আমরা খুব সহজে যেসব কীর্তিমান মানুষকে ভুলে যেতে বসেছি, মুনশী মেহের উল্লাহ তাঁদের অন্যতম। উপমহাদেশে মুসলমানদের বৃদ্ধিবৃত্তিক অসহায়ত্ব ঘোচাতে তাঁর কর্মতৎপরতা আমাদের জন্যে কেবলই মুগ্ধতা ও অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। এই আলোকিত মানুষটির বিস্ময়কর জীবন ও কর্ম বিস্মৃতির অতলে হারাতে চলেছে।
জাতি হিসেবে ইতিহাস চর্চা ও সংরক্ষণের প্রতি আমাদের এমনিতেই কোন দায়বোধ নেই, তার ওপর আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের চেতনাকে ধারণ ও লালন করে ভবিষ্যতের পথরেখা অঙ্কনের চিন্তাও এখন বিরল। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের গর্ব ও অহঙ্কার মুনশী মেহের উল্লাহ তেমনই একজন বিস্মৃত বিস্ময়।
মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বৃটিশ বাংলার অন্যতম বাগ্মী, ইসলাম প্রচারক, সমাজসংস্কারক ছিলেন। মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বৃহত্তর যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) কালীগঞ্জ উপজেলার ঘোপ গ্রামে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস যশোর সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। যশোর শহরে সামান্য দর্জিগিরি করে জীবকা নির্বাহ করতেন। এ সময় খ্রিষ্টান পাদ্রিরা ইসলাম ধর্ম বিরোধী প্রচারে এবং ইসলামের কুৎসা রটনায় তৎপর ছিল।
মুনশী মেহের উল্লাহ মুসলমানদের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য কী করেননি? মুনশী মেহের উল্লাহর পরিচয় তাঁর কর্মে। এ কারণেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও পেশাগত জীবনের দৈন্য জয় করতে পেরেছিলেন। রাজশক্তির বলে বলিয়ান খিষ্টানদের ধর্ম প্রচারের নামে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রোধে তিনি সর্বত্রই যুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছেন। বিভ্রান্তির অন্ধকার দূর করেছেন। লেখনী, বাগ্মিতা আর ক্ষুরধার যুক্তির অনল বর্ষণে মিশনারিদের সব অপতৎপরতার জবাব দিয়েছিলেন তিনি।
দুটো উদাহরণ দেই:
খ্রিস্টান পাদ্রীদের পক্ষ থেকে একটি বাহাসে প্রশ্ন করা হোল: ‘ইসলাম ধর্ম মতে জান্নাত হলো ৮টি এবং জাহান্নাম হলো ৭টি। এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। কারণ, আপনারাই বলেন মুসলমানরা ব্যতীত আর কেউ জান্নাতে যাবেনা। কিন্তু পৃথিবীতে মুসলমানদের বিপরীতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাই বেশি। আবার বলেছেন মুসলমানদের মধ্যেও সবাই জান্নাতে যাবেনা। খাঁটি ঈমানদারেরাই যাবে কেবল। দেখেন, তাহলে এই গুটিকয়েক মানুষের জন্য ৮টা জান্নাত আর বিপরীতে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য ৭টা জাহান্নাম! এর চে’ বড়ো কৌতুক আর কী হতে পারে?’ বলেই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
মুনশী মেহের উল্লাহ মুচকি হেসে ধীর-স্থির ভাবে এগিয়ে আসেন। প্রশ্ন করেন, ‘বাদুর দেখেছেন জনাব?’ পাদ্রী বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখেছি’। মুনশী এবার হাসি দিয়ে বললেন, ‘দেখেন, রাতের বেলা যখন শিকারীরা ত্রিশ থেকে চল্লিশটা বাদুর শিকার করেন। দিনের বেলায় সেই বাদুরগুলোকে শুধু একটা মাত্র বস্তায় চেপে চেপে ভর্তি করে নিয়ে আসে। কিন্তু জনাব, ময়না দেখেছেন না? মানুষ কিন্তু শুধু একটা ময়নার জন্যই ইয়া বিশাল খাঁচা কিনে আদর করে রাখে। এবার আপনারাই বলেন, চল্লিশটা বাদুরের জন্যে একটা বস্তা, আর একটা ময়নার জন্যে সেই বস্তার সমান পুরোদস্তুর একটা খাঁচা! এটা কি হাস্যকর শোনাবে?’ সবাই নীরব। মুনশী এবার বললেন, ‘ঠিক সেটাই। যার যেমন কদর, যার যেমন মূল্য।
এখন আপনারা যারা বুক ফুলিয়ে বলেন জাহান্নামে যাবো, তারা ঠিক বাদুরের মতোই! তাদেরকে জাহান্নামে রাখা হবে ঠাসাঠাসি করে। আর আমরা যারা জান্নাতে যাবার স্বপ্ন দেখি, আমাদেরকে ময়না পাখির মতোই আদর-যত্ন করে রাখা হবে তো, এ জন্যে অল্প মানুষের জন্যে বরাদ্দটা বেশি আর কি!’
