দুনিয়ার একমাত্র সৌন্দর্যমন্ডিত ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম ‘ইসলাম’। লালিত্য, কলা, সুরুচিপূর্ণতা, পরিচ্ছন্নতা, মার্জিত, মাধুর্য, রূপলাবণ্য, মহত্ত্ব সবকিছুর আধার হলো ‘ইসলাম’। তাই যুগে যুগে পথভ্রষ্ট মানুষের দল ইসলামের মহান সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে দ্বীন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। নিজের জন্মদাতা পিতাকে চিনতে পারা যেমন সার্থকতা ও আনন্দের তার থেকে লক্ষ-কোটি গুণ বেশি সার্থকতা ও আনন্দের বিষয় হলো নিজের সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারা। বহুমাত্রিক জগতের নিরঙ্কুশ মালিক আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ও নিদর্শন, নবী-রাসূলগণ (আ) ও দায়ী ইলাল্লাহর আহবান, আল কুরআন ও অন্যান্য আসমানি গ্রন্থের সংস্পর্শলাভ এবং দ্বীন ইসলামের অনুসারীগণের চারিত্রিক মাধুর্য প্রত্যক্ষ করে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এসেছে। ইসলাম এক কালজয়ী জীবনব্যবস্থার নাম। মানবরচিত মতবাদসমূহের বাহ্যিক চাকচিক্য এবং অন্তঃসারশূন্যতা চিন্তাশীল মানুষের বিবেকের খোরাক জোগাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তৃষ্ণার্ত, দিকভ্রান্ত ও ক্লান্ত মানুষ নিজেদের মনের পেরেশানি, হৃদয়ের ব্যাকুলতা ও হাহাকার, চিত্তের অস্থিরতা এবং চলমান প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের অসঙ্গতিভরা হাজারো প্রশ্ন নিয়ে জীবন সম্পর্কে যখন মারাত্মক হতাশায় নিমজ্জিত ঠিক তখন ইসলাম তাদেরকে অগ্নিকুন্ডলী সমেত গর্তের কিনার থেকে টেনে তুলে আনে। বিস্তীর্ণ-ঘন বটবৃক্ষের ছায়া যেমন অবিশ্রান্ত রাখালের দেহ-মনকে ছায়া ও শীতলতার নিবিড় পরশে মোহিত করে আল কুরআন তেমনি হতাশাগ্রস্ত মানুষের দেহ-মনে শান্তি, স্থিরতা ও আশার অম্লান প্রদীপ প্রজ্বলিত করে দেয়। পুনর্জন্ম হয় একজন বিবেকবান মানুষের।
দ্বীন ইসলামের চিরসত্য আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া একান্তই রাব্বুল আলামিনের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। তিনি যাকে চান তাকে হেদায়েতের অফুরন্ত নেয়ামত দিয়ে ধন্য করেন। আবু তালেব যখন মৃত্যুপথযাত্রী তখন রাসূলে পাক (সা) প্রাণপ্রিয় চাচার হেদায়েতবিহীন জাহেলি মৃত্যুতে পেরেশানি অনুভব করছিলেন। রাব্বুল আলামিন সাথে সাথে বলে দেন, “ইন্নাকা লা তাহ্দি মান আহ্বাবতা ওলাকিন্নাল্লাহা ইয়াহ্দি মাই্যাশা।” (সূরা ক্বাসাস-৫৬) সুতরাং হেদায়েত লাভ করা এবং হেদায়েতের ওপর আমৃত্যু টিকে থাকা নিঃসন্দেহে আল্লাহর অশেষ রহমত, সৌভাগ্য ও গৌরবের বিষয়।
মুসলিম পরিবার এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জন্মগ্রহণ করে ইসলাম বুঝা ও অনুশীলন এবং ‘মুসলিম মাইনরিটি’ এমন দেশে ইসলাম বুঝা ও চর্চার মধ্যে পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। মানবরচিত ধর্মগুলোর সীমাবদ্ধতা, অযৌক্তিকতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠান অতৃপ্ত মনকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। ইউরোপ-আমেরিকার উদভ্রান্ত মানুষ এ ধর্ম থেকে ও ধর্মে ছোটাছুটি করতে থাকে। কোন ধর্মই তাদের হৃদয়ের খোরাক জোগাতে পারে না। অবশেষে ইসলাম তাদের মনের সকল প্রশ্ন ও হতাশার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অশান্ত আত্মাকে শান্তির নিবিড় পরশে সিক্ত করে দেয়। প্রশান্ত আত্মা অতীত ভুলের জন্য বিগলিতচিত্তে বলে ওঠে, “প্রশংসা সেই আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি আমাদেরকে এই সত্য হেদায়েত দিয়ে ধন্য করেছেন। তিনি যদি দয়া করে হেদায়েত না দিতেন তবে আমরা কখনোই হেদায়েতপ্রাপ্তদের মধ্যে গণ্য হতাম না।”
বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে নবজীবন লাভকারী এমনি কতিপয় নওমুসলিমের ইসলাম গ্রহণের কারণসমূহ জানার এবং আমাদের বাস্তবজীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো।
সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের খন্ডিত বক্তব্য
ক্রিস্টিন জ্রেমসস্কি
ক্রিস্টিন জ্রেমসস্কি (৫৫) ওয়াশিংটন ডিসির অধিবাসী। তিনি বলেন, যখন আমি একজন প্রোটেস্ট্যান্ট এবং পরে যখন একজন ক্যাথলিক ছিলাম তখন ঈশ্বরকে একজন রাগী এবং শাস্তিপরায়ণ বলে মনে হতো। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইসলাম আমাকে শিখিয়েছে যে, আল্লাহ কেবল পরাক্রমশালীই নয়, তিনি অসংখ্য গুণে গুণান্বিত। তার ৯৯টি নাম থেকে আমি শিখতে পেরেছি, আল্লাহ হচ্ছেন পরম প্রেম, করুণা, উদারতা, সহানুভূতি এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক। এ ছাড়াও তিনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক এবং আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ডের হিসাব গ্রহণকারী। মহান আল্লাহ হচ্ছেন আমাদের স্রষ্টা এবং তিনি একাই আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং এর জন্য তাকে অন্য কারো সহায়তা নিতে হয়নি। আল্লাহ হচ্ছেন একক সত্তা এবং একমাত্র তিনিই আমাদের উপাসনার যোগ্য। আমি অনুভব করতে পারি যে, আমাদের কাছে আল্লাহ খুব সহজেই প্রবেশযোগ্য। কেননা তিনি নিজেই আমাদেরকে বলেছেন, তিনি ‘আমাদের ঘাড়ের শিরার চেয়েও কাছাকাছি’ অবস্থান করেন। আল্লাহর দিকে আমরা এক পা অগ্রসর হলে তিনি আমাদের দিকে দৌড়ে আসেন।’
