মূল: ড্যানিয়েল হাকিকাতজ্যু | অনুবাদক: নুরুস সালামাত সিয়াম
লিবারেল, সেক্যুলার এবং প্রগতিশীলরা (পাশাপাশি মানবতাবাদী, নাস্তিক, সংস্কারবাদীরা এবং অন্যান্যরাও) মনে করে, সময়ের সাথে সাথে নৈতিকতার পরিবর্তনে কোনো সমস্যা নেই। বরং এটি স্বাভাবিক ও অনিবার্য প্রক্রিয়া এবং আমাদের সবার এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করে নেওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, তারা নৈতিকতার মূল প্রকৃতি সম্পর্কে বিভ্রান্ত।
সময়ের সাথে সাথে যখন ধর্মীয় নৈতিকতা লোপ পায়, তখন এই সকল ব্যক্তি তাতে কোনো সমস্যা দেখে না। কারণ, তারা ধর্মীয় রীতিনীতিগুলোকে নৈতিকভাবে বাধ্যতামূলকই মনে করে না। তারা বলে, “অতীতে ধর্মীয় অনুভূতির কারণে বিবাহবহির্ভূত শারিরীক সম্পর্ককে ‘অন্যায়’ মনে করা হত। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। আমাদের কাছে এগুলো আর ‘খারাপ’ মনে হয় না। কারণ আমাদের প্রগতি হয়েছে।”
এই চিন্তাভাবনা কতটা ঘোলাটে তা দেখানো খুবই সহজ। শুধু এমন কোনো মূল্যবোধের কথা ভাবুন, যাকে তারা নৈতিকভাবে ‘বাধ্যতামূলক’ মনে করে। যেমন, জাতিগত সমতা। তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, যদি কোনো দিন সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তারা কি তা মেনে নিবে? এমন বলাটা কি যুক্তিযুক্ত যে, নৈতিকতা বিকশিত হয়ে একদিন এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যেখানে সাদাদের শ্রেষ্ঠত্বই হবে নৈতিকভাবে আদর্শ, সবার যাকে আকাঙ্ক্ষা করা উচিৎ? কেন যুক্তিযুক্ত হবে না?
যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে সাদাদের শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যে আসলে কোনো ভুল নেই, কিন্তু আমরা এখনো সেটা বুঝতে পারছি না। ভবিষ্যতের মানুষেরা এটি বুঝতে সক্ষম হবে। ঠিক যেভাবে এক পর্যায়ে যিনা করা অন্যায় মনে করা হতো, কিন্তু পরবর্তী সময়ের মানুষেরা আবিষ্কার করলো এটি আসলে সেরকম খারাপ না। পার্থক্যটা কী? নৈতিকতা কেন এভাবে বিকশিত হতে পারে না?
এখন, এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে, “নৈতিকতা বিশৃঙ্খলভাবে বিকশিত হয় না, বরং একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে বিবর্তিত হতে থাকে। কুসংস্কার ত্যাগ করা এবং ক্ষতিকে চিনতে পারার মাধ্যমে আমাদের নৈতিকতা দিনে দিনে নিখুঁত হয়ে উঠে। আসলে, একমাত্র সত্যিকারের অনৈতিক কাজ হচ্ছে অন্যের ক্ষতি করা, যাকে আমরা ‘Harm Principle’ বলি।”
লিবারেল ও সেক্যুলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ কিছু ব্যক্তির মতে, বাস্তবে একমাত্র সত্য নৈতিক মূলনীতি হলো ‘Harm Principle’। এই যুক্তি ব্যবহার করে তারা দাবি করে (বিপরীতে প্রচুর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও), “আমরা আবিষ্কার করেছি, যিনা আসলে মানুষের ক্ষতি করে না।
তাই একে অনৈতিক মনে করা উচিত নয়। তাছাড়া, আমরা আবিষ্কার করেছি, সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষতিকারক, তাই একে অনৈতিক মনে করা উচিত।”
এক মুহুর্তের জন্যে একটু পিছনে ফিরে আসি। প্রথমত, লিবারেল ও সেক্যুলারদের দাবি অনুযায়ী যদি এই ‘Harm Principle’ সকল নৈতিকতার মূল চাবিকাঠি হয়, তাহলে তারা কি মেনে নিতে পারবে যে, এই নীতিরও বিকাশ হতে পারে? যদি নৈতিকতার বিকাশ এবং অগ্রগতি হয়, তাহলে কি আমরা একদিন এমনও আবিষ্কার করতে পারি যে, মানুষের ক্ষতি করা আসলে নৈতিকভাবে অনুমোদিত এবং ‘Harm Principle’ মূলত অতীতের সেকেলে ধ্যান-ধারণা বা কুসংস্কারমাত্র?
