বই রিভিউ | লিখেছেন: কামরুল হাসান
ড. ইউসুফ আল কারজাভী | অনুবাদক: তারিক মাহমুদ
গার্ডিয়ান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ১১১ পৃষ্ঠার বইটি মুসলমানদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি গাইডলাইন হতে পারে। মানুষের জীবনের ক্ষুদ্রতম ইউনিট হচ্ছে সময়। জীবনটা কিছু সময়ের সমষ্টি মাত্র। সে হিসাবে আমরা বলতে পারি, সময়ই জীবন, জীবনই সময়। কেউ যদি সময়কে গুরুত্ব দেয় বা সঠিক ব্যবহার করে প্রকারান্তরে সে জীবনকে গুরুত্ব দিবে। আর সময়ের অপব্যবহার মানে জীবনের অপব্যবহার।
তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো সময়ের প্রতিটা অংশকে কোন না কোন উপকারী কাজে ব্যয় করা। তা হতে পারে জ্ঞান অর্জন অথবা কল্যাণমুখী কাজ অথবা আত্ম উন্নয়নমূলক কাজ অথবা আল্লাহর পথে জিহাদ। মানুষ যদি বুদ্ধিমান হতো! তাহলে দুনিয়ার সঙ্গে এমন আচরণ করত, যেন তাকে চিরকাল দুনিয়াতে থাকতে হবে। আর আখেরাতের সঙ্গে এমন আচরণ করত, যেন আগামীকালই তার মৃত্যু হবে।
সময় পরিচর্যা:
ইবাদতে সময়ের মূল্যঃ শেষ বিচারের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। তার মধ্যে দুটি সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। একটি হলো জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে? আরেকটি হলো যৌবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে?
ইসলামিক স্কলার্সবৃন্দ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে দিনের সময় ওজনের দাঁড়িপাল্লা বলেছেন। আর জুমাবারকে সপ্তাহের, রমজানকে বছরের এবং হজকে জীবনের দাঁড়িপাল্লা গণ্য করেছে। তারা চাইতেন সবাই প্রত্যেকটি দিন কাজে লাগাক। দিনের কাজ দিনে শেষ করুক। সপ্তাহের কাজ সপ্তাহে। মাসের কাজ মাসে। কারো যদি দিনের কোন কাজ ছুটে যায়, তা সপ্তাহের মধ্যে সমন্বয় করে নিবে। সপ্তাহের কোন কাজ ছুটে গেলে, মাসের মাঝে শেষ করবে। এভাবে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর এবং পুরো জীবনকে কাজে লাগবে।
সময় এর বৈশিষ্ট্য: সময় এর বৈশিষ্ট্য তিনটি।
১. তড়িৎ ফুরিয়ে যাওয়া।
২. সময় কখনো ফিরে আসে না।
৩. সময় মূল্যবান সম্পদ।
একজন মুসলিম মানুষের উপর সময়ের সাথে কিছু কিছু দায়িত্বও চলে আসে এবং তাকে এ দায়িত্বগুলো বাস্তবায়ন করে দেখাতে হয়। মুসলমানদের প্রথম কর্তব্য হল সময়কে সংরক্ষণ করা। আমাদের স্কলার্সরা সবচেয়ে বেশি কৃপণ ছিলেন সময়ের ব্যাপারে। সময়ের গুরুত্ব এবং মূল্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলেন সর্বাধিক মুনাফাভোগী ব্যবসায়ীর মত। হাসান বসরী রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, আমি বেশকিছু জাতির সঙ্গে মেলামেশা করেছি। তোমরা তোমাদের দিরহাম-দিনারের প্রতি যতটুকু মনোযোগী হও, তারা তাদের সময়ের প্রতি তারচেয়ে বেশি মনোযোগী হয়।
সময়ের অপচয় করা হলো অস্থিরতার আলামত। একটি ধারালো তরবারি। যদি তুমি তাকে কাটতে না পারো, তাহলে সে তোমাকে কেটে ফেলবে। তারা সর্বদা নিজেদের ভবিষ্যৎকে বর্তমানের চেয়ে উন্নত করার জন্য কাজ করতেন। বর্তমানে “সময় কাটানো” বা “টাইম পাস” শব্দ দুটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মনে রাখতে হবে সময় কাটানোর বিষয় নয় বরং কাজে লাগানোর বিষয়।
অবসরের গনিমত:
রাসূল (স) হাদিস হল পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে গনীমত হিসাবে গ্রহন করো। তার মধ্যে একটি হলো ব্যস্ততার পূর্বে অবসর।
• কথায় আছে পুরুষের অবসর অকর্মণ্যতার আর নারীর অবসর কামনার।
• অবসরের ভয়াবহতা ঠিক তখন বৃদ্ধি পায় যখন তার সাথে যৌবন যুক্ত হয়।
• যৌবন, অবসর ও প্রাচুর্য এই তিনটি যখন একসাথে হয়। তখন তা হয় খুবই ভয়ঙ্কর।
• কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা করা প্রয়োজন।
• একজন বিবেকবান এর চারটি সময় থাকবে।
১. একটা সময় সে তার রবের কাছে চাওয়া পাওয়ার কথা বলবে।
২. একটা সময় সে নিজেকে মূল্যায়ন করবে।
৩. একটা সময় আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে ভাববে।
৪. আর একটা সময় তার খাবার-পানীয়ের জন্য খালি রাখবে।
