রেদওয়ান রওয়াহা |
১.
নিহাল ছেলেটা বেশ একরোখা। কাউকে মানে না, কাউকে গোণেও না। বয়স বেড়েছে। শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পদার্পণ শেষে এখন ঝলমলে তারুণ্য চলছে তার জীবনে। তবুও তার চিন্তা-চেতনা ও আচরণে ভারসাম্য আসেনি বিন্দুমাত্রও। কলেজে উঠে তো আরো মারাত্মক লেভেলের এগ্রেসিভ আচরণ শুরু করেছে সে।
আজ মোহনের সাথে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ক্যাম্পাসের দিকে যাওয়ার সময় নাঈমের সাথে দেখা। নাঈম চলছে রাস্তার অপর পাশ দিয়েই। মোহন ওরে ডাক দিয়েছে নিজেদের দিকে। কাছে আসতেই মোহন কষে এক চড় বসিয়ে দিলো তার গালে। মোহন সিগারেটের ধোঁয়া ছুড়তে লাগলো তার মুখে। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি সে, একেবারে পুরোপুরি ‘থ’ বনে গেলো নাঈম। আশ্চর্য না হলে হয়তো সে এমন চড়ের চোটে ব্যথায় ককিয়ে উঠতো। ভীষণরকম আশ্চর্য হওয়ার সময় মানুষ হয়তো বড়ো বড়ো আঘাতেও ব্যথা পায় না।
নাঈম মূলত কলেজে নতুন। আজই ক্লাস করতে আসছে। পাড়ার সবচেয়ে ভদ্র ছেলে। পুরোদমে বইপোকা। সময় কাটানোর জন্যেও বাহিরে কোনো রকমের আড্ডায় জড়ায় না। বই আর পড়াশোনাই হলো তার পৃথিবী। পৃথিবীতে তার সবচেয়ে ঘৃণিত গন্ধ হলো সিগারেটের গন্ধ, আর সবচেয়ে প্রিয় গন্ধ হলো নতুন বইয়ের মোহনীয় ঘ্রাণ। ছোটোবেলা থেকেই সে সিগারেট ঘৃণা করে। তাই সিগারেট টানা কোনো মানুষের কাছেই সে ভিড়ে না। ভিড়তে চায় না।
নাঈমের সাথে ওদের এমন আচরণ দূর থেকে প্রত্যক্ষ করলো তাহমীদ। তাহমীদ ছেলেটার আচার-আচরণ ভীষণরকম ভালো। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে ভালোভাবে, ভালোবাসে। নিহাল-মোহনের মতোন ছেলেগুলো তাকে দেখতে পারে না। তবে সামনা-সামনি খারাপ আচরণও করে না অতোটা।
তাহমীদ কাছে এসে বিষয়টা জিজ্ঞেস করলো, এখানে কী হয়েছে? মোহন চট করে জবাব দিলো, “ভাই, এই ছোকরাটা আমাদের দেখেও সালাম করেনি।” কত্তো বড়ো বেয়াদব দেখছেন?
মোহনের অভিযোগ শুনে নাঈম তো পুরোই তব্দা খেয়ে গেলো। কী সব যে বলে, সালাম না দেয়াতে এমন আচরণ! অথচ সালাম দিতে তো খুবই অভ্যস্ত সে। এরা সিগারেট টানে বলে সে এড়িয়ে গেলো। স্রেফ এতোটুকুনই তো।
২.
