ড. সাইয়েদ হোসাইন নাসর | অনুবাদ: জোবায়ের আল মাহমুদ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য এবং তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করছি। রাসূল (সা)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করছি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি প্রায় ৫০ বছর যাবৎ বিভিন্ন ইসলামী সভা-সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে আসছি। কিন্তু এইবারেই প্রথম আমাকে দর্শন নিয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য আহবান করা হয়েছে। আমি খুবই আনন্দিত এ কারণে যে, ইসলামী দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দর্শন পড়াশুনার জন্য আমি আমার সারাজীবন ব্যয় করেছি। তাই আজকের এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক জীবন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করা যাবে।
গত কয়েক দশক ধরে ইসলামী বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনগুলো দর্শনচর্চাকে অবহেলা করে আসছিলো। তাই আমি আজকে বলবো, আমাদের মুসলিমদের জন্য এবং বিশ্বমানবতার জন্য দর্শন চর্চা কেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমি দর্শনের মতো একটি বড় বিষয়কে অল্প সময়ে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
প্রথমে দর্শন শব্দের সংজ্ঞা নিয়ে একটু বলি। আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদ ও সমাজ বিনির্মাণকারী অনেকের মধ্যেই দর্শন শব্দটি নিয়ে একটা ভয় কাজ করে। যেমন, মোহাম্মদ আবদুহু ও জামাল উদ্দিন আফগানিসহ আরো অনেকে আছেন, যদিও জামাল উদ্দিন আফগানী ইসলামী দর্শন নিয়ে অনেক বছর ইরানে পড়াশুনা করেছেন, এবং এরপর আফগানিস্তান, মিসর ও তুরস্কেও পড়াশুনা করেছেন। যাই হোক, দর্শন একটি ব্যাপক বিষয় হবার কারণে এটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক অস্পষ্ট। যদিও এই অস্পষ্টতা মুসলিম বিশ্বে এবং পশ্চিমা বিশ্বে এক নয়, বরং দুই ধরনের অস্পষ্টতার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে দর্শনের ভিন্ন ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময় অর্থ রয়েছে। সেখানকার মানুষেরা প্লেটোকেও দার্শনিক মনে করে, আবার দেরিদাকেও দার্শনিক মনে করে। অথচ এই দুই ব্যক্তির মাঝে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ, পশ্চিমা বিশ্বে দর্শনের অনেকগুলো বৈশ্বিক ধারণা রয়েছে, তারা কেবল একটিমাত্র ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ পশ্চিমা দর্শনের সাথে বিগত হাজার বছরের গ্রিক ও রোমান দর্শনের মিল নেই। পশ্চিমা গ্রিক ও রোমান দর্শনের সাথে ইসলামী দর্শনের বেশ মিল ছিলো। কিন্তু পশ্চিমা দর্শন আধুনিক যুগে এসে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। ফলে অনেক জ্ঞানী মানুষ পশ্চিমা দর্শনকে এখন আর দর্শন মনে করেন না। কারণ, দর্শন মানে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু অনেক পশ্চিমা দার্শনিক জ্ঞানকে ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা করেন।
অন্য দিকে, মুসলিমদের নিকট দর্শনের অস্পষ্টতার কারণ হলো, অনেক মুসলিম ভুলেই গেছেন যে, কোরআনে অসংখ্যবার ‘হিকমাহ’ বা দর্শন শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহ যার ভালো চান, তাকে তিনি হিকমাহ বা দার্শনিক জ্ঞান দান করেন।” (সূরা বাকারা : ২৬৯) আরবিতে হিকমাহ ও ফালসাফা শব্দ দু’টি দর্শন অর্থে ব্যবহৃত হয়, যদিও ফালসাফা শব্দটি গ্রিক ফিলোসোফিয়া শব্দ থেকে এসেছে। ফালসাফা বা দর্শন ইসলামের একটি বিশেষ জ্ঞান হলেও ইসলামে এ জাতীয় আরো অনেক জ্ঞান রয়েছে। যেমন, কালাম, উসুল, এবং ধর্মতাত্ত্বিক অন্যান্য বিষয়গুলো। এগুলোকে সরাসরি দর্শন বলা না হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এগুলো দর্শনের-ই অনুরূপ হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, সুন্নি মতাবলম্বী ও আশয়ারি চিন্তার প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আশয়ারির কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি গ্রিক ফালসাফার সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তিনি নিজেই যুক্তি ও বুদ্ধির পক্ষে কথা বলতেন, যা দর্শনের-ই একটি বিষয়। এ ছাড়া, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস ও যুক্তি নিয়ে প্রচুর আলোচনা করা হয়, যা আসলে দর্শনেরই আলোচ্য বিষয়। ক্লাসিক্যাল যুগের প্রত্যেক ইসলামী চিন্তাবিদই যুক্তি ও বুদ্ধি নিয়ে কথা বলেন, যদিও তাদেরকে দার্শনিক বলা হয় না।