আরেকবার একজন পাদ্রী বললেন, ‘ইসলাম ধর্মে দাবী করা হয় মুহাম্মদই শ্রেষ্ঠ নবী। এবং তাঁর আগমনে নাকি পূর্বের সব নবী-রসূলের শরীয়ত রহিত হয়ে গেছে। এটা পুরোটাই তাদের বানোয়াট কথা ছাড়া আর কিছু নয়। দেখেন, মুসলমান ভায়েরা, আমাদের নবী ঈসাকে আল্লাহ কিন্তু আসমানের ওপর তুলে নিয়েছেন। আর আপনাদের নবী মাটির নীচে শুয়ে আছে। এবার আপনারাই বিচার করুন, কে শ্রেষ্ঠ? আমাদেরকে মুসলমান হতে না বলে বরং আপনারাই খ্রিস্টান হওয়া যৌক্তিক।’
মুনশী দেখছেন এদের ভাষা এবং প্রশ্ন করার ঢঙে যথেষ্ট বাড়াবাড়ি হচ্ছে এবং সীমা অতিক্রমের সম্ভাবনা আছে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি খুব শান্ত ভাবে বললেন, ‘জনাব! আমরা কিন্তু কুরআনের নির্দেশ মতো কোন নবী-রাসূলের মাঝে পার্থক্য করি না। তাঁরা সকলেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি আপনি মান উঁচু-নীচুর প্রশ্নে আসেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করতেই হয়, মুক্তা দেখেছেন? মুক্তা কিন্তু সমুদ্রের তলায় থাকে, আর উপরে যা থাকে, তা হলো জোয়ারের ফেনা!’ উপস্থিত সবাই নীরব এবং বিস্মিত!
