যেহেতু ইসলাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আচরণের সঠিক পন্থা নির্দেশ করে, সেহেতু অর্থনৈতিক জীবনের সঠিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে উৎপাদন শক্তিগুলো যথা শ্রম, ভূমি ও মূলধনের ব্যবস্থাপনার সঠিক পন্থাও নির্দেশ করে দেয়। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্বের মতো এখানেও কুরআন কেবলমাত্র মৌলিক নীতিমালা বর্ণনা করে। সঙ্গত কারণেই কুরআন এবং সুন্নাহর মধ্যে একজন বিশ্বাসী উৎপাদনকারী, ভোক্তা বা মূলধনের মালিক হিসেবে কিরূপ আচরণ করবে তার অনেক দিকনির্দেশনা পাওয়া গেলেও সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিকব্যবস্থা সম্পর্কে এখানে কোনো বাধাধরা কাঠামোর দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। গোটা সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে যেরূপ, এখানেও ঠিক একইরকমভাবে ইসলাম অর্থনৈতিক জীবনের নৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি মনোসংযোগ করে মাত্র। উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থার নৈতিক দিকগুলোর প্রতিই ইসলাম বেশি মনোযোগ দেয়। (অর্থনীতির ‘অর্থ’ নয় ‘নীতি’-ই ইসলামের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়-সম্পাদক)।
তথাপি কুরআন এ ক্ষেত্রে একটি অবকাঠামোগত নীতিমালা নির্দিষ্ট করে দেয়, যা কোনো অর্থনীতিকে ইসলামী বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
১. নীতিগতভাবে কুরআন ব্যক্তিগত মালিকানার পক্ষপাতী, যা উৎপাদন উপকরণগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আইনি তত্ত্ব অনুসারে এই ব্যক্তিগত মালিকানা কিন্তু রোমান আইনের মতো নিরঙ্কুশ মালিকানা নয়। যেহেতু সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার মালিকানায়, তাই এই মালিকানা শর্তসাপেক্ষ ভোগদখলী স্বত্ব মাত্র। যার মধ্যে আবার রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্বগত সূত্রবন্ধন। অবশ্য এই সীমাবদ্ধ মালিকানা কিন্তু নিতান্তই ব্যতিক্রমধর্মী, যা মর্যাদাগতভাবে সম্ভাব্য রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করে। প্রাকৃতিক সম্পদ যথা বায়ু, পানি, বনাঞ্চল, পশুচারণভূমি এবং খনিজসম্পদ ব্যক্তিগত মালিকানার তালিকার বাইরে অবস্থিত; কিন্তু প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্র এগুলোর ব্যবহারের নিমিত্তে সনদ প্রদান করতে পারে।
২. একজন মুসলমান কেবল সৎ ও উৎপাদনশীল কাজের দ্বারা তার জীবিকা অর্জন করতে পারে, কোনো অবস্থাতেই ভিক্ষাবৃত্তি, ফটকাবাজি অথবা ঘুষের মাধ্যমে সে জীবিকা নির্বাহ করবে না, যদি তা কমিশন নামেও অভিহিত হয়। মুনাফার জন্য ব্যবসায় করা এবং স্বাধীনভাবে মূল্য নির্ধারণ করা ইসলামে বৈধভাবে একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। (মুহাম্মদ সা: মক্কাতে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন, যার মালিক ছিলেন পরবর্তীকালে তার স্ত্রী খাদিজা রা:)। জুয়া বা ঝুঁকিবিহীন আয়, তথা যাবতীয় ফটকাবাজির আয়, স্টক এক্সচেঞ্জ, ভবিষ্যতের বাজার সৃষ্টি করা তথা পুঁজির ওপর সুদ গ্রহণ করা হারাম।
৩. রাষ্ট্র সর্বদাই বাজারকে পর্যবেক্ষণ করবে (যাতে করে ওজনের হেরফের, একচেটিয়াবাদ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক অপরাধ সংঘটিত না হতে পারে)।
৪. রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিশেষত, শুল্ক ও করের ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করবে। অবশ্য উত্তরাধিকার এবং জাকাতের কুরআন নির্দেশিত ঐশী বিধান বলেও এটির হার সর্বক্ষেত্রেই সমান থাকে। এর সাথে আরো রয়েছে অর্থসম্পদের অসম পুঞ্জীকরণ ও বিলাসিতার ওপর নৈতিক নিষেধাজ্ঞা। অবশ্য সম্পদ এবং আয়ের সীমা নির্ধারণ বা জবরদস্তিমূলক সমীকরণ ইসলামের আর্থসামাজিক বিধান বা আদর্শ নয়।