সিমনি লোভানু
নিউ জার্সির ব্রান্সউইকের বাসিন্দা সিমনি লোভানু (২৬)। তিনি খ্রিস্টীয় ক্যাথলিক চার্চ থেকে ইসলামে দীক্ষিত হোন। তিনি বলেন, “ইসলামের পতাকাতলে আসা হচ্ছে আল্লাহর নিকট শান্তিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করা। আল্লাহ হচ্ছেন আমার চারপাশের সব কিছুর নির্মাতার একটি শক্তিশালী উপলব্ধি। ইসলামের অভিপ্রায় হলো একটি স্বীকৃতি যে, আমাদের সকল মতামত এবং জ্ঞান একমাত্র স্রষ্টা থেকেই আসে এবং তাকে স্মরণ করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি পালন করাই হচ্ছে ইসলাম। সবধরনের সাহায্যের জন্য আমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা, যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে তাকে স্মরণ এবং তার অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রার্থনা করাই হলো ইসলামের শিক্ষা। ইসলাম আমাকে একেবারে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় জীবনের মধ্যে অস্পষ্টতা দূর করেছে। ইসলামে আমি সর্বদা এক অদৃশ্য আল্লাহর একটি শক্তিশালী ধারণা লাভ করে থাকি। তিনি হচ্ছেন এক এবং অবিভাজ্য। তাঁর কোনো সঙ্গী নেই। তিনি হচ্ছেন স্রষ্টা এবং সকল আকৃতির অবিরাম নির্মাতা। তিনি হচ্ছেন সর্বদা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরম দয়ালু, শ্রেষ্ঠ বিচারক, শান্তির উৎস, সর্বশক্তিমান এবং শুরু থেকে শেষ। আমি ধর্ম-কর্ম পালনের জন্য খ্রিস্ট ধর্মের মতো একজন যাজকের ওপর নির্ভরশীল নই।’’
ইসলাম অন্ধ বিশ্বাস নয়; বাস্তব জীবনব্যবস্থার নাম: শিল্পী ও ডিজাইনার ব্রান্ডি চেজ
আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের কবি, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পী ও ডিজাইনার ব্রান্ডি চেজ। বর্তমান নাম আমিনা জাহিরাহ। তিনি বলেন, “নওমুসলিম মহিলারা বলছেন, ইসলাম তাদেরকে বন্দী বা ঘরকুনো করে রাখেনি, বরং হিজাব পরার ফলে তারা নৈতিক অবক্ষয় কবলিত পাশ্চাত্যে অশালীনতা ও লজ্জাহীনতার স্রোতের মধ্যেও লজ্জাশীলতা বজায় রাখার ও শালীন পোশাকে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।”
আমিনা জাহিরাহ তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, “আমি খ্রিস্টান হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাম। কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত এই পরিচয় বজায় রেখেছিলাম। এ ধর্মের মধ্যে আমি আমার চাহিদাগুলোর জবাব দেখতে পাইনি। তাই এ ধর্ম পরিত্যাগ করে নাস্তিক হয়ে পড়ি। কিন্তু কিছুকাল পর জীবনের কাজে আসবে এমন একটি ধর্ম খোঁজা শুরু করি। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে যৌবনেই ইসলাম ধর্ম উপহার দিয়েছেন। ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে গঠনমূলক সহাবস্থান ও সমচিন্তাকে গুরুত্ব দেয়। ইসলাম সৃষ্টির সেবাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পন্থা বলে মনে করে ও ইবাদতের মর্যাদা দেয়। যে মানুষ আল্লাহকে জানা ও চেনার ক্ষেত্রে যত বেশি অগ্রসর হয় সে তত বেশি মানবসেবায় নিবেদিত হয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর বান্দাদের সেবায় নিয়োজিত হওয়া এমন দু’টি পুণ্যগুণ যে এর চেয়ে বড় কিছু নেই। আসলে পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিক শূন্যতাই সেখানকার মানুষকে ইসলামের প্রতি দিনকে দিন গভীর আগ্রহী করে তুলছে। শত শত বছর ধরে তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক শূন্যতায় এবং পরিচিতির সংকটে ভুগছে। আধ্যাত্মিক পিপাসায় কাতর পশ্চিমা নাগরিকরা বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মত প্রাচ্যের ধর্মগুলোকেও পরখ করে দেখছেন। কিন্তু এসব ধর্ম তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি দিতে পারছে না বলে পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ জুড়াচ্ছেন। এ ধর্মের মধ্যেই তারা ফিরে পাচ্ছেন তাদের হারানো আত্মাকে।”
জাহরা সুজা খানি