দুই হাতে লিখেও গিয়েছেন প্রচুর। খ্রিষ্টানদের অপপ্রচার, সমাজের কুসংস্কার এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি গদ্যে-পদ্যে বহু বই পুস্তক রচনা করেছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
খিষ্টান ধর্মের অসারতা (খৃষ্টীয় ধর্মের অসারতা), রদ্দে খ্রিস্টান/খ্রিষ্টান, দলিলুল ইসলাম, দেবলীলা, খিষ্টান মুসলমান তর্কযুদ্ধ, জেয়াবুন নাসারা (জওয়াবে নাসারা), পন্দনামা, হিন্দু ধর্ম রহস্য বা দেবীলীলা, বিধবা গঞ্জনা, মেহেরুল ইসলাম প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্ল্খেযোগ্য। মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালে তৎকালীন সরকার তার বিধবা গঞ্জনা ও হিন্দু ধর্ম রহস্য বই দুটি বাজেয়াপ্ত করে।
মুন্সী জমির উদ্দিন নামে এক মুসলমান, পাদ্রিদের প্ররোচনায় পড়ে খ্রিষ্টানধর্ম গ্রহণ করে এলাহাবাদের ডিভিনিটি কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তিনি রেভারেন্ড জন জমির উদ্দিন নাম ধারণ করেন। পাদ্রি জমির উদ্দিন ইসলাম ও কোরআনের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন।
মুনশী মেহের উল্লাহর সাহিত্যকর্মের মধ্যে ১৮৯২ সালে খ্রিষ্টান জন জমির উদ্দিন লিখিত ‘আসল কুরআন কোথায়’ এর জবাবে সুধাকর পত্রিকায় ‘খিষ্টানি ধোঁকাভঞ্জন’ শীর্ষক সুদীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধ তৎকালীন সময়ে বিশেষভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। এরপরও তিনি ‘আসল কুরআন সর্বত্র’ শীর্ষক আর একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ সুধাকর ও মিহির পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর খ্রিষ্টানেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আর কিছু লেখার ও বলার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলে। তখন স্বয়ং জন জমির উদ্দিন মুনশী মেহেরুল্লাহ সাথে এক বিতর্কে পরাজিত হয়ে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাকি জীবন ইসলামের খেদমতে কাটিয়ে দেন।
মুন্সী মেহেরুল্লাহকে ইংরেজরা এক সভায় ভারতবর্ষের মানুষকে বলতেছিলো তোমাদের দেশের মানুষ-বাটু,লম্বা,খাটো,বড়,কালো,ধলো কেন। আর আমাদের দেশে সব সাদা। ইংরেজদের কথার উওরে “শুওরক্য বাচ্ছা এক কিছিম হ্যায়- টাট্টু ক্যা বাচ্ছা হ্যারেক রকম হ্যায়”
উপস্থিত বুদ্ধিতে আসলেই এই মানুষটির কোন তুলনা হয় না। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিচার-বুদ্ধিতে এতো বেশি বিচক্ষণ, সত্যিই বিরল! অবশ্য আমি বিশ্বাস করি, এখানে আল্লাহর সাহায্যও তাঁকে ছায়া দিয়েছে বারবার।
আমাদের কাছে যুক্তিতর্কগুলো খুব সাধারণ মনে হলেও, তখনকার প্রেক্ষাপটে এগুলোর যথেষ্ট আবেদন ছিলো। তার কারণ, বাহাসে যারা আসতো, তারা নিছক মজা পাবার জন্যে আসলেও তর্কের জয়-পরাজয় তাদের অনেকেরই ধর্মচ্যুত হবার সম্ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতো (ইতিহাস বলে)। শাসকগোষ্ঠৗর বৈরিতা ও রক্তচক্ষু অনেক মুসলিম পণ্ডিত, জ্ঞানী ও নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিকে আপোষকামিতায় বাধ্য করেছিলো।
