আমিনা জান্নাত |
অন্যান্য সো কল্ড মুসলিম পরিবারের মতো আমাদের পরিবারেও ছেলে মেয়ে কাজিনদের অবাধ মেলামেশা। এখানে সবাই ভাই বোন হিসাবে মিশে, এক সাথে গায়ে গা লাগিয়ে লুডু খেলার আসর বসে, হাসতে হাসতে ছেলেদের গায়ে পড়ে মেয়েরা। তারা তো ভাই-বোন, পর্দাতো বাইরের পুরুষদের জন্য!
আমি সায়বা। আমার এক ফুফাতো ভাই আছে। আমার সমবয়সী। তারা থাকতো ঢাকা আর আমরা কুমিল্লা। ঈদ বা গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদের দেখা হতো। ছোটবেলা থেকেই তার থেকে দূরে থাকতাম, কখোনো একসাথে খেলিনি। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে একই ক্লাস, এক বিভাগ, তাছাড়া সে খুব ভালো ছাত্র ছিলো বলে পড়ালেখা নিয়ে টুকিটাকি কথা হতে থাকে।
২০১৬ সাল। সে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হলো। সারাদিন চ্যাট করতাম আমরা। যা হবার হলো, প্রথমে ভালো বন্ধুত্ব তারপর প্রেম। আমরা তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সে যা-ই করতো, তার পড়ালেখাটা ঠিক রাখতো। কিন্তু আমি সবকিছুতে ফাঁকি দিতে থাকলাম। এমনকি আমার পরিবর্তন, পড়ালেখায় উদাসীনতা আমার শিক্ষকরা খেয়াল করতেন, বকা দিতেন। আমার স্বপ্ন ছিলো মেডিকেল, ভালো রেজাল্ট ছিলো আমার।
ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল খারাপ হবার পর আমি সিদ্ধান্ত নেই আমি তার থেকে এক বছর বিরতি নেব, অনার্সের পর আবার যোগাযোগ করব। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হলো না, সে আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে থাকলো এটা বলে যে, তার পক্ষে একটা দিনও আমাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব! প্রচন্ড ভালোবাসতাম তাকে, তার সব আবদার মেনে নিতাম।
আমাদের অভিভাবকদের মধ্য কাজিন-কাজিন বিয়েতে প্রচুর অনীহা আছে কারণ, ভাই-বোন বলে কথা! আমি তাকে প্রায়ই বলতাম, আমাদের পরিবার এই বিয়ে মানবে না। সে বলতো, “বিয়েতে তো অনেক দেরী। ততদিনে আমরা বড় হবো, আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকবে। তুমি দেখে নিও সবাই সব মানবে সিওর”।
ফাইনাল হয়ে গেলো। আমরা ঢাকায় কোচিং করতাম। আমি মেডিকেল আর সে ইঞ্জিনিয়ারিং। ফোনে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি দেখাও হতো আমাদের। ইন্টারের ফলাফল দিলো। সে পেল এ প্লাস আর আমি এ পেলাম। সে খুব আফসোস করেছিলো আমার ফলাফল নিয়ে। ফল খারাপ হবার কারণে আমার আর মেডিকেল পড়া হলো না। আমার বাবা আমার এই ফলাফলে খুব রাগ করে আমাকে অন্য কোথাও ভর্তি হতে দেননি। আমি আমাদের শহরেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা কলেজে ভর্তি হলাম। সে চান্স পেয়ে গেলো একটা প্রথম সারির প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২০১৮ সাল। ভার্সিটিতে ভর্তির পর থেকে সে আমাকে ইগনোর করতে থাকলো। সে সময় যত কেঁদেছি ততটা যদি রবের জন্য কাঁদতাম! আফসোস! সারারাত কেঁদে কেঁদে কত চোখ ফুলিয়েছি!
