তৌহিদুর রহমান |
ইতিহাস হলো এমন একটা সাবজেক্ট যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ছলচাতুরী করা হয়েছে। মুসলমানদের ইতিহাস এমন জঘন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে সত্যিকার ইতিহাসটা খুঁজে বের করা আজ চরম দুষ্কর ও অসাধ্য হয়ে পড়েছে। সত্যিকারের ইতিহাস জানতে হলে আপনাকে রীতিমতো গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত করে হাজার হাজার সৎ ও ন্যায়পরায়ণ গবেষক নিয়োগ দিয়ে সত্য উদঘাটনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিহাসের গতিপথ পর্যন্ত পাল্টে দেয়া হয়েছে, বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে ইতিহাসের সব রাস্তা। বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে ইতিহাসকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মুসলিম শাসক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক, গবেষকের নাম পর্যন্ত পাল্টে দেয়া হয়েছে। যেমন- স্পেনের প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক আবু রুশদ হয়ে গেছে আভিরস। এমন উদাহরণ ইতিহাসে বিস্তর। আপনার জানা ইতিহাসের পেছনে আরো একটা ইতিহাস আছে যা আজো উদ্ঘাটিত হয়নি, হয়তো কিয়ামত পর্যন্ত হবে কি না সন্দেহ আছে। বিকৃত মিথ্যা ইতিহাসকেই সত্য বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে হাজার বছর ধরে। আমাদের মনে রাখতে হবে ইতিহাসেরও একটা ইতিহাস থাকে।
ঘটনাপ্রবাহের বাঁক পরির্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় ইতিহাসেরও গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায়। ইতিহাসও নদীর মতো মোড় নেয়। আর সাধারণত ইতিহাসবিদরা সেই পরিবর্তিত স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। যে নদী সাগরে মিলিত হতে পারে না তার ইতিহাস হয়তো কখনো লিখিত হয় না। আর লিখিত হলেও তাতে উপাদেয় কিছু থাকে না। এটাই স্বাভাবিক। পরাজিত সিংহের রাজ্য ছেড়ে পালানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। তার ইতিহাস কেউ কখনো লেখে না। এই উদাহরণটাই যথেষ্ট, ১৯৪৭-এর আগে হানাদার ইংরেজদের নিকট হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতার শত্রু, যুদ্ধাপরাধী; তাদের অনেককে তখনকার ইংরেজ সরকার দিয়েছিল ফাঁসি, অসংখ্য স্বাধীনতাকামী ভারতীয় নাগরিককে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, অনেককে জনমানবহীন নির্জন দ্বীপে বন্দী রাখা হয়েছিল আমৃত্যু, অনেক স্বাধীনতাকামী কারাগারেই তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। আজ ভারতবর্ষ যদি স্বাধীন না হতো তাহলে তাদের সেই স্বর্ণালী ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। দেশ স্বাধীন হয়েছে তাই আজ তারা স্বাধীনতাকামী বীরমুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন না হলে এই মুক্তিযোদ্ধারাই হয়ে যেত দেশদ্রোহী, স্বাধীনতার শত্রু, মানবতার শত্রু। অত্রএব মনে রাখা দরকার ক্ষমতা যার ইতিহাসও তার।
