সূরা আল ক্বদর

নামকরণ:
প্রথম আয়াতের ‘আল কদর’(الْقَدْرِ) শব্দটি থেকে সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে।

নাযিলের সময়কাল:
সুরাটির মক্কী বা মাদানী হবার ব্যাপারে দ্বিমত রয়ে গেছে। আবু হাইয়ান বাহরুল মুহীত গ্রন্থে দাবী করেছেন, অধিকাংশ আলেমের মতে এটা মাদানী সূরা । আলী ইবনে আহমাদুল ওয়াহেদী তাঁর তাফসীরে বলেছেন, এটি মদীনায় নাযিলকৃত প্রথম সূরা।
অন্যদিকে আল মাওয়ারদী বলেন, অধিকাংশ আলেমের মতে এটি মক্কী সূরা। ইমাম সুয়ূতী ইতকান গ্রন্থে একথাই লিখেছেন। ইবনে মারদুইয়া ইবনে আব্বাস (রা), ইবনে যুবাইর (রা) ও হযরত আয়েশা (রা) থেকে এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, সূরাটি মক্কায় নাযিল হয়েছিল। সূরার বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলেও একথাই প্রতীয়মান হয় যে, এর মক্কায় নাযিল হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

শানে নুযূল(নাযিলের কারণ):
ইবনে আবী হাতেম (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে আছে, রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) একবার বনী-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনও অস্ত্র সংবরণ করেনি। মুসলমানগণ একথা শুনে বিস্মিত হলে এ সূরা কদর অবতীর্ণ হয়। এতে এ উম্মতের জন্যে শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের এবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইবনে জরীর (রহঃ) অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বনী-ইসরাঈলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সমস্ত রাত্রি ইবাদতের মশগুল থাকত ও সকাল হতেই জিহাদের জন্যে বের হয়ে যেত এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ্‌ তাআলা সূরা-কদর নাযিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
ইবনে আবী হাতেম (রাঃ), ইবনে জরীর (রহঃ), তাফসীরে মাযহারী, আসবাবুন নুযূল লিল ওয়াহিদী

বিষয়বস্তু:
লোকদেরকে কুরআন মজীদের মূল্য, মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করাই এই সূরাটির বিষয়বস্তু। কুরআন মজীদের বিন্যাসের ক্ষেত্রে একে সূরা আলাক এর পরে রাখাই একথা প্রকাশ করে যে সূরা আলাকের প্রাথমিক পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে যে পবিত্র কিতাবটির নাযিল শুরু হয়েছিল তা কেমন ভাগ্য নির্ণয়কারী রাতে নাযিল হয়, কেমন মহান মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব এবং তার এই নাযিল হওয়ার অর্থ কি এই সূরায় সেকথাই লোকদেরকে জানানো হয়েছে।

সরল অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর (আহসানুল বায়ান):
بِّسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
১) আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে ৷
সংক্ষিপ্ত তাফসীর:
অর্থাৎ, এই রাতে তা (কুরআন) অবতীর্ণ আরম্ভ করেছেন। অথবা তা ‘লাওহে মাহ্ফূয’ হতে দুনিয়ার আসমানে অবস্থিত ‘বাইতুল ইযযাহ’তে এক দফায় অবতীর্ণ করেছেন। আর সেখান থেকে প্রয়োজন মোতাবেক নবী (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তা ২৩ বছরে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। জ্ঞাতব্য যে, ‘লাইলাতুল কদর’ রমযান মাসেই হয়ে থাকে; অন্য কোন মাসে নয়। এর প্রমাণ, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘রমযান মাস; যাতে কুরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে।’’ (সূরা বাক্বারাহ: ১৮৫)

وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ
২) তুমি কি জানো, কদরের রাত কি ?
সংক্ষিপ্ত তাফসীর:
এখানে প্রশ্নবাচক শব্দ ব্যবহার করে এই রাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব অধিকরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে। যেন সৃষ্টি এর সুগভীর রহস্য পূর্ণরূপে জানতে সক্ষম নয়। একমাত্র আল্লাহই এ ব্যাপারে পূর্ণরূপ অবগত।

