আরিফুল ইসলাম |
একদিন আমার প্রোফাইলে লিখা উঠবে- Remembering! যে চেয়ারে বসে আজ লেখাটি লিখছি, সেই চেয়ারটি থাকবে; কিন্তু আমি থাকবো না। দিনের আকাশে সূর্য উঠবে, রাতের আকাশে চাঁদ। সেই চাঁদ-সূর্য দেখার সৌভাগ্য আমার হবে না। আমি থাকবো মাটির নিচে। আমার প্রিয়জনেরা আমাকে মাটি চাপা দিয়ে আসবে।
যে বাবা আমার গায়ে ধুলো লাগতে দেননি, যে ভাই মাটিতে পড়ে গেলে হাতে ধরে আমাকে মাটি থেকে তুলেছেন, যে চাচা বসার জন্য আমাকে কাগজ বিছিয়ে দিয়েছেন যাতে কাপড়ে মাটি না লাগে সেই প্রিয়জনেরা কিভাবে আমাকে কবরে মাটির নিচে রেখে আসবেন?
আজ থেকে চৌদ্দশো বছর আগে আমার মতো আরেকজনও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন। যেই রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখলে সাহাবীদের চোখ জুড়াতো, যেই রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) না দেখতে পেলে সাহাবীদের মন আনচান করতো, সেই রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিভাবে সাহাবীরা কবরে রাখলেন?
রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেয়ে ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সাহাবী আনাসকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন, “ও আনাস! রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাটি চাপা দিয়ে আসা তোমরা কিভাবে বরদাশত করলে?” [সহীহ বুখারী: ৪৪৬২]
যেখানে প্রাণের প্রিয় রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীরা মাটি চাপা দিয়েছেন, সেখানে আমাকে মাটি চাপা দিতে আমার আপনজনের কী এমন কষ্ট হবে! আমার মৃত্যুর সাথে সাথে চারিদিকে শুধু একটা প্রশ্নই শোনা যাবে- জানাজা কখন? কবর দেওয়া হবে কোথায়? সবার আগে আমার আপনজন তাড়াহুড়ো শুরু করে দিবে। আমাকে মাটির ঘরে রেখে আসার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
গরমের দিন বিছানায় না ঘুমিয়ে একটু আরামের জন্য ফ্লোরে ঘুমাতে গেলে মা বলতো- “উঠ বাবা, ঠাণ্ডা লাগবে, বিছানায় যা।” মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে ঘুমাতে কষ্ট হবে ভেবে মা আরেকটা বালিশ দিয়ে যায়। মৃত্যুর পর সেই আমাকে রেখে আসা হবে বিছানা, বালিশ ছাড়া মাটির নিচে?
পূর্ণিমারাতে চকোর পাখির মতো আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি। জোছনার আলোয় স্নান করার পর পাশের বেলীফুলের গন্ধ যখন নাকে আসে, তখন হঠাৎ মনের মধ্যে একটা শঙ্কা জেগে ওঠে। আমি তো সুন্দর জোছনা দেখছি, ফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছি, কিছুদিন পর তো আমি মারা যাবো। তখন কিভাবে জোছনা দেখবো? দেখলাম আমার বিরহে সুর মেলালেন এক আরব কবি। নাম তার ইলিয়া আবু মাদ্বির।
তার কবিতাটির নজীবানুবাদ হলো:
ফুলের পৃথিবী ছেড়ে একদিন মাটিতেই ঠাঁই হবে
আকাশে থাকবে জোছনা, অথচ কবরে আঁধার রবে।
আমার মৃত্যুর পর সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে, আমার মতো অনেক জোছনাপ্রেমী জোছনা উপভোগ করবে। ফুল ফুটবে, মৌমাছি ফুলবাগানে নাচবে। অথচ আমি থাকবো না। পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে এই হাহাকারে যখন আমার চোখ বেয়ে পানি ঝরে, তখন আমার রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশার বাণী শুনে আমি আবার চনমনিয়ে উঠি।
নবীজি বলেন, “মুমিন তার কবরে সবুজ উদ্যানের মধ্যেই থাকবে। কবরটা তার জন্য সত্তর গজ প্রশস্ত হয়ে যাবে। পূর্ণিমা রাতের পূর্ণ চাঁদের মতো আলোয় ভরে যাবে তার কবর।” [সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩১৯৯]
এ যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে, ‘আরিফ, তুমি জোছনা দেখতে গিয়ে হতাশ হচ্ছো? কবরে ফুলের ঘ্রাণ পাবে না বলে মন খারাপ করছো? আরে, মুমিন হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তো তোমার কবরটাই হবে বাগান আর জোছনাবিলাস তো তুমি কবরে গেলেও করতে পারবে।’
আশার বাণীর পাশাপাশি নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে কবরের আযাবের ব্যাপারেও সতর্ক করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক নামাজে নামাজে যেন আমরা চারটি জিনিস থেকে রক্ষা পাওয়ার দু’আ করি। তারমধ্যে একটি হলো কবরের আযাব। [সহীহ মুসলিম: ১২১১]
আজ যে আরামের বিছানায় আমি ঘুমাচ্ছি, এভাবে কয়দিন আর ঘুমাবো? রাতের বেলা কবরের পাশ দিয়ে যাবার সময় বুকটা ধ্বক করে উঠে। একা একা যে জায়গায় যাবার সময় গা শিরশির করে, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত সেই ‘ভয়ঙ্কর’ জায়গায় আমাকে থাকতে হবে। সাপ যদি দংশন করে আমার চিৎকার কবরের পাশে দাঁড়ানো কেউ শুনতে পাবে না। অথচ আমি সামান্য পিঁপড়ার কামড় সহ্য করতে পারি না।
মৃত্যুর পরের জীবনটা যেখানে কাটাবো, সেই জায়গাটি কেমন হবে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “কবর হলো জান্নাতের উদ্যানসমূহের একটি উদ্যান অথবা জাহান্নামের গর্তসমূহের একটি গর্ত।” [জামে আত-তিরমিজি: ২৪৬০, ইবনে হাজার আসকালানী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]
ধুলোর বিছানায় আমি ঘুমাই না। অথচ কতো শতো বছর যে আমাকে থাকতে হবে মাটির নিচে। আমার কবরের উপর ঘাস উঠবে, ফুল ফুটবে। কবরের ভেতরটা কী হবে- জান্নাতের উদ্যান নাকি জাহান্নামের গর্ত? আল্লাহই জানেন! আল্লাহ! এমন মৃত্যু দিও যেন চোখ বুজলেই জান্নাত পাই!
[এই লেখাটি লিখতে ‘জোছনাফুল’ পড়ে ইন্সপায়ার্ড হই]
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।