বুরহান উদ্দিন |
মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী বিপর্যয় ডেকে এনেছে পূঁজিবাদী সভ্যতা। বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে যে শ্রেণী বৈষম্য মানবতার ইতিহাসে তা আর কক্ষনো দেখা দেয়নি। সমগ্র মানবতা আজ পুঁজিবাদী সভ্যতার ফাঁদে বন্দী।
১৮৬০ সালে শিল্প উন্নত দেশ সমূহ দরিদ্র দেশ সমূহের তুলনায় যেখানে ৩ গুন বেশী ধনী ছিল সময়ের ব্যবধানে সেই দেশ সমূহ ১৯৬০ সালে এসে ৬০ গুন বেশী ধনী দেশে রূপান্তরিত হয়। বর্তমান সময়ের তারা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ গুন বেশী ধনী।
আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির জনক বলা হয় অ্যাডাম স্মিথকে। তার Wealth of Nations বইকে আধুনিক অর্থশাস্রের বাইবেল বলা হয়ে থাকে।
অ্যাডাম স্মিথ মূলত প্রভাবিত হয়েছিলেন হল্যান্ডের দার্শনিক Bernard Mandeville দ্বারা এবং বিশেষ করে তার লেখা বই “The Fable of the Bees or Private Vices, Publick Benefits” কে তিনি পরবর্তীতে থিওরিতে পরিণত করে পুঁজিবাদকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেন।
আসুন এখন Bernard Mandeville এর লেখা বই “The Fable of the Bees or Private Vices, Publick Benefits” কি আছে সেটাতে একটু চোখ বুলিয়ে নেই।
অনেক দিন আগে একটি মৌচাক ছিল। মৌচাকটি ছিল একটি ছোট রাষ্ট্রের মত। সেই রাষ্ট্রের পরিচালক মৌমাছিরা ছিল বড় বড় দুষ্কৃতিকারী। আদালত তো দূরে থাকুক আদালত নামে কোন শব্দেরই অস্তিত্ব ছিল না। মৌচাক নামক এই রাষ্ট্রটি রাষ্ট্রীয় ভাবে অনেক দুষ্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ফলফল কেন্দ্রীক রাজনীতির কারণে সেই রাষ্ট্রের কর্তাদের সকল কূটকৌশলকে তাদের বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হত। ধূর্ত প্রতারকদেরকে সবাই মান্য করে চলত।
সেই রাষ্ট্রে বসবাস কারী সকল মৌমাছির উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে নিজের জন্য একটি অংশকে নেওয়া। মৌচাকের সদস্যরা তাদের আয়-উপার্জন কে বেশী করার জন্য নতুন নতুন বিনিয়োগ ক্ষেত্র তৈরি করলে রাষ্ট্রের অর্থনীতি একটু উন্নতির দিকে যায়। এবং এক পর্যায়ে দেশটি উন্নতির উচ্চ শিখরে এসে উপনীত হয়। ধূর্ত প্রতারকদের হাত ধরে দেশ আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করলে, নেতাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বৃদ্ধ মৌমাছিরা বিদ্রোহ করে এক সাথে জড়ো হয় এবং তাদের সৃষ্টি কর্তার কাছে তাদের দেশে আখলাক পাঠানোর জন্য দোয়া করে।
এই দোয়া সাথে সাথে সৃষ্টি কর্তার দরবারের কবুল হয়ে যায় এবং তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সকল মৌমাছিরা আখলাক সম্পন্ন হয়ে উঠে। ফলে ধন-সম্পদের প্রতি কোন মৌমাছিরই আর কোন লোভ লালসা ছিল না। কেউ আর নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহন করতে চাচ্ছিল না। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক অপ্রত্যাশিত ফলাফলও দেখা দেওয়া শুরু করে। কেউ আর বিচারের জন্য কোর্টে যাচ্ছিল না, রাষ্ট্রের অনেক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ে। সকলেই কম করে ভোগ করা শুরু করে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করার ফলে উৎপাদন কমে যায়। সারা দেশ বেকারত্ত্বে ছেয়ে যায়। সেখানে বসবাসকারীদের মধ্যে উন্নতি ও অগ্রগতির কোন প্রতিযোগিতা না থাকার ফলে কেউ আর নতুন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছিল না। অবস্থা এমন হওয়ায় সেনাবাহিনীও পুলিশের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়।