ভারতীয় নওমুসলিম জাহরা সুজা খানি। তিনি মনে করেন, ইসলামের অন্যতম বড় আকর্ষণ হলো এর বাণীর গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা এবং স্পষ্ট অর্থ। ইসলাম নিজেকে প্রকৃতির ধর্ম ও বিবেকের ধর্ম বলে মনে করে। আর এ জন্যই পবিত্র অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি ও চিন্তাশীলদেরকে আকৃষ্ট করে এ মহান ধর্ম। ইসলাম ধর্মের উদ্দেশ্য হলো একত্ববাদী মানুষের মধ্যে ইসলামী ও মানবীয় গুণাবলি বিকশিত করা। এভাবে এ মহান ধর্ম মানুষের ব্যক্তিত্বের নানা দিককে পূর্ণতা দান করে এবং সৃষ্টির রহস্য তুলে ধরে মানুষের কাছে। ইসলাম মানুষের সত্তার প্রত্যেক দিক ও তাদের ইচ্ছা বা ঝোঁকগুলোকে গুরুত্ব দেয়। মানুষের স্বাভাবিক বা বৈধ চাহিদাগুলোকে অন্য কোনো চাহিদার জন্য বিসর্জন দেয় না ইসলাম। পবিত্র কোরআন মানুষের মধ্যে এমন বিশ্বাস বা ঈমানকে বদ্ধমূল করে যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় জীবনেই কল্যাণ বয়ে আনে। এভাবে ইসলাম সমাজ ও ধর্মকে সমন্বিত করে। আর এ কারণেই ইসলামের বাণী ও বক্তব্যগুলো যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের লোককে আকৃষ্ট করছে।
তিনি বলেন, “আমাদের আশপাশে মসজিদ ও মন্দিরগুলোতে সবাইই অবাধে যাতায়াত করতে পারত। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ২-৩ মাসের জন্য খ্রিস্টান হবো, এরপর ২ মাসের জন্য হিন্দু ও এভাবে একের পর এক অন্য ধর্মগুলোর অনুসারী হবো। এরপর মুসলমান হওয়ার পালা। এক মুসলমান প্রতিবেশী আমাকে নামাজ শেখার বই উপহার দিলেন। সে সময় আমার বয়স ও জ্ঞান দুই-ই অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও ইসলামকেই আমি শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে দেখতে পেয়েছিলাম।”
সুজা খানি বলেন, “আমার আত্মা ছিল সত্যের প্রতীক্ষায় শুকনো মরুভূমির মত তৃষ্ণার্ত। তাই প্রাণভরে তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। আর এ জন্য দরকার ছিল সময় ও অনুরাগ। সৌভাগ্যক্রমে এ দুই-ই আমার মধ্যে ছিল ব্যাপক মাত্রায়। ইসলাম সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব জানার জন্য বেশি বেশি পড়াশুনা ও গবেষণা করছিলাম। আমার অন্তরাত্মা ও প্রকৃতি যেন এ জন্য প্রস্তুত ছিল। আর এটাও মহান আল্লাহর এক বড় অনুগ্রহ। ব্যাপক পড়াশুনার সুবাদে বুঝতে পারলাম যে ইসলামই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উন্নত ধর্ম।”
একত্ববাদ হলো ইসলামের প্রাণ যা গভীরভাবে আকৃষ্ট করে সত্য-সন্ধানীদের। তিনি মনে করেন, ইসলাম মানুষের ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করে বলে এ ধর্ম চর্চার মাধ্যমে মানুষ নিজের ব্যক্তিত্বকে ও নিজেকে বুঝতে পারে খুব ভালোভাবে। ইসলাম চোখ, কান ও ইন্দ্রিয়গুলোকে খুবই সতর্ক রাখতে বলে। অনেক সময় এমন মনে হতে পারে যে, সামান্য সময়ের হারাম দৃষ্টি ও ছোটখাটো হারাম কোনো কাজ তেমন গুরুতর ব্যাপার নয়। কিন্তু বাস্তবে এইসব পাপ মানুষের আত্মার মধ্যে একটি বীজের মতই বিকশিত হতে থাকে। এসব শিক্ষা ও মনস্তত্ত্ব বহু বছর আগে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন বিশ্বনবী (সা)। অথচ পশ্চিমারা অতি অধুনা এসব বুঝতে শুরু করেছেন। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা মানুষকে প্রফুল্ল করে ও সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনে। এ ধর্ম পার্থিব জীবনে মানুষের করণীয় কাজগুলো কিভাবে সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে তা জানিয়ে দেয়। অজু করা, নামাজ পড়া, দাঁত মাজা ইত্যাদির রয়েছে নানা আদব-কায়দা। এসবই বিশ্বজগতের সঙ্গে বন্ধনের সুন্দরতম মুহূর্ত। এসবের মধ্যে রয়েছে জানার অনেক কিছু বা জ্ঞানের নতুন কিছু দিক।”
আল কুরআন অন্য ধর্ম গ্রন্থগুলোর মত নয়: ড্যানিয়েলে লোডুকা
ড্যানিয়েলে লোডুকা ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান। ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং পেশায় একজন শিল্পী। তিনি বলেন, একদিন দেখলাম, এমবিএর কিছু ছেলে কোরআন বিলি করছে। আমি জানতে চাইলাম, এগুলো কি ফ্রি? তারা হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে আমি একটা নিয়ে রওনা দিলাম। এসব বইয়ের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। কেবল ফ্রি পেয়েছিলাম বলে নিয়েছিলাম। তবে আমার উদ্দেশ্য ছিল, বইটা পড়ে আরো কিছু খুঁত যদি পাওয়া যায়, তবে ধর্মটির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। আমি যে কপিটা পেয়েছিলাম, সেটির পাতাগুলো মলিন হয়ে গিয়েছিল, অনেক পুরনো ছিল সেটি। কিন্তু আমি যতই পড়তে থাকলাম, ততই বশীভূত হতে লাগলাম। আমি আগে যেসব ধর্মীয় গ্রন্থ পড়েছি, তা থেকে এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি অর্থ সহজেই বুঝতে পারছিলাম। সবকিছুই ছিল স্পষ্ট। আমার মনে পড়ল, আমার এক বন্ধু যখন আমাকে ইসলামে আল্লাহ কেমন তা বোঝাচ্ছিল, আমি রেগে গিয়েছিলাম, কিন্তু এবার পাতার পর পাতা উল্টে অনেক জায়গায় দেখতে পেলাম তাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।’ মনে হলো, পবিত্র কোরআন সরাসরি আমার সাথে কথা বলছে, আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। এটা একটা ‘পুরনো গ্রন্থ’ কিন্তু পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। এর কাব্যিকতা, কল্পনাশক্তি এবং যেভাবে বার্তা পৌঁছে দেয়, তা আমাকে অন্তর থেকে নাড়া দিল। এর অভূতপূর্ব সৌন্দর্য আমি আগে কখনো টের পাইনি। মরুভূমির দমকা হাওয়া যেন সবকিছু উল্টে দিল। মনে হলো আমি যেন কিছু একটার জন্য দৌড়াচ্ছি। কোরআন আমার বোধশক্তিতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। নিদের্শনাবলি দেখে তারপর আমাকে চিন্তা করতে, ভাবতে, বিবেচনা করতে বলল। এটা অন্ধ বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে উৎসাহিত করে। কোরআন মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, ¯্রষ্টাকে স্বীকার করে নিতে বলে, সেইসাথে আধুনিকতা, মানবিকতা, সহমর্মিতার কথা বলে।
