অনাদিকাল থেকেই মানুষের মনে ঘুরপাক খেয়েছে অবশ্যম্ভাবী এক প্রশ্ন বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ পাক নিজে সৃষ্টি হয়েছেন কিভাবে? তাঁর শুরু কোথায়, শেষই বা কোথায়? প্রিয় সৃষ্টি মানুষের এমন প্রশ্নের জবাবে মহান আল্লাহ পাক নীরব থাকবেন, তা হওয়ার নয়। সৃষ্টির অন্য সব বিষয়ের মতো নিজের ব্যাপারেও আল্লাহ পাকের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট ও পরিষ্কার। নিজের সত্তা বিষয়ে আল্লাহ পাক বলেন, তিনি এমন যিনি জন্ম নেননি, তাকে কেউ জন্ম দেনওনি। তিনি আদি, তিনিই অনন্ত। যখন কিছু ছিল না তখনো ছিলেন তিনি, যখন কিছু থাকবে না তখনো থাকবেন তিনিই। তিনি এমন যাকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ঘুম-ক্লান্তি কখনো স্পর্শ করে না (সূরা ১১২ : আয়াত ৩; ৫৭:৩; ২:২৫৫ দ্রষ্টব্য)।
আল্লাহ পাকের এহেন একত্বের পর শর্তহীন বিশ্বাসই হলো ঈমানের মূল। এই বিশ্বাস অর্জনের সব উপায় ও উপকরণগুলোকে আল্লাহ পাক মানুষের জন্য অতীব সহজলভ্য করে দিয়েছেন এবং এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ পাককে উপলব্ধি করতে প্রতিটি মানুষের জন্য নিশ্চিত করেছেন পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ (৩৫:৩৭ দ্রষ্টব্য)। আজকের বিজ্ঞানও তেমনই এক মহা উপকরণ। বিশেষত বর্তমানের মহাকাশ বিজ্ঞান এ ক্ষেত্রে অনন্য।
মহাকাশ বিষয়ে মানুষের জানার পরিধি এখন বিস্তৃত সুদূরের অনন্ত নক্ষত্ররাজি অবধি। মানুষের পাঠানো নভোযান পৌঁছে গেছে আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের প্রায় শেষ সীমায়। মহাশূন্যে স্থাপিত হাবল টেলিস্কোপ মানুষের দৃষ্টিকে নিয়ে গেছে মহাকাশের আরো গভীরে। এখন নিয়মিত দেখা মিলছে মহাজাগতিক ভাঙা-গড়ার অবিশ্বাস্য সব দৃশ্যাবলির। আমাদের উপলব্ধিতে ধরা পড়ছে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব আরো স্পষ্টভাবে। জানা যাচ্ছে শক্তিমত্ত ব্ল্যাকহোলের রহস্য আরো নিখুঁতভাবে। এত কিছুর পরও ধারণা করা হচ্ছে যে, অনন্ত মহাশূন্যের মাত্র চার ভাগ এলাকাও সম্ভবত আমরা এখনো দেখে উঠতে পারিনি।
এত সামান্য জানাশোনার মধ্যেই এমন সব দূরবর্তী গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে, যেখানে আলোর গতিতে ছুটলেও পৌঁছতে লাগবে আমাদের সময়ের বহু সহস্র কোটি আলোকবর্ষ। ওই সব গ্রহ-নক্ষত্রের কতগুলোর আকার-আয়তন-উপকরণের বাহিরেও জানা গেছে সেগুলোর দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য ও ব্যাপ্তি। এমন অনেক গ্রহ-উপগ্রহের দেখা মিলেছে, যেখানকার একেকটা দিনের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর বহু বছরের সমান। ধারণা করতে কষ্ট হয় না যে, মহাশূন্যের আরো গভীরে এমন গ্রহ-উপগ্রহ নিশ্চয়ই আছে, যেখানকার একেকটা দিন হতে পারে পৃথিবীর কয়েক শত বছর, এমনকি হাজার বছরের সমান। তেমন এলাকার সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সে রকম এলাকা যে আছে, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। মহাশূন্যের আরো কত গভীরে, কত বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিলে যে তেমন এলাকার দেখা মিলবে, পাওয়া যাবে মহাজগতের প্রান্ত সীমানা, তা এখনো আমাদের অজানা। অজানা সেই প্রান্তের সন্ধান পেতে আমাদের বিজ্ঞান এখন মরিয়া, একেবারে পাগলপারা।
