রেদওয়ান রাওয়াহা |
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী, সর্বাধিক প্রভাবশালী-প্রতাপশালী শাসকের তথা বাদশাহ’র স্ত্রী তিনি। আরাম-আয়েশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ-বিত্ত —কোনোদিকেই ছিলো না তাঁর কমতি। বাহারি রকমের খানাফিনা-পোষাক-আশাকে ভর্তি ছিলো তাঁর হেরেম। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজা এবং সেই রাজপ্রাসাদের রানী বলে কথা। আয়েশী ও বিলাসী এক জিন্দেগীর অধিকারিনী তিনি। তাঁর বসবাসের জন্য ছিলো সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা সুউচ্চ প্রাসাদসমূহের জাঁকজমকপূর্ণ একাধিক আ্লিশান মহল। সেসব প্রাসাদ ও মহলের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে চির হরিৎ বৃক্ষরাজি। সেসব বৃক্ষরাজির তলদেশে বয়ে চলতো অবিরাম নীল দরিয়ার স্বচ্ছ-সুবিমল জলরাশির শান্ত স্রোত। এক কথায় তাঁর জীবনটা ছিলো শান-শওকতে কানায় কানায় পূর্ণ!
দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত অসীম ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেই স্বামী বাদশাহ’র খুবই ঘনিষ্ঠ তিনি। সেই প্রতাপশালী স্বামীর হৃদয়জুড়ে অনাবিল ভালবাসা ভরপুর রয়েছে তাঁর জন্য। কিন্তু দেশের জনসাধরণের জন্য সে ছিলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর। মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী, সর্বাধিক প্রভাবশালী-প্রতাপশালী এই শাসক সবচেয়ে বেশি পাষণ্ডও ছিলো। ছিলো সবচেয়ে বেশি উদ্ধত আর অহংকারী এবং জঘন্য এক পাপিষ্ঠ!
তার অহ্ংকার, তার পাপ, তার ঔদ্ধত্য এতোটাই বেড়ে গিয়েছে যে সে নিজেকে মানুষের রব্ব বলে দাবি করতো। প্রকাশ্য দিবালোকে ঘোষণা দিয়ে বলতো আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড়ো রব্ব! *১
হ্যাঁ, যার এবং যাদের কথা বলেছিলাম তারা হলো প্রাচীন মিশরের ফেরআউন দ্বিতীয় রামেসিস। এবং তার স্ত্রী আছিয়া বিনতে মুজাহিম। সে যতোটা পাষণ্ড আর বর্বর ছিলো, ঠিক এর বিপরীতটাই ছিলো তার স্ত্রী আছিয়া। তিনি ছিলেন অনেক বেশি দয়ালু আর সত্যনিষ্ঠ। মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, এক স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল। তাঁর স্বামীর নিকৃষ্ট আল্লাহদ্রোহিতা ও কুফুরি তাঁর ঈমানের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তিনি তাঁর স্বামীর নির্মম পাষণ্ডতার সামান্যতম ছোঁয়াও গায়ে মাখেননি।
আছিয়া বিনতে মুজাহিমের যে এতো এতো শান-শওকত, আরা-আয়েশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি; সেই তিনি এতোসব শান-শওকত, আরাম-আয়েশকে পদাঘাত করে বেছে নিলেন এক অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ও নির্যাতন-নিষ্পেষণের জীবন! যে স্বামীর এতো প্রিয়জন ছিলেন, এতো ভালোবাসার একজন প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলেন, ছিলেন এতোটাই ঘনিষ্ঠ জীবন সঙ্গিনী, সেই স্বামীর কাছেই হয়ে গেলেন পরিত্যক্তা। নির্মমভাবে খুন হলেন তাঁর সেই স্বামীর দ্বারাই!
