মিজানুর রহমান আজহারী | শ্রুতি লেখন: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
এই দুনিয়ার পুরো জীবনটাই হচ্ছে লালসাময় একটা জীবন। লোভ, মরীচিকা, মায়াজ্বাল। এই মায়াজ্বালে আমরা আটকে আছি। ফলে মৃত্যুর কথা আমরা ভূলে গিয়েছি। পাগলের মত ছুটছি..আরো টাকা লাগবে,আরো খ্যাতি লাগবে। আরো জশ লাগবে,আরো দাপট লাগবে আমার। এত টাকা দিয়ে কি হবে? এত সম্পদ দিয়ে কি হবে? এত ব্যস্ততা দিয়ে কি হবে তোমার?
STOP, থামুন!! অনেক হয়েছে আরনা। থামুন। Take a Rest, Take a Breath and Think about Death. Think that you have to go back to your lord.
একটু বসেন না, একটু ভাবেন। আমাকে চলে যেতে হবে। চলে যেতে হবে… এই কোলাহল, এই ব্যস্ততা, এগুলো থাকবে, থাকবনা আমি।
ওমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন, “মরার আগে একবার মর, তোমার হিসাব নেওয়ার আগে তুমি একবার নিজের হিসাব টা করনা।”
কাগজ বের করে একটু লিখনা কি কি ভাল কাজ করছিলা, যেগুলো দিয়ে নাজাতের উচিলা হতে পারে। ১,২,৩… আর কি কি আকাম-কুকাম করছ। লিখে দেখ তোমার অবস্থাটা কি। মরার আগে একবার মর।
মরার আগে খাটের মধ্যে চোখ বন্ধ করে একবার মরার ভান করে দেখেননা কেমন লাগে। চোখটা বন্ধ করেন আর ভাবেন আপনি নাই, কি কি হতে পারে ভাবেন।
আপনার ছেলে মেয়েরা কান্না জুড়ে দিবে। আপনার প্রাণের স্ত্রী বিলাপ শুরু করে দিবে।বন্ধু বান্ধবের চিৎকার আর মাতন, স্হানীয় এলাকার মসজিদে ঘোষণা অমুক এলাকার নিবাসী অমুক ভাই অমুকের ছেলে অমুক দুনিয়ায় নাই। সব আত্মীয়রা চলে আসবে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া হবে, সবাই সবাইকে জানাবে বিকাল ৪ টায় অমুক হাইস্কুল ময়দানে আপনার জানাজা।
ছুটে আসবে সবাই। ছুটে আসবে আপনাকে বিদায় জানানোর জন্য। ৪ তাকবীর দিয়ে আপনার জানাজা হবে, অশ্রুসিক্ত জানাজায় আপনার বিদায় হবে। কাটের খাটিয়ার মধ্যে রেখে কাঁধে তুলে আপনাকে কবরে নেওয়া হবে। আগে থেকে কুড়ে রাখা কবরটার মধ্যে আপনারে বিছিয়ে দেয়া হবে। বাশের খচি দিয়ে তার উপরে মাটির চাপা দিয়ে সবাই চলে যাবে।
ভাবেননা একবার চোখ বন্ধ করে।
This is the circle of life. This is the nature of life.
এটা সবার হবে। আমার হবে। আপনার হবে। এত মায়া,এত ভালবাসা কয় যাবে? কেউ থাকবেনা। সবাই আপনাকে অন্ধকার কবরে রেখে দিয়ে চলে আসবে।
উপরে বাশের কন্চি তার উপরে মাটির চাপা, অন্ধকার আর অন্ধকার, এ অন্ধকার যেন শেষ হতে চায়না। শুধুই অন্ধকার..ঠিক কিনা? এ জন্য আমাদেরকে চলে যেতে হবে। দাদা গেলে,নানা গেল,চাচা গেল,মামা গেল, আমাদেরকেও যেতে হবে।
“একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর,
মন আমার কেন বান্ধ দালান ঘর।
প্রাণ পাখি উরে যাবে পিন্জর অ ছেড়ে, ধরাদমে সবই রবে তুমি যাবে চলে।
বন্ধু বান্ধব যত মাতা পিতা দ্বারা সুতো,
সবই হবে তোমার পর…
ও মন আমার কেন বান্ধ দালান ঘর।”
ঠিক কিনা? সব পরে থাকবে, চলে যেতে হবে আমাদেরকে। এজন্য আখিরাতের কথা যেন আমাদের স্মরণ হয়।
বিশ্বনবী বলতেন, আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে আগে নিষেধ করতাম কিন্তু এখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলাম। এখন সবসময় তোমরা কবরের সামনে যাবা আর জিয়ারত করবা।
কবরস্হানে জানত? একটু জাবেন। একটু গেলে আখেরাতের কথাটা স্মরণ হবে, ওখানে ছোট শিশুরা শুয়ে আছে। কিশোর, যুবকরা আছে। আপনার মত তাগড়া যুবক, মুরব্বিরা আছে। এরা এই এলাকায় থাকত। এরা আকাশ থেকে নেমে আসেনাই, এরা এই এলাকারই সন্তান। আজ নাই। একটা Certain period শেষে আপনিও থাকবেননা।
This is the nature of life, This is the circle of life.
