মাহাদি হাসান |
মাহে রমজান। ত্রয়োদশ হিজরি। চলছে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর স্বর্ণালী শাসনকাল। অন্ধকারের অমানিশাকে দূরে ঠেলে ইসলামের নতুন সকালকে প্রস্ফুটিত করতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন প্রান্তে। আল্লাহর তরবারি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) তখন ছিলেন রোমকদের মূর্তিমান ত্রাস। সিরীয় অঞ্চলে তাঁর ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজ শুনে ক্রমেই কেঁপে উঠছে রোমের প্রাসাদ। অপরদিকে আরেক বীর মুজাহিদ মুসান্না ইবনুল হারেসা তখন করে দিয়েছেন পারসিকদের রাতের ঘুম হারাম। কিসরার প্রাসাদে বিরাজ করছিল বেদুইন আরবদের ভয়। দেখতে জীর্ণ-শীর্ণ মনে হলেও যুদ্ধের ময়দানে তাঁরা যেন প্রলয়ংকরী তুফান। যে তুফানের সামনে কচুকাটা হয়ে যায় সুদৃঢ় স্তম্ভ।
কিছুদিন আগেই জিসর তথা সেতুর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী হয়েছে চরম ক্ষতির সম্মুখীন। হারিয়েছে সেনাপতি আবু মাসউদ সাকাফি (রা.) সহ আরও চার হাজার সাহাবিকে। ফোরাত নদীতে নির্মিত এ সেতুর ওপারে মারুহা নামক স্থানে পারসিক বাহিনী নিয়েছিল যুদ্ধের বিশাল প্রস্তুতি। উদ্দেশ্য ছিল সেতুর ওপারে আরবদের দখলকৃত অঞ্চলগুলোর উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তারা নিয়ে এসেছে ৩০০ জঙ্গি হাতি, সাথে আছে আরও পাঁচ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের বাহিনী। পারসিয়ান বীর বাহমান জাদবিয়াকে দেয়া হয়েছে সেনাপতির দায়িত্ব।
ফোরাত নদীর অপরপ্রান্তে কিসসে নাতিফ নামক স্থানে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল মুসলিম বাহিনী। অপেক্ষা করছিলেন সেনাপতির নির্দেশের। সেনাপতি আবু মাসউদ সাকাফি কিছুতেই পারসিকদেরকে সেতুর এপারে আসতে দিতে চান না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন সেতুর ওপারে গিয়েই হবে যুদ্ধ। প্রথমে মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী সেতু পার হয়। পারসিকদের হাতির বহর দেখে তাঁরা হয়ে পড়েন হতভম্ব। ইতিপূর্বে কোনো যুদ্ধে তাঁরা এমন হাতির সমাবেশ হতে দেখেননি।
বিশালাকার হাতিগুলো দেখে মুসলিম বাহিনীর ঘোড়াগুলো হয়ে পড়ে অস্থির। এরপর পুরো মুসলিম বাহিনী সেতু পার হয়ে ওপারে যাওয়ার আগেই অপ্রস্তুত অবস্থায় তাদের উপর হামলা করে বসে পারসিক বাহিনী। বিশালাকার হাতি পালের সামনে মুসলিম বাহিনী কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিল না। সেনাপতি আবু মাসউদ সাকাফি মরণপণ লড়াই করতে করতে পরে যান হাতির পালের মাঝে। তিনি আগে থেকেই আঁচ করেছিলেন এ যুদ্ধে তিনি পান করতে যাচ্ছেন শাহাদাতের অমীয়সূধা। সেনাপতির পরাজয়ের পরও মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়নি। মুসান্না ইবনুল হারেসা (রা.) এর নেতৃত্বে তাঁরা পুনরায় ঘুরে দাঁড়ান। যুদ্ধ শেষ হয় অমিমাংসীতভাবে। মুসান্না (রা.) মুসলিম বাহিনী নিয়ে সেতুর ওপারে ফিরে যেতে সক্ষম হন।
কিন্তু এরই আগে হয়ে গেছে অপূরণীয় ক্ষতি। প্রায় চারহাজার মুসলিম সৈন্যের বিয়োগ ঘটে গেছে। কেউ হয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে শহীদ। কারো সলিল সমাধি হয়েছে আবে ফোরাতে। মুসান্না (রা.) নিজেও হয়েছেন অনেকগুলো আঘাতের শিকার। শোকার্ত এবং বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে মুসলিমগণ অপেক্ষা করতে থাকেন সঠিক সময়ের। যেদিন তাঁরা পারসিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করবেন সমুচিত ক্ষতিপূরণ।
জিসরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতির দুঃসংবাদ পৌঁছেছে দরদি খলিফাতুল মুসলিমীনের কানে। তাঁর তেজস্বীকতা এবং বীরত্বের কথা কে না জানে! এই মর্মান্তিক দুঃসবাদ শুনে তিনি হন সীমাহীন ব্যথিত। সাথে জেগে উঠে পারসিকদের উচিত শিক্ষা প্রদানের দৃঢ় সংকল্প। অচিরেই তিনি সেনাপতি মুসান্নাকে নির্দেশ দেন পারস্য আক্রমণের। জারির বিন আবদুল্লাহ আল-বাজালি, আরফাজা ইবনু হারসামা এবং গালিব ইবনু আবদুল্লাহ রা.প্রমুখের নেতৃত্বে পৃথক পৃথক সাহায্যকারী বাহিনী তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন ইরাকের উদ্দেশ্যে। মুসান্না (রা.) এর বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য। রিদ্দাহর ঘটনা থেকে যারা তওবা করেছিল তাদেরকেও তিনি করে দেন ইরাকমুখী। এদিকে মুসান্না (রা.) ও আশপাশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অবস্থানরত মুসলিমদেরকে আহ্বান করেন একত্রিত হওয়ার জন্য।
জিসর যুদ্ধ থেকে ফিরে মুসান্না ইবনুল হারেসা (রা.) বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছিলেন মারজুস সাবাখ নামক স্থানে। সেখানেই তিনি আসন্ন যুদ্ধের জন্য সৈন্য একত্রিত করছিলেন। এটি ছিল কাদিসিয়া এবং খাফফানের মধ্যবর্তী অবস্থানে। মরুভূমির নিকটে হওয়ার কারণে এখানে মুসলিম বাহিনীর জন্য ছিল সুযোগ-সুবিধা। কারণ, এ পরিবেশে লড়াই করে পারসিকরা অভ্যস্ত নয়। পারস্যের সিংহাসন তখন পুরুষ শাসক শূন্য। তাদের শাসন করছিল তখন রানী বুরান তখত। গোয়েন্দা মারফত তার কানে পৌঁছে যায় মুসলিম বাহিনীর প্রস্তুতির সংবাদ।
পারসিক বীর রুস্তম এবং ফাইরুযান রানীর কাছে অনুমতি চায় সেনা অভিযান পরিচালনার জন্য। অনুমতি পেয়ে সেনাপতি মাহরানের নেতৃত্বে তারা হিরাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। জিসরের যুদ্ধের সময় এই হিরাতেরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল মুসলিম বাহিনী। পারসিকদের বাহিনীতে ছিল বারো হাজার সৈন্য। যারা ছিল পারসিকদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী। এ বাহিনীতি পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যা ছিল সমান। সাথে ছিল তিনটি বিশালাকার হাতি। মুসান্না (রা.) তখনও মারজুস সাবাখেই নিচ্ছিলেন যুদ্ধের প্রস্তুতি। ইতিমধ্যেই পারসিক বাহিনীর হিরাত অভিমুখে যাত্রা সংবাদ গোয়েন্দা মারফত তাঁর কানে এসে পৌঁছায়। পূর্ববর্তী যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.এর সাহচর্যের ফলে এবার মুসান্না (রা.).কোনো ভুল করলেন না। সন্ধান করতে লাগলেন যুদ্ধের উপযুক্ত স্থানের।
অতঃপর বাহিনী নিয়ে যাত্রা করলেন ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে বুয়াইব নামক স্থানের উদ্দেশ্যে। জারির ইবনু আবদুল্লাহ আল-বাজালি এবং অন্যান্য সহযোগী বাহিনীকে সংবাদ পাঠালেন তাঁরা যেন বুয়াইবে গিয়েই মুসান্না রা.এর সাথে মিলিত হন।
বুয়াইব যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে। মুসান্না (রা.) বাহিনীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়েছেন বুয়াইবের পূর্বপ্রান্তে ফোরাত নদীর তীরে। তবে এবার তিনি নদী পার হয়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা করলেন না। খলিফাতুল মুসলিমীন ওমর রা.নির্দেশ দিয়েছেন পারসিকদের পরাজিত করেই কোনো নদী অথবা সেতু অতিক্রম করতে। জিসরের যুদ্ধের আঘাতের ক্ষত এখনো শুকোয়নি। মাঝে মাঝেই চিনচিনে ব্যথা করে উঠে। এই ব্যথা নিয়েই মুসান্না (রা.) পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন মুসলিম বাহিনীর অবস্থা। পদাতিক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছে তাঁর আপন ভ্রাতা মুয়ান্না ইবনু হারেসাকে। অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান তাঁর অপর ভ্রাতা মাসউদ ইবনু হারেসা (রা.)।