খ্রিষ্টানেরা হাটবাজারের দিন হাটে আগত মুসলমানদের জড়ো করে মিথ্যার তুবড়ি উড়িয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চাইলে তিনি ওই সভার পাশে দাঁড়িয়ে অসাধরণ ওজস্বিনী ভাষায় তার জবাব দিতেন। তিনি শুধু স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ করতেন না। বাংলার সর্বত্র তার উপস্থিতি ও প্রতিবাদ ছিল। পিরোজপুর জেলায় একবার খ্রিষ্টানদেও সাথে মুসলমানদের তিন দিন ধরে তর্কযুদ্ধ চলে। ওই তর্কে মুনশী মেহের উল্লাহ খ্রিষ্টানদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন।
তিনি মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সচেতনতাবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য ১৮৮৯ সালে যশোরে গড়ে তোলেন ‘ইসলাম ধর্মোত্তেজিকা’ নামে একটি ইসলাম প্রচার সমিতি। বৃহত্তর আঙ্গিকে কাজ করার জন্য তিনি কলকাতায় গঠিত ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলমান শিক্ষা সমিতি’র সাথে যুক্ত হন। ইসলামের বিরুদ্ধে যে ধরণের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার হতো মুনশী মেহের উল্লাহ সে ধরণের দাঁতভাঙা জবাব দিতেন।
ঠিক সেই সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন তেজোদ্দীপ্ত ঈমানের অধিকারী সাহসী পুরুষ মুনশী মেহের উল্লাহ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সভা-সমিতির আয়োজন করে মুসলমানদের ভগ্নহৃদয়কে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ইতিহাস সাক্ষী, একদিকে ব্রিটিশ রাজশক্তির রক্তচক্ষু, অন্যদিকে খ্রিস্টান মিশনারি ও বিদ্বেষী হিন্দু নেতৃবৃন্দের যুগপৎ ষড়যন্ত্রের পরও মুনশী মেহের উল্লাহ অনেকটাই সক্ষম হয়েছিলেন জনতার হৃত মনোবল ফিরিয়ে আনতে।
শুধু তাই নয়, মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে যখন কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছিলো; তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন সাহিত্য ও সমকালীন জ্ঞানচর্চায় মুসলমানদের এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা। সংবাদপত্র ও সাময়িকীর মাধ্যমে এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুভূতি জাগ্রত করে মুনশী মেহের উল্লাহ অনিবার্য জাগরণ ঠেকানোর সকল ফন্দি-ফিকিরের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছিলেন।
একবার খ্রিষ্টানেরা মুসলমানদের এই বলে বিভ্রান্ত করছিল, তাদের নবী ঈসা আ. শ্রেষ্ঠ নবী বলে তার স্থান চৌঠা আসমানে। বড়দের স্থান ওপরেই হয়।
মুনশী মেহের উল্লাহ এ কথার জবাব দিয়েছিলেন হাতেনাতে প্রমাণ দেখিয়ে। তিনি একটা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে এক পাশে ছোট বাটখারা এবং অন্য পাশে বড় বাটখারা রাখলেন। পরে দাঁড়িপাল্লা নিক্তি ধরে উঁচু করলে ছোট বাটখারার পাশ ওপরে উঠে যায় এবং বড় বাটখারার পাশ নিচে নেমে যায়। তিনি বলেন, ছোট বড়র বিচারের জন্য এর চেয়ে আর কি চান? এ ঘটনার পর খ্রিষ্টানেরা ওই ধরণের কথা আর কোনোদিন বলেনি।
আমাদের এখনকার ইন্টেলেকচুয়াল লড়াইয়ের গতি-প্রকৃতির সাথে তখনকার যুক্তি-তর্কগুলোর একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সময়, চাহিদা এবং জনসাধারণের অবস্থান বিবেচনায় মিশনারি তৎপরতাও ছিলো ভিন্ন। ধর্মান্তরিতকরণের জন্যে তারা মূলত ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম রিলেটেড কিছু কমন পয়েন্টকে লজিক্যালি আক্রমণ করতো। এরা কিন্তু বেশ সফলও হয়েছিলো। তার অন্যতম প্রমাণ মহাকবি শ্রী মধুসূদনের ‘মাইকেল মধুসূদন’ হওয়া। মুন্সী জমির উদ্দীন- ইনিও বেশ সমাদৃত ছিলেন থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে; কিন্তু তাঁকেও ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলো মিশনারি গোষ্ঠী। পরে অবশ্য মুনশী মেহের উল্লাহর প্রচেষ্টায় তিনি পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
আজকে আমরা যাঁদের নিয়ে গর্ব করি, সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন, শেখ ফজলল করিম- এঁদের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রেরণাদাতা ছিলেন মুনশী মেহের উল্লাহ। মুসলমানদের মধ্যে বিরাজিত মতানৈক্য এবং বিরোধ নিরসন করা এবং পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির উর্ধ্বে ওঠে ঐক্যের পতাকাতলে সবাইকে সমবেত করতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও প্রতিভার ক্ষমতায় পেশায় একজন সামান্য দর্জি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ হয়েও নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হতে পেরেছিলেন। নিজের চেষ্টা ও আন্তরিকতায় কম্পরেটিভ রিলিজিওন-এ এতো বেশি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন, ভাবতেই অবাক হতে হয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ভয়ানক দৌরাত্ম্য এবং তার বিপরীতে মুসলিম সমাজের দৈন্য অবস্থায় তিনি ব্যথিত হন এবং নিজেই উদ্যোগী হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনে যে ক’জনের ভূমিকা স্মরণযোগ্য তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
তিনি জীবনকে উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত এক দিনের সূর্যের মতো মনে করতেন। আর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌছানোর পথকে দীর্ঘ ভাবতেন। তাই তো তিনি বলতেন, ‘ভাব মন দমে দম/রাহা দূর বেলা কম।’ মুনশী মেহের উল্লাহ সময় পেয়েছিলেন খুব কম। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি অল্প সময় পেলেও তার প্রখর সময় চেতনাকে কাজে লাগিয়ে অসাধারণভাবে অজস্র কর্মধারার কল্যাণে সেই অল্প সময়কে বহুগুণে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯০৭ সালে এক জুমাবার তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের পাখি হিসেবে ক্ববূল করুন। তাঁর বিদায়ের পর তাঁরই হাতে গড়া সুযোগ্য শব্দশিল্পী ইসমাঈল হোসেন সিরাজী অনুভব করতে পেরেছিলেন কি বিশাল শূন্যতা মুসলমানদের উপর জেঁকে বসলো আজ থেকে! মুনশী মেহের উল্লাহর কর্মময় জীবন আর অনন্য সাধারণ অবদানগুলোর বর্ণনাসহ তাঁকে হারিয়ে কবি যে শোকগাঁথা রচনা করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় কি অমূল্য রত্ন ছিলেন তিনি!
“একি অকস্মাৎ হল বজ্রপাত। কি আর লিখিবে কবি।
বঙ্গের ভাস্কর প্রতিভা আকর অকালে লুকাল ছবি।
কি আর লিখিব কি আর বলিব, আঁধার যে হেরি ধরা।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল খসিয়া কক্ষচ্যুত গ্রহ তারা।
কাঁপিল ভূধর কানন সাগর প্রলয়ের প্রভঞ্জনে,
বহিল তুফান ধ্বংসের বিষাণ বাজিল ভীষণ সনে!
ছিন্ন হ’ল বীণ কল্পনা উড়িল কবিত্ব পাখী,
মহা শোকানলে সব গেল জ্বলে শুধু জলে ভাসে আঁখি।
কি লিখিব আর, শুধু হাহাকার শুধু পরিতাপ ঘোর,
অনন্ত ক্রন্দন অনন্ত বেদন রহিল জীবনে মোর।
মধ্যাহ্ন তপন ছাড়িয়া গগন হায়রে খসিয়া প’ল,
সুধা মন্দাকিনী জীবনদায়িনী অকালে বিশুষ্ক হ’ল।
বাজিতে বাজিতে মোহিতে মোহিতে অকালে থামিল বীণ,
প্রভাত হইতে দেখিতে দেখিতে আঁধারে মিশিল দিন।
মলয় পবন সুখ পরশন থামিল বসন্ত ভোরে,
গোলাপ কুসুম চারু অনুপম প্রভাতে পড়িল ঝরে।
ভবের সৌন্দর্য্য সৃষ্টির ঐশ্বর্য্য শারদের পূর্ণ শশী,
উদিতে উদিতে হাসিতে হাসিতে রাহুতে ফেলিল গ্রাসি।
জাগিতে জাগিতে উঠিতে উঠিতে নাহি হ’ল দরশন,
এ বঙ্গ-সমাজ সিন্ধুনীরে আজ হইলরে নির্গমন।
এই পতিত জাতি আঁধারেই রাতি পোহাবে চিরকাল,
হবে না উদ্ধার বুঝিলাম সার কাটিবে না মোহজাল।
সেই মহাজন করিয়া যতন অপূর্ব বাগ্মিতাবলে,
নিদ্রিত মোসলেমে ঘুরি গ্রামে গ্রামে জাগাইলা দলে দলে।
যার সাধনায় প্রতিভা প্রভায় নূতন জীবন ঊষা,
উদিল গগনে মধুর লগনে পরিয়া কুসুম ভূষা।
আজি সে তপন হইল মগন অনন্ত কালের তরে,
প্রবল আঁধার তাই একেবারে আবরিছে চরাচরে।
বক্তৃতা তরঙ্গে এ বিশাল বঙ্গ ছুটিল জীবন ধারা,
মোসলেম-বিদ্বেষী যত অবিশ্বাসী বিস্ময়ে স্তম্ভিত তারা।
হায়! হায়! হায়! হৃদি কেটে যায় অকালে সে মহাজন,
কাঁদায়ে সবারে গেল একেবারে আঁধারিয়া এ ভুবন।
কেহ না ভাবিল কেহ না বুঝিল কেমনে ডুবিল বেলা,
ভাবিনি এমন হইবে ঘটন সবাই করিনু হেলা।
শেষ হল খেলা ডুবে গেল বেলা আঁধার আইল ছুটি,
বুঝিবি এখন বঙ্গবাসিগণ কি রতন গেল উঠি।
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে মাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন বিশ্বময় অন্ধকার।”
কবির আশঙ্কা তবে কি সত্য হতে চললো? ইসলাম ও ইসলামী আদর্শের ওপর চতুর্মুখী আক্রমণ ও ষড়যন্তের বিপরীতে আমাদের পণ্ডিত সমাজ তাঁর মতো কি এগিয়ে আসবে না? বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের পাগলা ঘোড়া দেখে হতচকিত হয়েই বসে আছি যেনো আমরা সবাই; সেই ঘোড়ার গতিবেগ রুখে দিতে, আর ঘোড়ার সহিসকে লাগাম টেনে ধরায় বাধ্য করতে আমরা কি কেউ মুনশী মেহের উল্লাহর পথে হাঁটবো না? মাথা উঁচু করে স্বীয় আদর্শের কীর্তিধ্বজা পতপত করে উড়ানোর সাহস কি আমাদের হৃদয়ে সৃষ্টি হবে না?
মুনশী মেহের উল্লাহর সময় বাংলার মুসলমানদের এমন দুঃসময় ছিল, খ্রিষ্টানদের মুখরোচক প্রচারণা ও স্বার্থের লোভে দলে দলে মুসলমানেরা খ্রিষ্টধর্মে ভিড়তে থাকে। এ অবস্থা থেকে মুসলমানদের ঠেকাতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ান তিনি। সভা সমাবেশ তো ছিলই, তার ওপর ছিল লেখনি সংগ্রাম।
যেখানেই ইসলাম ধর্মের বিরোধীতা সেখানেই মুনশী মেহের উল্লাহর সভা, সমাবেশ, তেজস্বী বক্তৃতা। তার অসাধারণ বাগ্মিতা এবং অখন্ডনীয় যুক্তির কাছে হার মানতো খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকেরা। স্বল্প শিক্ষিত মেহেরুল্লাহ তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাহায্যে তৎকালীন উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি মদদপুষ্ট খ্রিষ্টান পাদ্রিদের ধর্ম প্রচারের গতিকে বিঘ্নিত করেছিলেন।
কর্মবীর মুনশী মেহের উল্লাহর মুসলিম জাগরণে অনলবর্ষী বক্তৃতা, লেখনি ও কর্মযজ্ঞে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার বিভিন্ন জেলায় বহু স্কুল কলেজ মাদরাসা মক্তব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। তার নিজ গ্রাম ছাতিয়ানতলার পাশে মনোহরপুরে বাংলা ১৩০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাদরাসায়ে কারামতিয়া ও আর একটি মাইনর স্কুল। পরে সেটি রুপান্তরিত হয়ে এম,ই স্কুলে। আদর্শবান চরিত্রবান সুনাগরিক গড়ে তোলাই ছিলো তাঁর লক্ষ। সমাজের কূসংস্কার দুরীকরণ ও ইসলামী মুলবোধ সৃষ্টি ছিল তাঁর কর্মময় জীবনের ব্রত। সর্বপরি খৃষ্টান মিশনারীদের তৎপরতাঁর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়হস্ত। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠানটি ছিল তাঁর আদর্শের প্রতিক। তার কীর্তি বহন করে চলেছে যশোর সদর উপজেলার ঝাউদিয়া গ্রামের মুনশী মেহের উল্লাহ অ্যাকাডেমি (মাধ্যমিক বিদ্যালয়)।
‘মুসলিম জাগরণের বিপ্লবী পথিকৃৎ’ শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার উল্লেখ করেছেন, মেহের উল্লাহর শাব্দিক অর্থ আল্লাহর অনুগ্রহ। প্রকৃত অর্থেই তিনি পথহারা বাংলার মুসলমানদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ছিলেন। মাদরাসায় পড়া খেতাবধারী আলেম না হয়েও আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য নানারূফ প্রতিকুলতার মধ্যে থেকেও অবিরাম সংগ্রাম, সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, কষ্ট, পরিশ্রম ও নিস্বার্থ আন্দোলন করে গেছেন।
মুনশী মেহের উল্লাহ ১৯০৭ সালের ৭ জুন ইন্তেকাল করলে কিছু দিন তার নাম যেন হারিয়ে ছিল। প্রায় ছয় দশক একান্ত অবহেলা উপেক্ষায় থেকে ১৯৬৬ সালে মুনশী মেহের উল্লাহর নাম স্বমহিমায় উঠে আসে জনারণ্যে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন সময়ে অংশগ্রহণ করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি জসিমউদ্দিন, কবি কাদের নওয়াজ, ড. গোলাম সাকলায়েন, সুন্দরবনের ইতিহাস লেখক এএফএম আবদুল জলিল, কবি নাসিরউদ্দিন আহমদ, ড. নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুমসহ খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক গবেষকেরা। এ ছাড়া মন্ত্রী, এমপি এবং উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে মেহের উল্লাহর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করেছেন।
মুনশী মেহের উল্লাহ বাংলাদেশের মুসলমানদের হৃদয়াসনে প্রতিষ্ঠিত একটি নাম। বিভিন্ন পর্যায়ে তার স্মৃতি ধরে রাখতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন তার ভক্ত অনুরক্তরা। তার নামে ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করায় তিনি জাতীয় মর্যাদা পেয়েছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি রেলস্টেশনকে মেহের উল্লাহ নগর রেল স্টেশন নামকরণ করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও রেল ভ্রমণকারীদের কাছে তার নামের পরিচিতি প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। যশোর টাউন হল ময়দান আজ মেহের উল্লাহ ময়দান নামে পরিচিত। যশোর শহর এবং তার নিজ এলাকার একাধিক সড়কের নামের সাথে কর্মবীরের নাম জড়িয়ে স্মৃতি অম্লান করা হয়েছে।
কালান্তরের কড়চায় মুনশী মেহের উল্লাহ বিস্মৃত ঠিকই, কিন্তু অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তিনি ভাস্বর থাকবেন ইতিহাস-সচেতন বাঙালী মুসলমানের মানস পটে। ঐশী আলোর দীপশিখা অনির্বাণ রাখার দুর্জয় প্রত্যয়ে মুনশী মেহের উল্লাহ হোক সাহস ও প্রেরণার প্রোজ্জ্বল বাতিঘর।
তথ্যসূত্র:
1. শতাব্দীর দর্পন, ফজলুর রহমান, পৃষ্ঠা ৫২, প্রকাশ ১৯৯৫।
2. Hussain, Mohsin। “Meherullah, Munshi Mohammad”।
3. Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত ২ জানুয়ারি ২০১৫।
4. মুসলিম বাংলার মনীষা