নাম খালিদ, ডাক নাম আবু আইউব। পিতা যায়িদ ইবন কুলাইব আল-নাজ্জারী আল-খাযরাজী। কেউ কেউ মালিক ইবন নাজ্জারের সাথে সম্পর্কের কারণে ‘আল-মালিকী’ এবং আনসারদের ‘আযদী’ হওয়ার কারণে তাঁকে ‘আল-আযদী’ বলেও উল্লেখ করে থাকেন। (দারিয়া-ই মা’য়ারিফ-ই-ইসলামিয়্যা, উর্দু ১/৭৪২), মাতা হিন্দা বিনতু সা’দ। (উসুদুল গাবা- ২/৮০) তবে ইবন সা’দের মতে যাহরা বিনতু সা’দ। (তাবাকাত- ৩/৪৮৪) ‘যাহরা’ আবু আইউবের পিতার মামাতো বোন। আবু আইউব চল্লিশ ‘আমুল ফীল’ (হস্তী বৎসর) অর্থাৎ হিজরাতের একত্রিশ বছর পূর্বে ইয়াসরিবে জন্মগ্রহণ করেন। ইতিহাসে তিনি ‘আবু আইউব’ ডাক নামে পরিচিত। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ-ই-ইসলামিয়্যা, (উর্দু)- ১/৭৪২) নাজ্জার খান্দানটি ইয়াসরিবের অন্যতম অভিজাত খান্দান। আর সেই আভিজাত্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে রাসূলুল্লাহর সা. মাতুল গোত্র হওয়ার কারণে। আবু আইউব এই অভিজাত নাজ্জার গোত্রের রয়িস বা নেতা।
রাসূলুল্লাহ সা. মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চলেছেন। ইসলামী দাওয়াতের জন্য মক্কার প্রতিকূল অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইয়াসরিবেও ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছে। নবুওয়াতের দশম বছরে ছয় জন, একাদশ বছরে বারোজন এবং দ্বাদশ বছরে তিহাত্তর মতান্তরে পঁচাত্তর জন ইয়াসরিববাসী (মদীনা বাসী) হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় এসে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একটি শপথ বাক্য উচ্চারণ করেন। ইতিহাসে যা ’আকাবার ১ম, ২য় ও ৩য় শপথ’ নামে পরিচিত। এই শেষ শপথে আবু আইউব উপস্থিত ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত হতে ইয়াসরিবে ফিরে যান। (উসুদুল গাবা- ২/৮০, তাবাকাত ৩/৪৮৪) তিনি যে মহাসত্যের সন্ধান নিয়ে ফিরে এলেন তা অন্যদেরকে না জানানো পর্যন্ত স্থির হতে পারলেন না। নিকট আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের আপনজনদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। শিগগিরই স্ত্রীকে স্বধর্মে টেনে আনলেন।
আকাবার শপথগুলিতে মদীনার বেশ কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করায় এবং মদীনায় প্রেরিত রাসূলুল্লাহর সা. প্রতিনিধি মুসয়াব ইবন ’উমাইরের রা. প্রচেষ্টায় সেখানে ইসলামী দাওয়াত খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। এদিকে রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে অনেক নির্যাতিত মুসলমান মক্কা থেকে চুপে চুপে হিজরাত করে মদীনায় চলে আসতে শুরু করলেন। কিন্তু হযরত রাসূলে কারীম সা. তখনও কুরাইশদের বৈরী পরিবেশের মধ্যে মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন। অবশেষে নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছরে আল্লাহর নির্দেশে তিনিও মদীনার দিকে বেরিয়ে পড়লেন।
মদীনাবাসীরা অধীর আগ্রহে মহানবীর আগমন অপেক্ষায় ছিল। আনসারদের একটি দল- আবু আইউব তাদের একজন- নিয়মিত প্রতিদিন সকালে মদীনার ৪/৫ মাইল দূরে ‘হাররা’ নামক স্থানে চলে যেত এবং রাসূলুল্লাহর সা. সম্ভাব্য আগমন পথের দিকে তাকিয়ে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। তারপর এক সময় তারা ফিরে যেত। এমনিভাবে একদিন তাঁরা ফিরে যাচ্ছে, এমন সময় জনৈক ইয়াহুদী বহু দূর থেকে রাসূলুল্লাহকে সা. দেখতে পেয়ে তাদেরকে সুসংবাদ দেয়। আনসাররা অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে মহানবীকে স্বাগতম জানানোর জন্য দ্রুত ছুটে যায়। বনু নাজ্জার ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী।
মদীনার উপকণ্ঠে ‘কুবা’ পল্লীতে হযরত রাসূলে কারীম সা. কয়েক দিন অবস্থান করলেন। অতঃপর তিনি মদীনার মূল শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কুবা থেকে মদীনার দিকে তাঁর যাত্রার সেই দিনটি ছিল মদীনার ইতিহাসের সর্বাধিক গৌরব ও কল্যাণময় দিন। বনী নাজ্জারসহ মদীনার সকল আনসার গোত্রের লোক মহানবীর চলার পথের দু’ধারে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে, আর গোত্র-পতিরা নিজ নিজ ঘরের দরযায় অপেক্ষমান। পর্দানশীল মেয়েরা ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে এবং হাবশী গোলামরা আনন্দ-ফুর্তিতে সামরিক কলা-কৌশল প্রদর্শনে মেতে উঠেছে। আর বনী নাজ্জারের ছোট ছেলে-মেয়েরা ‘তালায়াল বাদরু আলাইনা’- স্বাগতম সঙ্গীতটি সমবেত কণ্ঠে গেয়ে চলেছে। এমনি এক জাঁকালো ও পবিত্র অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে মহানবী মদীনায় প্রবেশ করলেন।
মহানবীর আতিথেয়তার সৌভাগ্য কার হয় তা দেখার জন্য মদীনার প্রতিটি লোক অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। তিনি পথ অতিক্রম করছেন, আর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা- আহলান, সাহলান ওয়া মারহাবান- স্বাগতম শুভাগমন ইত্যাদি বলে এগিয়ে এসে নিজ নিজ বাড়ীতে মেহমান হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে কিন্তু আল্লাহ পাক তো মহানবীর আতিথেয়তার জন্য আবু আইউবের বাড়ীটি নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর বাহন উটনীটির পথ রোধকারীদের বার বার বলছিলেনঃ ‘তোমরা তার পথটি ছেড়ে দাও, সে (আল্লাহর তরফ থেকে) নির্দেশ প্রাপ্ত।’ (উসুদুল গাবা- ২/৮০) ইমাম মালিক বলেন, সেই সময় রাসূলুল্লাহর সা. মধ্যে ওহীর অবস্থা বিরাজমান ছিল। তিনি অবতরণ স্থল নির্ণয়ের ব্যাপারে ওহীর প্রতীক্ষায় ছিলেন [সীয়ারে আনসার (উর্দু)- ১/১১০]