ছোট্ট শিশু হয়ে এসেছিলেন… শৈশব, কৈশোর, যৌবন, পৌড়ত্ব। আগে ছিলেন Single, বিয়ে করে হয়ে গেলেন ডাবল। এরপর আল্লাহ আপনাকে একটা মেয়ে দিল। এরপর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শশ্বুর হলেন। এরপর অই মেয়ের ঘরে সন্তান হওয়াতে নানা হলেন। আর কতদিন? অনেক দিন হলত। অনেক লম্বা সময় পেয়েছেন আপনি।
Think about death. এবার যাওয়ার কথা ভাবেন। আখিরাতের সামানের কথা ভাবেন। ফিরে যেতে হবে। কি শক্তিশালী যুবক, বার্ধক্য চলে আসলে লাঠি ছাড়া চলতে পারেনা৷ কুচকুচে কালো দাড়ি সাদা হয়ে যায়। দাড়ির শুভ্রতা, বয়সের ভাড়। রং ধরা যৌবন, জং ধরে শেষ। ঠিক কিনা?
This is the circle of life.
যুবক ভাইয়েরা এটাই জীবন। চলে যেতে হবে, কেউ থাকতে পারবেনা। ঠিক কিনা? এটার রিমাইন্ডার আল্লাহ এই সূরার ভেতর দিয়েছেন, তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। এই লোভ লালসা ছেড়ে দাও। রাব্বুল আলামীন বলেন ও গোলাম দুনিয়ার সম্পদ, লোভ লালসা তোদেরকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। এই লোভ পাগলামী কোনদিন তোদের থামবেনা যতদিননা তোরা কবরে ডুকবি। ঠিক কিনা? কার কথা? আল্লাহর।
আল্লাহ বললেন দুনিয়ার সম্পদ আর লোভ আর মোহে তোমরা গাফেল হয়ে গিয়েছ। আখেরাতের কথা বেমালুম তোমরা ভূলে গিয়েছ। কিন্তু আখেরাতে তোমাদের যেতেই হবে, কবরের বাড়িতে তোমাদের ডুকতেই হবে। ঠিক কিনা? যেতেই হবে, আমরা ভুলে যাই। অতিরিক্ত পাওয়ার লোভ, বেশি বেশি খাওয়ার লোভ, বেশি বেশি জমানোর লোভ মানুষকে গাফেল বানিয়ে দিয়েছে। এটা মানুষের স্বভাব।
আরো চাই, আরো চাই.. এ স্বভাবটা আছে না নাই? দেখবেন ছোট বাচ্চারা মসজিদের দোয়া অনুষ্ঠান শেষে জ্বিলাপী দেয়না? আগে বাতাসা দিতনা? এখন কি দেয়? জ্বিলাপী দেই,মিষ্টি দেই। মসজিদের ২, ৩ গেইট থেকে যদি দেই। ছোট বাচ্চারা দেখবেন এদিক থেকে কয়েকটি নেই, নিয়ে আবার অই গেইটে লাইন ধরে। ওর হাত হল ছোট হাত। ওর হাত ভর্তি জ্বিলাপী, আর নেওয়ার জায়গা নাই। এরপরও আরেক জায়গায় লাইন ধরছে। আরো লাগবে। এই আরো, আরো চাই… এই স্বভাবটাই মানুষকে কুড়ে কুড়ে শেষ করে দিয়েছে। এত লাগবে কেন তোমার? চাহিদার কোন শেষ নাই।
Unlimited demand of human being, যার আছে বেশি তার চায় বেশি, যার সাইকেল আছে তার হোন্ডা চাই, হোন্ডা আছেত প্রাইভেট কার চাই, প্রাইভেট কার আছেত প্লেন চাই, প্লেন আছেত হেলিকপ্টার চাই, হেলিকপ্টার আছেত অইটা চাই।
এলাকার মেম্বার যে হয়েছে চেয়ারম্যান হতে চাই। আছে না নাই। চেয়ারম্যান সাহেব এমপি হতে চাই। আছে না নাই? এমপি সাহেব মন্ত্রী হতে চাই। আছে না নাই?