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছে তাদেরও যে ভালো কিছু কর্ম ছিল না তা হলফ করে বলা সঙ্গত হবে না। সামান্য একটু ভুলের কারণেই আপনার ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতে পারে। জিন্নাহ ভারত উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে একজন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অখণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টিতে যার অসামান্য অবদান রয়েছে। বলা হয়ে থাকে অখণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে আলাদা বাংলাদেশ কখনো সৃষ্টি হতে পারত না। কারণ ১৯৪৭-এর পর ভারত থেকে বের হয়ে আলাদা আর কোনো নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারেনি। এখানে খালিস্তান আন্দোলনসহ অনেক বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি একটিও। বরং হায়দরাবাদ, কাশ্মির, সিকিমের মতো কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র আজ ভারতগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অতএব জীবনযুদ্ধের এই ময়দানে ভুল করার তিল পরিমাণও সুযোগ নেই। রাজা-বাদশাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কোনো একজন শাসকের সামান্য একটু ভুলের কারণে রাজ্যপাট তো গেছেই, সাথে পুরো রাজবংশ, পাইক-পেয়াদা, সৈন্য-সামন্তসহ বিলীন হয়ে গেছে। সেই সাথে বিলীন হয়ে গেছে তার ইতিহাসও।
দুনিয়াতে শুধু বিজয়ীদেরই ইতিহাসই সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে থাকে। এটাই নিয়ম, এটাই স্বাভাবিক- যারা জয়ী হয় তাদের ইতিহাস দুনিয়াতে থেকে যায়, জোর করে যদি পরাজিতদের ইতিহাস লেখাও হয় তা কখনো স্থায়ী হয় না এবং টিকেও থাকে না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্টোটা ঘটতে। পরাজিতের ভালো কাজও কালের পরিক্রমায় ঘৃণিত স্মারক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। পক্ষান্তরে বিজয়ীদের সব ধরনের কাজই স্মৃতিফলক হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে কালের আরশিতে; ইতিহাসের পাতায়। মুসলমানরা যেদিন থেকে পরাজিতের খাতায় নাম লিখেয়েছে সেদিন থেকে তার ইতিহাসও বিকৃত হতে হতে আজ প্রায় বিলীন হতে চলেছে। সোনালি যুগের এমনই এক স্বর্ণালি ইতিহাস এখানে উপস্থাপন করা হলো।
হিজরি ষষ্ঠ শতকের শেষের দিকের ঘটনা। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের খ্রিস্টান শাসকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রায় অর্ধশত যুদ্ধজাহাজ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পর্তুগালের উপকূল হয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে রওনা করে। পর্তুগালের তৎকালীন খ্রিস্টান সম্রাট বুজদিল আন্দালুসিয়ার মুসলিম শাসক, মুসলিম জনপদ এবং বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করার জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের খ্রিস্টান রাজার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তারই অংশ হিসাবে এই অর্ধশত জাহাজ বোঝাই করে ইংরেজ ও ফরাসি সৈন্যদের আগমন ঘটে। তাদের সহায়তায় পর্তুগালের শাসক এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্পেনের এডোরাবিজ ও সেলিবিজ আক্রমণ করে। আক্রমণকারীরা প্রথমেই আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয় এডোরাবিজ ও সেলিবিজ-এর শস্য ক্ষেতগুলো, ধ্বংস করে ফলের বাগান। তারপর মুসলমানদের ঘর-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ সময় প্রাণ নিয়ে পালানো হাজার হাজার নিরীহ মুসলিম জনতাকে ধরে ধরে পশুর মতো জবাই করে, যাকে সামনে পায় তাকেই তরবারি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে, বারুদ মেরে, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্কটের মতে, তখন এডোরাবিজ ও সেলিবিজের জনসংখ্যা ছিল আশি হাজার। তার মধ্যে