তাহমিদ ইসলাম |
আমিনা ব্লেকের জন্মদাত্রী মা তাকে গ্রহণ করেনি। জন্মের পর তাকে দত্তক দিয়ে দেয়া হয় এক ল্যাঙ্গুয়েজের প্রফেসরের কাছে। আপাতভাবে নিষ্ঠুর হলেও, আমিনা মনে করেন, তার জন্মের পূর্বে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাই ছিলো তার ইসলামের সাথে পরিচয়ের সূতিকাগার।
ভাষার অধ্যাপক হওয়ার দরুণ তার বাবার (দত্তক নেয়া) ছিলো পাঁচমিশালী ধরণের ছাত্রছাত্রী। যাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলো মুসলিম। এভাবে তিনি ছোটবেলায় মুসলিমদের সাথে কিছুটা পরিচিত হয়েছিলেন।
তবে আমিনা ব্লেক বেড়ে উঠেছিলেন একজন খ্রিষ্টান হিসেবে। তিনি সবসময়ই স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন। এমনকি স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করা ছিলো তার একটা অভ্যাস। কিন্তু তবুও খ্রিষ্টবাদের ঈশ্বরের পুত্র বা বাইবেলের নির্ভুলতা নিয়ে সন্দেহে ছিলেন।
এমন অবস্থায় একটা বিপদ তার জন্য নিয়ামত হয়ে আসে। তার লফজে শুনুন-
“আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন একটা অবস্থায় ফেলেছিলেন, যখন আমার নিজ গৃহত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। আর আরো আশ্চর্যজনক ভাবে, আমার এক মুসলিম বান্ধবী ছাড়া আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিলো না। একজন অধ্যাপকের মেয়ে হিসেবে আমি অনেক বই পড়তাম, আর তাদের পুরো বাসায় শুধু একটাই বই ছিলো, কুরআন”।
তিনি কুরআন হাতে নিয়ে অদ্ভূত এক অনুভূতি পেয়েছিলেন। প্রাক্তন খ্রিষ্টান হিসেবে কুরআন পড়তে গিয়ে তার বড়সড় কিছু ভুল ভেঙে যায়। পশ্চিমে এমনভাবে শেখানো হয় যে, খ্রিষ্টানধর্ম আর ইসলাম হলো বিপরীত মেরুর দুটো জিনিস। বলা হয়, গড আর আল্লাহ হলো দুটো আলাদা জিনিস, যেটা কখনোই এক হতে পারে না। কিন্তু কুরআন পড়তে গিয়ে বাইবেলের অনেক ঘটনার বর্ণনা তিনি সেখানে পেয়ে যান।
তার বান্ধবী দাবি করেছিলো এটাই হলো স্রষ্টার প্রত্যাদেশ। কিন্তু আমিনা ব্লেক ছিলেন সোজাসাপ্টা মানুষ। তিনি বলেন,
“যদি এটাই স্রষ্টার বাণী হয়ে থাকে, তাহলে আমার প্রমাণ চাই”।
দুঃখজনক হলেও, সেদিন তার বান্ধবী কোনো প্রমাণ দিতে পারে নি। কারণ সে প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ছিলো না। তবে তাদের এক প্রতিবেশি, যে নিজেও একজন রিভার্ট ছিলো, তার কাছে গেলে সে অনেক আমিনাকে অনেকগুলো আয়াত দেখায়। সে আয়াতগুলো ছিলো মূলত কুরআনের বৈজ্ঞানিক বিস্ময় বা মানবসভ্যতার নতুন আবিষ্কার নিয়ে।
আমিনাকে দেখানো হয় কীভাবে ১৪০০ বছর আগে এক নিরক্ষর মরুবাসী মানুষের কাছে আল্লাহ পৌঁছে দিয়েছিলেন বিভিন্ন বিস্ময়কর তথ্য যা আমরা বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সবেমাত্র জানতে পেরেছি।
এটা দেখে আমিনা অভিভূত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তাকে রাসূলের জীবনী নিয়ে একটা লম্বা মুভি দেয়া হয়। সেটার একেবারে শেষে ছিলো বিলালের (রা) আজান দেয়ার দৃশ্য। আজানের ধ্বনি তার হৃদয়কে এতোটা আলোড়িত করে যে তিনি বলে উঠেন,
“ইসলামে নামাজে ডাকার নিয়মই যদি এতো সুন্দর হয়, তাহলে আমি এখনই মুসলিম হতে চাই”।
তখনকার সেই অনুভূতিকে আমিনা আখ্যায়িত করেছেন, ‘Wash of Emaan’ নামে। তার কাছে সেটা ছিলো তার সর্বপ্রথম ঈমানের স্বাদ।
আমিনা ব্লেক মনে করেন, প্রায় সব নওমুসলিমের ইসলাম গ্রহণের আগে একটা সময় আসে যখন সে অনেকটা আইসোলেশনে চলে যায়। অনেকটা বর্তমান করোনার মতো। প্রাসঙ্গিক বলেই তার কথাটা এখানে উল্লেখ করছি-
“আল্লাহ আমাদের অনেকসময় একটা আইসোলেশনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যান। কারণ আমরা সমাজের চিন্তায় অনেকসময় স্রষ্টাকে ভুলে যাই। আল্লাহ চান, যেন তার বান্দা এই সময়ে তার রব্ব কে স্মরণ করে”।
ইসলাম গ্রহণের পর সালাত শিখতে গিয়ে তাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিলো। কারণ তার আশেপাশের মুসলিমরা ইসলাম থেকে এতোটা দূরে ছিলো যে তারা নিজেরাই সালাতের নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলো। কিন্তু পরিচিত এক সালাত আদায়কারীর মৃত্যুর পর তার নূর মিশ্রিত চেহারা দেখে তিনি সেদিন থেকে যেভাবেই পারেন এক ওয়াক্ত নামাজ ছাড়েন নি।
সদ্য মুসলিম হওয়া আমিনা ব্লেক কিন্তু ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেই ইসলাম প্রচারের কাজে নেমে পড়েছিলেন। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ছাড়া যখন তিনি অন্য কিছু জানতেন না তখন থেকেই তিনি দাওয়াত দেয়া শুরু করেছেন। এবং ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি এখন একজন উস্তাযা হয়ে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন।
তার একটা উক্তি দিয়ে লেখাটা শেষ করছি-
“আমার মতে ইসলাম গ্রহণের জন্য দুটো জিনিস প্রয়োজন।দুটো ইনগ্রেডিয়েন্ট। এক- ইলম, আর দুই-ক্বলব। শুদ্ধ জ্ঞান আর পরিশুদ্ধ হৃদয়। শুধু জ্ঞান থাকলেই যে যথেষ্ট না সেটা আমরা অনেক দার্শনিক আর প্রাচ্যবিদদের দেখে বুঝতে পারি। ইসলাম সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিলো, কিন্তু তাদের হৃদয় উন্মুক্ত ছিলো না”।