মানুষের চাহিদার কোন শেষ নাই। যার আছে বেশি তার চাই বেশি। এজন্য বিশ্বনবী বলেছেন তোমার চেয়ে যে খারাপ আছে তার দিকে তাকাও, তোমার চেয়ে যে ভাল আছে তার দিকে তাকাইও না। তোমার চেয়ে যে খারাপ অবস্হানে আছে ওর দিকে থাকাও।
অনেকে নিজের অবস্থান নিয়ে সুখীনা। এরকম আছে না নাই? আল্লাহ আমারে এটা দিলনারে অইটা দিলনারে, পাইলামনারে, কিচ্ছু হয়না, কি করব জীবনে!! হতাশ…
আসলে আছে কিন্তু অনেক। কিন্তু শোকরিয়া নাই, ডাকাত। ঠিক কিনা? নিজের অবস্থান নিয়ে সুখীনা কিন্তু অনেক লোক আছে তারা আপনার অবস্হানে পৌঁছাতে চায়। তাদের দিকে তাকিয়ে দেখেন, আপনি যে অবস্হানে আছেন সেই অবস্হানে পৌঁছানো অনেকের কাছে স্বপ্ন। তারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম আর Struggle করে যাচ্ছে আপনার অবস্থানে পৌছঁতে। আর আপনি এটা নিয়ে সন্তুষ্ট না।
শেখ ছাদীর নাম শুনেছেন? বালাগাল ওলাবিকা… কাশাফাদ দুজা… এই কবিতাটার রচয়িতা। ইরানের বিখ্যাত এক কবি। উনি একবার আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। টাকা নাই,পয়সা নাই। পায়ে দেয়ার মত জুতা নাই। উনি খুব দুঃখ পেলেন। হায়রে আমি ইরানের এত বড় কবি,দুঃখ ভরা মন নিয়ে রাস্তায় হাটতে বের হলেন। হাটতে হাটতে হঠাৎ দেখলেন একটা লোক শুয়ে শুয়ে কাঁদছে অই লোকটার দুইটা পাই নাই। পাই নাই… উনি সেজদায় পড়ে গেলেন, আল্লাহ অনেক দিয়েছেন শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
এইজন্য যেই পরিস্হিতিতে থাকিনা কেন আমরা কি পড়ব? জুড়ে বলেন কি পড়ব? আলহামদুলিল্লাহ। এজন্য অল্পে টুষ্ট থাকার নামই হল ইসলাম।
সম্পদ লাগবে কিন্তু সম্পদের পাহাড় লাগবেনা। ঠিক কিনা? অল্প খান, অল্প পড়েন, অল্পের ভিতরে বরকত ঢুকায় দিছে কে? আল্লাহ।
দেখবেন যাদের সম্পদ অল্প তারা সুখী বেশি। জরিপে এটা দেখা গিয়েছে। অনেক সার্ভেতে এটা এসেছে যাদের সম্পদ বেশি তারা দুঃখী বেশি। এদের দুঃখ বেশি। টেনশন বেশি। খুব স্বাভাবিক, টাকা যার বেশি রোগ তার বেশি। টাকা যার বেশি টেনশন তার বেশি। টাকা যার বেশি ঘরে শান্তি তার কম। আছে না নাই?
ঘরের ভিতরে অশান্তি, ছেলে কথা শুনেনা, মেয়ে করে পরকীয়া। আছে না নাই? স্ত্রী কথা শুনেনা, ভালবাসা নাই। ঘরটা জাহান্নামের টুকরা। রোগ বালাই… একেকটা হসপিটালের বিল পরিশোধ করতে মাসে ৫ লাখ, ১০ লাখ। আছে না নাই? কিছু খেতে পারেনা। ডাক্তার একেবারে ডায়েট মেনু বেঁধে দিয়েছে। ডায়েট, ভেরি ডায়েট মেনু। গরু খাবেননা, চিংড়ি খাবেননা শুধু ঘাস খাবেন। ইচ্ছে মত ঘাস খাবেন। মানে ঘাস জাতীয় যত আইটেম আছে সব খাবেন। শাক খাবেন, সবজি খাবেন, সালাদ খাবেন। গরু, চিংড়ি, ইলিশ কিছুই খেতে পারেনা।
তাইলে রোগ বেশি, খাওয়ার মজা নাই, ঘরে সাংসারিক শান্তি নাই, খালি ব্যারাম আর ব্যারাম।ঠিক কিনা। কিন্তু সম্পদের পাহাড় গড়েছে। আর অল্প যারা খায়, অল্প পড়ে, রিকশাওয়ালা, কুলিওয়ালা, অল্পবেতনের চাকরি কিন্তু হক হালালি মেনে চলে দেখবেন শান্তি আছে অনেক। বাসা ভাড়া দেই, ফ্যামিলি চালায়, বাচ্চাদের স্কুল বিল দেই..এরপরও মাস শেষে এক, দুই হাজার টাকা হাতে থেকে যাই। আর ওদিকে প্রতিমাসে ১০ কোটি টাকা ইনকাম তারপরও ব্যাংকের ঋণ আছে না নাই?
সুখ কারে বলে? কিভাবে আপনি সুখকে ডিফাইন করবেন? সুখত টাকাই কিনা যায়না… শান্তি টাকা দিয়ে হয়না, শান্তি দেওয়ার মালিক কে? আল্লাহ।
শান্তি আছে অল্প খেয়ে শোকর করার মধ্যে। শান্তি আছে আলহামদুলিল্লাহর মধ্যে।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।