আহমেদ আফগানী |
মুনাফিকরা একদিনে হুট করে তৈরি হয়নি। এর রয়েছে ধারাবাহিক পরিক্রমা। যখনই ইসলামের অবস্থা একটু ব্যাকফুটে থাকে তখন তাদের দৌরাত্ম দেখা যায়। ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, কটূক্তি, আনুগত্যহীনতা এবং ফিতনা তৈরি করে। বার বার আল্লাহর রাসূল সা.-কে তারা বিপদগ্রস্থ করে তুলেছিলো। তারপরও আল্লাহর রাসূল সা.-এর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত তাদেরকে কন্ট্রোলে রেখে সহবস্থানে বাধ্য করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে যতই ইসলামের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছিল ততই মুনাফিকরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। রাসূল সা. শেষদিকে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো।
মদিনায় রাসূল সা.-এর আগমনের পূর্বেই বিবদমান আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটি পারস্পরিক গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। তারা যথারীতি তাকে বাদশাহ বানিয়ে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। এমন কি তার জন্য রাজ মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল। এ ব্যক্তি আর কেউ নয় তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খাযরাজ গোত্রে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বসম্মত এবং আওস ও খাযরাজ ইতিপূর্বে আর কখনো একযাগে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব মেনে নেয়নি।
এই পরিস্থিতিতে ইসলামের সুমহান দাওয়াত মদিনায় পৌঁছে এবং এই দুটি গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। হিজরতের আগে আকাবার দ্বিতীয় শপথের সময় রাসূল সা.-কে যখন মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা রা. এ আহবান জানাতে শুধু এ কারণে দেরী করতে চাচ্ছিলেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও বাইয়াত ও দাওয়াতে শামিল হয়। সে যেন রাসূল সা.-এর প্রতিদ্বন্দ্বি না হয়। এভাবে মদীনা যেন সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু যে প্রতিনিধি দল বাইয়াতের জন্য হাজির হয়েছিল তারা এই যুক্তি ও কৌশলকে কোন গুরুত্বই দিলেন না এবং এতে অংশগ্রহণকারী দুই গোত্রের পঁচাত্তর ব্যক্তি সব রকম বিপদ মাথা পেতে নিয়ে নবী সা.-কে দাওয়াত দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল।
এরপর নবী সা. যখন মদীনায় পৌঁছলেন তখন আনসারদের ঘরে ঘরে ইসলাম এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিরূপায় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই সে তার বহু সংখ্যক সহযোগী ও অনুসারিদের নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উভয় গোত্রের প্রবীণ ও নেতা পর্যায়ের লোকেরা ছিল।
মদিনায় ইসলামের প্রসারে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অন্তরজ্বালা ও দুঃখ ছিল অত্যন্ত তীব্র। কারণ সে মনে করতো, রসূলুল্লাহ সা. তার রাজত্ব ও বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার এই মুনাফেকীপূর্ণ ঈমান এবং নেতৃত্ব হারানোর দুঃখ কয়েক বছর ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে থাকলো। একদিকে তার অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ সা. যখন খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠে বসতেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উঠে বলতো, “ভাইসব, আল্লাহর রসূল আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। তাই আপনারা সবাই তাঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা করুন। এবং তিনি যা বলেন গভীর মনযোগ সহকারে শুনুন এবং তার আনুগত্য করুন।“
সে এমন ঘোষণা দিয়ে নিজেকে খাঁটি ঈমানদার বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো। অপরদিকে অবস্থা ছিল এই যে, প্রতিদিনই তার মুনাফেকীর মুখোশ খুলে পড়ছিল এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইসলাম, রসূলুল্লাহ সা. এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা পোষণ করে। একবার নবী সা. কোনো এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন । এই সময় পথে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর সাথে অভদ্র আচরণ করে। তিনি খাজরাজ গোত্রের আরেক নেতা সা’দ ইবনে উবাদাকে বিষয়টি জানালে সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, আপনি এ ব্যক্তির প্রতি একটু নম্রতা দেখান। আপনার আগমনের পূর্বে আমরা তার জন্য রাজমুকুট তৈরী করেছিলাম। এখন সে মনে করে, আপনি তার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন।“