প্রায় পঁচানব্বই ভাগই ছিল মুসলমান। একটি যুক্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে এই শহর দুটি প্রায় দু’শ বছর আগে মুসলমানদের দখলে এসেছিল। কিন্তু খ্রিস্টান যোদ্ধারা সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে এই জনপদে ভয়াবহ তাণ্ডব চালায়। হঠাৎ এই আক্রমণে বিপর্যস্ত মুসলমানদের প্রতি সামান্যতম মানবতাও দেখায়নি খ্রিস্টান যোদ্ধারা। শিশু, বৃদ্ধ, নারী নির্বিশেষে সকল মুসলমানকেই তারা হত্যা করে। এই শহর দু’টি হতে মুসলমানদের নাম-নিশানা পর্যন্ত তারা মুছে ফেলে। তবে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা, অপমান-অপদস্থ করা ও নিজেদের জঘন্য-ঘৃণ্য লালসা চরিতার্থ করার জন্য মুসলিম যুবতী মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখে এবং জাহাজ বোঝাই করে তাদের ধরে নিয়ে যায়। তা ছাড়া আন্দালুসিয়ায় আক্রমণ না করার ব্যাপারে খ্রিস্টান রাজাদের সাথে সে সময় যে চুক্তি ছিল তাও পদতলে পিষ্ট করে এই হামলা চালানো হয়।
একপর্যায়ে স্পেনের মুসলিম শাসকরা হয়তো নির্বীর্য ও কাপুরুষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুনিয়ার অন্য স্থানের মুসলমানরা তখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তাদের রক্ত তখনো নিস্তেজ হয়ে যায়নি। আফ্রিকা, এশিয়া এবং স্পেনের কিছু কিছু মুসলিম শাসক তখনো প্রতাপের সাথে কালেমার পতাকা উড্ডীন রেখেছিলেন। ‘একমাত্র আল্লাহই সমস্ত শক্তির মালিক’ এই মন্ত্রের চালিকাশক্তি মুসলমানদের অনেকের রক্ত কণিকায় তখনো তুফান তরঙ্গের ঢেউ তুলছিল। আন্দালুসিয়ার প্রখ্যাত মুয়াহিদ বংশের শাসক আবু ইয়াকুব ইউসুফের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকুব আল মনসুর মরক্কো ও আন্দালুসিয়া তথা মুসলিম স্পেনের একাংশের বাদশাহ হয়েছিলেন। মরক্কোয় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ায় তিনি আন্দালুসিয়ার শাসনভার অন্যের ওপর অর্পণ করে মরক্কো চলে গিয়েছিলেন।
ইয়াকুব আল মনসুর ছিলেন খুবই আল্লাহভীরু, সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং বীরযোদ্ধা ও শক্তিশালী শাসক। ইংরেজ ও ফ্রান্সের সৈন্যদের সহায়তায় পর্তুগালের শাসকদের এই নির্বিচারে নৃশংসভাবে মুসলিম হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ঘটনা শুনে সাথে সাথে তিনি কর্ডোভার গভর্নরের কাছে অতি দ্রুতগামী অশ্বারোহী দূত পাঠিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেন। তিনি হুকুম দেন সেলিবিজের মুসলমানদের হত্যার এমন প্রতিশোধ নেয়া হোক যেন কিয়ামত পর্যন্ত খ্রিস্টান জগৎ তা মনে রাখে। তখন কর্ডোভার গভর্নর ছিলেন মুহাম্মদ। তার অধীনে ছিল পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী সেনা আর বিশাল পদাতিক বাহিনী। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের সৈন্যবাহিনী নিয়ে সেলিবিজের উদ্দেশে রওনা দেন। জানা যায় এতোটাই তুফানের গতিতে তিনি সেলিবিজে পৌঁছেছিলেন যে, তার সৈন্যবাহিনীর মাত্র এক দেড় হাজার অশ্বারোহী সেনা সেখানে পৌঁছতে সক্ষম হন। বাকি অশ্বারোহী সৈন্যরা তার থেকে অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছিল। যেসব খ্রিস্টান সেনারা মজলুম মুসলমানদের রক্তে নিজেদের হাত রঞ্জিত করেছিল তাদের ওপর তিনি মহাপ্রলয়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন।