কলেজের পশ্চিম উত্তর পাশে মস্ত বড়ো একটা দিঘি। দিঘির পানির ওপর জারুল গাছের ছায়া এসে পড়ে। জারুল গাছটা দীঘির পূর্ব পাশেই। নিচে ছলাৎ ছলাৎ পানির ঢেউ। ওপরে শোভন-সুন্দর জারুল ফুল। কী দারুণ এক পরিবেশ! মায়াবী এক মোহনীয়তার ছড়াছড়ি। দিঘির জলের শান্ত ঢেউ। জারুল গাছের ছায়া। সব মিলিয়ে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের এই তীব্র গরমে একটুখানি প্রশান্তির আবেশ পেতে আর কী লাগে।
প্রচণ্ডরকম গরমে হাত-মুখ ধুয়ে মাথায় পানি দিয়ে জিরোতে বসে বাদামের খোসা খুলে খুলে মুখে পুরে দেয়ার মজাই তো অন্যরকম। আশেপাশে ছাত্র-ছাত্রীরা জোড়ায় জোড়ায় বসে বসে এসব বিষয়গুলো উপভোগ করে। একে অন্যের জন্য গল্পের ঢালি সাজিয়ে নিয়ে বসে থাকে যেনো।
তাহমীদ আবার ব্যতিক্রম। তাঁর সম্পর্ক-চলাচল আলিমদের সাথে। মসজিদের খতিবদের সাথে তার নিয়মিত উঠাবসা হয়। দারুণ রকমের সখ্যতা তাদের সাথে। ছেলেটা আবার দারুণ এক সুদর্শন যুবক, ডাবের মতো গোলগাল চেহারা। মাথা ভর্তী কুচকুচে কালো চুল। চওড়া কাঁধ। লাল-সাদা গায়ের রঙ। অসংখ্য সব সুন্দরী মেয়েরা তাকে অনেক প্রপোজ করেছে সম্পর্কে জড়াবার জন্যে।
তার চেহারা সুরাত যেমন সুন্দর তারচে’ ঢের বেশি সুন্দর চরিত্র। কুরআনের নির্দেশ হলো মু’মিন পুরুষেরা যেনো তাদের চক্ষুকে অবনমিত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। [১] আল্লাহর ভয়-ভালোবাসায় ভরপুর তার হৃদয়ের মণিকোঠা। তাই সে কোনো হারাম সম্পর্কে জড়ায়নি। যাই হোক জারুল গাছটার সামনের দিকটায় মানুষ অতো একটা বসে না। তাই জায়গাটা খালি। নিহাল-মোহনদের নিয়ে সে তাই এখানটাতেই বসেছে।
৩.
শুনো নিহাল, সালাম দেয়াটা হলো নবীজি সল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ। এই সুন্নাহ সকলেই পালন করতে পারে। বড়োরাও ছোটোদের সালাম করতে পারে। এটা দূষণীয় নয়। বরং নবিজী স. এটা করেছেনও। [২] তবে আদব হলো ছোটোরা বড়োদের, দাঁড়ানো ব্যক্তি উপবিষ্ট ব্যক্তিকে সালাম করবে। [৩] এই আদব কেউ রক্ষা না করলে তাঁকে পিটিয়ে, চড়-কিল-ঘুষি মেরে, বকা দিয়ে তা করাটা অভদ্রতা। বর্বরতা। অনুচিত।
আমরা যেহেতু মুসলিম তাই এটা আমাদের জন্য ইসলামের শিক্ষার বিপরীত কর্ম। সে তোমার ছোটো। রাজনৈতিক ক্ষমতাও নেই তার। কোনো দলের সাথেও জড়িত নয় সে। এখন সে পুরোপুরিই দুর্বল। তুমি এখন তার প্রতি যা করেছো জুলম করেছো। ক্কিয়ামতের মাঠে এই যে জুলম, এটা অন্ধকার হয়ে তোমার জন্য আবির্ভূত হবে। [৪]
একটা অবোধ প্রাণীর প্রতিও যদি অন্য কোনো অবোধ প্রাণী জুলম করে তারও বিচার হবে। হাশরের মাঠে। আল্লাহর আদালতে। কাউকে কোনো বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড়ও দেয়া হবে না [৫]।
আর তোমরা যা করেছো তা জুলমের পাশাপাশি অহংকারও বটে। শুনো ভাই, অহংকার হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার চাদর। [৬] এই চাদর নিয়ে টানাটানি করাটা মোটেও ঠিক না। মারাত্মক রকমের একটা জঘন্য কাজ তা। বলো তো তোমার গায়ের যে জামাটা তুমি পরিধান করে আছো, যে চাদরটা তুমি হাড়কাঁপানো প্রবল শীতের প্রকোপে পরিধান করো, তা নিয়ে যদি কেউ টানাটানি করে তখন তা কি তোমার সহ্য হবে? ক্যামন লাগবে তখন তোমার? আর একই বিষয় তো তুমি তোমার রব্বুল আলামীন আল্লাহর সাথেই করছো! কী ভয়ংকর কাজ, ভাবতে পারো!