এই মৌচাকে বসবাসকারী সকল মৌমাছিরা ছিল শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে। তারা অন্য কোন মৌচাকের সাথে কোন ধরণের যুদ্ধ বিগ্রহ চাচ্ছিল না। কিন্তু একদিন এক শত্রু মৌচাক রাষ্ট্র এই আখলাক সম্পন্ন মৌচাকের উপর আক্রমন করলে আখলাক সম্পন্ন মৌচাকটি হেরে যায়। কারণ তাদের সেনাবাহিনী, ও আরও অন্যান্য অনেক কিছু না থাকায় তারা হেরে যায়। অনেক মর্মান্তিক ঘটনার পরে তারা খুব কষ্টে একটি গাছের গর্তে লুকাতে সক্ষম হয় এবং সেখানে অল্প সংখ্যক আখলাক সম্পন্ন মৌমাছি নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়।
Bernard Mandeville তার এই বইটি প্রকাশ করেন ১৭১৪ সালে। এই বইটি প্রকাশের পর সবচেয়ে মজার যে ঘটনা ঘটে তা হল এই বইটি সাহিত্যিক অঙ্গনের চেয়ে, অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনীতি ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করতেন তাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
Bernard Mandeville তার বইয়ে দাবী করেন যে, সকল মানুষই স্বার্থপর, এটা তার জন্য খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় এবং এমটাই হওয়া উচিত। তার মতে সততা কিংবা পরার্থপরতা একটি সমাজকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে পেছনের দিকে নিয়ে যায়। লেখকের মতে শ্রমিক শ্রেনী থেকে শুরু করে ডাক্তার পর্যন্ত সমাজের সকল শ্রেনী পেশার মানুষ যদি স্বার্থপর হয়ে নিজের উন্নতির জন্য কাজ করে তাহলে সেই সমাজে প্রাচুর্যের সৃষ্টি হবে। তার মতে অন্যের ভালোর কথা চিন্তা করে কাজ করলে তা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। Bernard Mandeville র মতে “ চরিত্রহীন হওয়া ছাড়া একটি সমাজ কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। সকল ধরণের সুখ কেবলমাত্র চরিত্রহীন হলেই পাওয়া সম্ভব। একমাত্র স্বার্থপরতাই মানুষকে সুখী করতে পারে’
মূলত এটাই হল বর্তমান পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি। এই নীতির উপর গড়ে উঠা পূঁজিবাদী সভ্যতার কারণেই সমগ্র মানবতা আজ এক ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন। Homo Economicus এর যে ধারণা এই ধারণা মূলত এই দর্শন থেকেই উৎসারিত।
পূঁজিবাদী সভ্যতার মূল কথাই হল স্বার্থপরতা ছাড়া, লোভ-লালসা ছাড়া এবং অন্যের সম্পদকে গ্রাস করা ছাড়া একটি দেশের উন্নতি সম্ভব নয়।
এখন আসুন জেনে নেই ইসলামী সভ্যতা কি বলে? মানবতার মহান শিক্ষক রাসূলে আকরাম (সঃ) একটি হাদীসে বলেন,
إن مَثَل المؤمن لكمَثَل النَّحلة، أكلَتْ طيبًا، ووضعَتْ طيبًا، ووقعَتْ فلم تكسِرْ ولم تُفسِدْ
অর্থাৎঃ “নিশ্চয় একজন মুমিনের উপমা হল মৌমাছির মত। সে উত্তম জিনিস খায় এবং উত্তম জিনিস উৎপাদন করে। সে তার অবস্থান গ্রহণ করবে কিন্তু কোন কিছু ভাঙবেও না ধ্বংসও করবে না।”
এটাই হল ইসলামের মূল কথা। ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে মানুষের সেবাই হল স্রস্টার সেবা। মৌমাছি যেমন উত্তম জিনিস উৎপাদন করে নিজে খায় এবং অন্যকে খাওয়ার সুযোগ করে দেয় একজন মুসলমানও তেমন হবে। ইসলাম চায় মানুষ পরস্পরের প্রতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর হবার পরিবর্তে সহধর্মী ও সহযোগী হবে। ইসলাম একদিকে আখলাকের শিক্ষার মাধ্যমে জনগনের মধ্যে অক্ষম ও পেছনে পড়ে থাকা মানুষের আশ্রয় প্রদানের মানসিকতা সৃষ্টি করতে চায়; অপরিকে সমাজে একটি শক্তিশালী সংস্থা গড়ে তুলতে চায় যে অক্ষম ও অসহায় লোকদের সাহায্য করার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে এমন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যাতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। আর সামাজিক স্বার্থের জন্যও তার স্বাধীনতা কোন ক্ষতির কারণ না হয় এবং অবশ্যই কল্যাণ হব হয়।
বুরহান উদ্দিন | আঙ্কারা, তুরস্ক