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
৩) কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো ৷
সংক্ষিপ্ত তাফসীর:
অর্থাৎ, এক রাত্রির ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। আর হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার উপর কত বড় আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাকে তার সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালে অধিকাধিক সওয়াব অর্জন করার সহজ পন্থা দান করেছেন।

تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ
৪) ফেরেশতারা ও রূহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়৷
সংক্ষিপ্ত তাফসীর:
এখানে ‘রূহ’ বলে জিবরীল (আঃ)-কে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, জিবরীল (আঃ) সহ ফিরিশতাগণ এই রাতে ঐ সকল কর্ম আঞ্জাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে অবতরণ করেন, যা আল্লাহ এক বছরের জন্য ফায়সালা করে থাকেন।

سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ
৫) এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত
সংক্ষিপ্ত তাফসীর:
অর্থাৎ এতে কোন প্রকার অমঙ্গল নেই। অথবা এই অর্থে ‘শান্তিময়’ যে, মু’মিন এই রাতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদে থাকে। অথবা ‘সালাম’-এর অর্থ প্রচলিত ‘সালাম’ই। যেহেতু এ রাতে ফিরিশতাগণ ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে সালাম পেশ করেন।

বিস্তারিত তাফসীর:
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ
কুরআন আল্লাহরই কিতাব:
প্রথমেই আল্লাহ বলেছেন ,আমি এটি নাযিল করেছি । অর্থাৎ এর মাধ্যমে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন এটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচনা নয় বরং আমিই এটি নাযিল করেছি ।

কুরআন রমযানেই নাযিল হয়েছে:
“নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। (সূরা কদর: ১-৫)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের অন্যত্র ঘোষনা করেছেন,
إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةٍ مُّبَٰرَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ
নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) এক মুবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।
(সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ১-৪)

সুরা বাকারায় আল্লাহ তাআলা বলেন:
شَهْرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٍ مِّنَ ٱلْهُدَىٰ وَٱلْفُرْقَانِ
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুরা বাকারা ১৮৫
সত্য মিথ্যার ফায়সালার একটা ইঙ্গিত বদর যুদ্ধ একই বছরে বা ২য় হিজরির রমযানেই সংঘটিত হয়

শুধু أَنزَلْنَاهُ আনযযালনাহু বলার কারণ:
আয়াতে “আনযালনাল কুরআন” বা কুরআন শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি শুধু আনযযালনাহু বলা হয়েছে। এটা এজন্য যে নাযিল কথাটি বললেই সেটা দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই কুরআন নাযিলই বুঝাবে।

সমস্ত ঐশী কিতাব রমযানেই অবতীর্ণ হয়েছে:
হযরত আবু যর গেফারী (রাঃ) বর্ণিত রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ্‌ (সাঃ) বলেনঃ ইবরাহীম (আঃ)-এর সহীফাসমূহ ৩রা রমযান, তাওরাতে ৬ই রমযান, ইনজীল ১৩ই রমযান এবং যবুর ১৮ই রমযানে অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআন রমযানের ২০ পরবর্তী লাইলাতুল কদরে নাযিল হয়েছে। – (মাযহারী)

শবেবরাত ও শবেকদর বিভ্রান্তি নিরসন:
যারা সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকাকে শবে বরাত বা ১৫ শাবান বলেন এই আয়াতে এই বিভ্রান্তিরও নিরসন করা হয়েছে। কারণ কুরআন শবে বরাতে বা ১৫ শাবানে নয় লাইলাতুল কদরে বা রমযানেই নাযিল হয়েছে। আর লাইলাতুল মুবারাকা বলে লাইলাতুল কদরকেই স্পষ্টভাবে ইঙিত করা হয়েছে।