জানোই তো প্রিয় ভাইয়া আমার! আল্লাহর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন কথা শুরুর পূর্বে সালাম দিয়ে শুরু করতে। [৭] আগে আগে সালাম দিতে। [৮] সালামের ব্যাপক প্রচলন করতে । [৯] এবং একটা গাছের আড়াল হলেও আবার পূনরায় সালাম করতে। [১০]
নিচের দিকে তাকিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে ওরা একাধারে কথাগুলো শুনেই যেতে লাগলো। তাহমীদের সামান্য সময়ের নিরবতায় ওরাও যেনো সম্বিত ফিরে পেলো।
তাহমীদ গলাটা একটুখানি ঝেড়ে আবারো বলতে শুরু করলো, দেখো ভাই, আমরা নিজেদেরকে মুসলিম হিশেবে পরিচয় দিই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত দাবী করি। অথচ তাঁর শিক্ষা তাঁর আদর্শের ছিঁটেফোঁটাও আমাদের মাঝে নেই। প্রচলিত নোংরা রাজনীতির নিচু মানুষদের নষ্ট আদর্শ আমাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে আমরা লালনপালন করি, ধারণ করি। আদর্শ হিশেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামের বিকল্প আর কে আছে, কে হতে পারে?
প্রিয় ভাইয়েরা আমার! পবিত্র কুরআন মাজিদ খুলেই দেখো না, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা স্পষ্ট করে তো বলেই দিয়েছেন যে, “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম হলো আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।” [১১] অথচ আমরা সেই মহৎ ও মহান মানুষের আদর্শটাকেই ফলো করছি না। ওনাকে বাদ দিয়ে আমরা মানছি হাবিজাবি কতোশতো মানুষ আর তাদের নির্জীব মরা অকেজো দুর্বল আদর্শ।
বলো তো ভাই, আমরা তাহলে কীসের মুসলিম? কীসের শিক্ষিত? আমরা যে শিক্ষা অর্জন করতে কলেজে এসেছি, সে শিক্ষা যদি আমাদের জীবনে পরিবর্তনের ফলগুধারা বইয়ে দিতে না পারে তাহলে কী লাভ এমন শিক্ষা অর্জন করে? এই যে শিক্ষা, এ শিক্ষা তো আমাদের জীবনে কিছু কাগুজে সনদের বোঝা ভারি করা ছাড়া আর কোনো উপকারই করছে না।
৪.