৫. মুসলমানেরা কৃপণ কিংবা ব্যয়বিলাসী কোনোটিই হবে না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেমন এখানেও তেমন। তারা হবে নমনীয় ও মধ্যপন্থী। এখানে সংসার বৈরাগ্যেরও কোনো স্থান নেই।
আদর্শ ইসলামী অর্থনীতির আরো কয়েকটি পার্থক্যসূচক দিক রয়ে গেছে, যেমন সেখানে হয়তো সীমিত দায়বদ্ধতাসম্পন্ন কোম্পানিগুলোর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত ঋণগুলোর ওপর সুদ নিষিদ্ধ হবে। অবশ্য এই দুটোই পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
পৃথিবীতে সুদ যে ভূমিকা পালন করে তা অবশ্যই পরার্থবাদী নয় বরং চূড়ান্ত লালসাবৃত্তিক, তবুও বিশ্ব-অর্থনীতিতে সুদ যে ভূমিকা পালন করে কুরআনে নিষিদ্ধকরণের প্রতিক্রিয়াটিকে তার ওপর যতটা সম্ভব হাল্কা করে ফেলার প্রচেষ্টা মুসলিম অর্থনীতিবিদেরা করে থাকেন, তাদের প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য বর্তমান মূলধন ব্যবস্থার সাথে কুরআনি নিষেধাজ্ঞার একটি সামঞ্জস্য বিধান করা। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংক এবং মক্কেলের মধ্যে বর্ধিত মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করিয়ে ঋণকে ক্রয় হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা।
বর্তমানে কিছু কিছু ‘সুযোগ মূল্য’ (হৃত মুনাফা) নামে যে পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করে থাকেন তাও আসলে ছন্দবেশী সুদ ছাড়া আর কিছু নয়। এর মাধ্যমে সুদকে মূল্য হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, যা সরাসরি ঋণের ওপর আরোপ করা হচ্ছে না, বরং বলা হচ্ছে এটি হলো একটি মূল্য বা মূল্য হিসেবে প্রদেয় অর্থ। কারণ, ঋণদাতা যদি প্রদত্ত ঋণের অর্থটি ব্যবসায় খাটাতেন তাহলে নিশ্চয়ই কিছু মুনাফা হতো, কিন্তু ঋণ দিয়ে ফেলার কারণে তিনি ওই টাকা আর ব্যবসাতে খাটাতে পারছেন না বিধায় ব্যবসাতে খাটালে ওই পরিমাণ অর্থে যে মুনাফা হতো তা ঋণগ্রহীতা ঋণদাতাকে প্রদান করবেন। আমার মনে হয় এটি একটি পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞাকে এড়িয়ে যাওয়ার হীন প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য বাঁধভাঙা মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতিটি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সূচিসংরক্ষণ আইনসিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, কারণ তা না হলে আমানতকারীরা ব্যাংকগুলোকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বাধ্যতামূলক ‘উপহার’ হিসেবে প্রদান করতে বাধ্য হবেন।
যাই হোক, মূলধারার ইসলামী শিক্ষা এখনো সর্বপ্রকার সুদকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন; মূলধন অর্থের ওপর মুনাফা তখনই গ্রহণযোগ্য হয় যখন ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার ব্যবসার অংশীদার হয়ে মুনাফা এবং ঝুঁকি উভয়েরই দায়ভাগ গ্রহণ করেন।
উদাহরণস্বরূপ : অর্থদাতাদের সবাই তা তাদের মধ্যে কয়েকজন ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করে (মুশারাকাহ) অথবা তারা ব্যবস্থাপনার পুরো দায়িত্ব অন্য লোকের ওপর ন্যস্ত (মুদারাবাহ) করে নিজেরা পরোক্ষ, বা সুপ্ত কিন্তু যথারীতি দায়ভাগী অংশীদার হিসেবে থাকতে পারেন, এই উভয় পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী উপাদানটি হচ্ছে অর্থ প্রদাতা শুধু মুনাফা নয় বরং ক্ষতি হয়ে গেলে তারাও অংশগ্রহণ করেন কি না। এটাই হচ্ছে সুদমুক্ত অর্থনীতির বাণিজ্য ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূলনীতি। আমার কাছে মনে হয় যে, এই নীতি পশ্চিমা অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে ইসলামের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে, যা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিনিয়োগের উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে তাকে আরো চাঙ্গা করে তুলতে পারে।
অনুবাদ : মঈন বিন নাসির