বদর যুদ্ধের পর বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অকারণে বিদ্রোহ করলে রসূলুল্লাহ সা. তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের সমর্থনে কোমর বেঁধে কাজ শুরু করে। সে নবীর সা. বর্ম ধরে বলতে লাগলো, এই গোত্রটির সাতশত বীরপুরুষ যোদ্ধা শত্রুর মোকাবেলায় সবসময় আমাকে সাহায্য করেছে, আজ একদিনেই আপনি তাদের হত্যা করতে যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ, আপনি যতক্ষণ আমার এই মিত্রদের ক্ষমা না করবেন আমি ততক্ষণ আপনাকে ছাড়বো না। পরে আল্লাহর রাসূল সা. আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথা আংশিকভাবে মেনে নেন। বনু কাইনুকার ইহুদীদের বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি না দিয়ে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন।
উহুদ যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গীরা তাদের সর্বোচ্চ মুনাফেকী প্রদর্শন করেন। তারা সরাসরি ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যুদ্ধ কোথা থেকে করা হবে এই নিয়ে পরামর্শ সভায় মতরিরোধ তৈরি হয়। আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে সবাই একমত হয়। কিন্তু পরে যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার তিনশত সঙ্গী-সাথীকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে থেকে ফিরে এসেছে। কী মারাত্মক বিপদে পড়েছেন রাসূল সা. এটা সহজেই অনুমেয়। মুসলিমদের মনোবল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কুরাইশরা তিন হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে মদীনার ওপরে চড়াও হয়েছিল আর রসূলুল্লাহ সা. মাত্র একহাজার লোক নিয়ে তাদের মোকাবিলা ও প্রতিরোধের জন্য বেরিয়েছিলেন। এক হাজার লোকের মধ্যে থেকেও মুনাফিকরা আলাদা হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে গেল এবং নবী সা.-কে শুধু সাতশত লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তিন হাজার শত্রুর মোকাবিলা করতে হলো।
উহুদের ঘটনার পর এটা সমস্ত মুসলিমদের কাছে নিশ্চিত ছিল যে আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার দল সত্যিকারের মুসলিম নন। নইলে আল্লাহর রাসূল সা.-এর সাথে বিদ্রোহ করে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে যেতে পারে না। এতে মুসলিমদের সুবিধে হলো তারা মুনাফিক সর্দার ও তার অনুসারীদের চিহ্নিত করার সুযোগ পেল। এ কারণে উহুদ যুদ্ধের পর প্রথম জুম’আর দিনে নবী সা. খুতবা দেয়ার পূর্বে আব্দুল্লাহ বিন উবাই যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়ালো তখন লোকজন তার জামা টেনে ধরে বলল, “তুমি বসো, তুমি একথা বলার উপযুক্ত নও। মদীনাতে এই প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে তাকে অপমানিত করা হলো। এতে সে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলো এবং মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। মসজিদের দরজার কাছে কিছু সংখ্যক আনসার সাহাবী তাকে বললেন, “তুমি একি আচরণ করছো? ফিরে চলো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ সা. কাছে আবেদন করো।“ এতে সে ক্রোধে ফেটে পড়লো এবং বললো! “তাকে দিয়ে আমি কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করাতে চাই না”।
হিজরী ৪ সনে বনু নাযীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় বিন উবাই ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের সাহায্য সহযোগিতা দান করে। একদিন রসূলুল্লাহ সা. এবং তাঁর সাহাবীগণ এসব ইহুদী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অপরদিকে এই মুনাফিকরা গোপনে গোপনে ইহুদীদের কাছে খবর পাঠাচ্ছিল যে, তোমরা রুখে দাঁড়াও । আমরা তোমাদের সাথে আছি। তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করা হলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব। আল্লাহ তা’আলা তাদের এই গোপন ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ করে দিলেন। সূরা হাশরে আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।