তখনো পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট মুসলিম জনপদগুলোতে খ্রিস্টান সৈন্যদের তাণ্ডব চলছিল। যারা মুসলিম এলাকাগুলোতে জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছিল সেই সব খ্রিস্টান সৈন্যদের তিনি নিমেষে ধুলায় মিশিয়ে দেন। তাদের এমনভাবে ধ্বংস করেন যে, এই প্রতিশোধ নেয়া দেখে বেঁচে যাওয়া হতভাগ্য মুসলমানরা তাদের সব ধরনের মনের কষ্ট ভুলে গিয়েছিল। এই যুদ্ধে যুদ্ধরত প্রায় সমস্ত খ্রিস্টান সৈন্য নিহত হয় মুসলিম বাহিনীর হাতে। তারপরও গ্রেফতারকৃত খ্রিস্টান সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় পঁচিশ হাজার। তা ছাড়া তাদের সাথে বন্দী করে কর্ডোভায় আনা হয়েছিল খ্রিস্টান সৈন্যদের সহযোগী পনেরো হাজার মহিলাকে। নজরদারিতে রেখে এই মহিলাদের কর্ডোভার বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল এই শর্তে যে, নিরীহ, নিরস্ত্র মুসলমানদের ওপর খ্রিস্টান যোদ্ধাদের ভয়াবহ জুলুম নির্যাতনের কাহিনী এই মহিলারা কর্ডোভার বাজারের রাস্তায় রাস্তায় বর্ণনা করে বেড়াবে। শর্ত মোতাবেক কিভাবে মুসলমানদের জবাই করা হয়েছিল, কিভাবে মুসলিম নারীদের বেইজ্জতি করা হয়েছিল, কিভাবে শিশুসন্তানদের আকাশে ছুঁড়ে মেরে তলোয়ার দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল, কিভাবে মুসলিম নারীর পেট চিরে গর্ভের সন্তান বের করে হত্যা করা হয়েছিল, কিভাবে বৃদ্ধ, শিশু ও অসহায় মুসলিম জনতাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ইত্যাদি কাহিনী তারা বর্ণনা করে কর্ডোভার মুসলমান জনগণকে শুনাতো। সেই সাথে তারা তাদের নিজেদের দুর্গতির কাহিনীও বর্ণনা করতো। এটাই ছিল তাদের শাস্তি। এর আগে পৃথিবীতে এমন অভিনব শাস্তির কথা কেউ কখনো শুনেছে কি না জানা নেই। এটা এ জন্য করা হয়েছিল যে, খ্রিস্টান ও ইহুদি জাতি তথা পৃথিবীর অপরাপর মানবতার মুখোশধারী শয়তানরা দেখুক মুসলামনরা তাদের চেয়ে কতটা বেশি মানবিক। তাদের স্ত্রী, মা-ভগ্নিদের মুসলমানরা ভয়াবহ অমানবিক ও নিকৃষ্ট পন্থায় চরমভাবে অপমান-অপদস্থ করেনি, যেমন তারা করেছে মুসলিম যুদ্ধবন্দী নারীদের ওপর। এই যুদ্ধবন্দী খ্রিস্টান নারীদের ওপর কোনো প্রকার যৌন-নির্যাতন বা শারীরিক টর্চার করা হয়নি, খাবারের কষ্ট দেয়া হয়নি। তাদের এই মানসিক কষ্ট এই জন্য দেয়া হয়েছিল যে, যাতে করে তারা শুধু মুসলমান নয় যেকোনো মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের ভয়াবহ পরিণাম উপলব্ধি করতে পারে। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা বুঝতে পারে। তাদের মাধ্যমে সমস্ত খ্রিস্টান জগতে যেন এই অভিনব শাস্তির বার্তা পৌঁছে যায়। পৌঁছে যায় শান্তির বার্তা। এই খ্রিস্টান বন্দী পনেরো হাজার নারী ও বিশ হাজার পুরুষের সাথে মুসলমানরা এতোটাই মধুর ব্যবহার করেছিল যে মুক্তিদানের পর তাদের অধিকাংশই আর কর্ডোভা ত্যাগ করে চলে যায়নি। তাদের প্রায় সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
এরপর কর্ডোভার গভর্নর মুহাম্মদ এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিখে মরক্কোর বাদশা ইয়াকুব আল মনসুরের কাছে পাঠান। মরক্কোর বাদশাহ এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বাদশাহ ইয়াকুব আল মনসুরের রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসতো না। তিনি মাঝে মাঝে হঠাৎ চিৎকার করে জেগে উঠতেন। শত্রুর হাতে বন্দী সেলিবিজের হাজার হাজার মুসলিম নারীর কান্নার আওয়াজ যেন সব সময় তার কানে বাজতো। খ্রিস্টানদের ঘরে তাদের দাসী-বাঁদীগিরির ছবি বাদশার মনের পর্দায় ভেসে উঠতো। তাদের ওপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের মর্মন্তুদ দৃশ্য তাকে সার্বক্ষণিক ব্যাকুল করে তুলতো। এভাবে দিনের পর দিন তাদের কান্নার আওয়াজ ইয়াকুব আল মনসুরকে পেরেশান করে তোলে। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি সব সময় ছটফট করতে থাকেন। তিনি নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারেন না। একপর্যায়ে তিনি সিংহাসন ছেড়ে উঠে বসেন। তরবারি হাতে রাজধানী ছেড়ে পথে বের হয়ে পড়েন। তিন লাখ মুসলিম সৈন্য সাথে নিয়ে তিনি আন্দালুসিয়ায় এসে পৌঁছান।
আন্দালুসিয়ায় পৌঁছে তিনি এই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে কাস্টালিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ইয়াকুবের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কাস্টালিয়া সীমান্তে পৌঁছার খবর পাওয়ার পর ওখানকার খ্রিস্টান রাজা আল ফানসু চোখে অন্ধকার দেখে। অনেক ছোটাছুটি ও প্রচেষ্টা চালিয়ে রাজা আল ফানসু ফরাসি রাজাদের সহায়তায় বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় তিন লক্ষ খ্রিস্টান সৈন্য জোগাড় করতে সক্ষম হয়। ঐতিহাসিক স্কটের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সুসজ্জিত ফরাসি এই তিন লাখের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আল ফানসু প্রথম আক্রমণে মুসলিম বাহিনীর ব্যূহ ভাঙতে সক্ষম হয়। এই সাফল্যে তারা প্রচণ্ড বেগে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়ে আক্রমণ চালায়। খ্রিস্টান বাহিনীর আক্রমণভাগে ছিল রাজা আল ফানসু, ফরাসি নবাব এবং ফরাসি নবাবদের মিত্র বিভিন্ন রাজ্যের সেনাপতি। প্রথম আক্রমণে মুসলমান সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। বিচক্ষণ, অসীম রণকৌশলী, বীরযোদ্ধা মুসলিম সেনাবাহিনীপ্রধান ইয়াকুবের এটা ছিল একটা যুদ্ধ কৌশল। খ্রিস্টান সেনারা মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ঢুকে পড়ার পর সেনাপ্রধান ইয়াকুবের নেতৃত্বে মুসলমান সৈন্যরা আক্রমণকারীদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম সৈন্যরা এমন প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় যে, এই সম্মুখ যুদ্ধে খ্রিস্টান বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী অধিকাংশ ফরাসি নবাব, রাজা ও খ্রিস্টান মিত্রবাহিনীর সেনানায়করা নিহত হয়। খুব কমসংখ্যক ফরাসি সৈন্য এখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিল। রাজা আল ফানসু অনেক কষ্টে এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এই বিজয়ের পর মুসলিম বাদশা ইয়াকুব আক্রমণ করেন ইককুস। এখান থেকে পলায়নরত একুশ হাজার খ্রিস্টান সৈন্য বন্দী করেন। বাদশা ইয়াকুব ছিলেন অত্যন্ত সৎ, আল্লাহভীরু, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ শাসক। তিনি বন্দীদের সাথে এমন অসাধারণ মানবিক আচরণ করেন- যা সেই যুগে ছিল কল্পনারও অতীত। কিছুদিন বন্দী রাখার পর তিনি সমস্ত যুদ্ধবন্দীকে বিনাশর্তে মুক্ত করে দেন। এমন মহানুভব আচরণে তারা বিমুগ্ধ হয়ে যায়, যার ফলে বহু খ্রিস্টান সৈন্য পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে।
