ড. মো. হাবিবুর রহমান |
عَنِ الْحَارِثِ الْأَشْعَرِيِّ أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ بِالْجَمَاعَةِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنْ الْجَمَاعَةِ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَا أَنْ يَرْجِعَ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى قَالَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ
অনুবাদ: হজরত হারিস আল-আশআরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, আমাকে পাঁচটি বিষয়ের আদেশ দেয়া হয়েছে। আমিও তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। তাহলো : ১. জামায়াতবদ্ধ জীবন, ২. নেতার আদেশ শোনা, ৩. নেতার আদেশ মানা, ৪. ইসলামের প্রয়োজনে হিজরত করা এবং ৫. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। যে জামায়াত থেকে এক বিঘত পরিমাণ সরে গেল সে তার গলা থেকে ইসলামের রশিটা সরিয়ে ফেললো। যতক্ষণ না সে আবার জামায়াতবদ্ধ জীবনে ফিরে আসে। আর যে জাহিলিয়াতের দিকে মানুষকে আহ্বান করে তাকে জাহান্নামের খড়ি তৈরি করা হবে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.! সে যদি নামাজ পড়ে ও রোজা রাখে? রাসূল সা. বললেন, সে যদি নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে এর পরও সে জাহান্নামি। (মুসনাদে আহমদ)
রাবি পরিচিতি:
নাম: হারিস ইবনে হারিস আল-আশআরী আশ-শামী। কেউ কেউ বলেছেন, হারিস আল-আশআরী আবু মালিক আল-আশআরী নামেও পরিচিত।
তার নামের ব্যাপারে এখতেলাফ আছে। কেউ বলেছেন, হারিস আল-আশআরী, আবু নাঈম ও আবু মালিক একই জন। (উসুদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা) আবু সালাম আল আসওয়াদ বর্ণনা করেছেন, তার নাম ছিলো আবি সালাম মামতুর আল-হাবশী।
কুনিয়াত: তার কুনিয়াত হচ্ছে আবু মালিক। তিনি আবু মালিক নামেই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
জন্মস্থান: তার জন্মস্থান শাম দেশে। তিনি শাম দেশেই বসবাস করতেন। সেখানে তার অনেক বন্ধুবর মানুষ ছিলেন। তিনি সবার কাছে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র ছিলেন।
হজরত হারিস আল-আশআরী বর্ণিত হাদিস সংখ্যা একটা। যে হাদিসকে জ্ঞানের মূল উৎস বলা হয়।
হাদিসের ব্যাখ্যা:
এটি হাদিসে কুদসি, যার কথা আল্লাহর ভাব, বর্ণনা রাসূল সা. এর। এমন হাদিসকে হাদিসে কুদসি বলা হয় যা রাসূল সা. আল্লাহর দিকে নিসবত করে উল্লেখ করেন, অর্থাৎ তিনি তা আল্লাহর কথা হিসেবে বর্ণনা করেন। উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
أَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ بِالْجَمَاعَةِ
“হে আমার সাহাবীরা আমি তোমাদের পাঁচটি বিষয়ের আদেশ দিচ্ছি যে আদেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আর তাহলো জামায়াতবদ্ধ জীবন যাপন করা।”
হাদিসের এ বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ইসলাম পালন করার জন্য এবং আল্লাহর দ্বীন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কায়েম করার জন্য সংগঠন কায়েম করতে হবে। মুসলিম মিল্লাতের জন্য ইসলামী সংগঠনভুক্ত থাকা ফরজ করা হয়েছে। আল-কুরআনে এ সংগঠনকে ‘আল্লাহর রজ্জু’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে
নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে এবং মতপার্থক্য করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।” (সূরা আলে-ইমরান : ১০৩)
যারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ
“নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।” (সূরা সফ : ৪)
আল-কুরআনে আরো বলা হয়েছে,
الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللَّهِ وَأَخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ فَأُولَئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ وَسَوْفَ يُؤْتِ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ أَجْرًا عَظِيمًا