উটনী চলতে চলতে এক সময় বনী মালিক ইবন নাজ্জারের মধ্যে এক স্থানে (পরবর্তীকালে মসজিদে নববীর দরযায়) বসে পড়ে। তারপর একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার উঠে পড়ে এবং একটু এদিক সেদিক ঘুরে আবার পূর্ব স্থানে ফিরে এসে বসে পড়ে। রাসূলুল্লাহ সা. নেমে পড়েন। নিকটেই ছিল আবূ আইউবের বাড়ী। (উসুদুল গাবা- ২/৮১) আবু আইউব এগিয়ে এসে আরজ করেন নিকটেই আমার বাড়ী, অনুমতি পেলে বাহনের পিঠ থেকে জিনিস পত্র নামাতে পারি। নিজের বাড়ীতে মেহমানদারি করার অভিলাষীদের ভিড় কিন্তু তখনও কমেনি। সবারই একান্ত ইচ্ছা রাসূলুল্লাহ সা. তারই মেহমান হউন। শেষমেষ লোকেরা নিজেদের মধ্যে কারয়া বা লটারী করে এবং তাতে আবূ আইউবের নামটি ওঠে। এভাবে আবূ আইউব মহানবীর মেহমানদারির মহাগৌরব অর্জনের সুযোগ লাভ করেন। (সীয়ারে আনসার- ১/১১১)
হযরত রাসূলে কারীম সা. মসজিদ ও মসজিদ সংলগ্ন তাঁর বাসস্থান তৈরী না হওয়া পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস আবূ আইউবের গৃহে অবস্থান করেন। অত্যন্ত প্রীতি ও বিনয়ের সাথে তিনি মেহমানদারির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ঘরটি ছিল দুইতলা। তবে ছাদটি ছিল সাদামাটা ধরণের। আবূ আইউব ওপরতলা রাসূলুল্লাহর সা. জন্য নির্ধারণ করেন। কিন্তু রাসূল সা. নিজের ও সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে নীচতলাই পছন্দ করেন। এভাবে দিন কেটে যেতে লাগলো। ঘটনাক্রমে একদিন ওপর তলায় পানির একটি কলস ভেঙ্গে পানি গড়িয়ে পলো। ছাদ ছিল অতি সাধারণ। পানি নীচে গড়িয়ে পড়বে এবং তাতে রাসূলুল্লাহর সা. কষ্ট হবে, এমন একটা ভীতি ও শঙ্কায় আবূ আইউব ও তাঁর স্ত্রী উম্মু আইউব অস্থির হয়ে পড়লেন। তাঁদের ছিল একটি মাত্র লেপ। পানি চুষে নেওয়ার জন্য তাঁরা সেটি পানির ওপর ফেলে দেন। সাথে সাথে তাঁরা নীচে নেমে এসে রাসূলুল্লাহকে সা. ওপরে যাওয়ার অনুরোধ করে নিজেরা নীচে নেমে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। (উসুদুল গাবা- ২/৮১)
এতটুকু কষ্ট অবশ্য তাঁদের জন্য তেমন কিছু ছিল না। তাঁরা অন্য একটি ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন। ‘আমরা ওপরে আর ওহীর বাহক, আমাদের নীচে’ এমন একটা তীব্র অনুভূতি তাদেরকে অস্থির করে তুললো। একটি রাত তো তাঁরা ঘুমাতেই পারলেন না। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই ঘরের এক কোণে গুটি-শুটি মেরে কোন মতে জেগে কাটিয়ে দিলেন। সকালে আবূ আইউব রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে গতরাতের ঘটনা ও তাঁদের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁদের অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাঁদের আবেদন মঞ্জুর করেন। তিনি ওপরে চলে যান। (সূরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৯৮, হায়াতুস সাহাবা- ২/৩২৮-৩২৯)
হযরত আবূ আইউবের মৃত্যুর পর এই বাড়ীটি তাঁর আযাদকৃত দাস আফলাহ-এর হাতে চলে যায়। ঘরটির দেওয়াল ধসে গিয়ে বিরান হওয়ার উপক্রম হলে তাঁর নিকট থেকে এক হাজার দিনারের বিনিময়ে মুগীরা ইবন ’আবদির রহমান ইবন হারিস ইবন হিশাম খরীদ করে সংস্কার করেন। আর আফলাহ সেই অর্থ মদনিার গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বন্টন করে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৯৮, টীকা নং- ৩)
হযরত রাসূলে কারীম সা আবূ আইউবের গৃহে অবস্থানকালে সাধারণতঃ আনসারগণ পালাক্রমে অথবা আবূ আইউব নিজে তাঁর জন্য খাবার পাঠাতেন। খাওয়ার পর যা বেঁচে যেত তিনি আবূ আইউবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। আবূ আইউব খাবারের থালায় রাসূলুল্লাহর সা. আাঙ্গুলের ছাপ দেখে দেখে যে দিক থেকে তিনি খেয়েছেন সেখান থেকেই খেতেন। ঘটনাক্রমে একদিন রাসূল সা. খাবার স্পর্শ না করে, সবই ফেরত পাঠান। দ্বিধা ও সংকোচের সাথে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে খাবার গ্রহণ না করার কারণ জানতে চান। তিনি বলেন, খাবারে রসুন ছিল। আমি রসুন পছন্দ করিনে। তবে তোমরা খাবে। আবূ আইউব বললেন, ‘আপনার যা পছন্দ নয়, আমিও তা পছন্দ করবো না।’ (মুসলিম- ২/১৯৮, সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৯৯, উসুদুল গাবা- ২/৮১)
হিজরাতের পর হযরত রাসূলে কারীম সা. হযরত আনাসের বাড়ীতে আনসার ও মুহাজিরদের সমবেত করেন এবং রুচি, সামাজিক মর্যাদা, ঝোঁক প্রবণতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অনুসারে একজন মুহাজির ও একজন আনসারের মধ্যে মওয়াখাত বা দ্বীনী ভ্রাতৃসম্পর্ক কায়েম করে দেন। ইয়াসরিবে ইসলামের প্রথম মুবাল্লিগ (প্রচারক) মুস’য়াব ইবন ’উমাইর আল-কুরাইশীর সাথে আবূ আইউবের ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। (তাবাকাত- ৩/৪৮৪) মুস’য়াব প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা এক উৎসাহী সাহাবী। ইসলামী দা’ওয়াতের পথে তিনি বহু কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় হিজরাতের পূর্বে সর্বপ্রথম দায়ী (প্রচারক) হিসাবে তাঁকে মদনিায় পাঠান। তাঁর সাথে আবূ আইউবের ভ্রাতু-সম্পর্ক স্থাপনের তাৎপর্য হল, তাঁর মধ্যেও মুসয়াবের মত উৎসাহ উদ্দীপনা বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের ঘটনাবলী একথার সত্যতা প্রমাণ করেছে।
