শাহীদুল হাসান তারেক |
সফলকাম হয়েছে মু’মিনগণ। যারা সালাতে বিনয়াবনত। যারা অর্থহীন কথাবার্তা থেকে বিরত। যারা আত্মোন্নয়নে থাকে সক্রিয়। যারা নিজেদের যৌন জীবনের হেফাযতকারী। নিজেদের স্ত্রী ও অধিকারভুক্ত দাসীদের বেলায় যৌন জীবন হেফাযত না করলে তিরষ্কৃত হবে না। কিন্তু এর বাহিরে অন্য কাউকে কামনা করলে সীমালঙ্ঘনকারী গণ্য হবে। (আরও সফলকাম) যারা নিজেদের আমানত ও অঙ্গিকার রক্ষা করে। সালাতের প্রতি যত্নবান হয়। আর তারা উত্তরাধিকারী। জান্নাতুল ফেরদাউসের। যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।
সূরার এই আয়াতগুলোর ব্যাপারে সায়্যিদুনা ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আমার ওপর এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যদি কেউ সে মানদণ্ডে পুরোপুরি উতরে যায় তাহলে নিশ্চিত জান্নাতে প্রবেশ করবে এরপর তিনি সূরার প্রথম দশটি আয়াত তেলাওয়াত করেন।
সূরা মু’মিনুন যখন নাযিল হয় তখন মক্কায় দুর্ভিক্ষ চলছিল। দেখুন, দুর্ভিক্ষের সময় আল্লাহ বান্দাহদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে দিবেন, কষ্ট দূর করার পদ্ধতি বাতলে দিবেন তা না করে একটা বক্তব্য হাজির করলেন। বক্তব্যটির সারসংক্ষেপ:
সফলতা ও ব্যর্থতার মানদণ্ড
যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালামের ওপর ঈমান এনেছিলেন তারা অনেকটা দুর্বল ও দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত ছিলেন। কিছু লোকের অবস্থা আগে থেকে ভাল হলেও ইসলাম গ্রহণের পর তারা সামগ্রিক চাপে অনেকটা নি:স্ব হয়ে পড়েন। অন্যদিকে যারা ইসলামী দাওয়াতের বিরোধী ছিল তাদের ব্যবসা বাণিজ্য উন্নতির পর্যায়ে ছিল। তারা প্রচুর ধনদৌলতের অধিকারী ছিল। বৈষয়িক সমৃদ্ধির যাবতীয় উপায় উপাদান তাদের হাতের মুঠোয় ছিল।
রেসালাতের দাওয়াত অস্বীকারকারী ধনীদের সাফল্য যখন নিশ্চিত আবার ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিমদের অবস্থা যখন সকল দিক থেকেই সংকটাপন্ন তখন মু’মিনদেরকেই নিশ্চিত সফলকাম বলে ঘোষণা করার অর্থই হলো, সফলতার মানদণ্ড আল্লাহর কাছে ভিন্ন। তোমাদের কাছে যা সাফল্য আল্লাহর কাছে তা চরম ব্যর্থতা। তোমাদের অনুমান নির্ভর সাফল্য পর্যালোচনা ত্রুটিপূর্ণ, তোমাদের দৃষ্টিশক্তি সুদূরপ্রসারী নয়। নিজেদের সীমিত ও সাময়িক সমৃদ্ধি চূড়ান্ত নয়।
পার্থিব সমৃদ্ধি, অর্থ-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব সব কিছুই অস্থায়ী, ভংগুর। পৃথিবীর আদি থেকে এরকম প্রভাব প্রতিপত্তিশীল কেউ স্থায়ী হয়নি। আল্লাহ প্রতাপশালী ফেরাউন বা নমরুদ, আদ অথবা সামুদ জাতিকে পৃথিবীর কাছে কল্যাণকর উদাহরণ বানাননি রাখাল লোকমান আলাইহিসালাম দুনিয়াবাসীর কাছে উদাহরণ হয়েছেন। কারণ তার অন্তর পরিশুদ্ধ ছিল। যাদের অন্তর পরিশুদ্ধ থাকে তারাই সফলকাম হয়। ‘যার অন্তর পরিশুদ্ধ সেই সফলকাম’ [৮৭:১৪]
দুর্ভিক্ষপীড়িত মুসলিম, কষ্টে নিপতিত ঈমানদারের জন্য পরিস্থিতির কাঠিন্য আল্লাহর পরীক্ষা। এরকম পরিস্থিতি দেখে ঈমান দুর্বল করা যাবে না। আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার ওপর বিশ্বাস নড়বড় করা যাবে না। ব্যর্থতা বা একাকীত্ব অনুভব করা যাবে না। বরং চরম বিপদেও আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ওপর অটল ও অবিচল থাকতে হবে।
তাই, সফলতা সুন্দর আচরণে, সুন্দর আমলে। আল্লাহ আয়াতগুলোতে আমলিয়াত ও ইনসানিয়াতের চমৎকার সমন্বয় করেছেন। আল্লাহর হক্ব আদায়ের ব্যাপারে প্রথম আয়াত, পরবর্তী আয়াতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এমন একটি সমস্যার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন ‘অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা’ -যে বা যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে তারাই সমাজের শৃংখলিত মানুষ।
পরে আবার আর্থিক পরিশুদ্ধতার কথা বলেছেন যাতে সমাজের মানুষ ভাল থাকে। দারিদ্র্যের অর্থকষ্ট দূর হয়। এরপরেই সমাজ নষ্ট হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটিতে ইংগিত করেছেন ‘যৌনাচারের সীমারেখা’ নির্ধারণ করেছেন। বিশ্বব্যাপী যৌনাচারের সীমালঙ্ঘন একটা বড় সংকট। এই সংকট পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আমানতের খিয়ানত, অংগিকার ভঙ্গ করা সমাজের ও সমাজের নেতাদের সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই সমস্যা। কখনো ঈমানদার ব্যক্তি আমানত ও অংগিকার ভঙ্গ করতে পারেন না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম বলেছেন: “যার মধ্যে আমানতদারীর গুণ নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার গুণ নেই তার মধ্যে দ্বীনদারী নেই।” [বাইহাকী, শুয়াইবুল ঈমান]
সর্বশেষ আবার সালাতে যত্নবান হওয়ার গুণাবলি বলে আল্লাহ জান্নাতের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করলেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত জাতির সামনে আল্লাহ সফলতার যে মানদণ্ড ঘোষণা করেছেন, পৃথিবীর সংকট বিবেচনায় এটাই চূড়ান্ত সাফল্য। এটাই সার্থকতা।
সুরা মু’মিনুন কোর’আনে কারীমের ২৩ নাম্বার সূরা। মোট আয়াত ১১৮ টি। রুকু সংখ্যা ৬।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।