেলে সম্মতি জানালেন।
মদিনায় গিয়ে রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সব কিছু খুলে বললেন তারা। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা তোমাদের অঙ্গিকার পূরণ করো’। তাই তারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
বদর যুদ্ধে হেরে কাফিরদের অবস্থা খারাপ। তারা আবারও যুদ্ধ করবে বলে স্থির করলো। আবারো তারা মুখোমুখি হলো মুসলিমদের সাথে উহুদের প্রান্তে। এদিকে হুজাইফা (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) এই যুদ্ধের জন্য মুসলিম বাহিনীর সাথে বেড়িয়ে পড়লেও তার পিতা বেশী বয়ষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে ও আরেক সাহাবীকে মদিনায় বাকিদের নিরাপত্তার দেখভাল করার জন্য রেখে দেয়া হলো।
কিন্তু তাদের শহীদ কামনা মন তো আর স্থির ছিল না। আল ইয়ামান (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) তার সাথীকে বললেন যে, বয়স তো কম হলো না, মৃত্যু সন্নিকটে। আমাদের কী উচিত নয় তরবারি হাতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া? হতে পারে আল্লাহ আমাদেরকে শহীদী মৃত্যু দান করবেন।
তারা দু’জন তরবারি হাতে বাড়িয়ে পড়লেন উহুদের উদ্দেশ্যে। তারা যুদ্ধের মাঝখানে প্রবেশ করতে চাইলেন এর মধ্যে তাদের মুখ ছিল ঢাকা, কেউ বুঝার উপায় নেই যে কে এসেছে। আল ইয়ামান (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) যখন যুদ্ধের ময়দানে ঢুকলেন তখন মুসলিমের মধ্য থেকে তাকে না চিনে একজন হত্যা করতে অগ্রসর হয়। এদিকে হুজাইফা (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) তার বাবাকে দূর থেকে চিনে ফেললেন এবং ‘আমার বাবা, আমার বাবা’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে কীভাবে ডাক শোনা যায়! তার পিতার মৃত্যু হলো একজন মুসলিমের হাতে, এটা ভুলবসত হয়েছিলো।
হুজাইফা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলেন যে, তার পিতা আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে রক্তমূল্য দিলে তিনি সেগুলোর সব মুসলিমদের জন্য দান করেন দেন।
খন্দকের যুদ্ধ শুরু। কাফিররা মদিনার বাহিরে অবস্থান নিচ্ছে। এদিকে মদিনায় থাকা ইহুদিরা চুক্তি ভঙ্গ করে কুরাইশদের সাথে হাত মিলিয়েছে, মুসলিমরা ভয়ে অনেক। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাত আদায় শেষ করে, সবার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন কে ঐপারে গিয়ে খবর নিয়ে আসতে পারবে, এভাবে তিনি তিনবার বললেন, কেউ জবাব দিলেন না, কারণ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ভয় ও ক্ষুদার্ত ছিলেন তারা। তারপর তিনি হুজাইফার (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) নাম নিলেন এবং তাকে সেখানে পাঠালেন। সাথে বলে দিলেন তিনি যেন শুধু খবর নিয়ে আসা ছাড়া আর কিছু না করেন।
তিনি চুপিসারে কুরাইশদের শিবিরে গিয়ে খবর নেয়ার জন্য বসে পড়লেন। এ সময় আবু সুফিয়ান [(রাদ্বি আল্লাহু আনহু) সে সময় তিনি ইসলামের ছায়াতলে আসেননি] বললেন যে, আমি ধারণা করছি যে আমাদের মধ্যে শত্রুর কেউ লুকিয়ে আছে, তাই তোমরা সবাই সবার পাশের জনের পরিচয় জিজ্ঞেস করো। সাথে সাথে হুজাইফা (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) তার দুই পাশের দুই লোকের হাত ধরে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তুমি?’ তারা তাদের উত্তর দিলো। এতে করে তাদের আর সন্দেহ থাকলো না।
আবু সুফিয়ান (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) তখন কুরাইশদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে নিজের উঠের পিঠে উঠে মক্কার দিকে রওয়ানা দিলেন। হুজাইফা (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) বলেন যে, তিনি চাইলে আবু সুফিয়ানকে (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) তাৎক্ষণিক হত্যা করে ফেলতে পারতেন।