বদর, উহুদ, খন্দক, বাইয়াতুর রিদওয়ান সহ সকল যুদ্ধ ও অভিযানে আবূ আইউব রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন। (উসুদুল গাবা- ২/৮০, আল-ইসাবা- ১/৪০৫) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট তিনি সত্যিকারেই জীবন ও ধন-সম্পদ বিক্রী করে দিয়েছিলেন। রাসূলে পাকের সা. ওফাতের পর খলীফাদের যুগে যত যুদ্ধ হয়েছে, হাজারো দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও তিনি তাঁর একটি থেকেও পিছিয়ে থাকেননি। রাত-দিন, প্রকাশ্যে ও নিরিবিলিতে সর্বক্ষণ তাঁর শ্লোগান ছিল আল্লাহর এই বাণী- ‘ইনফিরূ খিফাফান ওয়াসিকালান’- তোমরা হালকা এবং ভারী উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বেরিয়ে পড়। (তাওবা- ৪১) অর্থাৎ একাকী ও দলবদ্ধভাবে, উদ্দমী ও হতোদ্দম অবস্থায়, যৌবনে ও বার্ধক্যে, প্রাচুর্য ও দারিদ্রের মধ্যে- মোটকথা সর্ব অবস্থায়। (ফাতহুল কাদীর- ২/২৬৩) তিনি বলতেনঃ আমি নিজেকে সব সময় ‘খাফীফ ও সাকীল’- ই পেয়েছি। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৫৭-৪৫৮, তাবাকাত- ৩/৪৮৫)
রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর মাত্র একটি বার তিনি ঘর থেকে বের হননি। সেই যুদ্ধে খলীফা একজন কম বয়স্ক যুবককে সেনাপতি নিয়োগ করেন। যার নেতৃত্বের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতে সেই সেনাপতি হলেন ইয়াযীদ ইবন মু’য়াবিয়া রা.। তবে বেশী দিন ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তিনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আবর্তে দোল খেতে থাকেন, অনুশোচনায় দগ্ধিভূত হন। অল্প দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান। আপন মনে বলে ওঠেনঃ কে আমার আমীর, তাতে আমার কী আসে যায়? এমন চিন্তার পর একটি মুহূর্তও নষ্ট না করে সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। ইসলামী সেনা দলের একজন সৈনিক হিসাবে বেঁচে থাকা, তার পতাকাতলে যুদ্ধ করে ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রাখা- তিনি জীবনের পরম প্রাপ্তি বলে মনে করেন। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪০৬, হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৫৮) তিনি জিহাদের উদ্দেশ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশেই গমন করেন। (দারিয়া-ই মা’যারিফ-ই-ইসলামিয়্যা- ১/৭৪৩)
হিজরী ৩৫ সনে হযরত ’উসমান রা. যখন বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হন তখন আবূ আইউব মদীনা্য়। সেই দুর্যোগময় সময়ে মাঝে মাঝে তিনি মসজিদে নববীতে নামাযের ইমাম হতেন। আলী ও মু’য়াবিয়ার রা. মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকালীন সেই সংকটময় সময়ে তিনি বিনা দ্বিধায় আলীর রা. পক্ষ অবলম্বন করেন। কারণ, তাঁর মতে, তিনিই ইমাম, মুসলমানরা তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছে। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪০৭) ইবনুল আসীরের মতে আলীর রা. সাথে তিনি সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। (উসুদুল গাবা- ২/৮১) মাস’উদী ‘মুরূপজ আজ-জাহব’ গ্রন্থে হিঃ ৩৬ সনে আলীর রা. সাথে উটের যুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণের কথা বলেছেন। ইবন আবদিল বার ‘আল-ইসতী’য়াব’ গ্রন্থে মাস’উদীর কথা সমর্থন করেছেন। তবে হিঃ ৪র্থ শতকের ঐতিহাসেকি মাস’উদীর পূর্বের কোন ঐতিহাসিক আবূ আ্ইউবের উটের যুদ্ধে যোগদানের কথা বলেছেন বলে জানা যায় না। খারেজীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘নাহরাওয়ানের’ যুদ্ধে তিনি যোগদান করেন। যুদ্ধের পূর্বে যাঁরা খারেজীদের সাথে আপোষরফার চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে আবূ আইউবও একজন। তিনি আলীর রা. সাথে ‘মাদায়িন’ গমন করেন। তাঁর প্রতি আলীর রা. ছিল গভীর বিশ্বাস ও আস্থা। মদীনা থেকে ‘দারুল খিলফা’ (রাজধানী) কূফায় স্থানান্তরিত হলে আলী রা. তাঁকে মদীনায় স্থলাভিষিক্ত করে যান। আবূ আইউব সেই সময় মদীনায় আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। [সীয়ারে আনসার- ১/১১১, দারিয়া-ই মা’য়ারিফ-ই-ইসলামিয়্যা- (উর্দু) ১/৭৪৩]
হযরত আলীর রা. শাহাদাতের সময় আবু আইউব মদীনায়। তারপর হযরত মুয়াবিয়া রা. খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। আবূ আইউব চাওয়া-পাওয়ার লোক ছিলেন না। তাঁর একমাত্র বাসনা ছিল জিহাদের ময়দানে ও মুজাহিদদের সারিতে একটুখানি স্থান। হিজরী ৪২ সনে বাইজেন্টাইন রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অভিযান বৃদ্ধি পায়। তিনি এ সময় খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের পুত্র আবদুর রহমানের নেতৃত্বে জিহাদে শরিক হন। তখন তাঁর বয়স ৭৫ বছর। হিঃ ৪২ সনে সামুদ্রিক যুদ্ধে যোগদানের জন্য মিসর গমন করেন।
হযরত রাসূলে কারীম সা. বাইজেন্টাইন রোমানদের ঘাঁটি কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে যান। কার হাতে এ বিজয়-কর্ম সমাধা হয় তা দেখার জন্য মুসলিম আমীরগণ সব সময় উৎসুক ছিলেন। হিঃ ৫২ মতান্তরে ৪৯ সনে হযরত মু’য়াবিয়া রা. রোমানদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তিনি স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধের নির্দেশ দেন। এই বাহিনীতে ইবন ’উমার, ইবন ’আব্বাস ও ইবন যুবাইরের মত মর্যাদাবান সাহাবীদের সাথে আবূ আইউবও একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে যোগ দেন।