গুরুত্বহীন কাজ গুরুত্বপূর্ণ কাজের উপর প্রাধান্য না দেওয়া। সময় বিন্যাসের সময় একটি অংশ বিশ্রাম এবং একটি অংশ বিনোদনের জন্য রাখতে হবে। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলে, কাজে মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে যায় এবং বরকত কম পাওয়া যায়। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কাজ করা। আবু বকর (রা) ওমরকে (রা) দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সময় উপদেশ দিয়ে বলেন, দিনে আল্লাহর কিছু কাজ রয়েছে, যা রাতে কবুল হবে না। আর রাতের কিছু কাজ রয়েছে যা দিনে কবুল হবে না।
মর্যাদাবান সময়ে আল্লাহর ইবাদত করা। রাতের শেষ তিন ভাগের এক ভাগ তথা সেহেরির অংশকে মর্যাদাবান করেছেন। সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে তিনি জুমার দিনকে মর্যাদাবান করেছেন। আল্লাহতালা বছরের দিনগুলোর মধ্যে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনকে মর্যাদাবান করেছেন। আবার এই দিনগুলোর মধ্যে আরাফার দিন সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান। সারা বছরের মধ্যে মর্যাদাবান দিন হল আরাফার দিন। মাসগুলোর মধ্যে মর্যাদাবান মাস হলো রমজান মাস। আর রাতের মধ্যে মর্যাদাবান রাত হল লাইলাতুল কদরের রাত।
মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন:
যদি বরকতপূর্ণ জীবন পেতে চাও, তাহলে ইসলাম নির্ধারিত দৈনন্দিন জীবন পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। আর তা হলো, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা এবং সকাল সকাল ঘুমোতে যাওয়া। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সালাত আদায় করে গভীর ধ্যানের সাথে বুঝে বুঝে কিছু অংশ কোরআন তেলাওয়াত করা এবং পরিমিত পরিমাণ সকালের নাস্তা গ্রহণ করা। নাস্তা শেষে জীবিকা অন্বেষণ এবং রিজিকের সন্ধানে ছুটে চলা। দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ জিনিস হলো বেকারত্ব। মুসলমানদেরকে দৈনিক পরিকল্পিত একটা সময় পড়াশোনা করতে হবে। যার উদ্দেশ্য হবে জ্ঞানগত প্রবৃদ্ধি অর্জন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, আমার প্রভু! আমাকে জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। সূরা ত্বহা-১১৪
অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সময়:
যে সময়কে ঘিরে মানুষের বসবাস। তাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। অন্য ভাষায় বলতে গেলে গতকাল, আজ ও আগামীকাল। মানুষের মধ্যে একটি অংশ অতীতের জিঞ্জিরে আবদ্ধ। একটি অংশ বর্তমানের গোলামীতে লিপ্ত। আরেকটি অংশ ভবিষ্যতের পুজারি। কিছু মানুষ আছে যারা শুধু অতীত দিয়ে নিজেদের পরিচিত করতে চায়।
অতীতের নষ্ট হওয়ার সময় নিয়ে চিন্তা বা আফসোস নতুন কিছু সময়কে নষ্ট করে। আল্লাহ প্রদত্ত তাকদীরের উপর ঈমান ইতিবাচক মানসিকতার কর্মঠ ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে সহায়ক। একটি মানুষকে “যদি” এবং “যদি না” ইত্যাদি শব্দগুলো নেতিবাচক আছর থেকে বের করে, কর্মনিষ্ঠ জীবন এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের দিকে নিয়ে আসে। ভবিষ্যৎ নিয়ে নৈরাশ্য এক অসভ্য চিন্তা। সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আশা বা স্বপ্ন থাকা প্রয়োজন। যদি আশা না থাকতো, স্থপতি কোন স্থাপনা নির্মাণ করত না, কোন কৃষক গাছ লাগাত না, জ্ঞান-বিজ্ঞান সামনের দিকে এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতোনা। কবি বলেন, ‘জীবন কতই-না সংকীর্ণ! যখন অনুপস্থিত আশার আলো।’
ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ না হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম কাজ করে যেতে বলেছেন। তিনি বলেন, যদি কিয়ামত শুরু হয়ে যায়, আর তোমাদের কারো হাতে একটি গাছের চারা থাকে এবং সে তা রোপণ করতে সক্ষম, তার উচিত তা রোপন করে ফেলা। মুসনাদে আহমদ-১২৯০২
ভবিষ্যতের কল্পনা-বিলাস ও দিবাস্বপ্ন। আলী ইবনে আবু তালিব তার ছেলেকে বলেন, তুমি অতি উৎসাহী চিন্তা থেকে বিরত থাকো। কারণ এটা বোকা লোকের কাজ। কোরআন কল্পনা-বিলাসকে অপছন্দ করেছে; উচ্চাশাকে নয়। এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য হলো উচ্চাশার সঙ্গে কর্মের সংযোগ থাকে। আর যার সঙ্গে কর্মের কোন সংযোগ নেই সেটাই কল্পনা-বিলাস। একজন আলেম বলেন, কর্ম ক্ষমতা হারানোর পূর্বেই কাজগুলো সেরে ফেলো। আমি আজ বহু কাজ করতে চাই কিন্তু আমার কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে। এমন আফসোস যেন তোমাকে করতে না হয়। হে যুবক সম্প্রদায়! তোমরা কর্মে মগ্ন হও। যৌবনেই কিছু করার সময়।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।