ইয়াসিন মাহমুদ |
আল্লাহকে যারা বেসেছে ভালো
দুঃখ কি আর তাদের থাকতে পারে
যারা লয়েছে মুখে কোরআনের বাণী
হতাশা কি আর তাদের থাকতে পারে?
(চৌধুরী গোলাম মাওলা)
আমরা ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের নানাবিধ বিষয় নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে নিজেকে আড়াল করে ফেলি সমাজ থেকে। মনে হয় আমার কিংবা আমাদের দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়। কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই যুক্তিযুক্ত? সুখ-দুঃখ, সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েই তো আমাদের জীবনসংসার। আমাদের জীবনটা বহতা নদীর মতো। এখানে জোয়ার-ভাটা; উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া, ডুব-সাঁতারের খেলা নিত্যই প্রবহমান। প্রতিদিন মুখোমুখি হতে হয় নতুন চ্যালেঞ্জের। আর একজন মুমিনকে তো স্বাভাবিকভাবে পার করতে হতে আগুনসময়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর ঘোষণা : ‘আর নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, এবং ধন, প্রাণ ও ফল-শস্যের কোন একটি ক্ষতির দ্বারা পরীক্ষা করব, কিন্তু সুসংবাদ দাও (ঐসব) ধৈর্যশীলদেরকে, যাদের ওপর কোন বিপর্যয় আপতিত হলে বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় তাঁর দিকেই আমরা প্রত্যাবর্তন করব।’ (সূরা আল বাকারা : ১৫৫-৫৬) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন : ‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও অবশ্যই পরীক্ষা করেছিলাম; আর আল্লাহ নিশ্চয় সত্যবাদীদের (সত্যতা) এবং মিথ্যাবাদীদের (মিথ্যাচারিতা) সম্পর্কে অবহিত করবেন।’ (সূরা আনকাবুত : ২-৩)
ব্যক্তিজীবনে আমরা প্রত্যাশা করে থাকি নির্ঝঞ্ঝাট ও বিপদমুক্ত জীবনের। তবে এক্ষেত্রে মুমিনের জীবনপ্রবাহে ঘটে থাকে ভিন্নতা। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছেÑ রাসূল সা: বলেছেন- ‘মুমিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক। তার সমস্ত কাজই কল্যাণকর এবং মুমিন ছাড়া অন্যের জন্য এরূপ নয়। যদি তার জন্য ভালো কিছু ঘটে এবং সে আল্লাহর শোকর করে তা হলে তা তার জন্য মঙ্গলজনক হয়। আবার যদি তার ওপর কষ্টকর কিছু আপতিত হয়ও সে ধৈর্য ধারণ করে তবে সেটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।’ একজন মুমিনের প্রতিদিনের পথচলার মুহূর্তগুলো কেমন হবে সে সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা : ‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপদই আসে তা আমি সংঘটিত করার পূর্বেই কিতাবে (লাওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ থাকে। নিশ্চয় আল্লাহর জন্য এটা খুবই সহজ। এটা এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য হর্ষোৎফুল্ল না হও। আর আল্লাহ উদ্ধত ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা হাদিদ : ২২-২৩)
নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ মুসিবতে পড়ে আমরা অনেক সময় নিজের প্রতি নিজেই আস্থা হারিয়ে ফেলি। আমাদের বিশ্বাসে চিড় ধরতে থাকে। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে থাকিÑ আমি কি আসলেই ভুল করলাম কিনা। নানা জল্পনা-কল্পনায় আটকে যাই। অনেক সময় আমাদের ভুল সিদ্ধান্ত আমাদেরকে বিপথগামী করে। মহান আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন : ‘আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আছে যে আল্লাহর ইবাদত করে (ঈমানের) কিনারা ঘেঁষে (সন্দেহের সাথে); তার মঙ্গল হলে সে তাতে সন্তুষ্ট হয়, কিন্তু কোন বিপর্যয় ঘটলে সে তার পূর্বের অবস্থায় (ইসলাম গ্রহণের পর তার পূর্বের কুফরিতে) ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারায়; এটাই তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।’ (সূরা হজ : ১১)
মুমিনের জীবনে নানা সঙ্কট ও পরীক্ষা আসবে। তার মানেই এই নয় যে, আল্লাহ তার প্রতি নারাজ। বরং আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে খুব কাছাকাছি পেতে চান এবং এরই মাধ্যমে তাকে পুরস্কৃত করতে চান। পরীক্ষা একটি সাময়িক প্রেক্ষাপট। গাছ থেকে পাতা ঝরার মতো একটি মুহূর্ত। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে- আবু সাঈদ খুদরি ও আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন- মুমিন বান্দার যে কোন ক্লান্তি, রোগ, দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, কষ্ট ও অস্থিরতা হোক না কেন, এমনকি কোন কাঁটা ফুটলেও তার কারণে মহান আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দেন। (বুখারি ৭.৫৪৫)
আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর সা: অসুখের সময় তাঁর নিকট গেলাম। সে সময় তিনি ভীষণ জ্বরে ভুগছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তো ভীষণ জ্বরে ভুগছেন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমাদের মত দু’জনের সমান জ্বরে ভুগছি।’ আমি বললাম, ‘কারণ আপনার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব সে জন্য? তিনি বললেন, হ্যাঁ, ঠিক তাই।’ যে কোন কষ্টদায়ক বস্তু দ্বারা, তা কাঁটা হোক বা অন্য কোন বেশি কষ্টদায়ক কিছু হোক না কেন, মুসলিম বান্দা কষ্ট পেলে মহান আল্লাহ অবশ্যই সে কারণে তার গোনাহ ক্ষমা করে দেন। আর তার ছোট গোনাহগুলো গাছের পাতার মত ঝরে পড়ে যায়। (বুখারি ৭.৫৫০)
অপর এক হাদিসে এসছে- আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, মহান আল্লাহ যে ব্যক্তির কল্যাণ চান তাকে বিপদে ফেলেন। (বুখারি- ৭.৫৪৮)
সকল কিছুর ঊর্ধ্বে একজন মুমিন সবসময় নিজেকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করেন এবং ঘোষণা করেন :‘ আমি তো একমুখী হয়ে তাঁর দিকেই আমার মুখ ফিরালাম, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি কখনো মুশরিকদের মধ্যে শামিল নই।’ (সূরা আনআম : ৭৯) আরো ঘোষণা করেন :‘হে রাসূল আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার সবরকম ইবাদত, আমার হায়াত, আমার মওত সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য।’ (সূরা আনআম : ১৬২)
একজন মুমিনের জন্য সময় অসময় বলে কোন কথা নেই। সর্বদা সে আল্লাহর ওপর ভরসা করেই চলবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষণা: যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। (সূরা তালাক : ৩)
আমাদের অনেকের ধারণা বাড়ি গাড়ি ধন দৌলতই জীবনের সবকিছু। এখানেই সকল সফলতা। অন্যথায় জীবনটাই বরবাদ। সত্যি কি তাই? এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর ঘোষণা :‘ যেসব মানুষ পরকালের বিনিময়ে এ পার্থিব জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে, মানুষের উচিত আল্লাহ তায়ালার পথে (তাদের বিরুদ্ধে) লড়াই করা, যে আল্লাহর পথে লড়াই করবে সে (এ পথে) নিহত হবে কিংবা বিজয় লাভ করবে, (উভয় অবস্থায়) আমি তাকে বিরাট পুরস্কার দিবো।’
‘তোমাদের এ কি হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে সেসব অসহায় নর- নারী ও (দুস্থ) শিশু-সন্তানদের (বাঁচাবার) জন্য লড়াই করো না, যারা ( এই বলে) ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব, জালেমদের এই জনপদ থেকে তুমি আমাদের বের করে নাও, অতঃপর তুমি আমাদের জন্য তোমার কাছ থেকে একজন অভিভাবক বানিয়ে দাও, তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য একজন সাহায্যকারী বানিয়ে দাও।’
‘যারা ঈমান এনেছে, তারা (সর্বদা) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, আর যারা (আল্লাহ তায়ালাকে) অস্বীকার করেছে তারা লড়াই করে মিথ্যা মাবুদের পথে, অতএব তোমরা যুদ্ধ করো শয়তান ও তার চেলা-চামুণ্ডাদের বিরুদ্ধে, অবশ্যই শয়তানের ষড়যন্ত্র একান্ত দুর্বল।’ (সূরা আন নিসা : ৭৪-৭৬)
একজন মুমিন কখনো হতাশ হতে পারে না। মুমিনের তো কোন পরাজয় নেই। একজন মুমিনের কাছে আল্লাহর প্রত্যাশা:‘ তোমরা হতাশ হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা সত্যিকার মুমিন হয়ে থাকো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৯)
ইসলামের আহবান মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়াটা কখনো সহ্য করতে পারেনি খোদাদ্রোহীরা। ইসলামের বিজয় ঠেকানোর জন্য বরাবরই শত্রুতা করেছে। সবিশেষ তাদের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহর ঘোষণা : ‘এ লোকেরা তাদের মুখের ফুৎকারেই আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়; অথচ আল্লাহ তাঁর এ নূরকে পরিপূর্ণ করে দিতে চান; কাফেররা তাকে যতোই অপছন্দ করুক না কেন’!
