হামিদ জামিল |
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ১৪৫০ বছর পূর্বে মুহাম্মদ (সা.) এর নিকট প্রয়োজনানুযায়ী ২৩ বছর ধরে পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। কুরআন যখন নাজিল হয় তখন মানুষ একে খুব ভালোভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তাই তাঁরা নিজেদেরকে জীবন্ত কুরআনে পরিণত করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষগণের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাঁরা একসময় লুণ্ঠন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, কন্যা প্রোথিতকরণের কাজে নিত্যনৈমিত্তিক জড়িত ছিল। কুরআনকে ধারণের পর তাঁরা প্রত্যেকজন এমন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে এমন মানুষ আর সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি এবং সন্ধানও মিলেছে খুব কমই। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন নিজেই, তখন আল্লাহ বলবেন, “এটি এমন একটি দিন যেদিন সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যতা উপকৃত করে। তাদের জন্য রয়েছে এমন বাগান যার নিম্নদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে তারা থাকবে চিরকাল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” আল্লাহ বলছেন-
“এটি এমন একটি দিন যেদিন সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যতা উপকৃত করে। তাদের জন্য রয়েছে এমন বাগান যার নিম্নদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে তারা থাকবে চিরকাল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” (সূরা আল-মায়িদাহ : ১১৯)
এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবা : ১০০, মুজাদালাহ : ২২, এবং বাইয়্যেনাহ : ৮ -এর মধ্যেও সরাসরি বর্ণনা করেছেন।
সাহাবিদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তরভেদ থাকতে পারে কিন্তু পরবর্তী যুগের কোন মুসলমানই তা যত বড় জ্ঞানী-গুণী ও সাধক হোক না কেন কেউই একজন সাহাবির মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।
আল্লাহর পবিত্র কালাম, কুরআনের ব্যাখ্যা, আল্লাহর রাসূলের পরিচয়, তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ ইত্যাদি দ্বীনের সবকিছুই একমাত্র তাঁদেরই সূত্রে, তাঁদেরই মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। সুতরাং এই প্রথম সূত্র উপেক্ষা করলে বা বাদ দিলে অথবা তাঁদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে দ্বীনের মূল ভিত্তিই ধসে পড়ে। এ কারণেই তাঁরা ‘খায়রুল কুরুন’ ও ‘খায়রু উম্মাতিন’ এর মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। আমি এখানে সাহাবায়ে কেরামের আলোচনা করার কারণ হচ্ছে, কুরআনের ‘জীবন্ত কয়লা’ উনারাই ছিলেন।
কুরআনের মৌলিক দাবি হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কুরআনকে বুঝার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা ধারণ করো তবে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর সে দু’টি জিনিস হচ্ছে, ১. কুরআন ২. আমার সুন্নাহ।’
কুরআনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা
১. তাজা কুরআনের আহবান: ১৪৫০ বছর আগের কুরআন আর এখনকার কুরআনের মধ্যে পুরোপুরি মিল রয়েছে। কুরআনের লক্ষ লক্ষ কপি আজ প্রচারিত। রাত-দিন বিরামহীনভাবে বাড়ি, মসজিদ ও মঞ্চ থেকে কুরআনের মধুর তেলাওয়াত শোনা যায়। এতদসত্ত্বেও আঁখি অশ্রুসজল হচ্ছে না, হৃদয় আলোকিত হচ্ছে না, মনকে স্পর্শ করছে না। বিপদ ও অধঃপতন যেন কুরআন পাঠকদেরকে দিন দিন আঁকড়ে ধরছে। কিন্তু এমনটি হলো কেন? কারণ আমরা কুরআনকে জীবন্ত বিষয় বলে গ্রহণ করতে পারিনি। আমরা কুরআনের কথাকে অতীত মনে করি। কুরআনের কথাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কারণ আমাদের মন-প্রাণে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে আমরা নিজেদেরকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় পদদলিত করতে গিয়ে কুরআনের গুরুত্বকে একটি ছোট কাপড়ের ভিতরে রেখে তাকের উপর রেখে এর গুরুত্বকে কবর দিতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু হওয়ার কথা ছিল, আমরা কুরআন পড়ার সময় আল্লাহর সাথে কথা বলছি। এ পর্যায়ে পৌঁছার জন্য আমাদের কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত: কুরআন কী, কুরআনের তাৎপর্য কী এবং কুরআন নিজের জন্য কী রকম মহিমা, আকাক্সক্ষা ও ভালোবাসা চায় সে অনুযায়ী কুরআনের হৃদয়ঙ্গম করা।
