আমাদের দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অংশ মনে করে, ইসলাম ধর্ম থাকবে মসজিদ, খানকা, মাদরাসা, মক্তব ও ঘরে। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ইসলামের কিছু করার নেই। তারা রাষ্ট্র আর ধর্মকে আলাদা করে দেখে। তাদের মতে রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার। সংসদে বা সরকারি অফিসে ইসলাম প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ইসলামী জীবন বিধানের পাঁচটি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো আকায়িদ, ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাত ও আখলাকিয়াত। এই পাঁচ বিভাগের ওপর আমল করে একজন মানুষ খাঁটি মুসলমান হতে পারে। একজন মুসলমানের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো তার ‘তাকওয়া’ বা পরহেজগারি। তার ধর্ম, সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, পদপর্যাদা, বংশমর্যাদা, নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ইত্যাদি তার শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না নিশ্চিতরূপে যে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা : ২০৮)।
তোমরা পূর্ণাঙ্গ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। অর্থাৎ এমন যাতে না হয় যে, ইসলামের কিছু বিষয় মেনে নিলে আর কিছু মানতে গিয়ে গড়িমসি করতে থাকলে। তা ছাড়া কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বর্ণিত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের নামই হচ্ছে ইসলাম। কাজেই ইসলামের সম্পর্ক বিশ্বাস ও ইবাদতের সাথেই হোক কিংবা আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিকতা অথবা রাষ্ট্র বা রাজনীতির সাথে হোক বা এর সম্পর্ক বাণিজ্য কিংবা শিল্পের সাথে হোকÑ ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা দিয়েছে তোমরা তারই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। মূল প্রতিপাদ্য মোটামুটিভাবে এই যে, ইসলামের বিধানগুলো, তা মানবজীবনের যেকোনো বিভাগের সাথেই সম্পৃক্ত হোক না কেন, যে পর্যন্ত তার সব বিধিনিষেধের প্রতি সত্যিকারভাবে স্বীকৃতি না দেবে, সে পর্যন্ত মুসলমান যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না।
যারা ইসলামকে শুধু মসজিদ আর ইবাদাতের সাথে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে সামাজিক আচার-ব্যবহারকে ইসলামী সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে না, তাদের জন্য এ আয়াতে কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। তথাকথিত দ্বীনদারদের মধ্যেই বেশির ভাগ ত্রুটি দেখা যায়। এরা দৈনন্দিন আচার-আচরণ, বিশেষত সামাজিকতার ক্ষেত্রে পারস্পরিক যে অধিকার রয়েছে, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। মনে হয়, এরা যেন এসব রীতি-নীতিকে ইসলামের নির্দেশ বলেই বিশ্বাস করে না। তাই এগুলো জানতে ও শিখতে, তেমনিভাবে অনুশীলনেও তাদের কোনো আগ্রহ নেই। (তাফসির, পৃ: ১০৫ ও ১০৬)।
ইসলামের অন্যতম একটি ফরজ বিধান ‘জিহাদ’। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমাদের ওপর জিহাদ ফরজ করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোনো একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তো বা কোনো একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। (সূরা বাকারা : ২১৬)।
এ আয়াতে বোঝা যাচ্ছে জিহাদ করা ফরজ। তবে জিহাদ স্বাভাবিক অবস্থায় ‘ফরজে কেফায়া’। যদি মুসলমানদের কোনো দল তা আদায় করে তবে সব মুসলমানই এ দায়িত্ব থেকে রেহাই পায়। আর যদি মুসলমানদের নেতা প্রয়োজনে সবাইকে ‘জিহাদে’ অংশগ্রহণ করার আহ্বান করেন, তখন জিহাদ ‘ফরজে আইনে’ পরিণত হয়ে যায়। (তাফসির, পৃ: ১১০-১১১)।
‘জিহাদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো চরম প্রচেষ্টা। আর পারিভাষিক অর্থ হলো আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করা, তার জন্য মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া এবং যাবতীয় শক্তিকে ওই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করা। জিহাদ শুধু সশস্ত্র অভিযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষের চিন্তাধারাকে সঠিক পথে নিয়ে আল্লাহর দ্বীনের অনুগামী করাও জিহাদ। আবার দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অর্থসম্পদ ব্যয় করাও জিহাদ। চরম অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ করে জাহেলি ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে খোদায়ি ব্যবস্থা কায়েম করার নামও জিহাদ। হাদিসে ঈমানের পরেই জিহাদকে সর্বোত্তম কাজ বলা হয়েছে।
মহানবী সা: বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় কাজ অনুষ্ঠিত হতে দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগে) বাধা দেয়। যদি সে এ ক্ষমতা না রাখে, তবে যেন মুখের (কথায়) দ্বারা তা বাধা দেয়। যদি সে এ ক্ষমতাটুকুও না রাখে, তবে যেন অন্তরের দ্বারা এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। আর এটা হলো ঈমানের দুর্বলতম (নিন্মতম) স্তর। (মুসলিম)।
মুসলিম সম্প্রদায় বৈরাগ্যকে মানবতার প্রতি জুলুম বলে মনে করে এবং অন্য দিকে আল্লাহ ও রাসূলের বিধিবিধানের জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ধর্মনীতি ও রাজনীতির মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই এবং ধর্ম শুধু মসজিদ ও খানকায় আবদ্ধ থাকার জন্য আসেনি; বরং হাটঘাট, মাঠ-ময়দান, অফিস-আদালত ও মন্ত্রণালয়গুলোতে এর সাম্রাজ্য অপ্রতিহত। তারা বাদশাহীর মাঝে ফকিরি এবং ফকিরির মাঝে বাদশাহী শিক্ষা দিয়েছে। (তাফসির, পৃ: ৭৪)।
আলোচ্য বিষয় থেকে সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় যে, ইসলামের নির্দেশনা শুধু মসজিদ ও খানকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সামাজিক শৃঙ্খলা, শান্তি, ন্যায়নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অপরিসীম ভূমিকা ও স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দোয়া ও বিবৃতিদানের মধ্যে ইসলাম আবদ্ধ নয়। ইসলাম শুধু একটি ধর্মের নামই নয়, বরং ইসলাম হচ্ছে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিধানসংবলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী জীবনব্যবস্থা। ইসলামকে শুধু একটি ব্যবহারিক ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। ইসলামে প্রগতির দিক আছে, বিপ্লবের দিক আছে। ইসলাম প্রগতির পথে অন্তরায় নয়। ইসলাম জীবনের সব বিভাগের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা মানবজাতিকে উপহার দিয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের অনুশাসন রয়েছে।
লেখক : প্রবন্ধকার।