‘তিনি তাঁর রাসূলকে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ও সঠিক জীবনবিধান দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি এক দুনিয়ার সব কয়টি জীবনব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করে দিতে পারেন, মোশরেকরা তাকে যতই অপন্দ করুক না কেন’!
‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি (লাভজনক) ব্যবসার সন্ধান দেবো যা তোমাদের (জাহান্নামের) কঠোর আজাব থেকে বাঁচিয়ে দেবে’!
‘(হ্যাঁ, সে ব্যবসাটি হচ্ছে,) তোমরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে এবং আল্লাহর (দ্বীন প্রতিষ্ঠার) পথে তোমাদের জান ও মাল দিয়ে জেহাদ করবে; এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বুঝতে পারো।’
‘আল্লাহ তায়ালা (এর ফলে) তোমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দেবেন এবং (শেষ বিচারের দিন) তোমাদের তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এমন এক (সুরম্য) জান্নাতে, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত থাকবে, (সর্বোপরি) তিনি তোমাদের আরো প্রবেশ করাবেন জান্নাতের স্থায়ী নিবাসস্থলের সুন্দর ঘরসমূহে; আর এটাই হচ্ছে সবচাইতে সাফল্য।’ (সূরা আস সাফ : ৮-১২)
পার্থিব চাকচিক্যের সাময়িক প্রভাবে মোহিত হয়ে নিজেদেরকে বিপথে পরিচালিত করার সুযোগ কোথায়? একজন মুমিনই সবসময় সফলকাম। আল্লাহর ঘোষণা : ‘অবশ্যই যারা (আল্লাহর তায়ালার ওপর) ঈমান এনেছে এবং ভালো কাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত- যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত; সেটাই (সেদিনের) সবচেয়ে বড় সাফল্য।’ ( সূরা আল বুরুজ : ১১)
সামান্য ক্ষমতার দাপটে যারা আজ দিশেহারা, পৃথিবীর রঙিন মোহে নিজের অস্তিত্ব ভুলে অহমিকায় বাকবাকুম। আল্লাহ তাদেরকে একটু অবকাশ দিয়েছেন মাত্র। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর শাস্তি। এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা :
‘নিঃসন্দেহে তোমার মালিকের পাকড়াও হবে ভীষণ শক্ত।’ (সূরা আল বুরুজ : ১২)
একজন মুমিনের জন্য দুনিয়াটা ফুলশয্যা নয় বরং প্রতিটি ক্ষণে তাকে অতিক্রম করতে হয় কাঁটাযুক্ত হাজারো গলিপথ। একজন মুজাহিদের পেছনে ফেরার ইতিহাস জানা নেই। প্রসঙ্গক্রমে আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ) এর একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য: ‘এ কাজের জন্য এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন, যারা সত্যের ওপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে থাকবে। অন্য কোনো দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না। পৃথিবীতে যা-ই ঘটুক না কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না।’ সুতরাং আমরা যে সময়ের মুখোমুখি হই না কেন সত্যের প্রতি অবিচল থেকেই যেন চলতে পারি সেই প্রত্যাশা।
সূর্য উঠবেই। আঁধার কেটে একদিন আলো আসবেই। চারিদিক আলোয় ঝিলমিল করবে। বর্ণিল সাজে সাজবে পৃথিবী। আমরা সেই স্নিগ্ধ সকালের অপেক্ষায় পৃথিবীর দিগন্ত রেখায় তাকিয়ে রই প্রতিদিন। আমরা জেনে বুঝেই যে পথে পা বাড়িয়েছি সে পথের সীমানা অনেক দূর। তবুও মনজিলে যাওয়া চাই। কবি মোশাররফ হোসেন খানের ভাষায় : ‘শাহাদাত আরাধ্য আমার/ আতীব্র তৃঞ্চার পানি/ পেছনে ফেরার আমি কোনো দরজা রাখিনি।’
লেখক : এমফিল গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া