দর্শনকে আমরা রাজনীতির সাথে তুলনা করতে পারি। রাজনীতিতে যেমন ভালো-মন্দ রয়েছে, তেমনি দর্শনেও ভালো-মন্দ রয়েছে। রাজনীতি ছাড়া আমরা যেমন কোনো সমাজ চিন্তা করতে পারি না, তেমনি দর্শন ছাড়াও আমরা কোনো সমাজ চিন্তা করতে পারি না। কেউ সচেতনভাবে জানুক অথবা না জানুক, সব সমাজেই দর্শনের ধারণা বা নৈতিকতাগুলো থাকে। যেমন, ভালো কি এবং মন্দ কি? সত্য কি এবং মিথ্যা কি? সুন্দর কি এবং অসুন্দর কি? দর্শনের এই ধরণাগুলো ছাড়া কোনো সমাজ চলতে পারে না।
১৭৯৮ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে নেপোলিয়ন যখন মিসর দখল করে নেয়, তখন মুসলিম চিন্তাবিদদের জন্য একটি মারাত্মক বিপদ নেমে আসে। এই ঘটনার পর, গত ২০০ বছর পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা ক্রমাগতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ চালিয়ে যায়। তখন পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদেরকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা দর্শনের অনেক ধারণাকে বর্জন করে ফেলেন। অথচ তখন পশ্চিমা দর্শনের মোকাবেলায় ইসলামী দর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন ছিলো।
ইসলামী বিশ্বে অনেকগুলো ইসলামী আন্দোলন রয়েছে, যারা দর্শন চর্চার বিরোধী। অথচ আমাদের বুঝা উচিত যে, মোঙ্গলরা যেভাবে ইসলামকে আক্রমণ করেছে, পশ্চিমা বিশ্ব সেভাবে ইসলামকে আক্রমণ করেনি। পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে আক্রমণ করেছে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে। যখন মোঙ্গলরা ইসলামকে আক্রমণ করেছিলো, তখন তারা লক্ষ লক্ষ ঘোড়া এনে মুসলিমদের সম্পূর্ণ এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছিলো এবং অসংখ্য মুসলিমকে হত্যা করেছিলো। কিন্তু তারা মুসলিমদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আক্রমণ করতে পারেনি। তখন চেঙ্গিস খানের নাতী হালাকু খান যেভাবে তীর, ধনুক ও ঘোড়া দিয়ে ইসলামকে আক্রমণ করেছিলো, সেটা মুসলিমদের জন্য বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। এখন যেভাবে পশ্চিমা বিশ্ব প্রতি রাতে মুসলিম শিশুদের ওপর ড্রোন হামলা করছে, সেটাও বড় ধরনের কোনো ক্ষতি নয়। বরং মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ। এখানে খুবই দুঃখজনকভাবে বলে রাখি, যখন অ্যামেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের নীল চোখ ওয়ালা কোনো শিশুর মৃত্যু হয়, তখন বিশ্বের সবাই কান্নাকাটি শুরু করে। কিন্তু যখন আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা সিরিয়ার কালো চোখওয়ালা কোনো শিশুকে ড্রোন দিয়ে হত্যা করা হয়, তখন কেউ একটু শব্দও করে না। যাই হোক, ড্রোন দিয়ে মুসলিমদেরকে হত্যা করা, অথবা, আইএমএফ এর মাধ্যমে মুসলিমদেরকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে রাখা, অথবা পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের পছন্দ মতো মুসলিম বিশ্বের সরকার নির্ধারণ করা, এ সবগুলোর চেয়েও বড় ক্ষতি হলো মুসলিমদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ করা।
মুসলিমদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আক্রমণ করার ফলে মুসলিমরা তাদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। মুসলিমরা এখন কোনো কিছুই সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে না। মুসলিমদের চিন্তার সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। যে সভ্যতা পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বড় বড় দার্শনিক ব্যক্তিদেরকে জন্ম দিয়েছিলো, সে সভ্যতা আজ চিন্তাশূন্য। তাই, এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে, অনেকগুলো ইসলামী আন্দোলন আজ দার্শনিক চিন্তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। যদিও মুসলিমদের ঈমানি শক্তি এখনো আছে, আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু মুসলিমরা চিন্তা-ভাবনা করা ও দর্শন চর্চা করা থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গিয়েছে। এমনকি, অনেকে চিন্তা-ভাবনা ও দর্শন চর্চা করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না। অথচ, দর্শন চর্চার ঐতিহ্যটি মুসলিমদের এগারো শত বছরের ঐতিহ্য। আব্বাসী খেলাফতের সময়ে দর্শনের ওপর প্রচুর কাজ হয়েছিলো। মুসলিমরা আজ কোরআনের ঐ আয়াতটি ভুলে গেছে, যেখানে বলা হয়েছে, “আমি আরবি ভাষায় এই কোরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করতে পারে।” (সূরা ইউসুফ : ২)