এই রাতে কোরআন নাযিল করার দুটি অর্থ হতে পারে:
১. এই রাতে সমগ্র কোরআন ওহীর ধারক ফেরেশতাদেরকে দিয়ে দেয়া হয় । যা দুনিয়ার আকাশ বাইতুল ইযযাহতে থাকে। অতপর অবস্থা ও ঘটনাবলী অনুযায়ী তেইশ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহর হুকুমে তার আয়াত ও সূরাগুলি রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর ওপর নাযিল করতে থাকেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ অর্থটি বর্ণনা করেছেন।
২. এই রাত থেকেই কোরআন নাযিলের সূচনা হয়। এটি ইমাম শা’বীর উক্তি।
৩. ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত: কদর রাত্রিতে পূরো কুরআন দুনিয়ার আকাশ বাইতুল ইযযাতে অবর্তীণ হয়। এই মতটিই সর্বাধিক শক্তিশালী।
তবে উভয় মত অনুযায়ীই কুরআন রমাদানের লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ হয় বা অবতরণের সূচনা হয় এটাই বুঝায়। এবং এটাও বোঝা যায় যে হেরা গুহায় কুরআন নাযিল হওয়ার ঘটনাটিও রমাদান মাস বা লাইলাতুল কদরই ছিল।

সূরার ক্রম ও সম্পর্ক:
কুরআন মাজিদে সুরার ক্রম দেখলেও বোঝা যায় সূরা আলাকের পরই সূরা কদর এসেছে এর মাধ্যমে আল্লাহ এই ইঙিত দিয়েছেন যে তোমাদের হয়তো প্রশ্ন থাকতে পারেন হেরা গুহায় প্রথম ওহী সূরা আলাক এবং কুরআন নাযিল কখন শুরু হয়েছে এবং সেই সময়টার মহাত্ম্য কী?
মাযহারী, তাফহীমুল কুরআন

কুরআন নাযিলের পর্যায়: ২টি
১.‘লাওহে মাহ্ফূয’ হতে দুনিয়ার আসমানে অবস্থিত ‘বাইতুল ইযযাহ’
২.‘বাইতুল ইযযাহ’ থেকে প্রয়োজন মোতাবেক নবী (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তা ২৩ বছরে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।

কদর শব্দটির অর্থ:
কদরের রাতের দু’টি অর্থ-
১. অনেক তাফসীরকার কদরকে তকদীর অর্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই রাতে আল্লাহ তকদীরের ফায়সালা জারী করার জন্য তা ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেন। সূরা দুখানের এ আয়াতটি এই বক্তব্য সমর্থন করে-
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
“এই রাতে সব ব্যাপারে জ্ঞানগর্ভ ফয়সালা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। (সূরা দুখান: ৪)”
যেমন মৃত্যু বয়স রিজিক ইত্যাদি (কুরতুবী)
অর্থাৎ এ রাত্রিতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমান নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয়, এমনকি, এ বছর কে হজ্ব করবে, তাও লিখে দেয়া হয়।

