ডা. সাঈদ |
ইসলাম শাশ্বত ও চিরন্তন ধর্ম। এর বিধিবিধান সব কিছু পরিব্যাপ্ত, বিস্তৃত। মানবজীবনের সব দিক আলোচিত হয়েছে এখানে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের প্রসঙ্গও এ ধর্মে উপেক্ষিত হয়নি। পশু-পাখি প্রকৃতির অন্যতম উপাদান। এগুলোর ব্যাপারেও রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান।
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে একটি সংগঠন প্রাণীদের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার হয়। ধীরে ধীরে তাদের চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশে দেশে। বলা যায়, তখন থেকেই সভ্য দুনিয়া পশু-পাখির প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শনে মনোযোগী হয়েছে। পরে আরো কিছু সংগঠন প্রাণিজগতের অধিকার আন্দোলনে যোগ দেয়। তবে তাদের কার্যক্রম ছিল সচেতনতামূলক। এর জন্য কারো ওপর আইনকানুন ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। অথচ আমরা পবিত্র কোরআন ও হাদিসে দেখতে পাই, প্রকৃতি ও প্রাণিজগৎ নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত সুবিন্যস্ত। পশু-পাখির অধিকার রক্ষায় ইসলাম নির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। প্রাণীদের অধিকার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি শরয়ি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
পশু-পাখির বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
এটা সত্য যে মানুষই এই পৃথিবীতে মুখ্য। তবে জড় জগৎ, জীব জগৎ ও উদ্ভিদ জগৎও এই পৃথিবীর উপাদান। জড় জগৎ প্রাণহীন। উদ্ভিদ জগতেও আছে ন্যূনতম প্রাণের স্পন্দন। পশু-পাখির মধ্যে প্রাণের উপস্থিতির পাশাপাশি রয়েছে আহার-বিহার, বিচরণ ও সন্তান ধারণের ক্ষমতা। এসব গুণ-বৈশিষ্ট্য আছে মানুষেরও। এরই সঙ্গে মানুষের আছে বিবেক ও বোধশক্তি; জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা এবং সত্য-মিথ্যা পরখ করার ক্ষমতা। এই গুণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ জীবের আসনে সমাসীন। ইসলাম মনে করে, এই পৃথিবীতে মানুষের পরেই প্রাণিজগতের স্থান। প্রাণিজগৎকে পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিয়ে কোরআন বলছে : ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে আর যত পাখি দুই ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতো একেক জাতি।’ (সুরা আনআম, আয়াত ৩৮)
পবিত্র কোরআনে বিক্ষিপ্তভাবে অসংখ্য আয়াতে প্রাণিজগতের প্রসঙ্গ এসেছে। এর বাইরেও পৃথকভাবে বিভিন্ন প্রাণীর নামে অনেকগুলো সুরার নামকরণ করা হয়েছে। যেমন সুরা বাকারা (গাভি), সুরা আনআম (উট, গরু, বকরি), সুরা নাহল (মৌমাছি), সুরা নামল (পিপীলিকা), সুরা আনকাবুত (মাকড়সা), সুরা ফিল (হাতি) ইত্যাদি। এসব নামকরণ থেকে প্রাণিজগতের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে।
পশু-পাখির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি খাবার-দাবার ও প্রয়োজনে ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম এগুলোকে প্রকৃতি ও পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কোরআনের বক্তব্য দেখুন : ‘প্রাণিকুল সৃষ্টির (অন্যতম) কারণ হলো, এগুলোতে তোমরা আরোহণ করে থাকো আর এগুলো সৌন্দর্যের প্রতীক।’ (সুরা নাহল, আয়াত ৮)
ইসলাম ধর্ম মতে, পশু-পাখির প্রতি নম্রতা প্রদর্শন ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত। পশু-পাখিকে কষ্ট দেওয়া গুনাহের কাজ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একবার এক পিপাসাকাতর কুকুর কূপের পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। পিপাসায় তার প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচারী নারী তা দেখতে পায়। সে নিজের পায়ের মোজা খুলে কুকুরটিকে পানি পান করায়। এ কারণে তার অতীত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি : ৩৪৬৭)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘একজন মহিলা একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। সে তাকে খাবার দিত না আবার ভূখণ্ডে বিচরণ করে খাবার সংগ্রহের সুযোগও দিত না। এ কারণে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে।’ (বুখারি : ৩৩১৮)
অন্যত্র এসেছে : ‘যেকোনো প্রাণীর ওপর দয়া করার মধ্যেও সওয়াব আছে।’ (বুখারি : ৬০০৯)
পশু-পাখির যেহেতু বোধশক্তি নেই, ভালো-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা নেই, তাই পশু-পাখির মাধ্যমে মানুষ বা সম্পদের কোনো ক্ষতি হলে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। তবে এগুলোর সঙ্গে মালিক বা রাখাল থাকলে জরিমানা দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘চতুষ্পদ জন্তুর অনিষ্ট ক্ষমাযোগ্য।’ (বুখারি শরিফ : ৬৯১২)
পশু-পাখির অধিকার
পশু-পাখি মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত। কুদরতিভাবে আল্লাহ তাআলা এগুলোকে মানুষের করায়ত্ত করেছেন। এরা অবশ্যই করুণার পাত্র। ইসলাম ধর্ম মতে, পশু-পাখির সঙ্গে যথাসম্ভব দয়াশীল আচরণ করতে হবে। এদের সঙ্গে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। পশু-পাখির অঙ্গহানি করা নিষিদ্ধ। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে।’ (বুখারি : ৫১৯৫)