মুনাফিকদের মুখোশ খুলে পড়ার পরও রসূলুল্লাহ সা. তার কার্যকলাপ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে গিয়েছেন। কারণ মুনাফিকদের একটা বড় দল তার সহযোগী ছিল। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের বহু সংখ্যক নেতা তার সাহায্যকারী ছিল। কম করে হলেও মদীনার গোটা জনবসতির এক চতুর্থাংশ ছিল তার অনুসারী। উহুদ যুদ্ধের সময় এ বিষয়টিই প্রকাশ পেয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ শত্রুর সাথেও যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়া কোন অবস্থায়ই সমীচীন ছিল না। এ কারণে তাদের মুনাফিকী সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও নবী সা. দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে ঈমানের দাবী অনুসারেই তাদের সাথে আচরণ করেছেন।
অপরদিকে এসব লোকেরও এতটা শক্তি ও সাহস ছিল না যে, তারা প্রকাশ্যে কাফের হয়ে ঈমানদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে লড়াই করতো অথবা খোলাখুলি কোন হামলাকারী শত্রুর সাথে মিলিত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতো। বাহ্যত তারা নিজেদের একটা মজবুত গোষ্ঠী তৈরী করে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বহু দুর্বলতা ছিল। সূরা হাশরের ১২ থেকে ১৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে সেইসব দুর্বলতার কথাই তুলে ধরেছেন। তাই তারা মনে করতো মুসলমান সেজে থাকার মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। তারা মসজিদে আসতো, নামায পড়তো এবং যাকাতও দিতো। তাছাড়া মুখে ঈমানের লম্বা চওড়া দাবী করতো, সত্যিকার মুসলমানদের যা করার আদৌ কোন প্রয়োজন পড়তো না।
নিজেদের প্রতিটি মুনাফিকী আচরণের পক্ষে হাজারটা মিথ্যা যুক্তি তাদের কাছে ছিল। এসব যুক্তি দিয়ে তারা নিজেদের স্বগোত্রীয় আনসারদেরকে এই মর্মে মিথ্যা আশ্বাস দিত যে, আমরা তোমাদের সাথেই আছি। আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের অনেক ক্ষতি হতো । এসব কৌশল অবলম্বন করে তারা যেসব ক্ষতি থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিল। তাছাড়া তাদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মুসলমানদের ভেতরে কলহ কোন্দাল ও ফাসাদ সৃষ্টির এমন সব সুযোগও তারা কাজে লাগাচ্ছিল যা অন্য কোন জায়গায় থেকে লাভ করতে পারত না।
এসব কারণে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার অনুসারী মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে বনু মুসতালিক যুদ্ধাভিযানে শরীক হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল এবং এই সুযোগে একই সাথে এমন দুটি মহাফিতনা সৃষ্টি করেছিল যা মুসলমানদের সংহতি ও ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতো। কিন্তু পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং রসূলুল্লাহ সা.এর পবিত্র সাহচর্য থেকে ঈমানদাগণ যে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তার কল্যাণে যথাসময়ে এ ফিতনার মুলোৎপাটন হয়ে যায় এবং এসব মুনাফিক নিজেরাই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। এ দুটি ফিতনার মধ্যে একটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নূরে। আর অপর ফিতনাটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা মুনাফিকুনে।
বনু মুসতালিককে পরাস্ত করার পর ইসলামী সেনাবাহিনী তখনও মুরাইসী নামক কূপের আশেপাশের জনবসতিতে অবস্থান করেছিল। ইতোমধ্যে হঠাৎ পানি নিয়ে দুই ব্যক্তির মধ্যে বচসা হয়। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জাহ্জাহ্ ইবনে মাসউদ। তিনি ছিলেন হযরত উমরের রা.-এর কর্মচারী। তিনি তাঁর ঘোড়ার দেখাশোনা করতেন। অন্যজন ছিলেন সিনান ইবনে ওয়াবার ইল জুহানী। তাঁর গোত্র খাযরাজ গোতের মিত্র ছিল। মৌখিক বাদানুবাদ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে পরিণত হয় এবং জাহজাহ সিনানকে একটি লাথি মারে। এতে সিনান সাহায্যের জন্য আনসারদেরকে আহবান জানায় এবং জাহজাহও মুহাজিরদের আহবান জানায়।
এই ঝগড়ার খবর শোনামাত্র আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের উত্তেজিত করতে শুরু করে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে দ্রুত এসো, নিজের মিত্রদের সাহায্য করো। অপরদিকে থেকে কিছু সংখ্যক মুহাজিরও এগিয়ে আসেন। বিষয়টি আরো অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো। তাই আনসার ও মুহাজিরগণ সম্মিলিতভাবে সবেমাত্র যে স্থানটিতে এক দুশমন গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের পরাজিত করেছিলেন এবং তখনও তাদের এলাকাতেই অবস্থান করেছিলেন সে স্থানটিতেই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লিপ্ত হয়ে পড়তেন।