মুজাহিদ (রহ:) বলেন
লাইলাতুল কদর অর্থ লাইলাতুল হুকুম (কুরতুবী)
এটি এমন একটি রাত যে রাতে তকদীরের ফায়সালা করা হয়। অথবা অন্য কথায় এটি সাধারণ রাতের মতো কোন মামুলি রাত নয়। বরং ভাগ্যের ভাঙা গড়া চলে । এই রাতে এই কিতাব নাযিল হওয়া নিছক একটি কিতাব নাযিল নয় বরং এটি শুধুমাত্র কুরাইশ ও আরবের নয় , সারা দুনিয়ার ভাগ্য পাল্টে দেবে।
তাফহীম
২. এটি বড়ই মর্যাদা ,মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের রাত। এটি হাজার মাসের চাইতেও উত্তম । এর সাহায্যে মক্কার কাফেরদেরকে পরোক্ষভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেশকৃত এই কিতাবকে নিজেদের জন্য একটি বিপদ মনে করেছে। তোমাদের ওপর এ এক আপদ এসে পড়েছে বলে তোমরা তিরস্কার করছো। অথচ যে রাতে এর নাযিল হবার ফায়সালা জারী করা হয় সেটি ছিল পরম কল্যাণ ও বরকতের রাত। এই একটি রাতে মানুষের কল্যাণর জন্য এত বেশী কাজ করা হয়েছে যা মানুষের ইতিহাসে হাজার মাসেও করা হয়নি।
ইমাম যুহরী বলেন, কদর অর্থ হচ্ছে শ্রেষ্টত্ব ও মর্যাদা। অর্থাৎ এটি অত্যন্ত মর্যাদাশালী রাত। এই অর্থ সমর্থন করে এই সূরার এ আয়াতটি
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
“ কদরের তার হাজার মাসের চাইতেও উত্তম। ”

কদরের রাত আসলে কোনটি?:
কদরের রাত কোনটি এ বিষয়ে মোটামুটি ৪০টি মত পাওয়া যায় তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হল-
১. সাধারণভাবে আলেমসমাজের অধিকাংশের মতে রমযানের শেষ ১০ রাতের বেজোড় রাতগুলির কোনো একটিতে লাইলাতুল কদর এর মধ্যে কিছু লোক বলেন ২৭ রমযানই লাইলাতুল কদর। এবং সেভাবেই এই রাতটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন তারা।
২ মুসনাদে আহমাদে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে রাসূল সা: কে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন সেটি ২৭ কিংবা ২৯ তারিখ রাত। আবার আবু হুরাইরা রা: র অন্য একটি হাদীসে আছে সেটি রমযানের শেষ রাত।
৩. যির ইবনে হুবাইশ রা: উবাই ইবনে কা’ব রা: কে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন সেটি ২৭ রমযান। এই হাদীসটি তিরমিজি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে হিব্বানে বর্ণিত আছে।
৪. আবু যার রা:কে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন হযরত ওমর রা:, আবু হুযাইফা রা: সহ অনেক সাহাবার এ ব্যাপারে সন্দেহ ছিল না যে ২৭ রমযানেই লাইলাতুল কদর। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ)
৫. হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত রা: বলেন রমযানের শেষ ১০ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যেই রয়েছে লাইলাতুল কদর (মুসনাদে আহমাদ)
৬. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন রাসূল সা: বলেছেন তোমরা তাকে( লাইলাতুল কদর) খোঁজো রমযানের শেষ দশদিনের যখন ৯দিন, ৭ দিন বা ৫ দিন বাকি থাকে (বুখারী) অধিকাংশ আলেম এর মতে এর অর্থ ৯,৭,৫,৩,১ বা বোজোড় রাতগুলি ।
৭. আবু বাকরাহ (রা:) বলেন ৯দিন, ৭ দিন বা ৫ দিন বা ১ দিন বাকি থাকতে বলতে রাসূল সা: শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলিই বুঝিয়েছেন।
৮. আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন তোমরা রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলিতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ ও তিরমিজি)
৯. আয়েশা রা: ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: বর্ণনা করেন রাসুল সা: মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ ১০ দিন ই’তিকাফ করতেন।

১১. ইব্‌নু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী সা. এর কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নের মাধ্যমে রমাযানের শেষের সাত রাত্রে লাইলাতুল ক্বাদর দেখানো হয়। (এ শুনে) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে। (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব যে ব্যক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে। (বুখারী পর্ব ৩২ : /২ হাঃ ২০১৫, মুসলিম ১৩/৪০, হাঃ ১১৬৫)
উল্লেখ্য: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, মুয়াবিয়া রা: বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে অনেক আলেম ২৭ রমযানকেই লাইলাতুল কদর বললেও। রমযানের শেষ ১০ দিনের সবগুলিই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূল সা: এই দিনটিকে নির্দিষ্ট করে দেন নি। এটাও আল্লাহর হেকমত বলা যায় যমেন হাদীসে আছে-
আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে রমাযানের মধ্যম দশকে ই‘তিকাফ করি। তিনি বিশ তারিখের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমাকে লাইলাতুল ক্বাদর (-এর সঠিক তারিখ) দেখানো হয়েছিল পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান কর….।
(বুখারী পর্ব ৩২ : /২ হাঃ ২০১৬, মুসলিম হাঃ)