“যারা তওবা করে নিজেদেরকে শুধরে নেয়, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে এবং আল্লাহর জন্য নিজেদের দ্বীনকে খালেস করে, তারা মুমিনদের সাথে থাকবে। আর অচিরেই আল্লাহ মুমিনদেরকে মহাপুরস্কার দান করবেন।” (সূরা আন-নিসা : ১৪৬)
আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনে আরো বলেছেন, মুসলমানদের মধ্যে একটা দল থাকবে যারা মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করবে এবং মানুষকে অন্যায়-খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে।
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।” (সূরা আলে-ইমরান : ১০৪)
আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলমানের উপরে দ্বীন কায়েমের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এবং মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে মতপার্থক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহি পাঠিয়েছি এবং ইবরাহিম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” (সূরা শুরা : ১৩)
وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ
“নেতার আদেশ শোনা এবং নেতার আদেশ মানা”
যখনই একটা দল বা সংগঠন তৈরি হবে তখন সেই সংগঠন পরিচালনা করার জন্য একজন দায়িত্বশীল বা নেতা থাকবে। আর ঐ সংগঠনের সকল জনশক্তি বা কর্মীরা ঐ দায়িত্বশীলের আনুগত্য করবে। শুধু সংগঠনই নয় যদি ছোট একটা গ্রুপও কোথাও পাঠানো হয় তাহলেও সেই গ্রুপের জন্য একজন নেতা বা দায়িত্বশীল থাকতে হবে। এ সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ ্র إِذَا كَانَ ثَلاَثَةٌ فِى سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوا أَحَدَهُمْ গ্ধ
“হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যখন তোমরা কোথাও তিনজন সফরে যাবে তখন এর মধ্য থেকে একজনকে তোমাদের নেতা বানিয়ে নিবে।” (সুনানে আবু দাউদ)
একজন মুসলিমকে ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীলের আনুগত্য করা অর্থাৎ নেতার আদেশ শোনা এবং মানা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
“হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের।” (সূরা আননিসা : ৫৯)
এ আয়াতের মর্ম হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মান্য করা এবং রাসূল সা. এর আনুগত্য করার ক্ষেত্রে কোনো শর্ত নেই বরং শর্তহীন আনুগত্য করতে হবে। তবে দায়িত্বশীলের আনুগত্যের ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আল-হাদিসে বলা হয়েছে দায়িত্বশীল যদি ইসলামবিরোধী কোনো আদেশ দেন বা নিজের ইচ্ছামত কোনো আদেশ করেন সে ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা যাবে না। রাসূল সা. বলেন,
لاَ طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةٍ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ
“পাপ কাজের আদেশ পালনে আনুগত্য নেই বরং আনুগত্য হচ্ছে ভালো কাজে।” (সহীহ আল-বুখারি)
তবে দায়িত্বশীল যদি সৎকাজের আদেশ দেন আর যদি কোনো জনশক্তি বা কর্মী তার আনুগত্য না করে এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয় তাহলে তার জাহেলিয়াতের মৃত্যু হবে। এ সম্পর্কে আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ مَنْ خَرَجَ مِنْ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
“হজরত আবু হুরায়রা রা. রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি নেতার আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গেল এবং জামায়াতবদ্ধ জীবন থেকে পৃথক হয়ে গেল, তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।” (সহীহ মুসলিম)
দায়িত্বশীলের আনুগত্যের মর্যাদা এতই বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, কেউ যদি দায়িত্বশীলের আনুগত্য করে তাহলে সে রাসূল সা.-এর আনুগত্য করলো এবং যে দায়িত্বশীলের অবাধ্য হলো সে রাসূল সা.-এর অবাধ্য হলো। এ সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন,
مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللَّهَ ، وَمَنْ أَطَاعَ أَمِيرِي فَقَدْ أَطَاعَنِي ، وَمَنْ عَصَى أَمِيرِي فَقَدْ عَصَانِي.
“যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহর আনুগত্য করলো, আর যে আমার অবাধ্যতা করলো সে আল্লাহরই অবাধ্য হলো। আর যে আমিরের আনুগত্য করলো সে আমার আনুগত্য করলো আবার যে আমিরের অবাধ্য হলো সে আমারই অবাধ্য হলো।” (সহীহ আল-বুখারি)
وَالْهِجْرَةِ
“ইসলামের প্রয়োজনে হিজরত করা”
ইসলামের প্রয়োজনে নিজের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার নাম হচ্ছে হিজরত। ইসলামের কাজ করতে গিয়ে যদি বাতিলের পক্ষ থেকে বিরোধিতা আসে এবং সে বিরোধিতা মোকাবিলা করার সামর্থ্য যদি না থাকে তাহলে আত্মরক্ষা ও ইসলাম প্রচারের স্বার্থে নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ কোনো স্থানে চলে যাওয়ার বিধান রয়েছে ইসলামে। রাসূল সা.- এর উপরে যখন অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা সহ্যের বাইরে চলে গিয়েছিলো তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। যা আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا (৮০)
“আর বল, হে আমার রব, আমাকে (মদিনায়) প্রবেশ করাও উত্তমভাবে এবং (মক্কা থেকে) বের কর উত্তমভাবে। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাকে সাহায্যকারী শক্তি দান কর।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৮০)
এ নির্দেশের পর রাসূল সা. সাহাবীদের নিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন এবং সেখানে একটা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বর্তমান সময়েও যদি জালিম শক্তির পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপরে এরকম অত্যাচার-নির্যাতন নেমে আসে তাহলে নিজের ঘরবাড়ি থেকে বের হয়ে নিরাপদ কোন স্থানে গিয়ে দ্বীনের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকার ও দ্বীনের দাওয়াতি কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। এর পরেও দ্বীন থেকে সরে আসা যাবে না। তবে দ্বীনের স্বার্থ ছাড়া দুনিয়াবি কোন স্বার্থের জন্য হিজরত করা জায়েজ নেই। এ সম্পর্কে আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى ، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا ، أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ.
“প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল হয়। আর প্রত্যেকে তাই পায় যা সে নিয়ত করেছে। কারো হিজরতের উদ্দেশ্য যদি দুনিয়া লাভের জন্য হয় তাহলে সে তাই পাবে। অথবা কারো হিজরত যদি কোনো নারীকে বিবাহ করার জন্য হয়। প্রত্যেকে তাই পাবে যে উদ্দেশ্যে সে হিজরত করেছে।” (সহীহ আল-বুখারি)
আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَنْ يُرِدْ ثَوَابَ الْآخِرَةِ نُؤْتِهِ مِنْهَا
“যে ব্যক্তি দুনিয়াবি পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে আমি তাকে দুনিয়া থেকেই দেবো। আর যে ব্যক্তি পরকালীন পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে সে পরকালের পুরস্কার পাবে।” (সূরা আলে-ইমরান : ১৪৬)
আল্লাহর জন্য বা দ্বীন ইসলামের জন্য হিজরত কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে। এ সম্পর্কে আল-হাদিসে হজরত মুয়াবিয়া রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি, হিজরত বন্ধ হবে না যতক্ষণ না সূর্য তার অস্ত যাওয়ার দিক থেকে উদিত হয়। (সুনান আবু দাউদ)
وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
“আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা”
আল্লাহর জন্য হিজরত করার পরে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর রাস্তায়ই জিহাদ করতে হবে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরমান। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী সা.কে জিহাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
“হে নবী, কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তাদের উপর কঠোর হও, আর তাদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম; আর তা কতই না নিকৃষ্ট স্থান।” (সূরা তওবা : ৭৩)
শুধু রাসূল সা.ই নয় বরং সকল মুসলমানের উপরেই আল্লাহ তায়ালা এ নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“তোমরা হালকা ও ভারী উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বের হও এবং তোমাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।” (সূরা তওবা : ৪১)
আল্লাহ তায়ালা শুধু জিহাদের জন্য রাস্তায় বের হতেই বলেননি বরং সকল মুসলমানকে তার সাধ্যমত কাফিরদেরকে ভয় দেখানোর জন্য শক্তি-সামর্থ্য ও ঘোড়া প্রস্তুত রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ
“আর তাদের মোকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত কর, তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং এরা ছাড়া অন্যদেরকেও, যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আর তোমরা যা আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর, তা তোমাদেরকে পরিপূর্ণ দেয়া হবে, আর তোমাদেরকে জুলুম করা হবে না।” (সূরা আনফাল : ৬০)
জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর গুরুত্ব সম্পর্কে আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ
“হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি জিহাদে শরিক হলো না, কিংবা জিহাদ সম্পর্কে কোনো চিন্তা-ভাবনাও করলো না; আর এ অবস্থায় সে মারা গেল, সে যেন মুনাফিকের মৃত্যুবরণ করল।” (সহীহ মুসলিম)
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ النَّاسِ أَفْضَلُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُؤْمِنٌ يُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ
“হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা.কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, হে আল্লাহর রাসূল সা.! মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম কে? উত্তরে রাসূল সা. বললেন, যে ব্যক্তি তার জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে।” (সহীহ আল-বুখারি)
যে ব্যক্তি জিহাদে শামিল হয় না তার অন্তরের মধ্যে শস্যদানা পরিমাণ ঈমান নেই। এ সম্পর্কে আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
مَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ
“যে ব্যক্তি হাত দ্বারা জিহাদ করলো সে মুমিন, যে ব্যক্তি মুখ দ্বারা জিহাদ করলো সেও মুমিন এবং যে ব্যক্তি অন্তর দ্বারা জিহাদ করলো সেও মুমিন। আর যে ব্যক্তি এর একটাও করলো না তার অন্তরে শস্যদানা পরিমাণ ঈমান নেই।” (সহীহ মুসলিম)
فَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنْ الْجَمَاعَةِ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَا أَنْ يَرْجِعَ
“যে জামায়াত থেকে এক বিঘত পরিমাণ সরে গেল সে তার গলা থেকে ইসলামের রশিটা সরিয়ে ফেললো। যতক্ষণ না সে আবার জামায়াতবদ্ধ জীবনে ফিরে আসে।”
হাদিসের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়, জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কখনোই সংগঠন থেকে বিমুখ হওয়া যাবে না। যদি কেউ সংগঠন থেকে দূরে সরে যায় তাহলে সাথে সাথে আবার সংগঠনের আনুগত্যের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। আর যদি কেউ ফিরে না আসে তাহলে সে ইসলামের রশি তার গলা থেকে সরিয়ে ফেললো। আল-হাদিসে মুমিনের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে রাসূল সা. এমনই বলেছেন,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَثَلُ الْمُؤْمِنِ وَمَثَلُ الْإِيمَانِ كَمَثَلِ الْفَرَسِ فِي آخِيَّتِهِ يَجُولُ ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَى آخِيَّتِهِ وَإِنَّ الْمُؤْمِنَ يَسْهُو ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَى الْإِيمَانِ
“মুমিন ও ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে খুঁটিতে বাঁধা ঘোড়ার ন্যায়। যতদূর তার দড়িতে ঠাঁই পায় ততটুকু সে যায়, আবার খুঁটির নিকট ফিরে আসে। সে ভুল করে এবং আবার ঈমানের কাছে ফিরে আসে।” (মুসনাদ আহমদ)
অনুরূপভাবে একজন মুমিন যদি সংগঠন থেকে দূরে সরে যায় তাহলে তাকে আবার সংগঠনের আনুগত্যের মধ্যে ফিরে আসতে হবে অন্যথায় সে ইসলামের গ-ি থেকে দূরে সরে যাবে। তাই আমাদের সব সময় জামায়াতবদ্ধ জীবনের মধ্যে থাকতে হবে।
وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى قَالَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ
“আর যে জাহিলিয়াতের দিকে মানুষকে আহ্বান করে তাকে জাহান্নামের খড়ি তৈরি করা হবে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.! সে যদি নামাজ পড়ে ও রোজা রাখে? রাসূল সা. বললেন, সে যদি নামাজ আদায় করে, রোজা রাখে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে এর পরেও সে জাহান্নামি।”
হাদিসের শেষাংশে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি জামায়াতবদ্ধ জীবন থেকে সরে গিয়ে জাহিলিয়াতের দিকে মানুষকে আহবান করবে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। সে যদি নামাজ আদায় করে, রোজা রাখে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে এর পরেও সে জাহান্নামে যাবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি জামায়াতবদ্ধ জীবন, দায়িত্বশীলের নির্দেশের আনুগত্য, দ্বীনের স্বার্থে হিজরত ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজ থেকে দূরে সরে যাবে সে জাহিলিয়াতের মধ্যে শামিল হয়ে যাবে। এদের জন্য জাহান্নামের কঠিন শাস্তি রেখে দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।
পরিশেষে বলা যায়, একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী সংগঠনের সাথে থাকা এবং ঐ সংগঠনের দায়িত্বশীলের আনুগত্য করা, দ্বীনের স্বার্থে প্রয়োজনে হিজরত করা এবং সর্বদা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজে আত্মনিয়োগ করা। তাহলেই পরকালে আল্লাহর কাছে মহা পুরস্কারস্বরূপ জান্নাত পাওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (১১) يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ “তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত এবং চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহে উত্তম আবাসগুলোতেও (প্রবেশ করাবেন)। এটাই মহাসাফল্য।” (সূরা সফ : ১১-১২)
লেখক : গবেষক ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