মৃত্যুসংবাদ শুনলে বা কোনো বিপদাপদের সম্মুখীন হলে আমরা পড়ে থাকি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’, অর্থাৎ আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাবো।’ এটা আল্লাহরই শেখানো দোয়া বা জিকির। আল্লাহ পাকের বাণী ‘আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে ভয়, বিপদ, অনশন, জানমালের ক্ষতি ও আমদানি হ্রাসের দ্বারা পরীক্ষা করব। এসব বিপদাপদ উপস্থিত হলে যার ধৈর্যধারণ করে ও বলে, আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাবো; তাদের জন্য সুসংবাদ।’ এখানে আল্লাহ পাকের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট তিনি তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নেবেন। কুরআন মজিদের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে এ পরীক্ষা গ্রহণের কথা তিনি বলেছেন। কখনো বলেছেন, ‘তোমরা কি মনে করেছ যে ঈমান এনেছি এতটুকু বললেই ছেড়ে দেয়া হবে; অথচ তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না।’ আবার বলা হয়েছে ইতঃপূর্বে অতিক্রান্ত সবারই পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। ‘তদীয় রাসূল ও তঁার সঙ্গীসাথীরা চিৎকার করে বলে উঠেছে আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে?
সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।’ বোঝা যায়, আল্লাহর জান্নাত অত্যন্ত দামি এবং মূল্য দিয়েই তা লাভ করতে হবে।
আল্লাহর এ পরীক্ষা সুদূর অতীত থেকে সব নবী-রাসূল ও তাঁদের সঙ্গীসাথীদের জীবনে ঘটেছে। হজরত নুহ আ:, লুত আ:, ইউনুস আ:, আইউব আ:, জাকারিয়া আ:, ইবরাহিম আ:, মূসা আ:, ইসা আ: ও মুহাম্মদ সা:সহ সবার জীবনে পরীক্ষা সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এ পরীক্ষা কাউকে রোগশোক দিয়ে, কাউকে বা স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে, আবার কাউকে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা এবং বাতিলের মোকাবেলায় হকের প্রতিষ্ঠায় জুলুম-নির্যাতন সবার জীবনে কমবেশি ঘটেছে। নাম না-জানা অসংখ্য নবী-রাসূলের শাহাদতের কথা আমরা কুরআন মজিদে পাই।
বর্তমান সময়ে ইসলামকে বিজয়ী আসনে সমাসীন করার লক্ষ্যে একদল আল্লাহর গোলাম প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতীতের মতো তারাও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন তাদের ওপর চেপে বসেছে। ইসলামী আন্দোলনকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিত করার জন্য ইসলামের দুশমনদের রয়েছে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে বাতিলকে সব সময়ই আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা গেছে। নবী-রাসূলদের এ দাওয়াত ছিল মূলত আখিরাতকেন্দ্রিক। এ দাওয়াতে সাড়া দিয়ে জুলুম-নির্যাতনে পরম ধৈর্য অবলম্বনের ফলে যা প্রাপ্তি, কুরআন মজিদে তা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে ‘তোমাদের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে, যার তলদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত এবং তোমরা যা পছন্দ করো আল্লাহর সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়, হে নবী! মুমিনদেরকে সে সুসংবাদও দাও।’
বর্তমানে দেশে দেশে যেসব সন্ত্রাসী কাণ্ড ঘটছে তার সাথে প্রকৃত ইসলামপন্থীদের দূরতম সম্পর্কও নেই। ইসলামকে কলঙ্কিত করা বা মুসলমানদের বিপদগ্রস্ত করার লক্ষ্যে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা বা ইসলামের দুশমন কর্তৃক বিভ্রান্ত কিছু মুসলমানের দ্বারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: মুসলমানদের কেবল ইতিবাচক কাজেরই নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ সব প্রতিকূল পরিবেশে দ্বীনের দাওয়াত অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছেন। ‘তার চেয়ে ভালো কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে নেক আমল করে এবং বলে আমি একজন মুসলমান।’ মনে রাখতে হবে, মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা এ কাজটি একান্তই আল্লাহর এবং যারা দ্বায়ি ইলাল্লাহ হিসেবে কাজ করেন তারা আল্লাহর সাহায্যকারী ও প্রতিনিধি। এদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক উচ্চে।
রাসূল সা: মক্কায় নীরবে সব জুলুম-নির্যাতন সয়ে গেছেন। আল্লাহও তাই চান। মক্কায় তাঁর হেদায়াত ‘তোমাদের হাত সংবরণ করো ও নামাজ কায়েম করো।’ তিনি বারবার বলেছেন ‘মুমিনদের উচিত কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করা।’ কাফিরদের মন্দ আচরণের জবাবে মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেছেন ‘ভালো ও মন্দ কখনো এক নয়। মন্দকে দূর করো সেই ভালো দ্বারা যা অতীব উত্তম। তাহলে দেখবে তোমার জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে।’
দাওয়াতে দ্বীনের কাজ বা ইকামতে দ্বীনের কাজ তো আল্লাহরই কাজ। যারা এ কাজটি আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে তারা আল্লাহর সাহায্যকারী ও প্রতিনিধি। তাই আল্লাহর পথে যারা জীবন দেয় তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হন তাদেরকে মৃত বোলো না, তারা জীবন্ত; তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের কোনো চেতনা নেই।’
মুমিনরা ইসলামের পথ আঁকড়ে ধরার কারণে সারাক্ষণ বাতিলের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি ও নানা জুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করে থাকে। আবার অনেকে জেল-জুলুম ও মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে দিন যাপন করে। ফলে সারাক্ষণ তাওবা-ইস্তেগফারের মধ্যে তাঁদের সময়গুলো অতিবাহিত হয়। আল্লাহ তায়ালা এসব পরীক্ষা দিয়ে তাঁর বান্দাদেরকে সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ করে তাঁর কাছে ফিরিয়ে নেন। এসব মুমিন বান্দাদের মুখে একটি কথাই সারাক্ষণ উচ্চারিত হয় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’, অর্থাৎ আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাবো।’ সন্তান যেমন তার মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য থাকে উদগ্রীব, আল্লাহর এসব বান্দার অবস্থাও যেন তেমনটি। যে রবের পক্ষে তারা এ জমীনে কাজ করে সেই রবের সাথে সাক্ষাৎ এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাওয়া সত্যিই বড় পাওনা তাদের। শুধু পরকালে অনন্ত সুখের নিশ্চয়তাই নয়, আল্লাহ মুমিনদেরকে দুনিয়ার জীবনে খিলাফত দানেরও প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন।
আল্লাহর বাণী ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন, যেমন তাদের আগে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দ্বীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন, তাদের (বর্তমান) ভয়ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক না করে।’ মনে রাখতে হবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ একান্তভাবে আল্লাহর। আমরা কেবল তাঁর সাহায্যকারী। নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমানের সাথে সাথে সৎ কর্মে ভূষিত হওয়ার শর্ত পূরণ করলেই আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন। নেক আমল শুধু নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনই নয়, বরং তার আচার-আচরণ, লেনদেন, ব্যবসাবাণিজ্য, চাকরি, চাষাবাদসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক : প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী, শিক্ষাবিদ।