আমার দাদা একজন সো কল্ড আলেম। আমাদের বংশের অনেকেই মাদ্রাসার ছাত্র। এমনকি আমার বয়ফ্রেন্ড একজন হাফেজ, তাছাড়া সে ঢাকার নামকরা একটি মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। আমাদের বাসার ভেতর পর্দা না থাকলেও বাইরে সবসময় বোরখা-নিকাব পরতাম। আত্নীয়-বন্ধু বান্ধবের বাইরে পর্দার নিয়ম ছিলো। আমাদের বাসায় হালকা-পাতলা ইসলাম চর্চা হতো, যদিও বাসায় একটা কুরআনের অনুবাদ পর্যন্ত ছিলো নাহ! আমারও ইসলামে কিছুটা আগ্রহ ছিলো।
আমি একটা ইসলামী ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করলাম। গ্রুপে হারাম সম্পর্ক নিয়ে লেখা পোস্টগুলো ছিলো আমার হিদায়াতের কারণ। যখন আমি জানলাম, আমি এতদিন যিনা করে এসেছি তখন আমি ঠিক করলাম এসব ছেড়ে দেব। একদিন আমি তাকে বললাম, “আমি এই রিলেশনে বিরতি চাই, আমরা কোন যোগাযোগ রাখব না, কিন্তু আমি তার জন্য অপেক্ষা করব, পড়ালেখা শেষে আমরা হালাল ভাবে বিয়ে করব।” সে বলে দিলো, “সে আর রিলেশন রাখতেই চায় না কারণ, আমাকে তার আর আগের মতো ভালো লাগে না, তাছাড়া তার পরিবার সম্পর্কটা মানবে না, আগে সে প্রেমে অন্ধ ছিলো, কিন্তু এখন ভার্সিটিতে উঠে সব বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে।”
ব্রেক আপ হয়ে গেল। তার শেষ কথাগুলো আমাকে খুব যন্ত্রণা দিতো। যার জন্য আমার স্বপ্নগুলো শেষ হলো সে এমন করলো শেষ পর্যন্ত! কিন্তু আমার ঐ ইসলামী গ্রুপটির উসিলায় আল্লাহ সব ঠিক করে দিলেন। খুব সুন্দর পোস্ট হতো গ্রুপে। “যে ভালোবাসা আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়, সেটার পরিণতি সবসময় কষ্টদায়ক। আর যে ভালোবাসা আল্লাহর খুশির জন্য, সে ভালোবাসা আল্লাহ স্থায়ী করে দেন”।
“মানুষকে ভালোবাসলে কষ্ট পাওয়া যায় কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় শুধুই প্রশান্তি!”। “মানুষকে খুশি করার চেয়ে আল্লাহকে খুশি করা সহজ”। এই পোস্টগুলো এবং বোনদের দ্বীনে ফেরার গল্পগুলো আমাকে আল্লাহর দিকে পরিপূর্ণভাবে ফিরতে খুব সাহায্য করেছে। যারা পোস্টগুলো করেছেন, আল্লাহ তাদের জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন!
আমি আল্লাহকে ভালোবাসতে থাকলাম। নন মাহরামদেরকে আনফ্রেন্ড করে দিলাম, কয়েকজন ছেলে ক্লাসমেটের সাথে কথা বলা অফ করায় তারা খোঁটাও দিয়েছে আমার অতীত নিয়ে। শরীরের গঠন বোঝা যায় না এমন বোরখা পরতে থাকলাম, জোরে হাসা, কথা বলা বাদ দিলাম। নামাজে মনোযোগ দিলাম, নিজের বিভিন্ন আমল ঠিক করলাম, তওবা করতে থাকলাম রবের কাছে। তাফসীর, বাংলা মিনিংসহ কুরআন পড়তাম নিয়মিত।
যখন মানুষের খোঁটা, অতীতে হারানো অগনিত স্বপ্নের কথা, অতীতে করা হাজারো পাপের কথা ভেবে কষ্ট লাগতো তখন কুরআন পড়ছি আর আমার রব তার সুন্দর কথা দিয়ে আমার অশ্রুগুলো মুছে দিতেন আলহামদুলিল্লাহ।
ফেসবুকে সব ফালতু পেইজ আনলাইক করে ইসলামী গ্রুপ, পেইজ, রাইটারদের পোস্ট, ইসলামী বইগুলো নিয়মিত পড়তাম, বান্ধবী-ভাই-বোন-মাকে দাওয়াত দিতাম অনলাইন-অফলাইনে। একসময় ইসলামী জ্ঞান এতো ভালো লাগতে লাগলো যে ক্লাসের পড়াগুলো অর্থহীন লাগতো। যারা মাদ্রাসায় পড়ে তারা কত ভাগ্যবান কিন্তু তারা সবাই প্রকৃত আলেম হয় না। আফসোস!