আরবি ভাষায় আকল শব্দটি ক্রিয়াপদ এবং বিশেষ্যপদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আকল মানে কেবল যুক্তি (Reason) নয়, আকল মানে হলো বুদ্ধি (Intellect)। আকল হলো এমন একটি শব্দ যা যুক্তি ও অহির মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যা ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে সমন্বয় সাধন করে এবং যা দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে সেতুবন্ধ রচনা করে। সুতরাং, আকল শব্দটি দিয়ে কেবল যৌক্তিক বিশ্লেষণকে বুঝায় না, বরং আদিকাল থেকে চলে আসা সামগ্রিক বুদ্ধিকে আকল বলে।
আমরা মুসলিমরা এখন এমন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছি, যারা কোনো চিন্তা-ভাবনা করা ছাড়াই কোরআন পড়ে। আপনি চিন্তা করতে পারেন, এটি কতটা হাস্যকর? যে সভ্যতা সম্পূর্ণ জ্যামিতিক আকৃতিতে তাজমহল গড়লো, ইরানের এসফাহন মসজিদ তৈরি করলো, বিভিন্ন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলো, যেগুলো ছিলো গণিতের সর্বোচ্চ জ্যামিতিক আকৃতিতে গড়া; সে সভ্যতার মুসলিমরা এখন এতো দুর্বল হয়েছে যে, একটু চিন্তা-ভাবনাও করতে পারে না। পশ্চিমা বিশ্বের বিপজ্জনক চিন্তাগুলোকে মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী চিন্তা এখন মুসলিমদের নেই। আমাদের চিন্তা এখন খুবই দুর্বল। আমাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কথা বলেন, তাদের খুবই অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পায়। আমাদের অনেক ভালো ভালো ডাক্তার আছে, অনেক ভালো ভালো ইঞ্জিনিয়ার আছে, কিন্তু যখন চিন্তার জগতে প্রবেশ করা হয়, তখন আর কোনো মুসলিম চিন্তাবিদকে আমরা খুঁজে পাই না। এটা আমাদের নিজেদেরই ব্যর্থতা। অথচ যে কোরআনের ওপর ভিত্তি করে আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সে কোরআনে চিন্তা-ভাবনা করা এবং মাথা খাটানোর জন্য প্রচুর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আসুন বর্তমান দুনিয়ার দিকে একটু তাকাই। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে যতগুলো মতবাদ মুসলিম বিশ্বে এসেছে, সবগুলো মতবাদ সাগরের তরঙ্গের মতো, একটির পর একটি আসতে শুরু করেছে। যেমন, যুক্তিবাদ (rationalism), অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism), মানবতাবাদ, বিবর্তনবাদ, ইত্যাদি। রাজনৈতিক ও সামাজিক মতবাদগুলো হলো যেমন উদারনীতি (liberalism), সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে বিজ্ঞানবাদ। এ সবগুলো মতবাদ আমাদের চতুর্দিকে বাতাসের মতো ঘুরছে এবং বিভিন্নভাবে আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করছে।
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে উপনিবেশ সময়ে প্রতিষ্ঠিত খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলের ওপর ভিত্তি করে। অবশ্য, ইরান ও তুরস্কের মতো দু-একটি দেশ হয়তো ব্যতিক্রম আছে। মিসর, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ধনী মানুষদের ৯০ শতাংশ ছেলে-মেয়েকে মাদরাসায় না পাঠিয়ে পশ্চিমা উপনিবেশের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পাঠানো হয়। মাদরাসায় কেবল গরিব মানুষদের সন্তানদেরকে পাঠানো হয়। অথচ ২০০ বছর আগে মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিলো না। যারা পশ্চিমা উপনিবেশের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে, তাদের চিন্তা-ভাবনা সবকিছু পশ্চিমা মতবাদগুলো দ্বারা পরিপূর্ণ। এমনকি যারা খুবই ধার্মিক এবং নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, তাদের চিন্তা-ভাবনাও পশ্চিমা মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত। মুসলিমরা এ সমস্ত পশ্চিমা মতবাদকে মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বসন্তের দক্ষিণা বাতাসের মত কিছু দিন পরপর একেকটা নতুন মতবাদ এসে মুসলিম বিশ্বে হাজির হয়। আমরা মুসলিমরাও পশ্চিমাদের নতুন মতবাদের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নতুন একটা মতবাদ এলে, আমাদের কেউ কেউ হয়তো সেই মতবাদকে ভালো করে গিলে খায়, আবার কেউ কেউ হয়তো খুব একটা নজর দেয় না। কিন্তু আমাদের সবাইকেই পশ্চিমা মতবাদ খুব ভালোভাবেই প্রভাবিত করে। আমার মনে আছে, একবার ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ইরানের রাজধানী তেহরানে এলেন। মিশেল ফুকোকে পশ্চিমা বিশ্বের কেউ তখনো চিনতো না। যদিও তার ঈমান নেই, তবুও তিনি খুবই মেধাবী একজন মানুষ। একদিন সন্ধ্যায় আমি তার সাথে ছিলাম। সেখানে আমি ছাড়া কেউ ফরাসি ভাষা বুঝতো না, তাই কিছু ছাত্র ও শিক্ষক আমাকেও সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। মিশেল ফুকো আমাকে বললেন, ‘জানো, আমাদের ফ্রান্সে আমার চিন্তা যতটা না জনপ্রিয়, এখানে তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।’ আমি বললাম, ‘আপনি একেবারে ঠিক বলেছেন।’ যাই হোক, মিশেল ফুকো মারা গেলে দেরিদা আসে। দেরিদা মারা গেলে আরেকজন আসে। একজনের পর একজন পশ্চিমা বিশ্ব থেকে মুসলিম বিশ্বে আসতেই থাকে। আর আমরা সাগরের তরঙ্গের মতো অবিরাম একটার পর একটা মতবাদ গ্রহণ করতে থাকি। কিছু মতবাদ আমাদের নিকট খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যেমন, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র। আবার কিছু মতবাদ খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে না, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভালোই প্রভাব ফেলে। ফলে আজ আমরা নিজেরা একটা নিষ্ক্রিয় জাতিতে পরিণত হয়ে গেছি। আমরা কেবল পশ্চিমা মতবাদ আগমনের আশায় বসে থাকি।
পশ্চিমা বিশ্বের সবগুলো মতবাদের একটি নিজস্ব বিশ্বদর্শন রয়েছে এবং তাদের চিন্তা করার একটি নিজস্ব পদ্ধতিও রয়েছে। এমনকি যুক্তিবাদ (rationalism) নিজেও গড়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতার ওপর ভিত্তি করে। এখন অবশ্য আপনি যুক্তিবাদের পরের যুগ এবং উত্তরাধুনিক যুগের কথাও শুনে থাকবেন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তা ও মতবাদগুলো মূলত গড়ে উঠেছে বিংশ শতাব্দীর আগে এবং আধুনিক যুগের ওপর ভিত্তি করেই। যুক্তিবাদ (rationalism) নিজেই একটি দর্শন। যুক্তিবাদ বলে যে, কেবল যুক্তির সাহায্যেই মানুষ সত্যে পৌঁছাতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের অনেক মুসলিম আছেন, যারা খুবই ধার্মিক এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা নামাজ পড়েন, কিন্তু দিনশেষে তারাও যুক্তিবাদী দর্শনে বিশ্বাস করেন, এবং তারা নিজেদেরকে আধুনিক মুসলিম হিসাবে পরিচয় দেন। অনেক মুসলিম লেখক আছেন, যারা আকল (বুদ্ধি) এবং ইসতিদলাল (রেশনালিজম)-এর পার্থক্য বুঝেন না এবং এ পার্থক্য বুঝতে না পেরে তারা বলেন, ‘ইসলাম তো আধুনিক ও যৌক্তিক দর্শনের মতোই।’
আধুনিক টেকনোলোজির চরম উপাসনা এবং বিভিন্ন ধর্মের চরমপন্থীগণ একই বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। এটি মুসলিম বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই দেখা যায়। কিছু মুসলিম আছেন, যারা টেকনোলোজির উপাসনা করেন, তাদের হাতে টেকনোলোজির সর্বশেষ ভার্সন থাকে। তারা মুখে বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বললেও আসলে তারা আল্লাহর পরিবর্তে টেকনোলোজির উপাসনা করেন। এরা এক ধরনের চরমপন্থী। অন্য দিকে, কিছু চরমপন্থী মুসলিম আছেন, যারা ইসলামের অধিকার রক্ষা করতে চান, কিন্তু তারা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোকেই বাদ দিয়ে দেন।
