লোকমান হাকিম |
মানবজাতির সঠিক পথের দিশারী হিসেবে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিগণ হলেন নবী ও রাসুল। পৃথিবীর এমন কোনো জাতি নেই, যাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো নবী ও রাসুল প্রেরিত হয়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুতকে পরিত্যাগ কর।” (সূরা নাহল: ৩৬)
আর নবীগণ হলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যাদের সীরাত বা জীবনাদর্শে আল্লাহ তা’য়ালা সেই জাতির জন্য মুক্তির চুড়ান্ত আদর্শকে প্রদান করেছেন। আর এই সকল মহামানবদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও চুড়ান্ত আদর্শধারী রাসূল হলেন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যার সীরাত বা জীবনাদর্শে আল্লাহ তা’য়ালা বিশ্ব মানবতার জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রেখেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- “অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাব: ২১)
সীরাত আরবী শব্দ। মিসবাহুল লুগাতে সীরাতের অর্থ করা হয়েছে সুন্নাত, পদ্ধতি, অভ্যাস, জীবনচলার ধরন, পূর্ববর্তীদের কাহিনী ও ঘটনাবলীর বর্ণনা ইত্যাদি। আর ইসলামী বিশ্বকোষে সীরাতের অর্থ করা হয়েছে মাযহাব বা তরিকা, আকৃতি, অবস্থা, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর গাজওয়ার বর্ণনা, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবনচরিত এবং সম্প্রসারিত অর্থে বীর পুরুষদের কীর্তি বর্ণনা।
সমগ্র কুরআনে সীরাত শব্দটি একবার উল্লেখ রয়েছে। সূরা ত্বোহা এর ২১ নং আয়াতে, সেখানে আভিধানিক অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। মোটকথা সীরাত অর্থ হলো কোনো ভালো মানুষ বা নেককার লোকের চাল-চলন, কাজ, উঠা-বসা, মেজাজ-মর্জি এককথায় জীবনচরিত বা পদ্ধতি।
আর পারিভাষিক অর্থে, সীরাত দ্বারা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সার্বিক জীবনচরিত বা পদ্ধতিকে বুঝায়। তা্ই দেখা যায় যে, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবনীগ্রন্থগুলো সীরাত নামেই পরিচিত। যেমন, সীরাতে ইবনে হিশাম, সীরাতে সারওয়ারে আলম ইত্যাদি।
পৃথিবীর সকল মহান মনীষিদের সীরাত এমনকি অন্যান্য নবী রাসুলদের সীরাতের চেয়েও মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সীরাতের রয়েছে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য, যা তাঁর সীরাতকে অন্যান্য সকল সীরাত থেকে উচ্চতার চুড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।
সীরাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর ঐতিহাসিকতা, যার প্রতিটি তথ্যই বর্ণনা বিচারের মানদণ্ডে চুড়ান্তভাবে পরীক্ষীত। কিন্তু অন্য কোনো মহান ব্যক্তিত্বের জীবনী এমনকি কোনো নবী রাসুলদের সীরাতও এভাবে সংরক্ষিত হয়নি।
আর যতটুকুনও আছে তা বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয় বরং সংশয় ও ক্রটিপূর্ণ। সীরাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মহাগ্রন্থ আল কুরআন, যার বিশুদ্ধতা ইসলামের দুশমনদেরও অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি।
সীরাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মূলত কুরআনেরই বাস্তবচিত্র। হযরত সাঈদ বিন হিশাম (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম হযরত আয়েশা (রা.) এর নিকট রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সীরাত বা চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সীরাত বা চরিত্র হলো আল কুরআন। (আহমদ) হাদিসটি একাধিক সুত্রে বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
বিখ্যাত মনীষি ও গবেষক খুররম জাহ মুরাদ বলেন, “সর্বোত্তম সীরাত গ্রন্থ হলো কুরআন মজিদ, আর কুরআন মজিদের সর্বোত্তম তাফসীর হচ্ছে নবীপাকের সীরাত। কুরআন হচ্ছে সীরাতের নিখুঁত বর্ণনা আর সীরাত হচ্ছে কুরআনের জীবন্ত মডেল। এজন্য আমি মনে করি, যে ব্যক্তি কুরআনের বিশুদ্ধতম তাফসীর পড়তে চায়, দেখতে চায় জীবন্ত কুরআন, আর কুরআনকে পড়তে চায় শব্দের পরিবর্তে আসমানি জবানে, তার উচিত ইবনে কাসীর, কাশশাফ, আর রাযি প্রভৃতির চাইতে অনেক বেশী করে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অধ্যয়ন করা।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি দেখতে চায় মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে, সে যেন ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সা’দ পড়ার আগে কুরআনকে অধ্যয়ন করে।” (ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী, পৃ: ১৬)
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর মফিজুর রহমান সীরাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে বলেছেন, ‘কুরআনকে যদি বলা হয় তুমি মানুষ হয়ে যাও, কুরআন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়ে যাবেন, আর মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে যদি বলা হয় তুমি কিতাব হয়ে যাও, তবে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআন হয়ে যাবেন’।
সীরাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসসমূহ। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো মহামানব নেই যার কথা বা বক্তব্যগুলো হাদিসে রাসুলের মত এমনভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।
যার কথার বর্ণনাকারীদের উপর আলাদা জ্ঞানশাস্ত্র রয়েছে, রয়েছে হাজার হাজার কিতাব, রয়েছে স্বতন্ত্র অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্র, যেগুলোতে কেবল তাঁর কথাগুলোকে পড়ানোই হয়না বরং গবেষণাও করা হয়। তাঁর সীরাতের অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এ পরিপূর্ণতা ও সার্বজনীনতা। ইতিহাসের সর্বত্র কেবল একরোখা নায়কই দেখা যায়, কিন্তু মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার মধ্যে পূর্ণতার সমস্তগুণাবলী পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান।
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেই ছিলেন একজন দার্শনিক, ছিলেন মহাবিজ্ঞানী, একজন রাজনৈতিক কৌশুলী, সফল সমরনায়ক, আইনপ্রনেতা ও সফল রাষ্ট্রনায়ক। তার অর্থনৈতিক চিন্তা, প্রশাসন পরিচালনা পদ্ধতি, বিচারকার্যে দক্ষতা কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরনীয়।
তাঁর আদর্শ এতটাই পরিপূর্ণ যে, ব্যাক্তি জীবন থেকে আন্তর্জাতিক জীবন, রান্নাঘর থেকে সংসদ পর্যন্ত সকল স্তরের জন্য রয়েছে সীরাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মধ্যে সর্বোত্তম আদর্শ। আল্লহ তায়ালা বলেন অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সুরা আহযাব: ২১)। আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এই পূর্ণাঙ্গ জীবন গঠনে সমকালীন পরিবেশে কোনো অবদান নেই, বরং মহান স্রষ্টা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত।
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে জর্জ বার্ণাড শ’ বলেন “আমি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করেছি, আমার মনে হয়েছে তিনি এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। তিনি খ্রিস্টের বিরোধী তো নিশ্চয়ই নন, বরং তাকে বলা যেতে পারে মানবজাতির মুক্তিদাতা। আমি বিশ্বাস করি, যদি তাঁর মত ব্যক্তি বিশ্বের একনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন, তাহলে যেসব সমস্যায় জর্জরিত আজকের পৃথিবী তা তিনি সমাধানে সক্ষম হতেন এবং বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হতেন বহুপ্রত্যাশিত শান্তি ও সুখের পরিবেশ।”
তার সীরাতে অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি নির্দিষ্ঠ কোন জাতি, গোত্র, এলাকার জন্য বা নির্দিষ্ট কালের জন্য আদর্শ নন বরং কিয়ামত পর্যন্ত সকল জাতির, সকল গোত্রের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষীর মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শবাহী মহামানব ও রাসুল।
অতীতের সকল নবীগণ ছিলেন সুনির্দিষ্ঠ এলাকার সুনির্দিষ্ঠ সময়ের জন্য তাই তাদের আহবানও ছিল নির্দিষ্ঠ কওম বা এলাকার প্রতি। কিন্তু মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন গোটা বিশ্ববাসীর জন্য, তাই তাঁর আহবানও সার্বজনীন আল্লাহ তায়ালা বলেন, বলুন, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। (সুরা আ’রাফ: ১৫৮)।
আল্লাহ বলেন, আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানেনা। (সুরা সাবা: ২৮)। সকল মহান ব্যক্তিদের সম্পর্কে সর্বোচ্চ এভাবে বলা যেতে পারে যে, তিনি ছিলেন সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক কিন্তু মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন সর্বকালের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব।
মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সীরাতের অনুসরনের মাঝেই বিশ্ব নিয়ন্ত্রক আল্লাহ তা’য়ালা মানবতার জন্য ইহকালের শান্তি ও পরকালের সফলতা রেখেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, তোমরা যদি তাঁর (সীরাতের) অনুসরণ কর, তবে তোমরা সৎপথ পাবে। (সুরা নুর: ৫৪)
তিনি আরে বলেন, “রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ করো, আর যা হতে তোমাদের নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক।” (সূরা হাশর: ৭)।
রাসুলুল্লাহর সীরাতের বিপরীত জীবনযাপনে কখনোই শান্তি ও সফলতা আশা করা যায় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “সুতরাং, যারা তাঁর আদর্শের বিরুদ্ধাচরন করে, তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে, অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।” (সূরা নূর: ৬৩)
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।