মাইমানার নেতৃত্বে ছিলেন বশির ইবনুল খাসাসিয়্যাহ এবং মাইসারার নেতৃত্বে ছিলেন বুসর ইবনু আবি রুহাম (রা.)। মুকাদ্দিমাতুল জাইশ তথা সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন মুসান্না (রা.).নিজে। পদাতিক এবং অশ্বারোহী বাহিনীর পিছনে ছিল তিরন্দাজ বাহিনী। তাদেরও পিছনে ছিল রিজার্ভ বাহিনী। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন মাযউর ইবনু আদি (রা.)।
এভাবে বাহিনীকে বিন্যস্ত করে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন শত্রুবাহিনীর। যুদ্ধ পূর্বের মত বিনিময় শেষে পারসিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয় নদীর সংকীর্ণ সেতু পেরিয়ে আক্রমণের জন্য। আগে থেকেই উপযুক্ত স্থান নির্বাচিত করে নেয়ায় পারস্য বাহিনী পড়ে যায় ফাঁদে। হয়ে যায় অবরুদ্ধ। তাদের বাহিনীকে তিন কাতারে বিভক্ত করা হয়। প্রতি কাতারে ছিল একটি করে হাতি। মুসলিমদের প্রথম কাতারের সাহসী সিপাহীগণ পারসিকদের প্রথম কাতারের মুখোমুখি হতেই মুসান্না (রা.) ‘আল্লাহু আকবার’ বলে গর্জে উঠেন। দ্বিতীয়বার তাকবীর দিয়ে তৃতীয়বার বলার আগেই পারসিকরা যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে আচমকা হামলা করে বসে।
প্রথমে হতচকিত হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে মুসলিম বাহিনী নিজেদেরকে ঠিক করে নেয়। হাতিদের ভয়ে ভীত না হয়ে মুসলিম তিরন্দাজ বাহিনী হাতির পিঠে বসে থাকা পারসিক তিরন্দাজদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে তাদেরকে বিশৃঙ্খল করে দেয়। যুদ্ধের ময়দানের ধুলোবালি ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে। মুসলিম বাহিনীকে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে মাহরানের নেতৃত্ব পারসিকদের সম্মিলিত আক্রমণে শহীদ হন মাসউদ ইবনু হারেসা (রা.)। পুরো যুদ্ধ জুড়ে অসুস্থ শরীর নিয়েও নিজের বীরত্ব, জ্বালাময়ী বক্তৃতা এবং উৎসাহ দিয়ে মুসলিম সিপাহীদের উজ্জীবিত করে রাখেন মুসান্না ইবনু হারেসা (রা.)। বীরদর্পে অবতীর্ণ হন পারসিক সেনাপতি মাহরানের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক মুসলিম তিরন্দাজের আঘাতে মাহরান লুটিয়ে পড়ে ভূতলে। সেনাপতির মৃত্যু দেখে পারসিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দিকবিদিক পালাতে শুরু করে। পলাতকদের পিছু ধাওয়া করে করতলে আসে পারসিকদের আরও কিছু অঞ্চল।
মূলত এ যুদ্ধই মুসলিমদের জন্য উন্মোচিত করে দেয় পারস্যের দরজা। তাই গুরুত্বের দিক দিয়ে এ যুদ্ধ কোনো অংশেই কম নয়। আল্লামা ইবনে কাসির এ যুদ্ধকে তুলনা করেছেন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং মুসলিম বাহিনীর মধ্যকার ঐতিহাসিক ইয়ারমুক যুদ্ধের সাথে। এ যুদ্ধের পরেই সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক কাদিসিয়ার যুদ্ধ। প্রতিশোধপরায়ণ পারসিক বাহিনী বীর রুস্তমের নেতৃত্বে আক্রমণ করতে এসে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে আবারো। ধসে পড়ে তাদের অস্তিত্বের সর্বশেষ দেয়ালটি। মুসলিমদের জন্য পারস্য এবং ইরাকের দরজা হয়ে যায় পুরোপুরি উন্মুক্ত।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।