কিন্তু শোরগোল শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, “কী ব্যাপার? জাহেলিয়াতের আহবান শুনতে পাচ্ছি কেন? জাহেলিয়াতের আহবানের সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? এসব ছেড়ে দাও, এগুলো দুর্গন্ধময় নোংরা জিনিস। এতে উভয়পক্ষের সৎ ও নেককার লোকজন অগ্রসর হয়ে ব্যাপারটি মিটমাট করে দিলেন এবং সিনান জাহজাহকে মাফ করে আপোষ করে নিলেন।
এখানে এলাকাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে আল্লাহর রাসূল সা. জাহেলিয়্যাত বলেছেন। মদিনাবাসী ও মক্কাবাসী একে অপরের বিরুদ্ধে নিজের জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিলো। অথচ মুসলিমরা নিজেদের ভাইদের মধ্যে ইনসাফ কায়েম করবে। কেউ কোন অপরাধ করলে নিজের জাতির লোক বলে তাকে সাপোর্ট করবে না। আবার অন্য জাতির কেউ অপরাধ করলে পুরো জাতিকে দোষারোপ করা যাবে না। এভাবে এলাকাভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্থান ইসলামে নেই। এটা হারাম।
যাই হোক, এই মীমাংসার পর যাদের অন্তরে মুনাফিকী ছিল তারা সবাই এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে সমবেত হয়ে তাকে বললো, “এতদিন আমরা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তুমি প্রতিরোধও করে আসছিলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তুমি আমাদের বিরুদ্ধে এসব কাঙাল ও নিঃস্বদের (মুহাজির) সাহায্যকারী হয়ে গিয়েছো!“ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আগে থেকেই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। একথা শুনে সে আরো জ্বলে উঠল। সে বলতে শুরু করল, এসব তোমাদের নিজেদেরই কাজের ফল। তোমরা এসব লোককে নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছো, নিজেদের অর্থ-সম্পদ তাদের বন্টন করে দিয়েছো। এখন তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং আমাদেরই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এবং কুরাইশদের এই কাঙালদের অবস্থা বুঝাতে একটি উপমা হুবহু প্রযোজ্য। উপমাটি হলো, তুমি নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা করো, যাতে তা একদিন তোমাকেই ছিঁড়ে ফেঁড়ে খেতে পারে। তোমরা যদি তাদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নাও তাহলে তারা কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আল্লাহর শপথ, মদীনায় ফিরে গিয়ে আমাদের মধ্যে যারা মর্যাদাবান লোক তারা হীন ও লাঞ্ছিত লোকদের বের করে দেবে।“
এ বৈঠকে ঘটনাক্রমে হযরত যায়েদ ইবনে আরকামও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি একজন কম বয়স্ক বালক ছিলেন। এসব কথা শোনার পর তিনি তাঁর চাচার কাছে তা বলে দেন। তাঁর চাচা ছিলেন আনসারদের একজন নেতা। তিনি রসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে গিয়ে সব বলে দেন। নবী সা. যায়েদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি যা শুনেছিলেন আদ্যপান্ত খুলে বললেন। নবী সা. বললেন, তুমি বোধহয় ইবনে উবাইয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। সম্ভবত তোমার শুনতে ভুল হয়েছে। ইবনে উবাই একথা বলছে বলে হয়তো তোমার সন্দেহ হয়েছে।
কিন্তু যায়েদ বললেন, হে আল্লাহর রসূল সা.! তা নয়। আল্লাহর শপথ আমি নিজে তাকে এসব কথা বলতে শুনেছি। অতঃপর নবী সা. ইবনে উবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে সরাসরি অস্বীকার করলো। সে বারবার শপথ করে বলতে লাগলো আমি একথা কখনো বলি নাই। আনসারদের লোকজনও বললেন, হে আল্লাহর নবী! এতো একজন ছেলে মানুষের কথা, হয়তো তার ভুল হয়েছে।
তিনি আমাদের নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার কথার চেয়ে একজন বালকের কথার প্রতি বেশী আস্থাশীল হবেন না। বিভিন্ন গোত্রের প্রবীণ ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরাও যায়েদকে তিরস্কার করলো। বেচারা যায়েদ এতে দুঃখিত ও মনঃক্ষুণ্ন হয়ে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকলেন। কিন্তু নবী সা. প্রকৃত ব্যাপার কী তা তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারলেন।
হযরত ‘উমর এ বিষয়টি জানতে পেরে নবী সা.-এর কাছে এসে বললেন, “আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। কিন্তু নবী সা. বললেন, “এ কাজ করো না। ধৈর্য ধরো। লোকে বলবে, মুহাম্মাদ সা. নিজের সংগী-সাথীদেরকেই হত্যা করেছে”। উমার রা. আরো প্রস্তাব করলেন, যেহেতু আমি মুহাজির আমি হত্যা করলে নানান কথা উঠবে, তাহলে আপনি কোনো আনসার দিয়ে এই কাজটি করিয়ে নিন। নবী করিম সা. এবারো তাঁকে নিভৃত করলেন। ধৈর্যধারণ করতে বললেন।