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আগুন ধরাতে ধরাতে মোহন বলে উঠলো, ভাই দিলেন তো ভালোই বয়ান মেরে, অনেকক্ষণ আপনার বয়ান শুনছি আর না। কলেজ-ইউনিভার্টিতে আসবে পড়বে, পোলাপান থিকা একটু সিনিয়রটি নেবো না, কথা কইলেন একটা।
তাহমীদ বললো, শুনো মোহন, তুমি কি জানো সিনিয়র-জুনিয়রের এক চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ নির্দেশনা আছে মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের? তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়োদের সম্মান করে না সে আমার উম্মত নয়।” [১২] মোহন দাঁড়িয়ে বললো, “চল নিহাল! জাইগা এখান থিকা।”
নিহালের চোখজোড়া অনুতাপের অশ্রুতে সজল হয়ে উঠেছে। অশ্রুতে টলমল করছে আঁখিদ্বয়। চোখের পাতার চাপ পড়তেই দু’গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর দু’টো ধারা। তার এই অবস্থা দেখে মোহন বলতে লাগলো, “আরেহ নিহাল, ভাইয়ের বয়ানে দেহি তোর ব্রেইন ভালোই ওয়াশ হইছে। হা হা…. তুই থাক আমি গেলাম। সিগারেটের ধোঁয়া উপরের দিকে বাতাসে ভাসিয়ে দিতে দিতে হাঁটতে লাগলো মোহন।
মোহনের এমন আচরণের জন্য কলেজের অন্য কেউ হলে মানতে পারতো না। কষে চড় বসিয়ে দিতো গালে। কিন্তু তাহমীদ কিছুই করেনি, বলেওনি। তবে একরাশ আফসোসের ঢেউ বুকে এসে আঁচড়ে পড়লো তার বুকের ভেতর। তবে সেটা তার সাথে খারাপ ব্যাবহারের আফসোস নয়। আফসোস হলো এতো সুন্দর করে বুঝানোর পরেও ছেলেটা উগ্রতা প্রদর্শন করে অবজ্ঞা করে যে চলে গেলো, সে জন্য।
এদিকে নিহাল তাহমীদকে জড়িয়ে ধরে বললো সরি ভাইয়া। আমি এতটা জানতাম না। বুঝতাম না। যতটুকুন জানতাম তাও এতটা দরদের পরশ নিয়ে আমায় বুঝায়নি কেউ! আজ আমি বুঝতে পেরেছি। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শকেই অনুসরণ করবো। কথা-বার্তা, চালচলনে, আচার-আচরণে। ইন শা আল্লাহ।
নাঈমও নিহালকে সরি বললো, তাহমীদকে বললো ভাইয়া আমার জন্যই এতো কিছু। আমার জন্যই আপনি সিনিয়র ভাই হয়েও খারাপ আচরণ পেলেন মোহনের কাছ থেকে। আমি দুঃখিত ভাইয়া।
তাহমীদ মুচকি হেসে বলে উঠলো, “দূর বোকা, আমাদের নবিজি (স.) তো মানুষকে সত্য আর শুদ্ধতার আহ্বান করতে গিয়ে আরো অনেক অনেক বেশি লাঞ্ছিত হয়েছেন। আমার তো কিছুই হয়নি। এটা তো কোনো ব্যাপারই নাহ।
নাঈমও এবার দৃঢ়তার সাথে বলে উঠলো, “ভাইয়া আমিও আজ হতে রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করবো; একজন আদর্শ মানুষ, আদর্শ শিক্ষক হিশেবে।” তাহমীদ ছোট্ট আওয়াজে বলে উঠলো, ‘ইন শা আল্লাহ।’
রেফারেন্স: –
[০১] সুরা নুর-৩০
[০২] সহীহ্ মুসলিম ৩৯/৫, হা: ২১৬৮] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৮০৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৭০০, সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬২৪৭
[০৩] আদাবুল মুফরাদ। হাদিস নং-১০১০
[০৪] সহীহ্ মুসলিম- ৬৭৪১
[০৫] মুসনাদে আহমাদ: ২/৩৬২]
[০৬] সহীহ মুসলিম-৬৫৭৪
[০৭] আদাবুল মুফরাদ ১০১৮
[০৮] আদাবুল মুফরাদ ১০০৩
[০৯] তিরমিজি ১৮৫৫
[১০] সহীহুল বুখারী ৭৫৭, ৭৯৩, মুসলিম ৩৯৭ তিরমিযী ৩০৩, নাসায়ী ৮৮৪
[১১] সুরা আল আহযাব-২১
[১২] মাজমাউয যাওয়াইদ: খ.৮, পৃ.১৪
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।