অল্প সময়ের মধ্যেই আমার জীবনকে বদলে দেয়ার আগ্রহ তীব্র হয়। আমি ইসলাম সম্পর্কে অন্যান্য বই পড়তে শুরু করলাম। আমি দেখতে পেলাম, কোরআনে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, অনেক হাদিসেও তেমনটা আছে। আমি দেখলাম, পবিত্র কোরআনে অনেক স্থানে নবী মোহাম্মদকে সংশোধন করা হয়েছে। আমার কাছে অদ্ভুত লাগল। এতেই বোঝা যায়, তিনি গ্রন্থটির লেখক নন। আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। এই মহাবিশ্বের জটিল আর বৈচিত্র্যময় কোনো কিছুই ঘটনাক্রমে ঘটেনি। তা-ই সাধারণ বিষয় হলো, সেই একজন- যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তাকে অনুসরণ করতে হবে।
আমার অ্যাপার্টমেন্টের কৃত্রিম লাইটিং এবং বাতাসের ওজন নিয়ে ভাবতে ভাবতে পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি পড়লাম: কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলীর ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, এরপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না? (২১:৩০)। এই আয়াত পড়ে আমার মাথা যেন দুই ভাগ হয়ে গেল। এটাই তো বিগ ব্যাং তত্ত্ব। সব জীবন্ত সত্তাই পানি থেকে সৃষ্টি হয়েছে, বিজ্ঞানীরা মাত্র এটা আবিষ্কার করেছে। এটা ছিল অবাক করা বিষয়। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর এবং সবচেয়ে ভীতিকর সময়। আমার সামনে দু’টি বিকল্প ছিল। একটা আসলে কোনো বিকল্পই ছিল না। আমি যা আবিষ্কার করেছিলাম, তা অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করতে পারছিলাম না। আগের মতোই চলব, এমনটাও ভাবছিলাম সামান্য সময়ের জন্য। সেটাও সম্ভব ছিল না। আমার কাছে পথ খোলা ছিল কেবল একটাই। ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না আমার সামনে। অন্য কিছু করা মানেই ছিল সত্যকে অস্বীকার করা।
আনা লিন্ডা নূর
ড্যানিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী আনা লিন্ডা। পড়াশোনার জন্য লিন্ডা অনেক দেশ গমন করেন। কায়রো সফর তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কায়রো সফরের সময় তিনি বাইবেল বা ইঞ্জিল ও তাওরাত বা ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ার সুযোগ পান। বাইবেলের অনেক কিছুতেই অসঙ্গতি ও গোঁজামিল দেখতে পান তিনি। লিন্ডা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘হজরত ঈসা (আ)-কে আমার কাছে কখনও আল্লাহর পুত্র বলে মনে হয়নি। আর অন্য মানুষদের পাপ মোচনের জন্য এ মহাপুরুষকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল বলে যে দাবি করা হয় তাও আমার দৃষ্টিতে অযৌক্তিক। এইসব অযৌক্তিক বক্তব্যের কারণে আমি অন্য ধর্মগুলো নিয়ে গবেষণার সিদ্ধান্ত নেই।’ তিনি বলেন, ‘বাইবেল পড়ার পর আমি ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত পড়ার উদ্যোগ নেই। বেশ কয়েকবার তালমুদ তথা ইহুদিদের প্রধান ধর্মীয় বইটি সংগ্রহের চেষ্টা করি। কিন্তু আমার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ ইহুদিরা অন্য কাউকেই তাদের ধর্মের অনুসারী হতে বলে না। এরপর কিছু দিন বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে গবেষণা চালাই। কিন্তু খুব দ্রুত এই গবেষণা ত্যাগ করি। কারণ, দেখলাম যে তারা আসমান ও জমিনের স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসী নয়, অথচ আমি স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি।’
তিনি শেষে কুরআন পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক বন্ধুর কাছে আরবি শিখে কুরআন পড়া শুরু করেন এবং অনুবাদের মাধ্যমে অর্থও জানেন। পড়া শেষে তার মনে হলো কত সুন্দর, জ্ঞানগর্ভ এবং দয়া ও অনুগ্রহে ভরপুর এ মহাগ্রন্থ! তিনি দেখেন, প্রাচ্যবিদদের প্রচারণার বিপরীতে ইসলাম নারীকে কত উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে ও কত বেশি প্রশংসা করেছে। প্রাচ্যবিদরা বিদ্বেষী মন নিয়ে কুরআন অনুবাদ করছেন এবং ইসলামকে এমন এক ধর্ম হিসেবে তুলে ধরছেন যে এর ইতিবাচক বা ভালো দিকগুলোর চেয়ে এর নেতিবাচক বা মন্দ দিকগুলোই বেশি! অথচ কুরআন এমন এক মহাগ্রন্থ যার মধ্যে মহাশূন্য, উত্তরাধিকার আইন, ভূতত্ত্ব, জীবনের উন্মেষ ও মানবসৃষ্টি সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে। অথচ এইসব বিষয়ে বিজ্ঞান সাম্প্রতিক সময়ে বক্তব্য রাখতে শুরু করেছে মাত্র। আর এটা এক মহাবিস্ময়। এটা কিভাবে সম্ভব যে একজন অশিক্ষিত ও নিরক্ষর নবী ১৪০০ বছর আগে এমন সমৃদ্ধ ও উচ্চ মানের বই তার অনুসারীদের উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন।