আমাদের মুসলিম বিশ্বের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে চিন্তার স্থবিরতা। বিভিন্ন দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর হাত দিয়ে ঘুষি মেরে দেয়া যায় না। কখনো বনে যদি আগুন লাগে, সেখানে বসে আপনি বেহালা বাজাতে পারবেন না। ভালো বেহালা বাজিয়ে আপনি খারাপ বেহালার সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারেন, কিন্তু আগুন নিভাতে হলে আপনাকে বেহালা বাজালে হবে না, পানি আনতে হবে। ভুল চিন্তার মোকাবেলা করার জন্য সঠিক চিন্তা নিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু ভুল চিন্তাকে দূর করার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই। কেবল আবেগ দিয়ে ভুল চিন্তার পরিবর্তন করা যায় না, এর জন্য সঠিক চিন্তা হাজির করা প্রয়োজন। এ কারণে কোরআন আমাদেরকে বারবার দিকনির্দেশনা প্রদান করে, আমরা যাতে সঠিক চিন্তা ও ভুল চিন্তার মাঝে পার্থক্য করতে পারি। কোরআনে বলা হয়েছে, “যারা জানে আর যারা জানে না, তারা উভয়ে কি সমান?” (সূরা যুমার, আয়াত : ৯) অর্থাৎ, যারা সাধারণ মুসলিম আর যারা চিন্তা-ভাবনা করা জ্ঞানী মুসলিম তারা উভয়ে সমান নয়। কোরআনের এ শিক্ষাটি আমরা আজ একেবারেই ভুলে গিয়েছি।
আমি একজন ছোটখাটো শিক্ষক হিসেবে প্রায় ৫০ বছর যাবৎ মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ১৯৭৭ সালে আমি মক্কায় একটি সম্মেলন করি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্যসূচি কেমন হবে, তা নিয়ে সেখানে আলোচনা করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। বাকি তিনজন হলেন ড. জোবায়ের, ড. নাসিফ এবং বাংলাদেশের স্কলার ড. সৈয়দ আলী আশরাফ। সেই অনুষ্ঠানে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও এবং বিভিন্ন দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ লোকজনকে আমন্ত্রণ করা হয়। এরপর বেশ কিছু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, সবগুলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী শিক্ষা প্রদান করতে একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ, ইসলামী শরিয়তের একটা বিভাগ ব্যতীত বাকি সবগুলো বিভাগে কেবল পশ্চিমা মতবাদগুলোই শিক্ষা প্রদান করা হতো। ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের তরুণদের মেধাকে ইসলামী পদ্ধতিতে কাজে লাগাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ফলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা মুসলিম হিসাবে চিন্তা করতে শেখেনি। আমি বলছি না, বিশ্ববিদ্যালয়কে ইসলামীকরণ করাটা খুবই সহজ, অবশ্যই কাজটা একটু কঠিন। কিন্তু কাজটা একেবারেই অসম্ভব নয়। আমরা যদি ইসলামী পদ্ধতিতে এবং সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আবার আমরা একটি ইসলামী সভ্যতা নির্মাণ করতে পারবো। আর এ জন্য ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন।
ইসলামী জ্ঞানের যত শাখা রয়েছে, প্রতিটি শাখাতে একেকটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এমনকি উসুলুদ্দিন ও উসুলুল ফিকাহের মতো জ্ঞানের শাখাতেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এ ছাড়া, ইসলামের বালাগাতশাস্ত্র বর্তমান পশ্চিমা দর্শনের একটি শাখা হিসাবেই বিবেচিত হয়। যাই হোক, আমি এসব বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি কেবল এটাই বলতে চাচ্ছি যে, ইসলামের মৌলিক জ্ঞানগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তাই এসব জ্ঞানের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আধুনিক মুসলিমরা ইসলামী ধর্মতত্ত্ব বা কালামশাস্ত্রকে আঘাত করে আসছে। যদিও মিসরে এখনো নতুনভাবে আশয়ারি চিন্তা কিংবা মুতাযিলা চিন্তার কিছুটা চর্চা হচ্ছে। কিন্তু, সালাফি আন্দোলনগুলো এসব বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ও ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে আসছে। তবে আশার দিক হলো, যারা ইসলামকে সিরিয়াসলি পড়তে চায়, তারা এসব ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ও ঐতিহ্যকে জানার চেষ্টা করছেন। যেমন, সুন্নি ও শিয়াদের মাঝে এখন অনেকেই কালামশাস্ত্রকে গুরুত্ব প্রদান করেন। আসল কথা হলো, আমাদের বর্তমান সময়ে কালামশাস্ত্রকে আবার পুনর্জীবিত করা উচিত এবং একই সাথে কালামশাস্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে আলাপ তোলা উচিত। এ ছাড়া, ইসলামের মেটাফিজিক্স বা সুফি তাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনাকেও সঠিকভাবে পুনর্জীবিত করা প্রয়োজন এবং একইভাবে মুসলিমদের বিজ্ঞান ও দর্শনের ঐতিহ্যকেও পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। যদি আমরা আমাদের সবগুলো জ্ঞানের শাখাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি, তাহলে আমরা নতুন একটা জ্ঞানের কাঠামো পাবো। তখন সেই জ্ঞানের কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আমরা নতুনভাবে চিন্তা করতে পারবো এবং আধুনিক সমস্যাগুলোর সমাধান বের করতে পারবো। আর এ কাজগুলো করতে পারলে তখনি আমরা আমাদের ইসলামী সভ্যতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবো।