কেনো এমনটা হলো? এর কারণ জানতে একটু পেছনে ফিরতে হবে পুনরায়। আমরা তো বলেছিই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুষ্ট, জালিম, নিষ্ঠুর শাসক ছিলো কিবতীদের ফিরআউন (হিব্রুতে ফারাও) দ্বিতীয় রামেসিস। কিবতী বংশীয় এই ফিরআউনের নির্মম দমন-পীড়নের হিংস্র টার্গেট ছিলো বানী ঈসরাইলীরা। হেন কোনো অত্যাচার নেই যা সে তাদের করতো না । জনসাধারণের ওপর ইনসাফের যে নীতি, সে নীতির ছিটেফোঁটাও তার প্রশাসন এবং তার ভেতর ছিলো না। এভাবেই চলতে লাগলো দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। সবর ছাড়া জনসাধারণের, বানী ঈসরাইলীদের করার আর কিছুই ছিলো না!
এভাবে দিন যায়। দিন শেষে ধরার বুকে রাত্রি নামে। একদিন রাত্রিতে ঘুমোতে যায় রামেসিস। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন ভয়ংকর। বড্ড ভয়ংকর ! সে দেখলো—বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে এক অগ্নিশিখা তার রাজ্যের বাড়িঘর এবং তার কওমের সকলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো! কিন্তু বানী ঈসরাইলীদের কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করলো না। *২
ভীতসন্ত্রস্ত রামেসিস জেগে ওঠলো! তার আত্মার সব পানি যেনো শুকিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো। গলাটাও শুকিয়ে যেনো কাঠ ! স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে ডেকে আনা হলো নামি-দামি সব জ্যোতিষী এবং যাদুকরদের। তারা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললো— হে বাদশা নামদার, খুব শীঘ্রই বানী ঈসরাইলীদের মাঝে এমন একটা ছেলে শিশু জন্ম নেবে, এবং তার হাতেই আপনি ফিরআউন রামেসিস ধ্বংস হবেন। *৩ বানী ঈসরাইলীদের মধ্যেও এমন বর্ণনা চলে আসছিলো যুগ যুগ ধরে। আর তা হোলো যে, “তাদের মধ্য থেকেই এমন একজন সন্তান জন্ম নেবে, যার হাতে মিশরের অত্যাচারিরা এবং এর বাদশা ধ্বংস হবে, হবে লাঞ্চিত-অপমানিত।’’ এবং এটা তাদের পাঠ্যভুক্তও ছিলো। বিষয়টা কিবতীরাও জানতে পারলো। জানিয়ে দিলো তারা ফারাওকে । *৪
ফারাও রামেসিস ফরমান জারি করলো বানী ঈসরাইলীদের যতো পূত্র সন্তান হবে, সবাইকে হত্যা করা হবে। কন্যা সন্তানদের রাখা হবে জীবিত । যেই ঘোষণা সেই কাজ। ধরে ধরে সে বানী ঈসরাইলীদের পূত্র সন্তান জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই খুন করতে লাগলো। আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা বিষয়টা তাঁর পবিত্র কালামে পাকে এভাবেই তুলে ধরেছেন— “নিশ্চয় ফিরআউন জমিনের বুকে বিদ্রোহাত্মকনীতি অবলম্বন করেছিলো, এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেয়। তাদের মধ্য থেকে একটি দলকে সে লাঞ্চিত করতো; তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত এবং মেয়েদেরকে জীবিত রাখতো। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।’’ *৫