‘আনা লিন্ডা নূর’ পবিত্র কুরআন সম্পর্কে বলেছেন : ‘যখনই কুরআন তিলাওয়াত করি তখনই অশ্রু আর বাধা মানে না। কুরআন আমার মধ্যে যতটা প্রভাব ফেলেছে আর অন্য কোনো বই-ই আমার ওপর এতটা প্রভাব ফেলেনি। এই মহান আসমানি কিতাব যতই পড়ি ততই তার অর্থ আরো স্পষ্ট হয় আমার কাছে। এ এমন এক গ্রন্থ যা আমার জ্ঞান ও উপলব্ধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।’
ইসলামের নামাজ ও ইবাদতের সৌন্দর্য: নূরে ফাতিমা
নূরে ফাতিমা। জন্ম মুম্বাই শহরের অভিজাত রাজপুত পরিবারে। মুম্বাইয়ের অভিজাত স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে চলে গিয়েছিলেন ক্যামব্রিজে। পরে স্বামীর চাকরি সূত্রে বাহরাইনে চলে যান। তিনি বলেন, আমি যে পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েছি সেটি ছিল কট্টর মৌলবাদী হিন্দু পরিবার। এরা মুসলমানদের প্রতি কঠোর ঘৃণা বিদ্বেষ পোষণ করে। বিয়ের পরেই আমি ইসলামকে উপলব্ধি করার সুযোগ পাই। আমাদের সমাজে একটা প্রথা বিরাজমান। যখনি কোনো মেয়ের বিয়ে হয় তাকে স্বামীর পা ধোয়া পানি পান করানো হয়। কিন্তু আমি যখন ঐ পানি পান করতে অস্বীকৃতি জানাই তখনি আমার ওপর নেমে আসে কঠিন শাস্তি। আমি স্কুল শিক্ষিকা ছিলাম। স্কুলের কাছাকাছি স্থানে একটি ইসলামিক কেন্দ্র ছিল। ঐ কেন্দ্রে গিয়ে আমি আল্লাহ বা ¯্রষ্টা সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের জ্ঞান লাভ করি। তাদের কথা ও দৃষ্টিভঙ্গি আমার কাছে ভালো লাগে, আমি সেখানে অব্যাহতভাবে যাতায়াত করতে থাকি। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে আমি জানতে পারি মুসলমানরা যে প্রতিপালকের ইবাদত করে তিনি আল্লাহ। যিনি সমগ্র বিশ্বের মালিক ও প্রতিপালক। মুসলমানদের নামাজ আমাকে খুবি আকৃষ্ট করে। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি এটি একটি ইবাদতের পদ্ধতি। আমি এটাকে এক ধরনের ব্যায়াম মনে করে নিয়েছিলাম। কিন্তু ইসলামী কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারলাম যে এটাকে নামাজ বলা হয়। এসময় আমি অদ্ভুত ধরনের স্বপ্ন দেখতে থাকি। যখনি ঘুমিয়ে পড়তাম আমার সামনে একটি বর্গাকৃতি ঘর দেখতে পেতাম। ভয়ে আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমি পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করতাম তখনি একি দৃশ্যের অবতারণা হতো। বাহরাইনে একজন মুসলমান যুবতীর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
একদিন আমার বান্ধবী এক মাসের জন্য তার বাসায় যাওয়া নিষেধ করে। কারণ জিজ্ঞেস করায় জানায় যে এটা রমজান মাস। এ মাসে সে নিরবচ্ছিন্ন ইবাদত করবে। আমি তার কথায় মনে খুব কষ্ট পেলাম। কিন্তু এবাদত বন্দেগি দেখার ও জানার খুব আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় আমি তাকে খুব অনুনয় বিনয় করতে থাকি। আমি কোনো কথা বলতে পারবো না এই শর্তে সে আমাকে তার বাড়ি যাবার অনুমতি দেয়। এভাবে আমার যাতায়াত অব্যাহত থাকে। কিন্তু একদিন নিজের উৎসুক দমন করতে না পেরে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে বসি তোমরা যে প্রতিদিন করে থাকো এটা কোন ধরনের ব্যায়াম আর এটা কি পাঠ কর তোমরা। সে জবাবে জানায় এটা ব্যায়াম নয় এটি নামাজ এবং এতে আমরা আল্লাহর পবিত্র বাণী কোরআন পাঠ করে থাকি। এই গ্রন্থ মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্য অবতীর্ণ। আমার বান্ধবীর সব ধরনের ইবাদত আমার ভালো লাগতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি। অবশেষে আমি তার অনুকরণ করতে শুরু করি। এক পর্যায়ে আমি নিজের বাসায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে নামাজ পড়তে শুরু করি। কিন্তু একদিন আমি দুর্বিপাকের মুখোমুখি হয়ে পড়ি।
আমি ঘরের দরজা বন্ধ করা ভুলে গিয়ে নামাজ পড়া শুরু করি এরি মধ্যে আমার স্বামী আমার কর্মকান্ড দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে তুমি এসব কি করছ? আমি তাকে জবাবে জানাই যে নামাজ পড়ছি। সে বলে তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি কি জান যে তুমি কি বলছো? প্রথমে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই এবং আতঙ্কে দুই চোখে অন্ধকার দেখতে থাকি। কিন্তু আকস্মিকভাবে আমার সব ভয় কেটে গিয়ে আমার মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হয়ে যায় এবং আমি চিৎকার করে বলতে থাকি। আমি মুসলমান হয়ে গেছি এবং নামাজ পড়ি। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি তোমার এই বাক্যটা দ্বিতীয় বার উচ্চারণ করতে পারবে? আমি বলি হ্যাঁ আমি মুসলমান হয়ে গেছি। এতে সে ক্রোধান্বিত হয়ে আমাকে মারধর শুরু করে। চিৎকার শুনে আমার বড় বোন এসে পৌঁছে যায়। প্রথমে সে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে আমার স্বামীর থেকে আসল ঘটনা জানবার পর ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং সেও তার সাথে নির্যাতনে অংশ নেয়। আমার স্বামী ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং আমাকে আরো নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে নিয়ে যখন এই নারকীয় খেলা চলছে তখন আমার ছেলেরা কাছেই ছিল। তাদের বোঝার মত বয়স হয়েছে। বড়টার বয়স তখন নয় বছর আর ছোটটার বয়স তখন আট বছর। এ ঘটনায় সবার সাথে আমার মেলামেশা বন্ধ করে দেয়া হয়। একটি ঘরে আটক রাখা হয় আমাকে। আমি কিন্তু তখনো আনুষ্ঠানিক ইসলাম গ্রহণ করিনি। শুধু বলেছিলাম আমি মুসলমান হয়ে গেছি। এর ফলে তারা আমাকে যা ইচ্ছা তাই নির্যাতন শুরু করে। এক রাতে আমার বড় ছেলে আমার ঘরে প্রবেশ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। সে বলে মা তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও ওরা তোমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে।
এখন বাড়িতে কেউ নেই তারা ধর্মীয় বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য কোথাও গিয়েছে। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে এমন কিছুই ঘটবে না। যদি আমি চলে যাই তাহলে তো তোমাদের সাথে আর দেখা হবে না। আমার ছেলে আমার কথার প্রতিবাদ করে জবাব দেয় মা তুমি যদি বেঁচেই না থাকো তাহলে তো এমনি দেখা হবে না। মা তুমি চলে যাও। আমি নিজেই নিজের এবং ছোট ভাইয়ের যতœ নিব। সে আমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার জন্য জেদ ধরে বসে। কিন্তু তখন আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। দু’টি নিষ্পাপ বাচ্চাকে ছেড়ে কিভাবে বের হয়ে যাই। কিন্তু ছেলের জেদ ও পীড়াপীড়ির কারণে নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। ঘরের দরজার বাইরে বের হয়ে এক হৃদয়ভরা দৃশ্য অবলোকন করি। আমার ছেলে তার জাগানোর চেষ্টা করছে এবং বলছে ভাই ওঠো মা চলে যাচ্ছে। কে জানে আর কখনো মায়ের সাথে আমাদের দেখা হবে কিনা। এ অবস্থা দেখে আমি সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে যাই। মনে হয় আমি এ কি দৃশ্য দেখছি। আমার পা যেন অবশ হয়ে মাটির সাথে আটকে যাচ্ছে। আমার চলনশক্তি রহিত হয়ে গেছে। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি। মনে হচ্ছে আমার সব কিছু লুণ্ঠিত হয়ে গেছে। এ সময় ছোট ছেলেটি চোখ কচলাতে কচলাতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে মা তুমি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছ? নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে ছেলেকে ছাড়িয়ে বলি হ্যাঁ, আমার সোনা মানিক। আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের আবার দেখা হবে। আমি মায়ের স্নেহ মমতা পদদলিত করে শুধুমাত্র ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণের জন্য নিজের নড়বড়ে পায়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। শেষবার পেছন ফিরে দেখতে পাই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমার ছোট দুই ছেলে হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে। বিদায়ের সে ঘটনা মনে হলেই আমার চোখের সামনে এ দৃশ্য ভেসে ওঠে এবং আমি কেঁদে ফেলি।
ঘর থেকে বের হয়ে আমি সোজা থানায় চলে আসি। সেখানে একজন অফিসার পেলাম যিনি আমার কথা বুঝতে পারেন। নির্যাতনের ফলে আমার সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত। ক্লান্তিতে সারা দেহ অবসন্ন। কথা বলার শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না। তাই পুলিশ অফিসারকে আমাকে কিছুটা সময় দেয়ার অনুরোধ করি। এর পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে আমি তার কাছে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করি এবং নিজের ইচ্ছা ও সঙ্কল্পের ব্যাপারে তাকে অবহিত করি। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তিনি নিজেও একজন মুসলমান এবং এ ব্যাপারে তার পক্ষে যতটুকু সাহায্য করা প্রয়োজন তিনি ততটুকুই করবেন।
এর মধ্যে আমার স্বামী থানায় গিয়ে অভিযোগ করে যে আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। তাকে জানিয়ে দেয়া হয় যে আমাকে কেউ অপহরণ করেনি আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য ঘর ছেড়েছি। সে ছলচাতুরীর মাধ্যমে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমি তাকে দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে দেই যে ইসলাম গ্রহণের পর তার সাথে আমার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি পুলিশ অফিসারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রথমে হাসপাতালে যাই। কারণ এসব জালেম আমার ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে তা