বড়ই কঠিন এই পথের অনুসন্ধান। এ ক্ষেত্রে মানব বিজ্ঞানের দিশা হারানোই স্বাভাবিক। বস্তুত সর্ববিষয়ে জ্ঞাত একমাত্র পরম সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয় অবিশ্বাস্য জটিল এই পথের ওপর গ্রহণযোগ্য কোনো ধারণা দেয়া। পরম স্রষ্টা আল্লাহ পাক ঠিকই কাজটা করেছেন তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টি মানুষের জন্য। পবিত্র কুরআনে জুড়ে দিয়েছেন আমাদের তীব্র ওই অনুন্ধিৎসার একটা সহজ পাঠ। মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল আ:) তাঁর দিকে আরোহণ করে যায় এমন এক ঊর্ধ্বলোকে, যেখানকার একেকটি দিন পৃথিবীর পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান’ (৭০ : ৪ দ্রষ্টব্য)।
শুধু বিবরণীতেই থেমে থাকেননি দয়াময় আল্লাহ পাক, বরং এই এলাকাকে মানুষের কাছে দৃশ্যমানও করে দিয়েছেন পবিত্র মেরাজের রাতে। মেরাজের বিবরণীগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক ঊর্ধ্বলোকের বিশেষ এক এলাকার। এই সিদরাতুল মুনতাহার কাছেই অবস্থিত জান্নাতুল মাওয়া (৫৩ : ১৩-১৭ দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য, পবিত্র মেরাজের ভ্রমণে নবীজী সা:-এর সফরসঙ্গী হিসেবে এই সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্তই যেতে পেরেছিলেন হজরত জিবারাইল আ:। ওই পয়েন্টের পর আল্লাহ পাকের আরশ পর্যন্ত নবীজী সা:-কে যেতে হয়েছিল একাকী। কারণ প্রধান ফেরেশতা জিবরাইল আ:-এরও অনুমতি ছিল না সিদরাতুল মুনতাহার ওপারে যাওয়ার (মেরাজ সংক্রান্ত সহি বোখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিস দ্রষ্টব্য)।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এই সিদরাতুল মুনতাহাই হলো মহালোকের সেই প্রান্তসীমা, যেখানকার একেকটা দিন পৃথিবীর পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এমনকি ফেরেশতারাও সর্বোচ্চ ওই পর্যন্তই যেতে পারেন, তার ওপারে নয়। কারণ এর পরই শুরু হয়েছে অবিনশ্বর জগৎ। নশ্বর কোনো কিছুই যেতে পারে না সেখানে। কোনো সৃষ্টির পক্ষেই সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়, যতক্ষণ না অনুমতি দেন পরম স্রষ্টা সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ পাক। সৃষ্টিকুলের মধ্যে একমাত্র নবী করিম সা:ই পেয়েছিলেন সেই অনুমতি। নশ্বর এই বিশ্বলোক থেকে শুধু তিনিই অবিনশ্বর ওই জগতে পরিভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন পবিত্র মেরাজের রাতে। পবিত্র মেরাজের সেই ভ্রমণে মূলত পরম এই সত্যকেই চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যেসব জগতের ওপর কর্তৃত্ব শুধু এক আল্লাহর। নির্দেশ দেয়ার মালিক শুধু তিনিই। তিনি যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন এবং অনন্ত এই বিশ্বলোকের যেকোনো স্থানে শুধু তাঁর নির্দেশই বিনা চ্যালেঞ্জে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হতে বাধ্য। এ ছাড়া মানুষকে চাক্ষুষভাবে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে নশ্বর এই জগতের তথা আমাদের এই মহাবিশ্বের শেষ সীমানা এবং বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে আল্লাহ পাকের মহা-আরশ তথা অনন্ত অবিনশ্বর জগতের অস্তিত্ব।
নশ্বর ও অবিনশ্বর জগতের প্রান্তসীমা এই সিদরাতুল মুনতাহাতেই বস্তুত শেষ হয়েছে সীমাবদ্ধ সময়ের ধারা। শুরু হয়েছে সময়ের পরিসীমাবিহীন, অন্তহীন ও অসীম অবিনশ্বর জগৎ। সেই জগৎ মৃত্যুহীন। মৃত্যুর মতো জন্ম বলেও কিছু নেই সেখানে। সেখানে ক্ষুধা নেই, ক্লান্তি নেই। ঘুম নেই, নিদ্রাও নেই। সেখানে অভাব নেই, অশান্তি বলে কিছু নেই। পরিপূর্ণ সেই শান্তিধামে কাল বলে কিছু নেই, সময় বলেও কিছু নেই। সেখানে সীমা নেই, পরিসীমাও নেই। সেখানে কিছুই কখনো সৃষ্টি হয় না; কিন্তু অন্য সব কিছুই সৃষ্টি হয় সেখান থেকে। যেহেতু সেখানকার কিছুই সৃষ্ট নয়, বরং সদাসর্বদা একইভাবে বিরাজমান, তাই সেখানে শুরু বলে কিছু নেই, শেষ বলেও কিছু নেই।
সেখানে আছে শুধুই এক ও একক। কারণ সেখানে দুই বা দ্বিতীয় বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়। একের অধিক সেখানে অস্তিত্বহীন। সেখানে যিনি ছিলেন তিনি সেখানেই আছেন, সেখানেই থাকবেন তিনি একইভাবে। যেহেতু কাল ও সময়, ধ্বংস বা মৃত্যু সেখানে অনুপস্থিত; তাই সেখানকার একক সত্তার নির্দিষ্ট কোনো কালব্যাপী সেখানে থাকার প্রশ্নই অবান্তর। একইভাবে শুরু-শেষ এবং ক্ষুধা-ক্লান্তি ও নিদ্রার মতো সীমিত বিষয়গুলোও সেই অসীম জগতে অসম্ভব। অবিনশ্বর এই জগতই হলো আল্লাহ পাকের সেই মহা-আরশ, যার অধিপতি শুধুই এক ও অদ্বিতীয় মহান আল্লাহ পাক।
তেমন অবিনশ্বর জগতের কথা আমরা ভাবতে পারি না। জন্ম-মৃত্যুহীন, শুরু বা শেষবিহীন কোনো কিছুর অস্তিত্ব আমাদের কল্পনাতেও আসে না। কারণ আমাদের এই বিশ্বজগতে আমরা সবাই কাল ও সময়, সীমা ও পরিসীমা, সৃষ্টি ও ধ্বংস এবং শুরু ও শেষের নির্দিষ্ট এক চক্রের মধ্যে আবদ্ধ। এটা এমনই এক চক্র, যার ভেতরে কেউই এককভাবে কিছুই করতে পারে না। এখানকার সব কিছুতেই দুই বা ততোধিকের যোগ ও মিশ্রণ আবশ্যক। সীমিত এই চক্রের বাইরে আমাদের চিন্তাচেতনা কোনোভাবেই কাজ করে না। এমনকি কাজ করতে পারে না আমাদের কল্পনা শক্তিও।
এটা একান্তই নশ্বর এই জগৎকেন্দ্রিক আমাদের সর্বব্যাপী সীমাবদ্ধতা। এর অর্থ এই নয় যে, এই সীমাবদ্ধতার বাইরে কিছু নেই বা থাকতে পারে না; বরং এপিঠ-ওপিঠের সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ীই সীমাবদ্ধ ও নশ্বর এই জগতের উল্টো পিঠে অসীম ও অবিনশ্বর জগৎ থাকাটাই স্বাভাবিক। আর যেহেতু জগৎটা অসীম ও অবিনশ্বর তাই ওই জগতের অধিপতিকেও অবশ্যই হতে হবে সব সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে অসীম, অবিনশ্বর ও শাশ্বত। বস্তুত সেই তিনিই হলেন মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। তাঁর অবিনশ্বর জগৎ এতটাই সীমা-পরিসীমা ও অন্তহীন যে তার তুলনায় ক্ষুদ্রতম ধূলিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র আমাদের এই নশ্বর মহাবিশ্ব।
তাই জন্ম-মৃত্যু, আহার-নিদ্রা এবং সব রকমের নশ্বর ধারণা ও সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে যে রয়েছে এক অবিনশ্বর মহাসত্তা, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই। বিন্দুমাত্র সন্দেহের সুযোগ নেই পবিত্র সেই মহাসত্তার বক্তব্য ও কালামে। পরম সেই সত্যের দিকেই বস্তুত ছুটে চলেছে আজকের বিজ্ঞান। বিভিন্ন তত্ত্ব ও সূত্রের বিচ্যুতিগুলো ঠিকঠাক করে যতই সামনে এগোচ্ছে বিজ্ঞান ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে একমাত্র পরম সত্য পথ, একক স্রষ্টা মহান আল্লাহ পাকের পথ। বোঝা যাচ্ছে যে, আজকের নাস্তিকতাবাদী বিজ্ঞান অচিরেই বাধ্য হবে মহান আল্লাহ পাকের সর্বময় একক মহাশক্তির কাছে অবনত হতে এবং মানুষ রক্ষা পাবে বিজ্ঞান নিয়ে ঔদ্ধত্যপনাকারীদের হাত থেকে।
লেখক : মঈনুল আহসান, [প্রবাসী, লস এঞ্জেলস, ইউএসও]