ক্বদর রাতের কিছু আলামত:
উপরের হাদীসের দ্বিতীয় অংশ: তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান কর। আমি (স্বপ্নে) দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে) কাদা-পানিতে সাজদাহ করছি। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে ই‘তিকাফ করেছে সে যেন ফিরে আসে (মসজিদ হতে বের হয়ে না যায়)। আমরা সকলে ফিরে আসলাম (থেকে গেলাম)। আমরা আকাশে হাল্কা মেঘ খণ্ডও দেখতে পাইনি। পরে মেঘ দেখা দিল ও এমন জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের শাখায় তৈরি মাসজিদের ছাদ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। সলাত শুরু করা হলে আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কাদা-পানিতে সাজদাহ করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই।

উল্লেখ্য প্রথম যুগে রমযানের ১০ থেকে ২০ রমযান মাঝের ১০ দিন ইতিকাফ করা হতো এরপরে ক্বদরের বিধান ও ক্বদর তালাশের জন্য শেষ ১০ দিন ইতিকাফের প্রচলন শুরু হয়।
(বুখারী পর্ব ৩২ : /২ হাঃ ২০১৬, মুসলিম হাঃ)
তাই সাতাশের রাতকেই সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলা উচিত নয়। খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, এ রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভবনা রয়েছে।
যদি লাইলাতুল-কদরকে রামাদানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে ঘূর্ণায়মান এবং প্রতি রামাদানে পরিবর্তনশীল মেনে নেয়া যায়, তবে লাইলাতুল-কদরের দিন-তারিখ সম্পর্কিত হাদীসসমূহের মধ্যে কোন বিরোধ অবশিষ্ট থাকে না। এটিই প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত।
ইবন হাজার: ফাতহুল বারী, ৪/২৬২–২৬৬
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ جَعْفَرٍ، حَدَّثَنَا أَبُو سُهَيْلٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‏”‏‏‏
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদ্‌রের অনুসন্ধান কর। সহীহ বুখারী ২০১৭ (ihadis)

দিনের তারতম্য:
প্রশ্ন আসতে পারে যে মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারায় যখন রাত থাকে তখন তো মুসলিম বিশ্বের অনেক জায়গাতেই দিন থাকে সেক্ষেত্রে তারা লাইলাতুল কদর পাবে কিভাবে? আমরা যেমন দিন বলতে রাত-দিনের সমষ্টি বুঝাই তেমনি আরবিতে রাত বলতে দিন ও রাতের সমষ্টিকেও বোঝানো হয়। অর্থাৎ লাইলাতুল কদরে দিন রাত যেটাই মিলে যাক ঐ তারিখের রাতটাই মূলত লাইলাতুল কদর হিসেবে ধর্তব্য হবে।
أَلْفِ شَهْرٍ