পশু-পাখিকে অহেতুক নিশানা বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর জমিনে তাদের অবাধ বিচরণের সুযোগ দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুই পাখি মেরে ফেলল, কিয়ামতের দিন পাখিটি আল্লাহর কাছে এই বলে নালিশ করবে যে হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে।’ (নাসায়ি, ইবনে হিব্বান)
যেসব প্রাণী প্রতিপালন করা হয়, সেগুলোর সুস্থতা ও খাবারদাবারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ওয়াজিব। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেছেন, ‘এসব বাক্শক্তিহীন প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। সুস্থ অবস্থায় এগুলোতে আরোহণ করো, সুস্থ অবস্থায় আহার করো।’ (আবু দাউদ : ২৫৪৮)
আমিষজাতীয় খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব ধর্ম, দর্শন ও সভ্যতার মানুষের মধ্যে ঐক্য দেখা যায়। যদিও নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে তাদের বিরোধও বিদ্যমান। হাজারো প্রাণীর মধ্যে ইসলাম সীমিত কিছু পশু-পাখি খাদ্য হিসেবে গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো জবাই করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অনুকম্পা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা জবাই করবে, সর্বোত্তম পন্থায় করবে। জবাইয়ের বস্তু ভালোভাবে ধার দিয়ে নেবে আর পশুটিকে স্বাভাবিকভাবে প্রাণ বের হওয়ার সুযোগ দেবে।’ (মুসলিম : ১৯৫৫)
তাই ফোকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, পশুদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এক পশুর সামনে অন্য পশু জবাই করা যাবে না। পরিপূর্ণ নিস্তেজ হওয়ার আগে ছুরিকাঘাত কিংবা চামড়া সরানো মাকরুহে তাহরিমি।
ইসলামে কোনো জীবন্ত পশু-পাখি আগুনে পোড়ানো নিষিদ্ধ। হজরত আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে এক সফরে আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গী ছিলাম। তিনি দেখতে পেলেন, আমরা একটা মৌমাছির বাসা জ্বালিয়ে দিয়েছি। তিনি বললেন, ‘কে এটি জ্বালিয়ে দিয়েছে?’ আমরা নিজেদের কথা বললাম। তিনি বলেন, ‘আগুনের স্রষ্টা ছাড়া কারো জন্য আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া শোভা পায় না।’ (আবু দাউদ : ২৬৭৫)
ফিকাহবিদরা বলেন, পিঁপড়া দংশন না করলে তাদের মেরে ফেলা মাকরুহ। আর এদের পানিতে নিক্ষেপ করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। বিচ্ছুকেও আগুনে পুড়ে ফেলা মাকরুহ।’ (ফতোয়ায়ে বাজাজিয়া : ৬/৩৭০)
পশু-পাখি জীবিত থাকা অবস্থায় তার কোনো অঙ্গ কর্তন করা যাবে না। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জীবিত অবস্থায় যে প্রাণীর কোনো অংশ কাটা হয়, সেটা মৃত তথা হারাম হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ১৪৮০)
পশু-পাখির চেহারায় প্রহার করা, অঙ্কিত করা ও চিহ্ন ব্যবহার করে চেহারা বিকৃত করা নিষিদ্ধ। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, চেহারায় প্রহার ও অঙ্কন করতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম : ২১১৬)
ইমাম নববি (রহ.) লিখেছেন, ‘যেকোনো প্রাণির চেহারায় আঘাত করা নিষিদ্ধ।’
পশু-পাখি আল্লাহর সৃষ্টি। এগুলোকে অশুভ মনে করা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। এমনকি পেঁচা বা সফর মাসেও কোনো কুলক্ষণ নেই।’ (বুখারি) অহেতুক পশু-পাখির পেছনে লেগে থাকা, অযথা এগুলোকে শিকার করা ইসলামে নিন্দনীয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানিও না।’ (মুসলিম : ১৯৫৭)
হজরত সাইদ ইবনে জুবাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হজরত ইবনে ওমর (রা.) কোরাইশ গোত্রের একদল বাচ্চাকে দেখতে পেলেন যে তারা পাখি শিকার করছে। এটা দেখে ইবনে ওমর (রা.) তাদের পৃথক করে দেন এবং বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে কোনো প্রাণবিশিষ্ট বস্তুকে লক্ষ্যবস্তু বানায়।’ (মুসলিম : ১৯৫৮)
সম্প্রতি গত কয়েকদিন আগে প্রচার করা হয়েছে, অধিক পানি পান করার অপরাধে ১ থেকে দেড় হাজার উট গুলি করে হত্যার ঘোষণা এবং তা বাস্তবায়ন করেন, অস্ট্রেলিয়ান সরকার। উট গুলোকে খাওয়ানোর দ্বায়িত্ব কি আপনাদের হাতে ছিলো? তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করেন কে? কে তাদেরকে পানি পান করান? আল্লাহ তায়ালা কি তাদের রিজিকের দ্বায়িত্ব নেননি?
অথচ গত কয়েক সপ্তাহে দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে গাছ পালা, পশু পাখিসহ অনেক জীব জন্তু! এর পরেও কি আল্লাহর গজবের ভয় তাদের দিলে জায়গা পায় না? নাকি আরও বড় ধরনের গজবের আশায় এমন জঘন্য ঘৃণ্য কাজ করেছে? অচিরেই আবার পাকড়াও হবেন আর, আল্লাহর গজবে পরিবেষ্টিত হবেন। এসব অবলা প্রানী গুলোকে হত্যার দ্বায়ে।
কোথায় তোদের গণমাধ্যম সংস্থা গুলো? মুসলিমদের কুরবানীতে যাদের পশু প্রেমে মায়া বেড়ে যায়, কোথায় আজকে সেই সুশীলরা??