রাখে আল্লাহ মারে কে! যে শিশুকে পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বিতাড়িত ও বঞ্চিত করতে সে অসংখ্য আদম সন্তানকে খুন করেছেন । শতো-সহস্র মায়ের বুক খালি করেছে, সে সন্তানকেই আল্লাহ আযযাওজ্বাল্লা তার ঘরেই লালন-পালনের বন্দোবস্ত করলেন। আর সেই সন্তান হোলো বানী ঈসরাইলীদের নবি মুসা আলাইসিস সালাতু ওসসালাম। বানী ঈসরাইলীদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা এ-এক অপার অসীম অনুগ্রহ প্রদান করেছেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমে বিষয়টি এভাবেই এসেছে—”হে বনী ইসরাইল, তোমরা ওই সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন আমি ফেরআউনী সম্প্রদায় থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলাম, যারা তোমাদেরকে অত্যন্ত মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিতো। তারা তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করতো এবং নারীদেরকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য জীবিত রাখত। এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ছিলো এক মহাপরীক্ষা।” *৬
বানী ঈসরাইলীদের এই শিশু, রামেসিসের ঘরে লালিত-পালিত হতে লাগলো। ধীরে ধীরে যৌবনে পদার্পণ করতে লাগলো সেই শিশু । এক সময় পরিপূর্ণ এক যুবকে পরিণত হলেন তিনি। এক পর্যায়ে এই যুবক আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াত ও রিসালাত প্রাপ্তির দাবি করলো। আল্লাহর নির্দেশে তাঁর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তাওহীদ-রিসালাতের দাওয়াত নিয়ে সে আসলো সীমালঙ্গনকারী রামেসিসের কাছে।# ৭ রামেসিস তা গ্রহণ করলো না। কিন্তু অন্যান্য লোকজন দলে দলে মুসার আনিত দ্বীন গ্রহণ করতে লাগলো। মুসার দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণের সেই তাওহীদি ঢেউ গিয়ে পড়লো রামেসিসের রাজপ্রাসাদেও। তাঁর স্ত্রী আছিয়াও মুসার আনিত দ্বীনের প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি তো সত্যের অনুগামী, তাই তিনি মুসাকে পরখ করতে লাগলেন।
মুসার সাথে রামেসিস যাদু যাদু খেলায় মেতে ওঠলো। সে সময়টা তো যাদুবিদ্যার জয়জয়কার ছিলো। যাদুকরদের দুর্দান্ত সব যাদুকে আল্লাহ প্রদত্ত মু’জিযা দিয়ে নাস্তনাবুদ করতে লাগলো মুসা। মুসার এমন বিজয় দেখে রামেসিসের স্ত্রী খুশি হয়। ভীষণ খুশি! বুঝতে পারেন তিনি, মুসা সত্যিই আল্লাহর প্রেরিত নবি। এদিকে মুসার কাছে এই যাদুবিদ্যা কিংবা যাদুযুদ্ধ প্রদর্শনীতে হেরে রামেসিস ক্ষোভে অপমানে গরগর করে কাঁপতে থাকে। আর জনসাধারণকে ডেকে জোর গলায় ঘোষণা করে—আমি তোমাদের সবচেয়ে বড়ো রব্ব। বাকী সব মিথ্যে। *৮
কিন্তু তার এই ঘোষণা, এই চিৎকার হালে এতোটা পানি পায় নি। ইতোমধ্যে রাজ্যের সেরা সেরা যাদুকররা মুসার আনিত দ্বিনের প্রতি, এক স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলো। তার পুলিশ প্রধানের স্ত্রীও ইতোমধ্যে ঈমানী নুরের কিরণচ্ছটায় উদ্ভাসিত। বিষয়টি ফারাও রামেসিসের কানেও গিয়ে পৌঁছলো। সে পুলিশ প্রধানের স্ত্রীকে তলব করলো। জানতে চাইলো বিষয়টি। তিনি অকপটে স্বীকার করে নিলেন। এবং জবাব দিলেন—আমি তাঁকেই রব মানি ,যিনি আমার, আপনার এবং আমাদের সকলেরই রব্ব ! ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো রামেসিস । এবং হুকুম করলেন তাঁকে চিৎ করে শুইয়ে দিতে। এরপর তাঁর হাত-পায়ে পেরেক মেরে দেওয়া হলো। সাপ এনে ছেড়ে দেওয়া হলো তাঁর দেহে, যেনো তাঁকে ধ্বংশন করে। একে একে তাঁর সব সন্তানদেরকেও হত্যা করা হলো। তবুও তিনি বিচিলিত হলেন না। ঈমানের পথ ছাড়লেন না । *৯