কিন্তু তিনি করেননি কারণ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে কোন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। ফিরে এসে দেখলেন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতে, এদিকে হাড়কাঁপানো শীতে কাঁপছেন হুজাইফা (রাদ্বি আল্লাহু আনহু), সালাত শেষে তাকে তিনি তার চাদরের নিচে নিয়ে উষ্ণতা দিলেন এবং তার কাছ থেকে ঐপারের খবর নিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় তিনি তার কাছেই থাকতেন, তার থেকে শিক্ষালাভ করেন। তিনি রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোপন খবর নিজের কাছে আমানত হিসেবে রাখতেন, কেউ সেটা জানতে পারতো না। একটা বিষয় লক্ষ করে দেখতে পারবেন যে, শেষ জমানায় কী হবে এর বেশীরভাগ বর্ণনা করেছেন হুজাইফা (রাদ্বি আল্লাহু আনহু)। কারণ তিনি রাসুলুল্লাহকে শেষ জমানায় কী হবে, আলামত কী কী হবে সেসব জিজ্ঞেস করতেন সবসময়।
রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তিনি বদর পরে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পর তিনি বেরিয়ে পড়েন আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য। খলিফাদের আমলে তিনি কমবেশি সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং একের পর এক অঞ্চল বিজয় করতে থাকেন।
উমার (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) জানতেন যে, হুজাইফার (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) কাছে মুনাফিকদের নামের লিস্ট আছে। তিনি তাকে এক ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে সরাসরি নাকচ করে দেন। তিনি তাকে নিজের নাম এতে অন্তর্ভুক্ত আছে কি না জানতে চাইলে তিনি তাকে মনে করিয়ে দেন যে তিনি আশারা মুবাশাশারার একজন।
উমার (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) চিঠি দিয়ে তাকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে নু’মানের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি এতে সাড়া দিয়ে সেখানে চলে যান। নু’মান যুদ্ধে শহীদ হলে, দায়িত্বভার আসে তার কাঁধে। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে পারস্য বাহিনীকে গুড়িয়ে দেন তারা, বিজয় ছিনিয়ে আনেন। পারস্যের অনেক অঞ্চল এসে যায় ইসলামের ছায়াতলে। এভাবে তিনি আরও কয়েকটি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
উমার (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) তাকে মাদাইন অঞ্চলের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং তিনি একটি গাঁধায় চড়ে শহরে প্রবেশ করেন, লোকেরা তা দেখে পুরোই অবাক হয়ে যায়। তারা তাকে কত টাকা কর দিবে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, আমার খাবার আর আমার গাঁধার জন্য ঘাস, এইটুকু প্রয়োজন।
উসমানের (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) শাসন আমল পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন এবং তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে তিনিও অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনিও পাড়ি জমান আখিরাতের উদ্দেশ্যে।
ইন্তেকালের আগে তাকে কাফন দেয়ার মতন কাপড় তার ঘরে ছিল না, তিনি সাধারণ কাফন একটি আনার জন্য বলেন। মৃত্যু শয্যায় তিনি কান্না করলে সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলো কেনক তিনি কাঁদছেন, তিনি বলেন যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না, তাকে আমি স্বাগতম জানাই। আমি এই ভেবে কাঁদছি যে, আমার আল্লাহ আমার উপর সন্তোষ কি না! সুবহানাল্লাহ। ‘সব করেও তারা চিন্তায় ছিলেন আর কিছু না করেও আমরা হয়েছি চিন্তামুক্ত’।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।