হাজার মাসের অর্থ কী:
এরকম নয় যে কদরের রাত হাজার “রাতের” চেয়ে উত্তম বরং হাজার “মাসের” চেয়েও উত্তম।
হাজার মাস বলতে কী আসলে সংখ্যার হাজার মাস বোঝায়?
বা ১০০০X৩০ বা ৩০ হাজার দিন
বা ৩০০০/৩৬৫= ৮২.১২ বছর এরকম ?
আসলে এরকম নয়, আরবী ভাষায় হাজার মানে সর্বাধিক সংখ্যা বা অনেক বেশী, আরবিতে লাখ কোটি ইত্যাদি সংখ্যার ব্যবহার ছিল না। এক লাখ বলতে ১০০ হাজার বলতে হয়। আরবরাও এভাবেই বহু পরিমাণ বোঝাতে দৈনন্দিন কথায় হাজার হাজার বলতো। যেমন আলিফ/আলফ লায়লা মানে হাজার রাত। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেমন কোটি কোটি বলি তেমন। অর্থাৎ এই রাতের মর্যাদা অন্য যেকোনো কালের চেয়ে বেশি।
তাফহীমুল কুরআন
الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ

রূহ বা জিবরাইল আ:কে আলাদা উল্লেখের কারণ:
আর জিবরাইল আ.–এর আগমনের অর্থ হলো প্রতি লাইলাতুল কদরে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনান আর নবীজিও তাকে শোনান। এ বছর থেকে পরবর্তী বছর পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করে এ রাতেই ফেরেশতাদের কাছে অর্পণ করেন। (কুরতুবী: ২০/১৩৩)
আয়াতে মালায়েকা বলার পরও জিব্রীল আলাইহিস সালামকে আলাদাভাবে রূহ বলা হয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কারণে। ফাতহুল কাদীর
হাদীসে আছে, “লাইলাতুল-কদরের রাত্রিতে পৃথিবীতে ফেরেশতারা এত বেশী অবতরণ করে যে, তাদের সংখ্যা পাথরকুচির চেয়েও বেশী।” [মুসনাদে আহমাদ: ২/৫১৯, মুসনাদে তায়ালাসী: ২৫৪৫]
بِإِذْنِ رَبِّهِم

আল্লাহর আদেশে:
কদর রাতের মর্যাদা, রহমত বর্ষণ ও ফেরেস্তা অবতরণ সবকিছু আসলে আল্লাহর আদেশেই হয়। এটি দ্বারাও এ রাতের মর্যাদা আরও শক্তিশালী ভাবে প্রমাণ হয়। অনেকটা এরকম আল্লাহ নিজেই সরাসরি বিশেষভাবে এই রাতের তত্বাবধান করেন এবং বিশেষভাবে ফেরেশতা অবতরণের আদেশ দেন।
দুনিয়ার জীবনে যেমন শোনা যায়: প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি নিজে ফোন করে তাকে ধন্যবাদ/শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এতে উক্ত লোকটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা যায়। এবং লোকটিও নিজেকে অনেক ধন্য মনে করে।
এর দ্বারআরও সাব্যস্ত হয় যে ফেরেশতারা নিজে থেকে কোনো কাজ করেন না। যা করেন আল্লাহর নির্দেশেই করেন।
مِّن كُلِّ أَمْر

প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। যেমন মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমান ইত্যাদি। যেমনটা সুরা দুখানে আছে
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
“এই রাতে সব ব্যাপারে জ্ঞানগর্ভ ফয়সালা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। (সূরা দুখান: ৪)”
যেমন মৃত্যু বয়স রিজিক ইত্যাদি (কুরতুবী)

এ রাত্রিতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমান নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয়, এমনকি, এ বছর কে হজ্ব করবে, তাও লিখে দেয়া হয়।

ফেরেশতাগণ শবে-কদরে সারা বছরের অবধারিত ঘটনাবলী নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করে। কোন কোন তাফসীরবিদ একে سلام এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে এ অর্থ করেছেন যে, এ রাত্রিটি যাবতীয় অনিষ্ট ও বিপদাপদ থেকে শান্তিস্বরূপ। [ইবন কাসীর]
বা এ রাতে ফেরেশতা আর রূহ তাদের রব-এর অনুমতিক্রমে প্রত্যেক আলাদা আলাদা দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। অথবা এর অর্থ প্রত্যেক বিষয়ের যা আল্লাহ এক বছরের জন্য ফায়সালা করে থাকেন তা নিয়ে তারা আসেন এবং বন্টন করেন।

আয়াতের আলোকে তাকদীরের অর্থ:
তাকদীরের আলোচনা অনেক সুক্ষ্ণ ও জটিল। আমরা তাকদীরকে সাধারণভাবে পুরোপুরি পূর্বনির্ধারিত বলে থাকি, আমরা বলে থাকি ভাগ্যে যা আছে তাই এই কথাটা আসলে পুরোপুরি ঠিক নয় বরং আংশিক ঠিক তাকদীরের কিছু বিষয় পূর্বনির্ধািরিত আবার কিছু অংশ আল্লাহ যেকোনো সময় পরিবর্তন করে থাকেন সেটা নির্ভর করে আপনি সে জন্য কতটা চেষ্টা করেছেন বা দোয়া করেছেন। যেমন আল্লাহ কুরআনে বলেছেন
وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسٰنِ إِلَّا مَا سَعٰى
এবং মানুষ তাই পায়, যা সে করে। সুরা নাজম ৩৯
আরও বলা হয়েছে
لَهُۥ مُعَقِّبٰتٌ مِّنۢ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِۦ يَحْفَظُونَهُۥ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتّٰى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۗ وَإِذَآ أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوٓءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُۥ ۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَالٍ
তাঁর পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তাদের অগ্রে এবং পশ্চাতে, আল্লাহর নির্দেশে তারা ওদের হেফাযত করে। আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোন জাতির উপর বিপদ চান, তখন তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।
সুরা রা’দ ১১

সুরা রাদের এই আয়াতটি একটি চিরন্তন ও সামগ্রীক মূল নীতি। সামাজিক পরিবর্তন সংক্রান্ত ইসলামের এই নীতি আমাদের বলছে যে, যে কোনো পরিবর্তনের জন্য প্রথমে মানুষকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
*“আমাদের ভাগ্যে যেটা আছে সেটাই হবে” এভাবে না বলে বলা যায় আমাদের যেটা হওয়ার কথা বা পাওয়ার কথা সেটাই আল্লাহ আমাদের দেবেন। আমাদের চেষ্টা আমাদের পরিশ্রম দেখেই আল্লাহ আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট নির্ধারণ করবেন। আর এই চেষ্টার শক্তিও আমরা আল্লাহর কাছে চেয়ে নিতে পারি যেটা আমরা বলি তাওফিক। আল্লাহ বলেন-
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسٰنَ فِى كَبَدٍ
নিশ্চয় আমি মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।
সুরা বালাদ ৪
سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ
অর্থাৎ এতে কোন প্রকার অমঙ্গল নেই। অথবা এই অর্থে ‘শান্তিময়’ যে, মু’মিন এই রাতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদে থাকে। অথবা ‘সালাম’-এর অর্থ প্রচলিত ‘সালাম’ই। যেহেতু এ রাতে ফিরিশতাগণ ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে সালাম পেশ করেন বা তাদের জন্য শান্তি কামনা করতে থাকেন।
কোন কোন তফসীরবিদ একে “সালামুন্‌” এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে এ অর্থ করেছেন যে, এ রাত্রিটি যাবতীয় অনিষ্ট ও বিপদাপদ থেকে শান্তিস্বরূপ। (ইবনে-কাসীর)
শবেকদর রাত্রের জন্য নবী (সাঃ) খাস দু’আ বলে দিয়েছেনঃ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন তুহিব্বুল আফ্ওয়া ফা’ফু আন্নী।’
অর্থাৎ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে পছন্দ কর। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
(তিরমিযী দা’ওয়াত পরিচ্ছেদ, ইবনে মাজাহ দু’আ অধ্যায়, দু’আ বিল্আফবে ওয়াল আফিইয়াহ পরিচ্ছেদ)
লাইলাতুল-কদরের এই বরকত রাত্রির শুরু অর্থাৎ সূর্যাস্তের পর হতে ফজরের উদয় পর্যন্ত বিস্তৃত। [সা’দী]

ফযিলাত:
১. শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাযহারি)
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ ঈমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদর রাত্রিতে সালাত আদায় করতে দাঁড়াবে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” [বুখারী: ১০৯১, মুসলিম: ৭৬০, আবু দাউদ: ১৩৭২, নাসায়ী: ৮/১১২, তিরমিযী: ৮০৮, মুসনাদে আহমাদঃ ২/৫২৯]
৩. এ রাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (বয়স, মৃত্যু, রিজিক ইত্যাদি) স্থিরীকৃত হয়।’ (সূরা আদ-দুখান: ৪)
৪. ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত এ রাত শান্তিময়।’(সূরা কদর: ৫)
৫. কেউ কেউ বলেন, ফেরেশতারা ফজর পর্যন্ত ইবাদতগোজার বান্দাদের সালাম দিতে থাকে (তাদের জন্য শান্তি কামনা করে থাকে)। (কুরতুবী: ২০/১৩৪)
৬. লাইলাতুল কদরে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, সবকিছুর পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদেরকে লিখে দেওয়া হয়, এমনকি কে হজ্জ করবে, তা-ও (মাযহারি)
৭. হাদীসে এসেছে, রামাদান আগমনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমাদের নিকট রামাদান আসন্ন। মুবারক মাস। আল্লাহ্ এর সাওম ফরয করেছেন। এতে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়ে থাকে এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানগুলোকে বেঁধে রাখা হয়। এতে এমন এক রাত রয়েছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত্রির কল্যান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সে তো যাবতীয় কল্যান থেকে বঞ্চিত হলো।” [নাসায়ী: ৪/১২৯, মুসনাদে আহমাদ: ২/২৩০, ৪২৫]
স্বাভাবিকভাবেই লাইলাতুল কদরে যদি সারা বছরের বরকত বরাদ্দ দেয়া হয় যে ব্যক্তি অনুপস্থিত সে তো বঞ্তি হবেই।

শিক্ষা:
১. যে কুরআনের মর্যাদায় এই শবেকদর ও রমযান এত মহিমান্বিত সেই কুরআন কতটা মহিমান্বিত সেটা উপলব্ধির মাধ্যমে কুরআনের আলোকে জীবন গড়াই হবে এ মর্যাদার যথাযথ মূল্যায়ন।
২. কুরআন নাযিলই মূলত মানবজাতির ভাগ্যপরিবর্তনের দ্বার উন্মুক্ত করে। কুরআন পাওয়াই সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আর এটাই লাইলাতুল কদরের কদর শব্দটির সবচেয়ে সঠিক অর্থ।
২. নির্দিষ্ট ১ দিন বা ২৭ রমযান নয় আমাদের পূরো রমযানকেই বা কমপক্ষে শেষ ১০ দিন গুনাহ মাফের বিশেষ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো উচিৎ।
৩. ফরয ইবাদতের বাইরে নফল ইবাদতই হল আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ, গুনাহ মাফ, ভাগ্য উন্নয়ন বা রিযিক বৃদ্ধির মোক্ষম উপায়।
আল্লাহ আমাদের লাইলাতুল কদরের যাবতীয় বরকত ও কল্যাণ দান করুন। আমাদেরকে তার দ্বীনের পথে শ্রম দেয়ার ও তার বিধানের আলোকে সমাজ পরিবর্তনের তাওফিক দিন। আমিন।।

সূত্র: তাফসীরে আহসানুল বায়ান, তাফহীমুল কুরআন, তাফসীরে মাযহারি, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে তাবারী, ইবনে কাছির, আসবাবুন নুযূল লিল ওয়াহিদী, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, ফাতহুল কাদীর, ফাতহুল বারী ও অন্যান্য।
https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A6%BE_%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%B0
http://www.quranmazid.com/
www.ihadis.com
www.hadithbd.com