রামেসিসের স্ত্রী আছিয়া বিনতে মুজাহিম আল্লাহর কাছে সেই মহিলার সুউচ্চ মর্যদা দেখতে পেলেন। পুরোদমে তিনিও ঈমান আনলেন আল্লাহ এবং তাঁর নবি মুসা আলাইহিস সালামের ওপর, এবং তাঁর ঈমান পূর্বের ছেয়ে আরো কয়েকগুন বেড়ে গেলো। রামেসিসেরও কর্ণগোচর হলো তার স্ত্রীর ঈমান আনার বিষয়টি।
ক্রোধে অগ্নিশর্মা রামেসিস সভাষদদের বৈঠক আহব্বান করলো। তাদের জিজ্ঞেস করলো—আমার স্ত্রীর খবর তোমাদের কাছে আছে কি? তোমরা তার সম্পর্কে কিরূপ ধারণা পোষণ করো? সকলেই একবাক্যে ফার্স্ট লেডির গুণকীর্তন-ই করলো। ভালো জানে বলে জানালো। কিন্তু রামেসিস বললো সে তো আমাকে রব্ব মানে না। সে মুসার রব্বকে রব্ব মানে। রামেসিস তাদের সাথে পরামর্শ করলো। পরামর্শে সীদ্ধান্ত হলো যে তাঁকে শাস্তি দিয়ে হত্যা করা হবে।
অতঃপর তলব করা হলো এক সময়ের খুব প্রিয়তমা ও গভীর ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্কের স্ত্রী আছিয়া বিনতে মুজাহিমকে। সোজাসাপটা তিনি ফারাও রামেসিসকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি এক আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমানদার। আর তৎক্ষণাত রামেসিসের নির্দেশে তাঁকে তীব্র তাপময় প্রখর রোদের মাঝে শুইয়ে দেওয়া হোলো। হাত-পায়ে পেরেক গেঁথে পাথর দিয়ে আঘাত করলো তাঁর নিষ্পাপ আর পবিত্র দেহবায়বে। তাঁকে বাঁধাবস্থায়-ই পবিত্র সেই দেহবায়বে পাথর নিক্ষেপে খুন করলো।
তাঁর ওপর যখন এতো এতো নির্মম আর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হলো, তখন তিনি তা হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছেন। তাদের নির্যাতন চালানোর সময় তাঁর মুখে একখণ্ড নির্মল প্রশান্তিময় দীপ্ত হাসি লাগে থাকতো। এই দেখে ফিরআউন বলতে লাগলো হায় হায়! এর তো মাথা খারাপ! এতো এতো কঠিন শাস্তিতেও সে হাসতেছে! তোমরা কি এতোটুকুনও বিষ্ময়বোধ করছো না? *১০
একদিকে শান-শওকতময়, প্রভাব-প্রতিপত্তিতপূর্ণ ও ফলে-ফুলেভরা সুশোভিত দুনিয়াবি জিন্দেগী, অন্যদিকে আল্লাহর ওপর ঈমান এনে তাঁর নিকৃষ্ট নরপিচাশ স্বামী রামেসিসের অবর্ণনীয় শাস্তি। তিনি শান-শওকতময় কুসুমাস্তীর্ণ আরাম আয়েশে সুশোভিত বাহ্যিকতার বর্ণচ্ছটায় ঘেরা যে জীবন, সে জীবনকে তালাক দিয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। স্বামী ফিরআউনের নির্মম শাস্তিকে বুক পেতে নিয়ে আল্লাহর কাছে কাতর কন্ঠে মিনতি করে গেছেন, বুকে পাথর চাপা নিয়ে গুণগুণ স্বরে আউড়িয়ে গেছেন— রব্বিবনি লি ইনদাকা বাইতান ফিল জান্নাতি…… —হে আমার রব্ব, আমার জন্য জান্নাতে তোমার কাছে একটি ঘর বানিয়ে দাও। আমাকে ফিরআউন এবং তার দুস্কর্ম হতে রক্ষা করো, এবং এই জালিম সম্প্রাদায় হতে আমাকে বাঁচাও। *১১