মিসর, সিরিয়াসহ মুসলিম খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভিন্ন ভিন্ন সেনা ইউনিট এ যুদ্ধে যোগ দেয়। মিসরীয় সেনা ইউনিটের কমাণ্ডার ছিলেন তথাকার গভর্ণর প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ’উকবা ইবন ’আমির আল-জুহানী। তাছাড়া ফুদালা ইবন ’উবাইদ ও আবদুর রহমান ইবন খালিদ ইবন ওয়ালীদের নেতৃত্বেও দু’টি সেনা ইউনিট যোগ দেয়।
রোমানরা যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বার জন্য এগিয়ে আসে। মুসলমানদের প্রস্তুতিও কম ছিল না। তাদের সংখ্যাও প্রায় শত্রুসংখ্যার সমান। মুসলিম সৈনিকদের মধ্যে আবেগ উৎসাহ এত তীব্র ছিল যে, কোন কোন ক্ষেত্রে একজন মাত্র মুসলিম সৈনিক রোমানদের একটি পুরো সারির বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। একজন মুসলিম সৈনিক একবার একাই রোমানদের ব্যুহ ভেদে করে তাদের ভেতরে ঢুকে পড়ে। তার এই দুঃসাহস দেখে অন্যান্য মুসলমানদের মুখ থেকে সমস্বরে এ কুরআনের আয়াতটি ধ্বনিত হয়ে ওঠেঃ লা তুলকূআয়দীকুম ইলাত তাহলুকাহ’- তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করোনা। (আল-বাকারা- ১৯৫) তাদের একথা শুনে আবূ আইউব এগিয়ে গিয়ে বললেনঃ তোমরা আয়াতটির এই অর্থ বুঝলে? এ আয়াতটি তো নাযিল হয়েছিল ব্যবসায় ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে আনসারদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে। একবার আসাররা বলল, গত বছর জিহাদে যোগদানের জন্য ব্যবসায়ের যে ক্ষতি হয়েছে এ বছর তা পুষিয়ে নিতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে এ আয়াতের অবতরণ। আয়াতটির তাৎপর্য হল, ধ্বংস জিহাদে নয়, জিহাদ ত্যাগ করা ও অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আহরণে ব্যস্ত থাকার মধ্যে ধ্বংস। (সীয়ারে আনসার- ১/১১২, হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৭০-৪৭১, ৪৫৮-৪৫৯, তাবাকাত- ৩/৪৮৪-৪৮৫)
এই কনস্ট্যান্টিনোপল অভিযানের সফরে এক মহামারি দেখা দেয়। বহু মুজাহিদ সেই মহামারিতে মারা যান। আবু আইউবও আক্রান্ত হলেন। তিনি অন্তিম রোগ শয্যায়। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ইয়াযীদ ইবন মুয়াবিয়া শেষ বারের মত তাঁকে দেখতে এলেন। তিনি জানতে চাইলেন, ‘আবু আইউব, আপনার কিছু চাওয়ার আছে কি? আমি আপনার অন্তিম ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করবো।’
কিন্তু যে ব্যক্তি জান্নাতের বিনিময়ে নিজের সবকিছু বিক্রী করে দিয়েছেন, এ নশ্বর পৃথিবীতে তাঁর চাওয়ার কী থাকতে পারে? তিনি জীবনের অন্তিম মুহূর্তে ইয়াযীদের কাছে যা আশা করলেন তা কোন মানুষের কল্পনায়ও আসতে পারে না। তিনি ধীর স্থিরভাবে বললেন, আমি মারা গেলে তোমরা আমার মৃতদেহটি ঘোড়ার ওপর উঠিয়ে শত্রু-ভূমির অভ্যন্তরে যতদূর সম্ভব নিয়ে যাবে এবং শেষ প্রান্তে দাফন করবে। মুসলিম বাহিনীকে এই পথে দ্রুত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে যাতে তাদের অশ্বের পদাঘাত আমার কবরের ওপর পড়ে এবং আমি বুঝতে পারি, তারা যে সাহায্য ও কামিয়াবী চায় তা তারা লাভ করতে পেরেছে। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪০৭, আল ইসাবা- ১/৪০৫)
আবূ আইউবের মৃত্যুর পর তাঁর অন্তিম ইচ্ছার বাস্তবায়ন করা হয়। একদিন রাতে মুসলিম বাহিনী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে লাশটি উঠিয়ে নেয় এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের (আধুনিক ইস্তাম্বুল) নগর প্রাচীরের গা ঘেঁষে তাঁকে দাফন করে। মুসলিশ বাহিনীর সকল সদস্য তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে। বিধর্মীরা তাঁর মাযারের অবমাননা করতে পারে, এই চিন্তায় ইয়াযীদ কবরটি মাটির সাথে সমান করে দেন। পরদিন সকালে রোমানরা মুসলিম মুজাহিদদের কাছে জানতে চাইলো, কাল রাতে আপনাদের একটু ব্যস্ত দেখা গেল, কী হয়েছিল? তাঁরা জবাব দিলেন, আমাদের নবীর একজন অতি সম্মানিত সংগীর মৃত্যু হয়েছে, তাঁরই দাফন কাজে আমরা ব্যস্ত ছিলাম। যেখানে দাফন করা হয়েছে তোমরা তা জান। যদি তাঁর মাযারের অবমাননা করা হয় তাহলে জেনে রাখ, বিশাল ইসলামী খিলাফতের কোথাও তোমাদের ‘নাকুস’ আর বাজবে না। (সীয়াবে আনসার- ১/১১৩) ইস্তাম্বুলের সন্নিকটে হযরত আবু আইয়ূবের কবরটি আজও বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের এক তীর্থ-স্থান। রোমানরা তাদের দুর্ভিক্ষ ও খরার সময় তাঁর কবরে নিকট সমবেত হয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করতো এবং পানি চাইতো। (দারিয়া-ই মায়ারিফ-ই-ইসলামিয়্যা- ১/৭৪৫, উসুদুল গাবা- ২/৮২)
হযরত আবু আইউবের মৃত্যুসন সম্পর্কে মতভেদ আছে। ইবনুল আসীর উসুদুল গাবা (২/৮১) গ্রন্থে তিনটি মতের উল্লেখ করেছেন। যথ হিজরী ৫০, ৫১ ও ৫২ সন। তবে হিজরী ৫২ সন অধিকাংশের মত বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। ইবন আসাকির তাঁর একটি মতে হিজরী ৫৫ সন বলে উল্লেখ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় আশি বছর।
হযরত আবু আইউবের ফজীলাত ও মর্যাদা সম্পর্কে বহু কথা হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। তাঁর জীবনের এমন অনেক ঘটনা জানা যায় যা খুবই শিক্ষণীয়। এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে সেসব বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
হযরত ইবন ’আব্বাস বলেন, ‘একথা প্রচন্ড গরমের দিনে ঠিক দুপুরের সময় আবু বকর ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে আসলেন। ’উমার তাঁকে দেখে প্রশ্ন করলেন,
– এমন অসময়ে বের হলেন যে?
– কী করবো, দুঃসহ ক্ষুধা তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
– আল্লাহর কসম, আমারও একই দশা। তাঁদের দু’জনের কথা শেষ না হতেই হযরত রাসূলে কারীম সা. সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে দেখে বললেনঃ
– কি ব্যাপার, এ অসময়ে তোমরা এখানে?
– ক্ষুধার জ্বালায় আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি।
রাসূল সা. বললেনঃ যার হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ, আমিও ক্ষুধার জ্বালায় ঘরে থাকতে পারিনি। এসো তোমরা আমার সাথে।
তাঁরা তিন জন হাঁটতে হাঁটতে আবু আইউবের বাড়ীর দরজায় পৌঁছলেন। আবু আইউবের অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন রাসূলে কারীমের সা. জন্য খাবার তৈরী রাখা। তিনি দেরি করলে বা না খেলে তাঁর পরিবারের লোকেরা তা ভাগ করে খেয়ে ফেলতো; তাঁদের তিনজনের সাড়া পেয়ে উম্মু আইউব (আবু আইউবের স্ত্রী) বেরিয়ে এসে বললেন,
– আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়, আহলান ওয়া সাহলান।
– আবু আইউব কোথায়?
আবু আইউব নিকটেই তাঁর খেজুর বাগানে কাজ করছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. গলার আওয়ায শুনে এই কথা বলতে বলতে ছুটে আসলেনঃ
– ইয়া রাসূলুল্লাহ, এমন সময় তো আপনার শুভাগমন হয় না।
– তোমার কথাই ঠিক।
আবু আইউব দৌড়ে বাগানে গেলেন এবং এক কাঁধি শুকনো ও পাকা-কাঁচা খেজুর কেটে নিয়ে আসলেন।
রাসূল সা. বললেনঃ তুমি এটা কেটে আন তা কিন্তু আমি চাইনি।
– আপনি এর থেকে কিছু শুকনো, পাকা ও কাঁচা খেজুর খান- এটাই আমার একান্ত ইচ্ছা। আমি আপনাদের জন্য এক্ষুণি বকরী জবেহ করব। রাসূল সা. বললেনঃ জবেহ করলে দুধালো বকরী জবেহ করবে না।
আবু আইউব দুধ দেয় না এমন একটি বকরী জবেহ করলেন। স্ত্রীকে বললেনঃ গোশত ভূনা কর এবং রুটি বানাও। তুমি তো রুটি বানাতে দক্ষ। আবু আইউব লেগে গেলেন বকরীর অর্ধেকটা রান্না করতে। রান্নার কাজ শেষ করে তা রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের সামনে হাজির করলেন।
রাসুল সা. এক টুকরো গোশত উঠিয়ে একটি রুটির ওপর রেখে বললেনঃ
– আবু আইউব, শিগগির তুমি এই টুকরোটি ফাতিমাকে দিয়ে এস। বহু দিন সে এমন খাবার দেখে না।
তাঁরা সকলে পেট ভরে খেলেন। তারপর রাসূল সা. বললেন, ‘রুটি, গোশত, খুরমা, পাকা ও আধাপাকা খেজুর।’ চোখ দু’টি তাঁর পানিতে ভরে গেল। তারপর বললেনঃ ‘‘যার হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ! এই নি’য়ামত (দান, অনুগ্রহ) সম্পর্কে কিয়ামতের দিন তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমরা এই নিয়ামত লাভ করলে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তাতে হাত দেবে এবং পেট ভরে খাওয়ার পর বলবে ‘আলহামদুলিল্লাহ আল্লাজী আশবা’য়ানা ওযা আন’য়ামা আলাইনা ফা আফদালা।’’
রাসূলুল্লাহ সা. বিদায় নেওযার সময় আবু আইউবকে বললেনঃ
– আগামী কাল আমার সাথে দেখা করবে।
পরদিন আবু আইউব রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি ছোট একটি দাসীকে আবু আইউবের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেনঃ আবু আইউব, তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। আমার কাছে যতদিন ছিল, আমরা তাঁর মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু দেখিনি।
দাসীটি সংগে করে আবু আইউব বাড়ী ফিরলেন। স্ত্রী প্রশ্ন করলেনঃ আইউবের বাপ, এটা আবার কার?
রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে দান করেছেন। ‘দাতা অতি মহান, দানটিও অতি সম্মানিত’- স্ত্রী মন্তব্য করলেন।
– রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর প্রতি ভালো আচরণের উপদেশ দিয়েছেন।
– উপদেশ কিভাবে বাস্তবায়ন করবে?
– তাকে আযাদ করে দেওয়া ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. উপদেশ বাস্তবায়নের আর কোন উত্তম পন্থা নেই।
– তুমি সঠিক হিদায়াত পেয়েছ। তুমি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
অতঃপর তাঁরা দাসীটি আযাদ করে দিলেন। (সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা- ১/১২৪-১৩০; হায়াতুস সাহাবা- ১/৩০৮-৩১০)
উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়া বিনতু হুয়াই-এর সাথে যে রাতে রাসূলুল্লাহর সা. প্রথম বাসর হয়, সে রাতে সকলের অজ্ঞাতসারে আবু আইউব রাসূলুল্লাহর সা. দরযায় কোষমুক্ত তরবারি হাতে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রত্যুষে রাসুল সা. বের হয়ে আবু আইউবকে দেখতে পান। আবু আইউব বলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ আপনি তাঁর বাপ, ভাই ও স্বামীকে হত্যা করেছেন- এজন্য আমি আপনাকে নিরাপদ মনে করিনি। তাঁর কথা শুনে রাসূল সা. হেসে দেন এবং তাঁর জন্য দু’আ করেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৪৩, হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৬৩)
সাহাবা সমাজের মধ্যে তাঁর মর্যাদা এত উঁচুতে ছিল যে, অন্যান্য সাহাবীরা তাঁর নিকট বিভিন্ন বিষয়ে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করতেন। ইবন ’আব্বাস, ইবন ’উমর, বারা’ ইবন আযিব, আনাস ইবন মালিক, আবু উমামা, যায়িদ ইবন খালিদ আল-জুহানী, মিকদাম ইবন মা’দিকারাব, জাবির ইবন সুমরা, আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযীদ আল-খাতামী প্রমুখের ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীরা তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেণ। আর সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, ’উরওয়া ইবন যুবাইর, সালিম ইবন ’আবদিল্লাহ, ’আতা ইবন ইয়াসার, ’আতা ইবন ইয়াযীদ, লায়সী, আবু সালামা, আবদুর রহমান ইবন আবী-লায়লার মত বিশিষ্ট তাবে’ঈগণও ছিলেন তাঁর শাগরিদ। তাঁরা সকলে তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (উসুদুল গাবা- ২/৮১; আল-ইসাবা- ১/৪০৫)
আবু আইউব ছিলেন সাহাবাদের কেন্দ্রবিন্দু। কোন মাসযালায় সাহাবাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে সবাই তাঁর কাছে ছুটে যেতেন। একবার ইহরাম অবস্থায় জানাবাতের গোসলের সময় হাত দিয়ে মাথা ঘষা যায় কিনা- এ ব্যাপারে ইবন ’আব্বাস ও মিসওয়ার ইবন মাখরামার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। তাঁরা বিষয়টি জানার জন্য আবদুল্লাহ ইবন হুসাইনকে পাঠালেন আবু আইউবের নিকট। আবদুল্লাহ যখন পৌঁছলেন তখন ঘটনাক্রমে আবু আইউব গোসল করছিলেন। আবদুল্লাহর উদ্দেশ্য জানতে পেরে তিনি মাথাটি বাইরে বের করে দিয়ে তা ঘষতে ঘষতে বলেন, দেখ, এভাবে রাসূলুল্লাহ সা. গোসল করতেন। (বুখারী- ১/২৪৮)
হযরত আমীর মু’য়াবিয়ার রা. খিলাফতকালে ’উকবা ইবন ’আমির আল-জুহানী যখন মিসরের গভর্ণর তখন আবু আইউব দুইবার মিসর ভ্রমণ করেন। প্রথম সফরটি হাদীসের অন্বেষণে। তিনি শুনেছিলেন, ’উকবা রাসূলুল্লাহর সা. একটি হাদীস বর্ণনা করেন। ’উকবার মুখ থেকে সেই একটিমাত্র হাদীস শোনার জন্য মদীনা থেকে মিসর পর্যন্ত এত দীর্ঘপথ পাড়ি দেন। মিসর পৌঁছে তিনি মাসলামা ইবন মাখলাদের বাড়ীতে যান। মাসলামা তাঁকে স্বাগতম জানিয়ে বুকে বুক মিলান। আবু আইউব তাঁকে বলেন, ‘আমাকে একটু ’উকবার বাড়ীটি দেখিয়ে দাও।’ সেখানে পৌঁছে তিনি ’উকবাকে বলেন, ‘একটি কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা সেই সময় উপস্থিত ছিলেন, আমি ও আপনি ছাড়া তাঁদের আর কেউ এখন বেঁচে নেই। আচ্ছা, ‘সতরুল মুসলিম’- মুসলমানের সতর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহকে সা. আপনি কী বলতে শুনেছেন?’ ’উকবা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ ‘দুনিয়াতে যে ব্যক্তি কোন মুমিনের কোন গোপন বিষয় গোপন রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।’ এতটুকু শুনেই আবু আইউব মদীনার দিকে যাত্রা করেন। বাহনটিকে ছেড়ে দিয়ে একটু বিশ্রামও নিলেন না। অতঃপর হাদীসটি তিনি এভাবে বর্ণনা করতেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৯৮; মুসনাদে ইমাম আহমাদ- ৪/১৫৪)
হযরত আবু আইউবের জ্ঞান আহরণ ও তার প্রচার প্রসারের প্রতি এত তীব্র আকর্ষণ ছিল যে, মৃত্যু শয্যায়ও তা থেকে বিরত থাকেননি। তাঁর মৃত্যুর পর সাধারণ ঘোষনার মাধ্যমে হাদীস দু’টি মানুষের মধ্যে প্রচার করা হয়। (মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪১৪)
হযরত আবু আইউব কুরআনের হাফেজ ছিলেন। ইবন সাদ বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. যুগে আনসারদের মধ্যে পাঁচ জন কুরআন সংগ্রহ করেন। মা’য়াজ ইবন জাবাল, ’উবাদাহ্ ইবন সামিত উবাই ইবন কা’ব, আবু আইউব ও আবু দারদা। দ্বিতীয় খলীফা ’উমারের খিলাফতকালে ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ান রা. খলীফাকে লিখলেনঃ শামের অধিবাসীরা নানা পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করছে। তাদেরকে সঠিকভাবে কুরআন শিক্ষা দিতে পারে এমন কিছু বিজ্ঞ শিক্ষক সেখানে পাঠান। এই চিঠি পেয়ে ’উমার উপরোক্ত পাঁচ জনকে ডেকে পাঠান। তাঁরা উপস্থিত হলে বলেনঃ ‘তোমাদের শামবাসী ভাইয়েরা কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে আমার সাহায্য চেয়েছে। তোমাদের মধ্য থেকে অন্ততঃ তিনজন এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য কর। আর ইচ্ছা করলে তোমরা সবাই অংশগ্রহণ করতে পার।’ তাঁরা খলীফার আবেদনে সাড়া দিলেন। তাঁরা বললেনঃ ‘আবু আইউব বয়সের ভারে দুর্বল, আর উবাই ইবন কা’ব রোগগ্রস্ত।’ অতঃপর বাকী তিনজন যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৯৫)
হযরত আবু আইউব থেকে দেড়শো হাদীস বর্ণিত হয়েছে বলে সীরাত গ্রন্থসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ‘জালা’ আল-কুলুব’- এর গ্রন্থকার তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ২১০টি বলে উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে পাঁচটি হাদীস মুত্তাফাক আলাইহি। ইমাম আহমাদ তাঁর ‘মুসনাদ’- এর ৫ম খন্ডে ৪১২ থেকে ৪২৩ পৃষ্ঠায় ১১২টি এবং ১১৩-১১৪ পৃষ্ঠায় তাঁর বর্ণিত আরও কিছু হাদীস সংকলন করেছেন। [দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ-ই-ইসলামিয়্যা (উর্দু)- ১/৭৪৫]
হযরত আবু আইউবের চরিত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে বিদ্যমান ছিল। ১. রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি গভীর ভালোবাসা, ২. ঈমানী তেজ ও উদ্দীপনা, ৩. সত্য ভাষণ। রাসূলুল্লাহকে সা. এত গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন যে, তাঁর ওফাতের পর রওজা পাকের কাছে গিয়ে পড়ে থাকতেন।
তাঁর ঈমানী তেজ ও দৃঢ়তার প্রমাণ এই যে, রাসূলুল্লাহর সা. যুগে সংঘটিত কোন একটি যুদ্ধেও তিনি অনুপস্থিত থাকেননি। আর জীবনের শেষ প্রান্তে আশি বছর বয়সেও মিসরের পথে রোম সাগর পাড়ি দিয়ে ইস্তাম্বুলের নগর প্রাচীরের সন্নিকটে ইসলামী দা’ওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য গমন করেন।
আর ব্যক্তি বা রাষ্ট্র- কারও ভয়েই তিনি সত্য কথা বলা থেকে কখনও বিরত থাকেননি। একবার মিসরের গভর্ণর ’উকবা ইবন ’আমির আল-জুহানী- যিনি একজন সাহাবী, কোন কারণবশতঃ মাগরিবের নামায পড়াতে একটু বিলম্ব করলেন। আবু আইউব উঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলেন ‘মা হাজিহিস সালাতু ইয়া উকবা’- উকবা এটা কেমন নামায? উকবা বললেন, একটি কাজে আটকে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে। আবু আইউব বললেনঃ ‘আপনি রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী, আপনার এই কাজের দ্বারা মানুষের ধারণা হবে রাসূলুল্লাহ সা. এই সময় নামায আদায় করতেন। অথচ মাগরিবের নামায তাড়াতাড়ি আদায়ের জন্য তিনি কত তাকীদ দিয়েছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪১৭)
ইসলামী বিধি-বিধান তিনি নিজে যেমন পরিপূর্ণরূপে অনুসরণ করতেন তেমনি অন্যদের নিকট থেকেও অনুরূপ অনুসরণ আশা করতেন। কারও মধ্যে সামান্য বিচ্যুতি লক্ষ্য করলেও তা সংশোধন করে দিতেন। একবার হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের ছেলে আবদুর রহমান কোন এক যুদ্ধে চারজন বন্দীকে হাত-পা বেঁধে হত্যা করেন। এ কথা আবু আইউব জানতে পেরে তাঁকে বলেন, ‘পশুর মত এভাবে হত্যা করা থেকে রাসূলুল্লাহ সা. নিষেধ করেছেন। আমি তো এভাবে একটি মুরগীও জবেহ করা পছন্দ করিনে।’ (মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪২২)
রোমানদের সাথে যুদ্ধের সময় জাহাজে একজন অফিসারের তত্ত্বাবধানে বহু সংখ্যক যুদ্ধবন্দী ছিল। একদিন আবু আইউব দেখতে পেলো একজন মহিলা কয়েদী বড় ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। তিনি মহিলাটির এভাবে কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। লোকেরা বলল, ‘তার সন্তান থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।’ আবু আইউব ছেলেটির হাত ধরে মহিলার হাতে তুলে দেন। অফিসার আবু আইউবের বিরুদ্ধে কমান্ডারের নিকট অভিযোগ করেন। কমান্ডারের প্রশ্নের জবাবে আবু আইউব বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. এ ধরণের কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪১২)
তিনি সিরিয়া ও মিসরে গেলেন। দেখলেন, সেখানকার পায়খানাসমূহ কিবলামুখী করে তৈরী করা। তিনি বার বার শুধু বলতে লাগলেন, ‘কী বলবো? এখানে পায়খানা কিবলামুখী করে তৈরী করা, অথচ রাসূল সা. এমনটি করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ- ৫/৪১২)
সালিম ইবন ’আবদিল্লাহ ইবন ’উমার বলেনঃ ‘আমার পিতার (আবদুল্লাহ ইবন ’উমার) জীবদ্দশায় একবার আমাদের বাড়ীতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হল। আমার পিতা অন্যদের সাথে আবু আইউবকেও দাওয়াত দিলেন। সুন্দর সুন্দর সবুজ চাদর দিয়ে আমাদের বাড়ীর দেওয়াল ঢেকে দেওয়া হল। আবু আইউব এসেই মাথা উঁচু করে একবার তাকিয়ে দেখলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেনঃ ‘আবদুল্লাহ, তোমরা দেওয়াল ঢেকে দিয়েছ?’ সালেম বলেনঃ আমার পিতা লজ্জিত হয়ে জবাব দিলেন, ‘আবু আইউব, মহিলারা আমাদেরকে কাবু করে ফেলেছে।’ আবু আইউব বললেনঃ ‘সবার ব্যাপারে এ আশংকা আমার আছে। তবে তোমার ব্যাপারে এমন আশংকা ছিলনা। আমি তোমার বাড়ীতে ঢুকবো না, আহারও করবো না।’ (হায়াতুস সাহাবা- ২/৩০৫)
হযরত আবু আইউব যে কত উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইফ্ক-এর ঘটনায়। এই ইফ্ক বা হযরত ‘আয়িশার রা. প্রতি অপবাদ আরোপের ঘটনায় তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সুষ্ঠু। একদিন তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেনঃ আবু আইউব, ’আয়িশার সম্পর্কে লোকেরা যা বলাবলি করছে, তা কি তুমি শুনেছ?’ বললেনঃ ‘হাঁ, শুনেছি। ডাহা মিথ্যে কথা। উম্মু আইউব, তুমি কি এমন কাজ করতে পার?’ বললেনঃ আল্লাহর কসম! এমন কাজ আমি কক্ষণও করতে পারিনে।’ আবু আইউব বললেনঃ ‘তাহলে ’আয়িশা- যিনি তোমার চেয়েও উত্তম, তিনি কিভাবে করতে পারেন?’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩০২)
কনস্ট্যান্টিনোপল যুদ্ধের সময় একদিন একজন মুসলিম সৈনিক তাদের জাহাজে আবু আইউবকে খাবারের দা’ওয়াত দিল। তিনি হাজির হলেন এবং বললেন, ‘তোমরা আমাকে দাওয়াত দিয়েছে; অথছ আজ আমি রোযা রেখেছি। তোমাদের দাওয়াতে সাড়া দেওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। কারণ আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ একজন মুসলমানের ওপর তার অন্য এক মুসলিম ভাইয়ের ছয়টি অধিকার আছে। তার কোন একটি চেড়ে দিলে একটি অধিকার ছেড়ে দেওয়া হবে। ১. দেখা হলে তাকে সালাম দিতে হবে। ২. দাওযাত দিলে সাড়া দিতে হবে। ৩. হাঁচি দিয়ে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বললে তার জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলে জবাব দিতে হবে। ৪. অসুস্থ হলে দেখতে যেতে হবে। ৫. মারা গেলে তার জানাযায় শরিক হতে হবে। ৬. কোন ব্যাপারে উপদেশ চাইলে উপদেশ দিতে হবে।’ (হায়াতুস সাহাবা- ২/৫০৫)
হযরত আবু আইউব ছিলেন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। কুয়োর ধারে গোসলের সময়েও চারিদিকে কাপড় টানিয়ে ঘিরে নিতেন। (বুখারী- ১/২৪৮)
কাফির মুনাফিকদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। এ কঠোরতা বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সে সময় মদীনার মুনাফিকরা (কপট) মসজিদে আসতো, মুসলমানদের নানা কথা কান পেতে শুনতো। বাইরে গিয়ে তারা মুসলমানদের দ্বীন নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো। একদিন কতিপয় মুনাফিক মসজিদে নববীতে একত্রিত হল। তারা যখন পরস্পর গায়ে গা মিশিয়ে নিচুস্বরে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করছে, ঠিক সেই সময় রাসূল সা. তাদেরকে দেখে ফেলেন। তিনি তাদেরকে মসজিদে থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে আবু আইউব ছুটে গিয়ে ’আমর ইবন কায়েসের একটি ঠ্যাং ধরে টানতে টানতে মসজিদের বাইরে নিয়ে গেলেন। তিনি তার ঠ্যাং ধরে টানছেন আর সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেঃ আবু আইউব, তুমি এভাবে আমাকে বনী-সা’লাবের মিরবাদ (খোঁয়াড়) থেকে বের করে দিচ্ছ? (মসজিদের স্থানে পূর্বে উট-বকরীর খোঁয়াড় ছিল) তারপর আবু আইউব রাফে ইবন ওয়াদীয়ার দিকে ধেয়ে যান এবং তার গলায় চাদর পেঁচিয়ে টানতে টানতে ও লাথি-চড় মারতে মারতে মসজিদ থেকে বের করে দেন। আবু আইউব টানছেন আর মুখে বলছেনঃ ‘পাপাত্মা মুনাফিক দূর হ। যে পথে এসেছিস সেই পথে চলে যা।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫২৮)
হযরত আবু আইউব ও তাঁর স্ত্রী যেভাবে রাসূলুল্লাহকে সা. আশ্রয় দেন এবং প্রাণ দিয়ে তাঁর সেবা করেন তাতে নবী-খান্দানের লোকদের নিকট বিশেষভাবে, আর সাধারণভাবে সকল মুসলমানদের নিকট তাঁরা এক বিশেষ মর্যাদার আসন লাভ করেন, হযরত আলীর খিলাফতকালে হযরত ইবন ’আব্বাস রা. যখন বসরার গভর্ণর তখন একবার আবু আইউব গেলেন সেখানে। ইবন ’আব্বাস তাঁকে বললেন, ‘আমার ইচ্ছা, যেভাবে আপনি রাসূলুল্লাহর সা. জন্য ঘর খালি করে দিয়েছিলেন, আজ আমিও তেমনিভাবে আপনার জন্য ঘর খালি করে দিই।’ একথা বলে তিনি পরিবারের সকল সদস্যকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে সকল সাজ সরঞ্জামসহ বাড়ীটি তাঁর থাকার জন্য ছেড়ে দেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪০৫)
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর সাহাবা-ই-কিরামের পূর্ববর্তী সেবা ও আত্মত্যাগ অনুযায়ী প্রত্যেকের ভাতা নির্ধারিত হয়। আবু আইউবের ভাতা প্রথমে ৪০০০ (চার হাজার) দিরহাম নির্ধারিত হয়। হযরত আলী তা বাড়িয়ে বিশ হাজার করেন। তাঁর ভূমি চাষাবাদের জন্য প্রথমে ৮ (আট) টি দাস নিযুক্ত ছিল, হযরত আলী রা. তা চল্লিশ জনে উন্নীত করেন।
হযরত আবু আইউবের ভাগ্যবতী স্ত্রীর নাম উম্মু হাসান বিনতু যায়িদ। অভিজাত আনসারী মহিলা। ইবন সা’দের বর্ণনা মতে, তাঁর গর্ভে একমাত্র ছেলে ’আবদুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন।
যদিও হযরত আবু আইউবের রা. জীবন যুদ্ধের ময়দানে কেটেছে এবং তরবারি কাঁধ থেকে নামিয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাননি, তথাপি সে জীবন ছিল প্রভাতের মৃদুমন্দ শীতল বায়ুর ন্যায় প্রশান্ত। কারণ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনেছিলেনঃ
‘‘তুমি যখন নামায আদায় করবে, তা যে শেষবারের মত আদায় করছো, এমনভাবে করবে। এমন কথা কক্ষণও বলবে না যার জন্য পরে কৈফিয়াত দিতে হয়। মানুষের হাতে যা আছে তা পাওয়ার আশা কক্ষণও করবে না।’’
কোন ঝগড়া-বিবাদে কক্ষণও তাঁর জিহ্বা অসংযত হয়নি। কোন লালসা তাঁর অন্তরকে কক্ষণও কাবু করতে পারেনি। একজন ’আবেদের মত, দুনিয়া থেকে এই মুহূর্তে একজন বিদায় গ্রহণকারীর মত সারাটি জীবন তিনি অতিবাহিত করে গেছেন। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪০৮)
গ্রন্থনায়: ড. মুহাম্মাদ আবদুল মা’বুদ