দ্বিতীয়ত, কুরআন শুধু শুধু তেলাওয়াত না করে অর্থসহ যতটুকু পড়া যায় ততটুকু পড়া। কুরআন অর্থসহ বুঝে তেলাওয়াত করা যদিও তা ৫ আয়াতও হয়।
তৃতীয়ত, কুরআনের প্রতিটি কথা বর্তমান জীবন ও বাস্তবতার সাথে মিল রেখে অনুধাবন করা। আল্লামা ইকবাল তাঁর ‘জাভেদনামায়’ বলেন-
‘A hundred new worlds life in its verses
Whole centuries are involved in its moments’
২. আধুনিক সময়ে কুরআন: মানবজীবনে সফরে সঙ্গী হিসেবে যদি কুরআনকে নেয়া যায় তাহলে সেই সফর হবে আশীর্বাদময় ও সত্য পথে চলার উদ্ভাবনী শক্তি।
‘Only the Quran which can lead you on and on to success and glory in this world and in the world-to-come. (Way to the Quran)
পুঁজিবাদী গণতন্ত্র (Capitalist Democracy), জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র (National Socialism), এবং কমিউনিজমের শক্তিগুলো মূলত একই সভ্যতার তিনটি শাখা। এগুলো মানুষকে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বলে পরিচয় দিলেও তাদের হাতে মানুষ বিদ্যুতের মতো নিষ্পেষিত হতে থাকে।
সুতরাং এই বিশ্ব মানবতাকে শান্তি দিতে হলে আমাদেরকে সেই ১৪০০ বছর পূর্বে যে শাসন অনুযায়ী চলার ফলে শান্তি এসেছিল সে শাসনের সংবিধান হিসেবে কুরআনকে গ্রহণ করতে হবে ও সংবিধানে মানবগড়া আইন বাদ দিয়ে কুরআনের প্রত্যেকটি লাইনকে আইনের কর্ণধার মনে করতে হবে। আল্লাহ বলছেন-
“যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সন্তোষকামী লোকদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথপ্রদর্শন করেন এবং নিজ ইচ্ছাক্রমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের দিকে নিয়ে আসেন এবং সরল-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন।” (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৬)
(তোমরা এ অস্থায়ী জীবনের প্রতারণা জালে আবদ্ধ হচ্ছো) আর আল্লাহ তোমাদের শান্তির ভুবনের দিকে আহবান জানাচ্ছেন। (হেদায়াত তার ইখতিয়ারভুক্ত) যাকে তিনি চান সোজা পথ দেখান। (ইউনুস : ২৫)
৩. শান্তি নামক সোনার হরিণ: আমরা দুনিয়ায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পেতে দুনিয়াবি জিনিসের পিছনে ছুটে চলি। দুনিয়ায় মোহিত হওয়ার মতো অনেক বিষয় আছে। দুনিয়ার পিছনে ছুটে চলা ব্যক্তি ‘মরুভূমির মরীচিকা’ এর পিছনে ছুটে চলা ব্যক্তির ন্যায়। দুনিয়ায় কে বিল্ডিং আগে বাঁধবে ও কত উঁচু করে বেঁধে তাতে টাইলস লাগাবে এ প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে আছে। তাঁরা মদের বারে, অশ্লীল সিনেমায় শান্তি পেতে চায়। কিন্তু আল্লাহর বক্তব্য কী?!
“পূর্ববর্তী লোকদের এ কাহিনীর মধ্যে বুদ্ধি ও বিবেচনাসম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। কুরআনে এ যা কিছু বর্ণনা করা হচ্ছে এগুলো বানোয়াট কথা নয় বরং এগুলো ইতঃপূর্বে এসে যাওয়া কিতাবগুলোতে বর্ণিত সত্যের সমর্থন এবং সবকিছুর বিশদ বিবরণ, আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য হেদায়াত ও রহমত।” (ইউসূফ: ১১১)
“যখন তুমি কুরআন পড়ো তখন আমি তোমার ও যারা আখেরাতের প্রতি ঈমান আনে না তাদের মাঝখানে একটি পর্দা ঝুলিয়ে দেই।” (বনি ইসরাইল : ৪৫)
৪. রাষ্ট্রীয়/ সামাজিক শান্তি কোথায়: রাষ্ট্রে কুরআনি আইন বাদ দিয়ে মানবরচিত আইন চলার ফলে গুম, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি নির্বিচারে চলছে। আসমানি কিতাবের সামনে; স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্টি বিষয় আর মানবরচিত বিষয় দুটি কি সমান হতে পারে? কিন্তু নির্বোধেরা তাদের আইনের মধ্যে শান্তি খুঁজতে গিয়ে শান্তি হারিয়ে ফেলে ‘শান্তির সোনার হরিণ’ বিহীন বনে সেই হরিণ খুঁজতে যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে কুরআন থাকলে একে অপরকে সম্মান করত এবং মালিকে-শ্রমিকে হিংসা-বিদ্বেষ থাকতো না। মালিক তার শ্রমিকের ওপর অন্যায়ের বোঝা তো চাপাতোই না বরং সৃষ্টি হতো ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক। আল্লাহ তায়ালা বলছেন-
“এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।” (আল-হজ : ৪১)
আল-কুরআনকে একটি বই/কিতাব হিসেবে না ভেবে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সংবিধান মনে করার মধ্য দিয়েই পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করবো ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়