মো: সাইফুদ্দীন খালেদ
উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক দিক দিয়ে। পাঠ্যশিক্ষার হার বাড়ছে দিন দিন, কিন্তু এই শিক্ষার আসল সুফল কি সমাজ পাচ্ছে? এক দিকে বাড়ছে শিক্ষার হার, অন্য দিকে সমাজে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা, কলহ, অশ্লীলতাসহ নানা অপরাধপ্রবণতা। সমাজ ক্রমেই হয়ে উঠছে অস্থির।
সামাজিক শৃঙ্খলা আর মূল্যবোধ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়, আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমাজব্যবস্থা। নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতির বেপরোয়া অনুকরণ, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব এবং পারিবারিকভাবে মৌলিক শিক্ষার ঘাটতি আজকের যুবসমাজ পরিণত হতে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধহীন এক যান্ত্রিক মানুষ। একটা সমাজের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, আচরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সামাজিক মূল্যবোধ। অথচ আজকের দিনে বিষের মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে হিংসা, দলাদলি, অন্যায়-অনাচার, দুর্বলের ওপর অকথ্য নির্যাতন, ঘুষ, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য কার্যকলাপ; যা বিশ্বের কাছে আমাদের জাতির জন্য লজ্জার।
নৈতিক মূল্যবোধের এই ধ্বংসাত্মক চিত্র রোধে কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন অতীব প্রয়োজন। এই নিশ্চিত অধপতন ঠেকাতে সন্তানদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সমানভাবে দেয়া প্রয়োজন। তা হতে হবে ব্যবহারিক কাজের মধ্যে, তাদের বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করে নষ্ট চিন্তা থেকে দূরে রাখতে হবে। তা ছাড়া পাঠ্যবইয়ের বাইরেও শিক্ষামূলক গল্প কাহিনী পড়ায় আগ্রহী করে তোলা অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর জীবনকে কোনো আদর্শের লক্ষ্যে পরিচালিত করে তার চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করা। সত্য বলা, কথা দিয়ে কথা রাখা, মানুষ ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতাবোধ, দয়া-করুণা, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ, শান্তি, মানবাধিকার, পারস্পরিক অধিকার ও মর্যাদা দেয়ার মানসিকতা ও অভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি সামাজিক কল্যাণমূলক ও দেশের মানোন্নয়নমূলক মানবীয় গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দেয়া হয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা।
একটি শিশুর প্রাথমিকভাবে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার গুণাবলি তার পরিবারের মাধ্যমেই শুরু হয়। পরিবারের, বিশেষ করে মায়ের কাছ থেকেই সে প্রাপ্ত হয় বিশেষ নৈতিক শিক্ষা। তারপর তাকে শিক্ষা দেয় সামাজিক পরিবেশ এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। একজন প্রকৃত শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিতভাবে সেই সব শিক্ষা দেন, যা তাকে মূল্যবোধ তৈরি করতে সহায়তা করে। শিক্ষকরাই হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকের চলাফেরা, ওঠা-বসা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ সব কিছু একজন ছাত্রের ওপর প্রভাব ফেলে, তাই শিক্ষককে সদা সতর্ক থাকতে হয় এবং ছাত্রের সুষ্ঠু মেধা বিকাশে যত্নশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। কারণ একটি ফুলের বাগান তত্ত্বাবধায়কের অবহেলা কিংবা অযত্নের কারণে অনেক ফুলের কলি ঝরে যেতে পারে। তেমনি শিক্ষকের যথাযথ ভূমিকা, সহযোগিতা, তত্ত্বাবধান ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন বিনষ্ট হতে পারে।
অপর দিকে, একজন শিক্ষকের একটু উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নৈতিক মূল্যবোধের দিকনির্দেশনার ফলে একজন ছাত্রছাত্রী নিজের জীবন গঠন করে শুধু দেশের নয়, সমগ্র মানবতার কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। সমস্যা এখন এটাই যে, আধুনিক শিক্ষার মাপকাঠিতে বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার আলাদা করে কোনো ক্লাস হয় না। যা একান্তভাবে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না কোনো মতেই। শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক পড়ানোর সময় নিজেদের মতো করে নৈতিক শিক্ষা দিতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই তা গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণভাবে সেই শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। নৈতিকতা জোর করে কাউকে গ্রহণ করাতে বাধ্য করা যায় না। যদি না সে নিজে তা গ্রহণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে মা-বাবার দায়িত্ব অনেক।
সন্তানের নৈতিক শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম মা। তিনি যতটা শেখাতে পারেন, শিক্ষক বা সমাজ ততটা পারে না। সমাজ থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ আর নৈতিক শিক্ষাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সভ্য ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হয় না। প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবার ও সমাজের নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত আলাদা কাউন্সেলিং ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরিবারের অভিভাবকদেরও নিজের সন্তান ও অন্যান্য সদস্যের আচার-আচরণ এবং চলাফেরার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। দল-মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে নৈতিক মানের অবক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্য এবং পরিবার-শিক্ষক সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে।
এমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যে শিক্ষা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জ্ঞানী, দক্ষ ও ভালো-মন্দ বোঝার মতো করে গড়ে তোলার পাশাপাশি হৃদয়বান, রুচিশীল, নান্দনিক, নৈতিক ও মানবিক বোধসম্পন্ন, ধার্মিক, দেশপ্রেমিক ও সর্বোপরি আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা জরুরি।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট