ইসলাম ধর্মে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রুকনের মধ্যে হজ হচ্ছে চতুর্থ রুকন বা স্তম্ভ। সম্পদশালী ও বিত্তবানদের জন্য হজসহ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভই ফরজ। কালেমা, নামাজ, রোজা হচ্ছে কালবি ইবাদত। আর হজ হচ্ছে আর্থিক ও বদনি বা শারীরিক ইবাদত। হজ ইসলামী কানুনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কানুন বা ইসলামী সংস্কৃতি।
এমনিভাবে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আনআমের ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘হে রাসূল সা: আপনি বলে দিন’, ‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার হজ, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু একমাত্র বিশ্ব জাহানের প্রতিপালকের জন্য।’ খেয়াল করেছেন? এ কথা বলার অর্থ কী? আপনার নিজের বলতে কিছুই নেই। সব সমর্পণ করেছেন আল্লাহ রাহে।
বুখারি শরিফের প্রথম খণ্ডের ১৪৯৯ নং হাদিসে পাওয়া যায়, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অশ্লীলতা ও পাপমুক্ত হয়ে হজ আদায় করল, সে যেন নবজাতক শিশু হয়ে ঘরে ফিরল।’
বায়হাকি শরিফে পাওয়া যায়, হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘যে বান্দার শরীর আমি সুস্থ রেখেছি এবং তার জীবনযাত্রার সচ্ছলতা দান করেছি, এভাবে পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সে আমার ঘরে আগমন করল না। সে বঞ্চিত ও হতভাগা।’
বায়হাকি শরিফের অন্য হাদিসে পাওয়া যায়, হজরত আবু উসামা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করিম সা: থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘যাকে প্রকাশ্য কোনো প্রয়োজন বা বাধাদানকারী কোনো রোগ অথবা অত্যাচারী বাদশাহ হজ করতে বাধা না দেয়া সত্ত্বেও হজ করল না, চাই সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করুক বা নাসারা হয়ে মৃত্যুবরণ করুক।’ এসব আলোচনায় তাহলে কী বোঝা গেল? হজের গুরুত্ব অপরিসীম। হজে মকবুল তথা একজন কবুলকৃত হজকারী আল্লাহর দরবারের বিশেষ মেহমান। তিনি আল্লাহর কাছে যে দোয়াই করেন, আল্লাহ পাক তা কবুল করে নেবেন।
আমি এই সম্মানের অধিকারী হাজী ভাই-বোনদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছি।
আপনারা যারা হজ করেছেন, আল্লাহ আপনাদের তৌফিক দিয়েছেন, এখন কি মনে করেন? আপনাদের আর কোনো ইবাদত করা লাগবে না, এটা মনে করার সুযোগ নেই। বরং হজ করার কারণে দায়িত্ব বেড়ে গেল। আপনাদের এখন গুরু দায়িত্ব হলো ইসলাম প্রচারকের দায়িত্ব পালন করা। আপনাদের চালচলনে, কথাবার্তায়, কাজকারবারে খোদাভীতি বা খোদার প্রেম দেখা যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাহলে অন্যরা উদ্বুদ্ধ হবেন হজ করতে। না হজের ব্যাপারে সবার ধারণাই উল্টে যাবে।
মনে রাখবেন, হজ পালনকারী ব্যক্তি আর মৃত ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য নেই। আপনি ইহরাম বাঁধলেন মানে মুর্দা হলেন, কাফনের কাপড় পরলেন। যদি এই মনোবাসনা না করেন, তবে আপনার হজ কেমন হয়েছে আল্লাহই ভালো জানেন। আপনারা সৌভাগ্যবান, কিন্তু সেই সম্মান ধরে রাখতে হবে। হজ করে এসে যদি আপনারা আগের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন, কটুকথা বলেন, ভুলভাল বলেন, মন্দ বলেন, গিবত করেন, পর্দা লঙ্ঘন করেন, হাতে চুরি, কলমে চুরি, ঘুষ-দুর্নীতিসহ যাবতীয় খারাপ কাজ করেন, তাহলে অন্যদের হাসির পাত্র হবেন। ইসলামের সাথে লুকোচুরি করলেন।
আসলে হজের আগে ফরজ ওয়াজিবগুলো ঠিক করা উচিত। অর্থ আছে বলে মক্কা গেলেন-আসলেন তাতে কী হলো? আপনার নামের আগে হাজী শব্দটা যুক্ত করলেন। যার কোনো গুরুত্ব আল্লাহর দরবারে নেই। আপনি হাজী সাহেব, আপনার বউকে সাথে নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন, তিনি পর্দার সাথে নেই, এটা কি আপনার বিবেকে লাগল না? আপনার ঘরে সাত বছরের বড় সন্তান আছে, সে নামাজ পড়ে না। আপনি তাকে নামাজের জন্য বললেনও না। ইসলামের ধারক-বাহক হবেন কী করে? এসব বিষয়ে কি আপনাকে জবাব দিতে হবে না? মনে রাখবেন, দায়ী ইলাল্লাহ হতে হবে আপনার সব কিছুতে।
কী চিন্তা করেছেন? ইসলাম এত সোজা! কালেমার অর্থসহ ব্যাখ্যাটা খেয়াল করেছেন? আপনার সব ইচ্ছাকে নিহত করে আল্লাহর গোলামি ও রাসূল সা:-এর আনুগত্যকে প্রধান্য দেয়াই কালেমার দাবি। আপনি সেখানে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, বলে কী বুঝিয়েছেন জানেন? কাফনের কাপড় পরে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন আপনি তাঁর দরবারে পৌঁছে গেছেন।
আপনার নিজের ভেতরে কিংবা পরিবারেই যদি হজের আমল পৌঁছল না, আসমানে কিভাবে পৌঁছবে? আল্লাহর বান্দারা একসময় আল্লাহর প্রেমে ছয় মাস জাহাজে করে মদিনায় যেতেন-আসতেন। ‘জীবনটাই আল্লাহর জন্য’ এ কথা মানতে হবে। আপনিতেই মুখে আল্লাহর প্রশংসা আসবে। খোদার প্রেমের সাথে মানব প্রেম থাকতে হবে।
একজন হাজীর চালচলনে, কথাবার্তায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে আল্লাহওয়ালা হলেন কিভাবে? একজন হাজী ভাই হজ করে এসে সেখানকার তিক্ত অভিজ্ঞতা লিখেছেন। তিনি গেলেন আর আসার জন্য পেরেশান হয়ে গেলেন। অন্যের দোষগুলো বর্ণনা করলেন। আরে! আপনি তো লক্ষ লোকের চেয়ে ভাগ্যবান, যেতে পেরেছেন তাই সৌভাগ্য। মক্কায় গেলে তো আপনি কাবার সান্নিধ্যে রাত কাটিয়ে দেয়ার কথা। হাজী তো হওয়ার কথা তিনি, যিনি আল্লাহ ও তাঁর নবীর প্রেমে মশগুল হয়ে যাবেন। হাজীরা তো মৃত। দুনিয়ার মোহ তাঁর থাকবে না। যারা হজ করেননি, আশা করি তাঁরা হজের গুরুত্ব ও সম্মান বোঝে ফরজ, ওয়াজিবগুলো শিখে আল্লাহর এই ইবাদতের জন্য নাম লিখাবেন। তাতে আপনিও তৃপ্তি পাবেন, অন্যরাও আপনাকে দেখে ইসলাম শিখবে। সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, ‘সিবগাতাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও। Be color by the colored of Allah.
সমাজে দেখে থাকবেন কিছু রিকশাচালক, ভ্যান ড্রাইভার, গাড়িচালক মুখে সুন্দর লম্বা দাড়ি রেখেছেন, কিন্তু এক ওয়াক্ত নামাজও পড়তে দেখা যায় না। কী বুঝাচ্ছেন এই দাড়ি রেখে? শয়তানের কাজ করে দাড়িকে অপমান করা হলো না?
আপনার বিচারে ন্যায়ের ধর্ম থাকতে হবে। আল্লামা ইকবালকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি পাশ্চাত্যে লেখাপড়া করেছেন, কিভাবে ইসলামের জন্য এত সুন্দর সুন্দর লেখা লিখলেন? তিনি উত্তরে বললেন ‘সুরমাথা আঁখ মেরা খাকে মদিনা’। ‘আমার চোখে সবসময় মদিনার সবকিছু সুরমার মতো লাগানো ছিল।’
সর্বশেষ অনুরোধ, প্রত্যেকটি মুমিন মুসলমান মনে রাখা উচিত, আল্লাহ পৃথিবীর ভিডিও থেকেও বড় ভিডিও ফিট করে রেখেছেন আমাদের শরীরে। বিচার দিবসে সে ভিডিও ছেড়ে দেয়া হবে। আর তখন সবাইকে নিজ নিজ আমলের জবাব দিতে হবে।
আমাদের উচিত, অন্তত হজের পর সব আমল যেন মানতে পারি। হাজী সাহেবদের চিন্তাচেতনা যেন সবার থেকে ভিন্ন হয়। তাই আপনারা এমনভাবে চলুন, যেন আপনাদের দেখে আমরা মুসলমানের রূপ দেখতে পাই।
লেখক : আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন, প্রবন্ধকার।