অবর্ণনীয়। অবস্থা ছিল খুব শোচনীয়। আমাকে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। কোনভাবে হাসপাতাল থেকে অব্যাহতি পেয়ে নিজের আসল লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশে ইসলামী কেন্দ্রে চলে যাই। সেখানে পৌঁছার পর একজন আমাকে ওজু করান হয়। ঘরে প্রবেশের পর আমি নিজে থেকে চিৎকার করে উঠি। আমি প্রায় স্বপ্নে বর্গাকৃতি যে ঘরটি দেখতে পেতাম ঐ ঘরের ছবি এই কক্ষের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে। এতে তিনি মুচকি হেসে এই পবিত্র ঘর সম্পর্কে আমার কাছে অনেক কিছু বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এটি আল্লাহর ঘর যাকে ‘বায়তুল্লাহ’ বলা হয়। সারা পৃথিবীর মানুষ সেখানে গিয়ে হজ ও ওমরাহ করে থাকে। এর পর তিনি আমাকে কালেমায় শাহাদাত পাঠ করান এবং নিজের কন্যার মর্যাদা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান। এখন আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং নিজেকে নিরাপদ মনে করছি।
সেসিলিয়া কেনোলি
সেসিলিয়া কেনোলি। নতুন নাম মাহমুদা। ইসলামের প্রার্থনারীতি তাকে সর্বাধিক মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেন, আমার চোখের সামনে খ্রিষ্টধর্মের যেসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো আমার বুঝে আসে না। আমার মনে আছে, যখন আমি নবজাত শিশুর দিকে তাকাতাম, তখন ভাবতাম খ্রিষ্টধর্ম মতে এ শিশুটিও ঘৃণ্য পাপে নিমজ্জিত। কিন্তু এও কি সম্ভব! এই কুৎসিত বিশ্বাসকে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। গির্জার যেসব শিক্ষা আমার মনোপূত হতো না বা বিবেকসম্মত হতো না, সেসব বিষয়ে একজন সাধারণ খ্রিষ্টান থেকে নিয়ে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ পর্যন্ত যার কাছেই প্রশ্ন করেছি, সবার নিকট থেকেই একটি উত্তর পেয়েছি, তা হলো-‘গির্জার কোন শিক্ষা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যাবে না। অবশ্যই বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করতে হবে।’ তখন আমার এ কথা বলার সাহস হয় নাই যে, ‘যে বিষয় আমার বুঝে আসে না, তা আমি বিশ্বাস করতে পারি না।’ আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি-‘খ্রিষ্টান’ বলে পরিচিত অনেকেই আজ তাদের ধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষাসমূহের রহস্যময়তা ও অলৌকিকতার তুলনায় ইসলামের জীবনদর্শন অত্যন্ত সুন্দর এবং এতে রয়েছে নতুনত্বের ছোঁয়া। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও আচারসর্বস্ব কৃত্যানুষ্ঠানের উপস্থিতি ইসলামে নেই। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একদিন আমার মেয়ে ইসলাম সম্পর্কে একটি বই নিয়ে এলো। বইটি আমাদের এতই মুগ্ধ করল যে, আমরা ইসলাম সম্পর্কে আরো কয়টি বই কিনে ফেললাম। অচিরেই আমরা অনুধাবন করলাম যে, আমরা যা বিশ্বাস করছি এবং যে বিশ্বাসের দিকে আমাদের মন ব্যাকুল হয়ে ছুটে যাচ্ছে, ইসলাম যেন ঠিক তা-ই। যখন আমি খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাস করতাম, তখন মনে করতাম, ইসলাম রং-তামাশা বা কৌতুকসর্বস্ব ধর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যখন ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করলাম, তখন আমার ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। ইসলামের এক নতুন পরিচয় এক নতুন রূপ আমার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এর কিছুদিন পর কয়েকজন মুসলমানের সাথে আমার সাক্ষাৎ হলো।
ইসলামের যে বিষয়গুলো আমার নিকট পুরোপুরি পরিষ্কার হয় নাই, সেগুলো সম্পর্কে তাদের কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সতর্কতার সাথে তারা আমার সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলো। অথচ খ্রিষ্টানদের নিকট বারবার প্রশ্ন করেও আমাকে হতাশ হতে হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে গভীরভাবে পড়াশোনা ও অধ্যয়নের পর আমি এবং আমার মেয়ে উভয়েই মুসলমান হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, ইসলামে কোন বিষয়টি আমাকে সর্বাধিক মুগ্ধ করেছে, তবে আমি বলব, সেটা হলো, ‘ইসলামের প্রার্থনারীতি’। খ্রিষ্টধর্মের প্রার্থনা রীতিতে সাধারণত যিশুর মাধ্যমে ¯্রষ্টার কাছে দুনিয়ার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু ইসলামের রীতি এরূপ নয়। আমরা মুসলমানরা প্রার্থনার সময় সর্বশক্তিমান আল্লাহপাকের প্রশংসা করি, তাঁর নেয়ামতসমূহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কেননা, আমাদের মঙ্গলের জন্য কি প্রয়োজন, তা তিনি জানেন এবং না চাইতেই আমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু তিনি দান করেন।’
অন্যান্য ধর্মের অযৌক্তিক প্রথা ও বাড়াবাড়ি