আমি আপনাদেরকে দু’টি উদাহরণ দিচ্ছি। একটা প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে এবং অন্যটি মানবিক বিজ্ঞান সম্পর্কে। প্রথমেই প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু কথা বলি। গত ত্রিশ-চল্লিশ বছর থেকে আমরা ইসলাম ও বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলছি। ১৯৬৪ সালে যখন আমি ২০ বছর বয়সী তরুণ, তখন আমি ‘ইসলামে বিজ্ঞান ও সভ্যতা’ নামে একটা বই লিখেছিলাম। ইসলামী বিজ্ঞান নিয়ে তখন একটা বিতর্ক হচ্ছিলো। তখন কেউ কেউ মনে করতেন, ইসলামী বিজ্ঞান মানে আরবদের বিজ্ঞান। আসলে এ কথাটির ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি ছিলো না। মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবাই কেবল আরবের ছিলো না, বরং পারস্য সাম্রাজ্যে, উসমানী খেলাফতের অঞ্চলে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক বেশি মুসলিম বিজ্ঞানী ছিলেন। যেমন, বিখ্যাত বিজ্ঞানী ইবনে সিনা ও আল বিরুনিসহ অনেকেই আরবের ছিলেন না। কথা হলো, ইসলামী বিজ্ঞান আরব জাতীয়তাবাদের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং কোরআনের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী আমার এ চিন্তাকে তখন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাদের কথা হলো, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে ইসলামের সম্পর্ক রয়েছে। আমি বলেছি, মোটেও না। আধুনিক বিজ্ঞান কেবল একটি বিজ্ঞান নয়, বরং এটি একটি বিশ্বদর্শন। নির্দিষ্ট একটি চিন্তার ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে। আপনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের দর্শন বিভাগের যে কোনো শিক্ষককে জিজ্ঞাস করলে তিনি আপনাকে একই কথা বলবেন। বিজ্ঞানবাদ নিজেই বিজ্ঞান নয়, বরং একটি দর্শন।
আমাদের মুসলিমদের বিজ্ঞান গড়ে ওঠা প্রয়োজন ইসলামী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে। আমি প্রায় ৫০ বছর যাবৎ এই জন্য সংগ্রাম করে আসছি। আমি বিজ্ঞানবাদের সমস্যা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। আমি মনে করি, বর্তমানে ইসলামী বিশ্বের সবচেয়ে বড় রোগ হলো বিজ্ঞানবাদ। সৌদি আরব বা ইরান হোক, অথবা, মালয়েশিয়া বা মিসর হোক, আমরা সবাই বিজ্ঞানবাদ রোগে আক্রান্ত। মুসলিম বিশ্বের সব দেশের সরকারই বিজ্ঞানকে গ্রহণ করতে চায়, কিন্তু বিজ্ঞান কি তা জানতে চায় না। কারণ, এসব সরকারের কাছে ক্ষমতা ও সম্পদই হলো বড় বিষয়, জ্ঞান নয়। এসব সরকারের বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যে, বিজ্ঞানের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করা যায়। আর, যে কোনো বিজ্ঞান মাত্রই ইসলামিক। কারণ, যেহেতু আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা জ্ঞান অন্বেষণ করো এবং যেহেতু বিজ্ঞান মানেই জ্ঞান, সুতরাং বিজ্ঞান অন্বেষণ করা হলো ইসলামেরই কাজ। অথচ এসব মুসলিম বুদ্ধিজীবী এটা বুঝেন না যে, আধুনিক বিজ্ঞানে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করাটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
আধুনিক বিজ্ঞানের কারণে একজন খ্রিষ্টান ভালো পদার্থবিজ্ঞানী হলেও তিনি নোবেল পুরস্কার পান না, কিন্তু একজন নাস্তিক সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানী হলেও তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান। তাই, এই ধরনের বিজ্ঞান কখনোই ইসলামী সভ্যতার অংশ হতে পারে না। খুব অল্প কিছু মানুষ এ কথাটি বলার সাহস রাখেন। আমার সম্পূর্ণ জীবন শেষ হয়ে গেছে এ কথাটি বলতে বলতে। আমার যখন ২৫ বছর বয়স ছিলো, তখনো আমি এ কথাটি বলেছিলাম, এখনো আমি একই কথা বলছি। আমাদের এটা বুঝা প্রয়োজন যে, আধুনিক বিজ্ঞানবাদকে আমরা কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারবো না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, অনেক মুসলিম চিন্তাবিদই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপাসনা করেন। তারা বলেন, ‘আমরা আল্লাহর ইবাদত করি।” আমি বলি, “হ্যাঁ, ঠিক।” দিনে কয়েক ঘণ্টা তারা আল্লাহর ইবাদাত করে ঠিক, কিন্তু বাকি সময়টা তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপাসনা করেন। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় রোগ হলো এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপাসনা। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারণে আমাদের চারপাশের পরিবেশ খুব দ্রুতই আমাদেরকে মহাবিপদে ফেলবে, তখনি কেবল আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপাসনা ছাড়ে দিতে পারবো।
কেবল মুসলিম বিশ্বে নয়, ভারতের মতো হিন্দু রাজ্যে, কিংবা, চীনের মতো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেও বিজ্ঞানের পূজা চলছে। ‘মাও সে তুং’ নিজেই পশ্চিমা বিজ্ঞানের উপাসনা করতেন। এ কারণে, তিনি চীনের লোকজনের সামনে বিজ্ঞানকে এমনভাবে রাখলেন, যাতে তারাও কমিউনিস্ট ও নাস্তিক হতে পারে। তারা তাদের ধর্মীয় মতবাদের সাথে বিজ্ঞানবাদের পার্থক্য করতে পারেন না। কিন্তু আমাদেরকে খুব সচেতনভাবে বিজ্ঞানবাদ ও ধর্মের পার্থক্যটি জানা উচিত।
আধুনিক বিজ্ঞানবাদকে আমরা তখনি কেবল মোকাবেলা করতে পারবো, যখন আমরা আমাদের নিজেদের দার্শনিক চিন্তাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবো। কারণ, বিজ্ঞানবাদ হলো আসলে একটি দর্শন। এটি হলো প্রকৃতি জানার একটি দর্শন এবং জ্ঞানের একটি দর্শন। আধুনিক বিজ্ঞান ছাড়া প্রকৃতিকে জানার আরো যত জ্ঞান ও দর্শন রয়েছে, বিজ্ঞানবাদ সেসব জ্ঞান ও দর্শনকে অস্বীকার করে। অথচ অতীতে প্রকৃতিকে জানার একটি বিশেষ জ্ঞান ও দর্শন ছিলো। তাই, আধুনিক বিজ্ঞানবাদের মোকাবেলা কেবল দর্শন দ্বারাই করা সম্ভব। আমাদের মুসলিমদের নিজেদের দর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করা ব্যতীত আধুনিক বিজ্ঞানবাদের বিপদকে মোকাবেলা করা সম্ভব না।
প্রকৃতি বিজ্ঞানের পর এবার মানবিক বিজ্ঞানের দিকে নজর দেয়া যাক। আমাদেরকে মানবিক জ্ঞানের শাখাগুলোকেও ইসলামী দর্শনের ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো প্রয়োজন। আমি ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগের ডিন ছিলাম অনেক বছর। সেখানে আমার নেতৃত্বে একটি আন্দোলন ছিলো, আমরা পদার্থবিজ্ঞানকে ইসলামীকরণ করতে না পারলেও, অন্তত মানবিক জ্ঞানের শাখাগুলোকে ইসলামী রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ইতিহাস পড়ানো হবে, তখন ইতিহাসকে কেবল ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গিতে না পড়িয়ে, সেখানে দু-একটা আর্টিকেলের মধ্যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিটা যুক্ত করে দেয়া। অথবা যখন সাহিত্য পড়ানো হবে, তখন কেবল ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে না পড়িয়ে, শেষে দু-একটা উর্দু সাহিত্যের লেখাও যুক্ত করে দেয়া।
আপনি যদি মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যসূচি দেখেন, তাহলে খুবই লজ্জিত ও হতাশ হবেন। পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা আছে, যারা নিজেদের ইতিহাস পড়ে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা? ঠিক এখন আপনি যদি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস বই দেখেন, দেখবেন সবগুলো বইতে পশ্চিমা দৃষ্টিতে বিশ্ব ইতিহাস লেখা রয়েছে। একইভাবে আপনি যদি নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানসহ যে কোনো মানবিক জ্ঞানের শাখাগুলোর দিকে লক্ষ করেন, তখন দেখবেন, সবগুলো বই পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা হয়েছে। একটি সভ্যতা কিভাবে বেঁচে থাকবে, যদি সে সভ্যতার সন্তানেরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন না শিখে? তারা যদি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ইতিহাস ও সাহিত্য না বুঝে, নিজেদের মতো চিন্তা করতে না পারে, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্বকে না বুঝতে পারে, এবং তারা যদি নিজেদের সভ্যতাকে নিজেদের মতো বুঝতে না পারে, তাহলে একটি সভ্যতা কিভাবে বেঁচে থাকবে?
অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিজেকে বুঝতে চাওয়ার চেষ্টাই হলো এখন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর এই সমস্যাকে কেবল নিজেদের দর্শনের দ্বারাই মোকাবেলা করা সম্ভব। আমাদের শিশু ও তরুণদেরকে কেবল শিক্ষা দিলেই হবে না, বুঝতে হবে, কোন ধরনের বিষয়কে কিভাবে শিক্ষা দিতে হবে। এটাই হলো শিক্ষার দর্শন। আলহামদুলিল্লাহ্, সব সময় তো আর অন্ধকার থাকে না, আলোও উদিত হয়। মুসলিমরা অনেকেই এখন আস্তে আস্তে এ বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করেছেন। ইসলামী দর্শন দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শনকে মোকাবেলা করাটা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগ্রাম। তাই এটিকে আরো সামনে এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। মরুভূমিতে চিৎকার করার মতো কেবল কথা বললে হবে না, আমাদেরকে কিছু কাজ করতে হবে। কারণ, সবসময় সত্যের জয় হয়।
আমি আশা করি এবং দোয়া করি, আজকে যারা তরুণ আছে, তারা আগামী দিনের ইসলামী সভ্যতা নির্মাণ করার জন্য ইসলামের দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখবেন এবং সন্তানদের বাবা-মা ও অভিভাবক যারা আছেন, তাদের উদ্দেশে আমার কথা হলো, আপনাদের সন্তানেরা যখন ইসলামী স্টাডিজ বা ইসলামী দর্শন পড়তে চাইবে, তখন তাদেরকে আপনারা পড়ার সুযোগ করে দিবেন। আমি একজন প্রফেসর, মুসলিম পরিবার থেকে আসা আমার অনেক শিক্ষার্থী আছে। তরুণরা যখন আমার দু-একটা লেকচার শুনে, তখন তারা ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা মেডিক্যাল ছেড়ে দিয়ে আমার সাথে ইসলামী দর্শন শিখতে চায়। কিন্তু তাদের বাবা-মা তখন খুব কষ্ট পান, কেউ কেউ হার্ট অ্যাটাক করে বসেন।
আপনারা যারা ইসলামকে ভালোবাসেন, তারা আল্লাহর কথা চিন্তা করে এবং ইসলামের কথা চিন্তা করে নিজেদের সন্তানদের উৎসর্গ করুন। আপনারা হয়তো বলবেন, আমাদের সন্তান ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, এটার কি দরকার নেই? আমি বলি, হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার দরকার আছে, কিন্তু তারচেয়ে বেশি দরকার এমন কিছু তরুণ, যারা নিজেদের জীবনকে ইসলামের দার্শনিক সংগ্রামে ব্যয় করবে। হয়তো একজন ভালো ডাক্তার কম টাকা নিয়ে চিকিৎসা করবে, কিন্তু একজন মুসলিম দার্শনিক সম্পূর্ণ মুসলিম সমাজকে আধুনিক দর্শনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে। কিছু তরুণ মুসলিমদের জন্যে চিন্তাবিদ হওয়াটা ফরজে আইন না হলেও ফরজে কেফায়া। মুসলিম উম্মাহর জন্য অভিভাবকদের এই ত্যাগ খুবই প্রয়োজন। বিশেষ করে যেসব মুসলিম ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাস করছেন, তাদেরকে এই ত্যাগটা বেশি করা প্রয়োজন।
আমি যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন সম্পূর্ণ অ্যামেরিকায় কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো, যেখানে ইহুদি ধর্ম বিভাগের শিক্ষক ইহুদি ছিলেন। বাকি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদি ধর্ম বিভাগের শিক্ষকরা ছিলেন খ্রিষ্টান। তারা হিব্রু ভাষা জানতেন এবং ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়াতেন। কিন্তু এখন অ্যামেরিকার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদি ধর্ম বিভাগের শিক্ষকরা সবাই ইহুদি। অথচ অ্যামেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বিভাগে এখনো অনেক অমুসলিম শিক্ষক রয়েছেন।
আমি আশা করি, যখন আমি মারা যাবো, তখন তোমাদের তরুণরা এই শূন্যস্থান পূরণ করবে এবং ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণের কাজকে সামনে এগিয়ে নিবে। মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে পুনর্জীবিত করার জন্য কেবল দুটি জিনিস প্রয়োজন। এক, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস এবং দুই, আল্লাহর সেরা দান জ্ঞান ও বুদ্ধি। এ দু’টি পায়ের ওপর ভর করে আমরা জান্নাতের দিকে হেঁটে যাবো, ইনশাআল্লাহ।
অনুবাদক : শিক্ষার্থী, উলুদাহ বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক
অনুবাদক : শিক্ষার্থী, উলুদাহ বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক