ফররুখের শিশুতোষ রচনা

আমজাদ ইউনুস |

বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবতারা কবি ফররুখ আহমদ। অফুরন্ত প্রেরণার প্রদীপ্ত বাতিঘর। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্য বিপুলভাবে লিখেছেন। শিশুতোষ কাব্য রচনায়ও তার নৈপুণ্য লক্ষণীয়। শিশু-কিশোরদের আত্মভোলা জগৎ নির্মল উপলব্ধি ও প্রাঞ্জল হাস্যময়তায় কবি জীবন্ত করে তোলেন।তাঁর কবিতায় শব্দেরা শিশিরভেজা চোখের মতোন ঝলমল করে।তাঁর রস টইটুম্বুর কলম থোকায় থোকায় শব্দ-মিঠাই বিলিয়েছে কিশোর-উঠোনে।

শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনায় কবি ফররুখ আহমদের অবদান কলেবরের দিক থেকে যেমন বিপুল, গুণগত মানের দিক থেকেও তাঁর শিশুতোষ ছড়া-কবিতা উৎকৃষ্ট ও অসাধারণ। শিশুসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায় ও নজরুলের পাশাপাশি ফররুখের অবদানও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। কবি ফররুখের ছড়া-কবিতায় রয়েছে শতমূলী লতা,কাঁটাগোলাপ, সেঁউতির ঝোপ, ঢাউস সাইজের ঘুঘু, পরিযায়ী হাঁস চেনা-অচেনা পাখি, হিজলের বিশাল বন,দিগন্ত পর্যন্ত সবুজ গালিচার মতো বিছানো দূর্বা-শ্যামল মাঠ,বিলের রূপালি জলরাশি, গ্রামবাংলার গুল্মময় পুষ্পিত বিলের প্রান্ত-ঘেঁষা নুয়ে পড়া তালগাছ, শেষপ্রান্তে মেঘালয় পর্বতের নীলাভ তরঙ্গমালা, প্রকৃতির মিষ্টি মধুর জল রঙ, রং-তামাশা এবং শিশুমনের বিচিত্র কৌতূহল-উদ্রেকর কথা।

শিশু সাহিত্যে এসব ছড়া-কবিতার সৃষ্টিতে এর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর কবিতায় যে বৈশিষ্ট তাঁকে অমর করে রেখেছে তার সৃষ্ট স্নিগ্ধ অনুরণিত শব্দময় উপমা এবং মেঘডুম্বুর ছন্দ-ধ্বনি। দীপ্তিময় শব্দ ও আত্মগত রুহানি নূর। শিশুদের কবিতায় তিনি ছাপ রেখেছেন শিশুতোষ হৃদয়ের সহজ-সরল কল্পনা রাজ্যে কথার ঝলমলে মণি-মাণিক্যে।

কবি ফররুখ আহমদ তাঁর ছড়া নির্মাণে অন্তমিল রেখেছেন শক্তিশালী ছন্দজ্ঞানে। তাঁর ছড়ায় ছিল না পাংশু বর্ণের এলোমেলো ও আলুথালু ভাবচিন্তা। শব্দ যেমন কমনীয় ও অতুলনীয় তেমনি দৃঢ়। তাঁর নিজ পবিত্রগুণের ঋজুতা ও দৃঢ়তার ছাপ রয়েছে তাঁর ছড়া ও কবিতার ছত্রে ছত্রে। সবচেয়ে বড় বিষয়, তাঁর ছড়া কবিতায় ছিল বিশ্বাসের দীপ্ত দ্যুতির ঝলকানি।

কবির প্রথম শিশু-কিশোর কাব্যগ্রন্থ ‘পাখির বাসা’। প্রথম প্রকাশিত হয় ১০৬৫ সালে বাংলা একাডেমী থেকে। এটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের নিকট বিপুলভাবে সমাদৃত হয় এবং এজন্য কবি ১৯৬৬ সনে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। বইটি উৎসর্গ করেন শিশু-কিশোরদের নামে। উৎসর্গিত সেই পঙক্তিটি হলো-
নতুন মানুষ এল যারা
খোদার দুনিয়াতে,
ছোট্ট আমার ‘পাখির বাসা’
দিলাম তাদের হাতে।