লিবারেল, সেক্যুলার এবং প্রগতিশীলরা যদি মনে করে এমনটি হওয়া সম্ভব নয়, বরং ‘Harm Principle’ সবসময় তার আদর্শের জায়গায় বাধ্যতামূলক থাকবে, তাহলে তো তারা নৈতিকতার ক্ষেত্রে আসলে প্রগতিশীল থাকছে না। তারা পরম-নীতিতে (Moral Absolutes) বিশ্বাস করে। তাহলে কীভাবে তারা ধর্মপ্রাণ মুসলিমদেরকে সময়ের সাথে অপরিবর্তনশীল পরম-নীতিতে বিশ্বাসের জন্যে দোষারোপ করতে পারে?
এখন ‘Harm Principle’ এর অসারতা প্রমাণ করা যথেষ্ট সহজ। (শুধু জিজ্ঞেস করবেন, কোন জিনিসগুলো সত্যিকার অর্থে ‘ক্ষতি’ গঠন করে, এবং কোনটা ক্ষতি আর কোনটা ক্ষতি না- সেটা কে ঠিক করে দেয়? এছাড়াও তাদেরকে দেখাবেন যে ‘ক্ষতি’ নিজেই এমন একটি ব্যক্তি-নির্ভর ধারণা যা আমাদের বৃহত্তর নৈতিক এবং সত্তাতাত্ত্বিক [১] (Ontological) প্রতিশ্রুতি এবং অন্যান্য জিনিসের উপর নির্ভর করে)। তবে আমি নৈতিকতার বিকাশের ধারণার দিকেই গুরুত্ব দিতে চাই। যারা ‘Harm Principle’কে পরম-নীতি মনে করেন, তারা বোঝাতে চায় যে সময়ের সাথে নৈতিক আচার-আচরণের পরিবর্তন ভালো-খারাপ নির্ণয়ের একটি প্রক্রিয়া। তাহলে প্রশ্ন আসে, এই প্রক্রিয়াটি কী?
জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে বলি, ক্ষতি আবিষ্কার করা আর নতুন গ্রহ কিংবা কেমিক্যাল আবিষ্কার করা কি এক? এটা কি বাহ্যিক অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু? কোথায় আপনি ক্ষতি দেখতে পারেন? তাছাড়া, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের এটাকে দেখার সামর্থ্য কীভাবে সময়ের সাথে উন্নতি লাভ করে? উন্নত টেলিস্কোপ-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মহাবিশ্বের গ্রহগুলো আবিষ্কার সহজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা যেমন আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নতুন ‘ক্ষতি’ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ঠিক কোন জিনিসটি আমাদের অনুমতি দিচ্ছে?