এই যুদ্ধে রাজা আল ফানসুর সমরশক্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এই লাঞ্ছনার পর আল ফানসু বাদশা ইয়াকুবের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। মহান শাসক বাদশা ইয়াকুব আল ফানসুকে ক্ষমা করে দেন। এরপর বাদশা ইয়াকুব কাস্টালিয়া ত্যাগ করে আশপাশের যেসব খ্রিস্টান রাজা এই যুদ্ধে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিল একে একে সেগুলো আক্রমণ করে তাদেরকে পরাজিত করেন এবং তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার ও কর দিতে বাধ্য করেন।
বাদশা ইয়াকুব ছিলেন একজন অতি উঁচুস্তরের আল্লাহভীরু মুসলমান। এইসব রাজ্য আক্রমণকালে তিনি কোনো ফসলের ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দেননি। কোনো ফলের বাগান ধ্বংস করেননি। আক্রমণকারী ছাড়া অন্যকে হত্যা করেননি। কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং নিরীহ কাউকে হত্যা বা নির্যাতন করেননি। এমনকি কোনো একজন নারীকেও বন্দী করে আনেননি।
তিনি ছিলেন খুবই ন্যায়পরায়ণ একজন শাসক। তিনি শাসনভার গ্রহণ করার সাথে সাথেই কিছু কিছু পুরাতন কর বা ট্যাক্স সম্পূর্ণরূপে মওকুফ করে দেন। গরিবদের সব রকমের করের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে দেন। গভর্নর, খলিফা, বাদশা ও আমির-ওমরাদের বাদশার দরবারে সব ধরনের উপঢৌকন, নজরানা ও উপহার পাঠানোর রেওয়াজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেন। তাঁর রাজ্যে যেসব কয়েদি জনসাধারণের জানমালের ক্ষতি করেছিল তাদের ছাড়া বাকি সবাইকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে আদালতের জন্য বিশেষ ফরমান জারি করেন। একজন নাগরিকের ওপরও যাতে অন্যায়, অবিচার ও জুলুম না হয় এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকলেই যাতে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার লাভে সক্ষম হয় তার জন্য বিচারপতিদের মহান আল্লাহর প্রতিটি আদেশ-নিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলার আদেশ দেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে খানিক দূরে দূরে তিনি সরাইখানা নির্মাণ করেন। প্রতিটি রাস্তার পাশে তিনি গাছ লাগান। দেশের প্রায় সর্বত্র পাকা সড়ক নির্মাণ করেন। প্রতিটি জনপদে মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেন। মসজিদকেন্দ্রিক মক্তব গড়ে তোলেন। সেখানে শিশুদের খেলাধুলা করা ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হতো। দশ থেকে বারো বছর পর্যন্ত শিশুদের শুধুমাত্র ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া হতো। বারো বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের কোনো প্রকার লিখিত পরীক্ষা নেয়া হতো না। শিশুরা যাতে মিথ্যা কথা না বলে এবং মহান আল্লাহর সাথে কথা ও কাজে কাউকে শরিক না করে দশ বছর পর্যন্ত এই শিক্ষা খুবই গুরুত্ব সহকারে প্রদান করা হতো। শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্ত ব্যয়ভার সরকারের পক্ষ থেকে বহন করা হতো। এই শিক্ষাপদ্ধতি আফ্রিকা ও স্পেনের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছিল।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে প্রশস্ত মসজিদ এবং মসজিদ সংলগ্ন স্থানে মুসাফিরখানা ও হাসপাতাল স্থাপন করেন। সেসব হাসপাতালের জন্য উন্নতপর্যায়ের প্রশিক্ষিত ডাক্তার নিয়োগ করেন। এই ডাক্তারগণ সকল ধর্মের লোকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি চিকিৎসাকেন্দ্রে ওষুধ সরবরাহ করা হতো। বাদশাহ ইয়াকুবের আদেশে স্পেন ও আফ্রিকার প্রায় সর্বত্র এই একই ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক