জাহিদ জাওয়াদ |
প্রশ্নটির উত্তর জানতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে ফিকহ কাকে বলে। ইমাম ইবনুল মুবারক রহ.ফিকহে হানাফীকে “আবু হানিফার মত” তাচ্ছিল্য করতে শুনে বললেন,”তোমরা (এটাকে)আবু হানিফার মত বলো না। বরং বলো (এটা)হাদীসের ব্যাখ্যা।” (ফাজাইলে আবু হানিফা,১০১)
সুতরাং ফিকহ হল মূলত কুরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট বিধানাবলী ও ইসলামী ইবাদতসমূহের নিয়ম-কানুনের সুবিন্যস্ত রূপ যা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের শিখিয়েছিলেন: তাঁরা তাবেয়ীগণকে এবং তাঁরা তাদের পরবর্তীদের শিখিয়েছেন। যেখানে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জীবনের সকল ক্ষেত্রের মাসায়েল বিভিন্ন অধ্যায়ে ও পরিচ্ছেদের অধীনে এক জায়গায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।আমরা প্রতিদিন যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি তার তাকবীরে তাহরীমা থেকে সালাম পর্যন্ত মাসালাসমূহ যদি আপনি হাদিসের কিতাব থেকে সংগ্রহ করতে চান তাহলে হাদিসের একটি-দুটি নয় ,দশ-বিশ কিতাবেও তা একসাথে পাবেন না।নামাজের বিবরণ সংক্রান্ত হাদিস যেগুলো একশরও অধিক কিতাবে বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে তা যদি আপনি এক জায়গায় একত্র করেন তারপরও এ সংক্রান্ত মাসআলা জানার জন্য আপনাকে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হবে।
হাদীসগুলোর সহীহ-যয়ীফ নির্ণয় করা, সেগুলোর সঠিক মর্ম নির্ধারণ করা। সেগুলোর মধ্যকার বৈপরীত্য দূর করা। এবং নামাজের প্রতিটি কাজের সুনির্দিষ্ট হুকুম (ফরজ,ওয়াজিব)বের করা। এগুলো কোন কিছুই হাদীসের কিতাবে নেই এবং এগুলো খুবই স্পর্শকাতর কাজ যা কেবল মুজতাহিদ ফুকাহায়গণের পক্ষেই আন্জাম দেয়া সম্ভব। (নির্বাচিত প্রবন্ধ,মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক হাফি:)
সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না রহ.যিনি ছিলেন অনেক উচ্চ পর্যায়ের মুহাদ্দিস। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের দাদা উস্তাদ। তিনি বলেছেন, الحديث مضلة إلا للفقهاء অর্থাৎ ফকীহগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদীস শরীফ বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (ইবনুল হাজ্জ মালেকী, আল মাদখাল, ১/১২৮) তিনি আরো বলেছেন, التسليم للفقهاء سلامة في الدين অর্থাৎ ফকীহগণের হাতে নিজেকে ন্যাস্ত করাই দ্বীন কে নিরাপদ রাখার নামান্তর। (তারীখে বাগদাদ, ৭/৫৬১)
আর ইমাম তিরমিযী বলেছেন, كذلك قال الفقهاء وهم أعلم بمعاني الحديث অর্থাৎ ফকীহগণ এমনটাই বলেছেন। আর হাদীসের মর্ম সম্পর্কে তারাই সবিশেষ জ্ঞাত।
তো ফুকাহায়ে কেরাম এইসব কাজগুলো করে উম্মতের জন্য সুবিন্যাস্ত ও বিস্তারিত আকারে সংকলন করে গেছেন। পাশাপাশি যেসকল মাসআলার আলোচনা কোরআন হাদিসের স্পষ্টভাবে নেই শরীয়তের নীতিমালার আলোকে সেই মাসআলাগুলো যুগ যুগ ধরে ফকীহগণ সংকলন করে গেছেন। জনৈক আলিম খুব সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন,ফিকহকে বপন করেছেন ইবনে মাসউদ রা.এতে পানি সিঞ্চন করেছেন আলকামা,এর ফসল কর্তন করেছেন ইবরাহীম,মাড়াই করেছেন হাম্মাদ,পেষণ করেছেন আবু হানিফা,খামিরা করেছেন আবু ইউসুফ,রুটি বানিয়েছেন মুহাম্মাদ রহ. আর এখন খাচ্ছে পুরো মুসলিম উম্মাহ।” (রদ্দুল মুহতার)
এই কথা তিনি ফিকহে হানাফীর ক্ষেত্রে বললেও এটি অনুসৃত অন্যান্য ফিকহের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ফিকহের এই পরিচয় পাওয়ার পর আমরা সহজেই বুঝতে পারলাম,ফিকহ আসলে হাদিস থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয় বরং হাদিস শরীফের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং হুকুম-আহকামের সুবিন্যস্ত ও সংকলিত রূপ।তাই খোদ হাদিসের জন্য এবং সহজভাবে সঠিক পন্থায় হাদীসের অনুসরনের জন্যই ফিকহের প্রয়োজন। আজকাল হাদীস অনুসরণের নামে ফিকহে ইসলামী ও হাদীস শরীফকে যেভাবে পরষ্পর বিপরীতমুখী করে দাঁড় করানো হচ্ছে,ফিকহের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে এটা কখনো হাদীসের অনুসরন হতে পারে না বরং এটা একটি ঐতিহাসিক দ্বীনি সিলসিলার বিরুদ্ধাচরণ ও হাদীস অনুসরণের বিদায়াতী পন্থা।
লেখাটি মিম্বার ফেসবুক গ্রুপের “মিম্বার ম্যাগাজিন” থেকে সংগ্রহীত।