এতে স্থান পেয়েছে ঘুঘু, বক, পেঁচা, গাঙশালিক, বাবুই, টিয়ে, ফিঙে, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, মোরগ, হাঁস, কবুতর, চড়ুই, সাতভায়রা, দোয়েল, কোকিল, শালিক, ময়না, চিল, কাক, শাহবাজ, আবাবিল পাখী, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, কাগাবেগা, পেঙ্গুইন, টুনটুনি ও কুটুম পাখিসহ আরো অন্যান্য পাখির বর্ণনা। একেক পাখির বাসা একেক ধরণের। খড়-তৃণগুচ্ছ দিয়ে কেউ বাসা বানায় লতাপাতার ঝোপে,কেউ বড় গাছের মগডালে বা গাছের কোটরে। পাখিদের বৈচিত্র এ বাসস্থানকে কবি ছন্দের তুলিতে চিত্রিত করেন এভাবে-
আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া
দিনটাতে,
পাখির বাসা খুঁজতে যাব
এক সাথে।
কোন্ বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন্ বাসাটায়
কোন্ বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝ রাতে।
ঝিলের ধারে ঝোঁপের মাঝে
কোন্ বাসাটা লুকিয়ে আছে
কোন্ বাসাটায় বাবুই পাখির
মন মাতে
নদীর ধারে নিরালাতে
গাঙ শালিকের বাস যেটাতে
রাত্তিরে সে থাকে, এখন
নেই যাতে॥

বর্ণ দিয়ে শব্দ, শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। বর্ণমালা শিখতে হয় মায়ের মুখ থেকে। বইয়ের পাতা থেকে। সেই বর্ণমালা যদি কেউ ছন্দে ছন্দে শিখান বা পড়ান তখন কেমন লাগবে। অবশ্যি শিশুদের জন্য তা হবে সুখপাঠ্য। কবি ফররুখ আহমদ তাঁর দ্বিতীয় ছড়াগ্রন্থ ‘হরফের ছড়ায় ‘ ছন্দে ছন্দে চমচম-রসমলাইয়ের মত বাংলা বর্ণমালা শিশু-কিশোরদের মুখে তুলে দেন।

‘হরফের ছড়া’ একটি পরিকল্পিত ও সুলিখিত ছড়াগ্রন্থ। কবির কল্পনাপ্রবণ কবিমন শিশুর সহজগ্রাহ্যতা সম্পর্কেও যথোচিত সচেতন ছিলেন। বর্ণ দিয়ে শব্দ তৈরি এবং শব্দ দিয়ে কথামালার বিন্যাসে তিনি অসাধারণ কুশলী ছান্দসিক কবি হিসাবে নিজের নৈপুণ্য প্রকাশ করেছেন। শিশুরা ছন্দের তালে তালে অবলীলায় পাঠে মনোযোগী হয়ে আনন্দে ও চিত্তের বৈভবে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। পাঠের সাথে সাথে তার মন নৃত্যচপল, ছন্দনূপুর হয়ে ওঠে। আনন্দ-বৈভবে সে পরিচিত হয় বর্ণমালার সাথে।

বইটিতে কবি ফররুখ আহমদ শিশুকে বর্ণ-পরিচয় দানের সাথে সাথে প্রতিটি বর্ণ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন।শিশুর একান্ত পরিচিত দৃশ্যপট এঁকেছেন ছন্দের তুলিতে। শিশুর পরিচিত পরিবেশে যেসব ফল-ফুল-পাখি, জীবজন্তু, গাছ-পালা ইত্যাদি সবকিছুর সাথেও ক্রমান্বয়ে কবি শিশুকে জুড়ে অচেনা এক জগতের সাথে। এভাবে বর্ণের সাথে পরিচিত হওয়ার সাথে সাথে শিশুটি তার পরিবেশেকে অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারে। দু’ একটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক,
অ য়ে অতসী-তিসির মাঠ,
অশথ গাছের সামনে হাট,
অলিগলি শহর চাই,
অলিগলি শহর পাই॥
আ য়ে আনারস, আম বাগান,
আসমানী রঙ ফুলটা আন,
আসমানী রঙ মন টানে;
আ যেতে চায় আসমানে॥

সবাই ফুল ভালোবাসে।পৃথিবীতে ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্প্রাপ্য।ফুলের কদর সবখানেই। সবাই চায় ফুলের মিষ্টি সৌরভে নিজেকে সুরভিত করতে, ফুলের স্নিগ্ধ অনিন্দ্য সাজে নিজেকে সাজাতে, ফুলের রঙিন রঙে নিজেকে রাঙাতে। তাই আমরা বাসার ছাদে, ঘরের ব্যালকনিতে মিষ্টি মিষ্টি ফুলের টব রাখি।

ফুল নিয়ে কবিতা লিখেননি, ফুল দিয়ে উপমা দেননি, এমনটা বিরল। সব কবিই কমবেশি ফুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ফুলের সুষমা গায়ে মেখেছেন। উপমায় ফুলের ব্যবহার করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত ফুল নিয়ে কবিরা কত শত-সহস্র কবিতা লিখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাভাষার জনপ্রিয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন-
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!