আমার বান্ধবীরা আমাকে দ্বীন মানতে খুব সাহায্য করেছে। বাসায় অন্য আমলগুলো করতে তত কষ্ট করতে হয়নি যতটা হয়েছে পর্দা করতে। শুরুতেই বলেছি, পরিবারে নন মাহরামদের সামনে পর্দার রীতি নেই। বাসায় কাজিনরা, নন-মাহরাম এলে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে এক রুম থেকে অন্যরুমে যেতে হতো, এক টেবিলে খেতে হতো,তাদের সাথে কুশল বিনিময় করতে হতো।
ছোটবেলা থেকে বাবাকে ভীষণ ভয় পাই। যতবার নন-মাহরাম থেকে পালানোর চেষ্টা করতাম, বাবার ধমক খেয়ে আমি আর আমার বোন ভয়ে নন মাহরামদের সামনে যেতে বাধ্য হতাম। একদিন ঠিক করলাম, সামনে যেতে হলে যাব কিন্তু তাদের দিকে তাকাবো না, কথাও বলবো না, এমন ভাব করবো যেন চিনিই না। এটাই করতে থাকলাম। ফলে নন মাহরামরা আমাদের সাথে কথা বলার, দেখা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেললো।
বাবাকে বোঝানো খুব কঠিন। কারণ, বাবার কাছে বসে দ্বীনের আলাপ করার সাহস আজও হয়নি আমার। ঠিক করলাম মা কে টার্গেট করি। আমার মা ইসলামী পরিবারের মেয়ে। নানা বাড়িতে পর্দা পরিপূর্ণভাবে মানা হয়, কিন্তু আফসোস মা দাদা বাড়িতে পর্দা ধরে রাখতে পারেননি পরিস্থিতির চাপে। মা আমার খুব সহজ সরল। মাকে বোঝানো খুব সহজ।
মাকে পর্দার বিভিন্ন বিধান, না মানার ফলে শাস্তি বিষয়ে বিভিন্ন পোস্ট,হাদীস পড়ে শোনাতাম। যে ইসলামী বইগুলো আমি পড়তাম সেগুলো মাকেও পড়তে দিতাম। সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে “দাইয়ুস” এর কনসেপ্টটা। মা, নানা আর মামাদেরকে খুব ভালোবাসেন। মা ছিলেন মরহুম নানা ভাইয়ের সবচেয়ে আদুরে কন্যা। মাকে যখন বলি, “আমাদের বেপর্দা থাকার কারণে আমার বাবা-ভাই, আর আমাদেরকে পর্দা করতে সাহায্য না করলে মায়ের কারণে নানাভাই-মামা দাইয়ূস হবেন।
নবীজি(সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম ) বলেছেন, “দাইয়ূস জান্নাতে যাবে না”। তাছাড়া পর্দাতো আল্লাহর আদেশ,ফরয কাজ, এটা ঠিকমতো না করলে শাস্তি ভীষণ ভয়াবহ হবে। তখন মা আমাকে পর্দা করতে সাহায্য করতে থাকেন।
একবার আব্বুর এক চাচাতো ভাই এসেছিলো আমাদের বাড়িতে। আমরা দুইবোন আড়ালে পালিয়ে ছিলাম বলে আমার বাবা আর এক ফুফু আমাকে ধমক দিয়েছিলেন, আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াত দিন। সেদিন প্রথম মা আমার এই পরিবারের ভেতর পর্দার পক্ষে ফুফুকে কথা শুনিয়েছেন। আমিও সেদিন সাহস পেয়ে ফুফুকে কিছু হাদীস বলি। যদিও এতে ফুফুর হিদায়াত আসেনি তবুও ভালো লেগেছিলো যে, আমাকে ডিফেন্ড করার জন্য মাকে দিয়েছেন আল্লাহ। তারপর থেকে মা আমাকে সব মাহরামরূপী নন-মাহরামের সামনে পর্দা করতে সাহায্য করছেন, আলহামদুলিল্লাহ!
আমি খুব ভাগ্যবান কারণ,আমার মনে যখন ইসলামের সামান্য একটু নূর জেগেছে, তখনই আল্লাহ আমাকে সহজেই সরল পথে এনেছেন। ঈমানদারের জীবনে কাঠিন্য আর পরীক্ষা অনন্ত। আমিও পরীক্ষা দিচ্ছি। এখন আল্লাহর কাছে চাই যেন তিনি আমাকে একজন প্রকৃত মুমিন জীবনসঙ্গী দেন যে আমাকে ইসলামের পথে ধরে রাখবেন।
আমার অভিভাবকরা যদিও আমার জন্য আধুনিক ছেলে খোঁজ করেন তবুও আমি আল্লাহকেই ভরসা করি, তিনিই উত্তম অভিভাবক। আমার সেসব কাজিনরা এখন আমার সাথে মিশতে চায় না কারণ আমি হুজুরনী হয়ে গেছি। আমি চাই তারাও ভূল পথ থেকে ফিরে আসুক। আল্লাহ যেন তাদের অন্তরকে ইসলামে ফেরান। আল্লাহ যেন আমাদেরকে বেপর্দা সমাজ ও তা হতে সৃষ্ট সকল ফিতনা থেকে হিফাজত করেন। আমিন।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।