স্পষ্টতই, এক্ষেত্রে লিবারেল, সেক্যুলার এবং প্রগতিশীলদের হাস্যকর, অথবা জোর করে দেওয়া উত্তর ছাড়া অন্য কিছু থাকবে না। তারা তখন এমন বলবে, “ক্ষতি কোনগুলো সেটা সবসময়ই জানা ছিল। কিন্তু শক্তিশালী, অসৎ, স্বার্থপর লোকেরা ক্ষতিগুলোকে সবার সামনে আসতে দেয়নি।”
তাই এই ব্যাপারে কিছু কথা। প্রথমত, কিছু ক্ষতি সবসময়ই জানা ছিল তার প্রমাণ কী? আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাস লক্ষ্য করি, বর্তমানের মানদণ্ডে যেগুলো মারাত্মক ‘ক্ষতিকর’ মনে করা হয় তার বেশিরভাগই অতীতে শোনা যায়নি। যেমন, হোমোফোবিয়া একটি উদাহরণ। ট্রান্সফোবিয়া আরেকটি। এছাড়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সর্বনাম ‘নির্বাচনের’ ক্ষেত্রে নির্যাতন ইত্যাদি। আপনার কাছের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লিবারেল আর্টসের ক্লাসে অংশগ্রহণ করুন, বিশেষ করে জেন্ডার-স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে। দেখবেন, সেখানে অত্যাচার-নিপীড়ন, বৈষম্য আর লিঙ্গবাদ (Sexism) এর নামে যা যা শিখানো হয় তার প্রায় সবটুকুই ইতিহাসে শোনা যায়নি।
যে ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে এই ‘ভুলগুলো’ তৈরি হয়েছে, এক বা দুই প্রজন্ম আগেই সেগুলো অস্তিত্বহীন ছিলো। তাহলে আজ লিবারেল, সেক্যুলার এবং প্রগতিশীলরা যেগুলোকে গুরুতর ‘ক্ষতি’ মনে করছে, সেগুলো ঐতিহাসিকভাবেও জানা ছিলো (কিন্তু কিছু মানুষের জন্যে সামনে আসেনি) এমন ধারণা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
দ্বিতীয়ত, তাদের এই প্রতিক্রিয়া নৈতিক অগ্রগতির পুরো ধারণাটিকেই ভিত্তিহীন করে ফেলে। যদি ‘Harm Principle’ অপরিবর্তনীয় অর্থাৎ পরম হয় এবং একইভাবে, কোনটা ক্ষতিকর এবং কোনটা ক্ষতিকর না এই বিষয়টাও অপরিবর্তনীয় বা পরম হয়, তাহলে আমরা যে এত নৈতিক অগ্রগতির কথা শুনছি তা ঠিক কোথায়? আমাদের সাথে আলাপে অংশগ্রহণকারী তখন বলতে পারেন যে অগ্রগতি ঠিক তখন হয় যখন খারাপ লোকেরা পরাজিত হয় এবং সত্য ও ন্যায়বিচার জয়লাভ করে।
তবে এটি নৈতিক অগ্রগতির খুবই দূর্বল একটি ধারণা। সবাই এই ধরণের নৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্বাসী! ভাল-মন্দের লড়াই চিরস্থায়ী। কখনো ভালো দল বিজয়ী হয়। অন্যান্য সময় তাঁরা পরাজিতও হয়। এমনকি যারা আস্তিক এবং লিবারেল ও সেক্যুলার আদর্শে বিশ্বাস করে না, তারাও এটা বিশ্বাস করে। মানব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নৈতিক অগ্রগতির এই ধারণাটি বিরল, যদিও লিবারেল এবং সেক্যুলাররা একে পছন্দ করে।
সবশেষে, যখন নৈতিক অগ্রগতির এই ধারণাকে সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করা হয়, তখন তা সামান্যতম সমালোচনাও প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। জ্ঞানতত্ত্বের (Epistemology) দিক থেকেও ধারণাটি গুরুতর ত্রুটিযুক্ত, এর একটি কারণ হচ্ছে ‘ক্ষতির নীতির’ তাত্ত্বিক অসম্পূর্ণতা। যখন লিবারেল-সেক্যুলার-প্রগতিশীলরা নৈতিক অগ্রগতির দিকে আহবান জানায়, তখন আমরা মুসলিমরা, যারা ওহী নাযিল থেকে আজ অবধি ইসলামের নৈতিক নীতিগুলির সার্বজনীনতা, অপরিবর্তনীয় প্রযোজ্যতায় বিশ্বাস করি, তাদের উচিত হবে এ আহবান ফিরিয়ে দেয়া। কেননা মুসলিমদের উচিত এইসব ধারণার সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা এবং আদর্শিক প্রতিপক্ষগুলো যেন নিজেদের চিন্তার গরমিল চিহ্নিত করে, সে দাবি জানানো।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।