কাজী নজরুল লিখেছেন-
কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল
টগর যূথী বেলা মালতী
চাঁপা গোলাব বকুল।
নার্গিস ইরানী গুল’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে
আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে।

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ‘হলুদ বরণী’ কবিতা লিখেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’ কবিতাংশটুকু আজ সবার মুখে মুখে। উভয় বাংলাট শ্রেষ্ঠ কবি ও কথাকোবিদ আল মাহমুদ ফুল নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন।
যেমন-
দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুলপাখিরা সব
কাব্য হবে কাব্য হবে জুড়লো কলরব
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে ফুলের কাছে মনের কথা কই।’

ফুলের প্রতি কবি ফররুখ আহমদের টান ও ভালোবাসা ছিলো আরো গভীর। তিনি ফুলকে নিয়ে আস্ত একটা কাব্যগ্রন্থ লিখে ফেললেন ‘ফুলের জলসা’ নামক। ‘ফুলের জলসা’ বইটি শিশু-কিশোরদের জন্য অনবদ্য রচনা। এতে কদম, কেয়া, শাপলা, গন্ধরাজ, শালুক, শিউলি, ঝুমকো-জবা, পদ্মফুল, গাঁদাফুল, জুঁই চাপা, অর্কিড ফুল, ডালিয়া, গুলমোহর, গোলাব, ক্রিসানথিমাম, রক্তকরবী, রঙ্গন, চম্পা, কাটালীচাঁপা, সূর্যমুখী, সন্ধ্যামণি, রাতের ফুল, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা, দোপাটি ও ম্যাগনোলিয়া ফুলসহ আরও নানা ধরণের ফুলের কথা সহজ-সরল ছন্দবদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করেছেন।

কোন সময়ে কোন ফুল ফোটে এবং কোন মাসে কোন ফুল ঝরে সেসব বিষয়ও শৈল্পিক ও নান্দনিক ভাষায় অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছেন।বন হলো রূপবতী রমণী। ঝুমকো জবা যেন তার দুল। ওলোট-পালোট হাওয়ায় হাওয়ায় সেই দুলের দুুলুনি দেখে কবির মনও দুদোল দোলায় দুলে ওঠলো।কবি লিখেন-
“ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠলো ফুটে বনের ফুল
সবুজ পাতা ঘুমটা খুলে
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে
সেই দুলুনির তালে তালে
মন উড়ে যায় ডালে ডালে।”

শৈশবে থুরথুরে বুড়ো দাদুর কোলে মাথা ঠেকিয়ে কত কেচ্ছা-কাহিনী ও গপ্প-গুজব শুনি আমরা। কোনটা বাস্তবিক আবার কোনটা কাল্পনিক। এসব গল্প শুনে-শুনে আমরা স্বপ্নের ভেলায় চড়ে ভেসে ভেসে পাড়ি জমাই সাত সাগর তেরো নদীর তীরে। কবি শৈশবে মা-বাবা হারিয়ে বড় হন দাদুর কাছে। তিনি দাদুকে খুব ভালোবাসতেন। দাদুর কোলে হাসতেন। দাদুর কোলে কাঁদতেন।দাদুর কোলে মাথা ঠেকিয়ে গল্প শুনতেন বড় হয়ে দাদুর সেইসব গল্পগুলো পুঁজি করে কবি রচনা করেন কাহিনীকাব্য।

ফররুখ এর অন্যতম অবদান বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য কাহিনীকাব্য রচনা। “কিসসা কাহিনী, “দাদুর কিসসা”, “সাঁঝ সকালের কিসসা” নামের গ্রন্থগুলিতে তিনি লিখেছেন বিশ্ব সাহিত্যের জনপ্রিয় চরিত্র আলাদিন, সিন্দবাদ, হাতেম তায়ী, আলিবাবা কাহিনীকে ছন্দমিলিয়ে শিশুদের জন্য আকর্ষনিয় করে। কাব্য ছন্দে সুপাঠ্য এই কাহিনীগুলি সহজেই শিশুরা পড়তে এবং রস আস্বাদন করতে সক্ষম। নৈতিক শিক্ষার জন্যও এই কাহিনীকাব্যগুলি উপযোগী।

কবি তাঁর দাদুকে নিয়ে লিখেন –
‘অবাক হলাম দাদুর হাতে
দেখে চুষি কাঠি
ঘোরেন তিনি মারবেল আর নিয়ে দুধের বাটি।
সবাই বলে শেষ বয়সে
আবদারটা চড়া
দাদু বলে আধা বুড়োরা কেন পড়ে ছড়া’।

হিশেব কষলে দেখা যায়, সব মিলিয়ে কবির কিশোর কাব্যের সংখ্যা মোট ২১টি। এছাড়া, কবি স্কুল-পাঠ্য হিসেবে চারটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এতগুলো শিশু-কিশোর গ্রন্থের রচয়িতা হলেও তাঁর জীবনকালে মাত্র ৪টি শিশু-কিশোর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাকিগুলো পাণ্ডুলিপি আকারে পাওয়া যায়।

লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।