এরপর এরপর নবী সা. তৎক্ষনাৎ যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিয়ে দিলেন। ক্রমাগত ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত থাকলো। এমন কি লোকজন ক্লান্তিতে নিস্তেজ ও দুর্বল হয়ে পড়লো। ক্লান্ত শ্রান্ত লোকজন মাটিতে পিঠ ঠেকানো মাত্র সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। এ কাজ রাসূল সা. এ জন্য করলেন যাতে, মুরইসী কূপের পাশে যে ঘটনা ঘটেছিল মানুষের মন-মগজ থেকে তা মুছে যায়। কিন্তু রাসূল সা.-এর ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন উবাই যে মন্তব্য করেছিলো তা ধীরে ধীরে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আনসার সাহাবীদের অনেকেই তাকে রাসূল সা.-এর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে তা করেনি। তার বেপরোয়া আচরণে সাহাবীদের মধ্যে তার সম্পর্কে আরো বিরূপ ধারণা তৈরি হয়।
এই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে মহান রাব্বুল আলামীন সূরা মুনাফিকুনে মুনাফিকদের আচরণের সাথে মুসলিমদের পরিচয় করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন,
যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। তারা নিজদের শপথকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। তারা যা করছে, নিশ্চিয় তা কতইনা মন্দ! তা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছিল তারপর কুফরী করেছিল। ফলে তাদের অন্তরসমূহে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারছে না।
আর যখন তুমি তাদের প্রতি তাকিয়ে দেখবে তখন তাদের শরীর তোমাকে মুগ্ধ করবে। আর যদি তারা কথা বলে তুমি তাদের কথা (আগ্রহ নিয়ে) শুনবে। তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতই। তারা মনে করে প্রতিটি আওয়াজই তাদের বিরুদ্ধে। এরাই শত্রু, অতএব এদের সম্পর্কে সতর্ক হও। আল্লাহ এদেরকে ধ্বংস করুন। তারা কিভাবে সত্য থেকে ফিরে যাচ্ছে!
আর তাদেরকে যখন বলা হয় এসো, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নেড়ে অস্বীকার করে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে। তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর অথবা না কর, উভয়টি তাদের ক্ষেত্রে সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।
তারা বলে, যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে অবশ্যই সেখান থেকে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু সকল মর্যাদা তো আল্লাহর, তাঁর রাসূলের ও মুমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।
উস্তাদ আবুল আ’লা মওদূদী র. বলেন, এ ঘটনা থেকে শরীয়াতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাসায়ালা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায়।
১. ইবনে উবাই যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছিল এবং যে ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল মুসলিম মিল্লাতের অন্তরভুক্ত থেকে কেউ যদি এ ধরনের আচরণ করে তাহলে সে হত্যা যোগ্য অপরাধী।
২. শুধু আইনের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি হত্যার উপযুক্ত হলেই যে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে তা জরুরি নয়। এরূপ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দেখতে হবে, তাকে হত্যা করার ফলে কোন বড় ধরনের ফিতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে কিনা। পরিবেশ-পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে অন্ধভাবে আইনের প্রয়োগ কোন কোন সময় আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী ফলাফল নিয়ে আসে। যদি একজন মুনাফিক ও ফিতনাবাজের পেছনে কোন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি থাকে তাহলে তাকে শাস্তি দিয়ে আরো বেশি ফিতনাকে মাথাচড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ দেয়ার চেয়ে উত্তম হচ্ছে, যে রাজনৈতিক শক্তির জোরে সে দুষ্কর্ম করছে কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তার মূলোৎপটন করা।
এই সুদূর প্রসারী লক্ষ্যেই নবী করিম সা. তখনো আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে শাস্তি দেননি যখন তিনি তাকে শাস্তি দিতে সক্ষম ছিলেন। বরং তার সাথে সবসময় নম্র আচরণ করেছেন ও তার ব্যাপারে সতর্ক থেকেছেন। শেষ পর্যন্ত দুই তিন বছরের মধ্যেই মদীনায় মুনাফিকদের শক্তি চিরদিনের জন্য নির্মূল হয়ে গেল।
-তাফহীমুল কুরআন ও সীরাতে ইবনে হিশাম থেকে সংকলিত