মহামহিম আল্লাহ তাঁর এই মিনতি সাথে সাথেই কবুল করেছেন । তাঁকে জীবিত থাকাবস্থায়-ই তাঁর জন্য জান্নাতে নির্মিত ঘরটি দেখানো হলো। এই দেখেই তাঁর মুখে প্রবল প্রশান্তিতে ঘেরা এক নির্মল হাসি ফুটে ওঠেছে । কিন্তু অপদার্থ রামেসিস তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রূহ দেহপিঞ্জর ছেড়ে চলে গেলো আল্লাহর বেহেশতে। পাথর নিক্ষেপ বা চাপা দেওয়া হলো শুধু তাঁর নিষ্প্রাণ দেহটির ওপর! *১২
এই যে আছিয়া ( আলাইহিস সালাম), কোন জিনিসটা তাঁর জীবনে ছিলো না? বিলাসিতার জন্য, পৃথিবীতে আনন্দ-উদ্দীপনার সাথে থাকবার জন্য, জীবনকে কাঁনায় কাঁনায় উপভোগ করার মতো কী না ছিলো তাঁর? আট-দশজন সাধারণ মানুষের মতো কোনো সাধারণ মানুষ তাঁর বর ছিলো না। ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে সবচে’ প্রভাবশালী বাদশার স্ত্রী। আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় ফার্স্ট লেডি, তিনি ছিলেন সে-সময়ের একজন সেরা ফার্স্ট লেডি। তাঁর ধারে কাছেও কেউ ছিলো না। অথচ দ্বীন-ঈমানের কাছে তিনি সব কিছুকেই বিসর্জন দিয়েছেন। প্রাধান্য দিয়েছেন প্রভুর কাছে জান্নাতের একটা ঘরকেই। যে ঘরটা, যে জান্নাতটা ঈমানদারদের আধিনিবাস। স্থায়ী ঠিকানা। তুচ্ছ্যতম ও ক্ষণস্থায়ী দু’দিনের যে দাপুটে দুনিয়া,সে দুনিয়ার বাহ্যিকতার যে বর্ণচ্ছটা, সে বাহ্যিকতার বর্ণচ্ছটায় বিকিয়ে দেন নি তিনি নিজেকে। আর তাই তো আমাদের রব্ব আল্লাহ তাঁকে এরচেয়ে শতো-সহস্র-কোটিগুণ আরাম আয়েশে ভরপুর জান্নাতে তাঁর নিজের কাছেই একটা বাড়ি বিনির্মাণ করে দিয়েছেন।
তাই তো তিনি পৃথিবীর মুমিন নারী-পুরুষের নিকট কিয়ামত অবধি আছেন এবং থাকবেন প্রেরণার পিরামিড হয়ে। আর সে-কারণেই আমাদের প্রিয় নবি, আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন, ‘সৃষ্টিজগতের মধ্যে চারজন নারী শ্রেষ্ঠ। তাঁরা হলেন, মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ও ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ।’ *১৩
আছিয়া (আলাইহিস সালাম) কী করেছেন? আর বিনিময় স্বরূপ তাঁর মর্যদা কেমন, কতোটুকুন এবং কোথায় — আমরা তা তো জানলামই। তিনি কী করেছেন? আমরা বা আমাদের মুসলিম নারীরা কী করি? সাধারণ একজন সেলিব্রিটি, একটু স্মার্ট, সামান্য পয়সাওয়ালা কারো ফ্যান্টাসিতে পড়েই আমরা সব হারাই। তার কথামতো অনেক কিছুই বিসর্জন করি। আগে কিছুটা হিজাব-নিকাব করলেও পরবর্তীতে সংসার টিকিয়ে রাখার দোহাই দিয়ে তা-ও থাকে না। তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে স্বাভাবিক স্বলাত সিয়ামও পরিত্যাগ করি। কখনো স্বামীর কথিত স্ট্যাটাস রক্ষা করতে গিয়ে শরীয়া গর্হিত জঘন্যতম সব কাজকে অনায়াসেই মুখ বুজে মেনে নিই । আর যাদের বিয়ে হয় নি বা করিনি তারা যদি সাধারণ ৫০/৬০ হাজার টাকা বেতনের ছেলেও পাই, তাহলে তো আর কিছুই বিবেচনা করি না। লাখ খানিক বেতনের মানুষ পেলে তো আর কথায়-ই নেই! রাজপ্রাসাদ কিংবা রানীর পদ পরিত্যাগ করে ঈমানের কারণে নির্যাতন সওয়া বা মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করা তো পরের বিষয়!