ভারতের অরণকুমার চক্রবর্তী। তিনি বলেন, আমার পিতা পেটের পীড়ায় মারা যান। বড় সন্তান হওয়ায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হিসাবে আমাকেই আমার বাবার মুখাগ্নি করতে হয়। বাবাকে আগুনে পোড়ানোর সেই দৃশ্য আমার জন্য খুবই কষ্টদায়ক ছিল। সেই সাথে এই ক্রিয়াকর্মে পুরোহিতদের আচার-আচরণ এবং আমার এই কঠিন মুহূর্তে তাদের বিভিন্ন চাওয়া-পাওয়া আমাকে হিন্দুধর্মের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দেয়। এর পাঁচ মাস পরে আমার বড় বোন দীর্ঘসময় মস্তিষ্কজনিত জ্বরে ভোগে মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর সময় সে সাত মাসের গর্ভবতী ছিলো। তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলো। পুরোহিতরা লাশ দেখে বলতে লাগল, এই মহিলাটি গর্ভবতী, তাকে এভাবে পোড়ানো যাবে না। তার পেট কেটে এই বাচ্চাটিকে বের করতে হবে এবং বাচ্চাটিকে পোড়ানো যাবে না, তাকে দাফন করতে হবে। আমি পন্ডিতজিকে বললাম যে, এই মৃত বোনের পেট কি করে ফাঁড়া হবে? এটা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। তিনি বললেন, তাহলে তাকে আমাদের শ্মশানে পোড়ানো যাবে না। আমি বললাম, আমরা নিজেরাই লাশ দাহ করব। তিনি বললেন, শ্মশানের বাইরে অন্য কোথাও গিয়ে করুন। আমি বোনকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে আত্মীয়-স্বজনকে তাগিদ করলাম, কিন্তু তারা তা করতে রাজি হলেন না। তারা যুক্তি খাড়া করলেন যে, এরা ধর্মের পন্ডিত, তাদের কথা মানতে হয়। এতগুলো মানুষের মতামতের তোড়ে আমার বক্তব্য অগ্রাহ্য হলো। আমার সামনে আমার বোনকে উলঙ্গ করে, পেট কেটে বাচ্চা বের করা হলো। এতে আমার মন ভেঙে গেল। আমি হিন্দুধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললাম। এ ঘটনার কিছু দিন পরে একজন ডাক্তার সাহেবের নার্সিং হাসপাতালে চাকরি নিলাম। ডাক্তার সাহেব মুসলমান ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে তার সাথে সংকোচ ভাব কেটে যাওয়ার পর আমার পুরো ঘটনা ডাক্তার সাহেবকে বললাম। তিনি খুবই ব্যথিত হলেন এবং আমাকে ইসলামের সুমহান পর্দা ও আদর্শিক বিধানের কথা জানালেন। আমি তখন ইসলাম গ্রহণ করার আগ্রহ ব্যক্ত করলাম। ডাক্তার সাহেব আমাকে দিল্লি জামে মসজিদে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করার পরামর্শ দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ, এভাবে আমি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। আমার বর্তমান নাম আনাস।
ইসলামে নারীর মর্যাদা
মনিকা ওয়েট, ইসলামী নাম নার্গিস। তিনি বলেন, যেসব বিষয় ইসলামকে অন্য ধর্মগুলোর চেয়ে বেশি মহীয়ান করেছে, সেসবের মধ্যে নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের অবসান অন্যতম। ইসলাম জাতি, বংশ, নারী-পুরুষের পার্থক্য-ভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বকামিতাকে ধ্বংস করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী, পুরুষ, ধনী-গরিব, সাদা-কালো এবং সুদর্শন ও অসুদর্শন মানুষ সবাই সমান। একমাত্র খোদাভীতি, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক গুণাবলি- এসবই শ্রেষ্ঠত্বের সত্যিকার মানদন্ড। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক প্রিয় যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।”
নারী সম্পর্কে ইসলামের বিধানগুলো নির্ভুল ও সুশৃঙ্খল এবং এক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধগুলো সর্বোচ্চ মাত্রায় রক্ষা করা হয়েছে। এভাবে ইসলাম নারীকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং তাকে দেখিয়েছে প্রকৃত মর্যাদার পথ। তিনি বলেন, “যেসব বিষয় ইসলাম সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করতে আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে নারীর প্রতি মানুষের আচরণের ধরন ও বিশেষ করে নারীর প্রতি ইরানি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ। যখন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলাম তখন পেশাগত প্রয়োজনে ইরানের সঙ্গে পরিচিত হই। এ সময় আমি ইরান সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করে এটা বুঝতে পেরেছি যে, নারীর সঙ্গে ইরানিদের দৈনন্দিন আচরণ নারীর প্রতি পশ্চিমাদের আচরণের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নারীরা কেন ইরানে এত সম্মানিত তার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি ইসলামকে আবিষ্কার করেছি। এ ধর্মের কারণেই মানুষের দৃষ্টিতে নারী এতটা মর্যাদা, সম্মান ও শক্তিমান সত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়।”
ইসলামের শালীন পোশাক-পরিচ্ছদ: সিস্টার আয়েশা জিবরিল
সিস্টার আয়েশা জিবরিল আমেরিকার অধিবাসী। রোমান ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে ওঠা এই নারী পেশায় বিমান সংস্থার পাইলট। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে আমার ভেতরে ভেতরে কিছু একটা অনুভূতি জাগছিলো। আগের পরা পোশাকে যেন নিজেকে অস্বস্তিবোধ করছিলাম। আগে টাইট জিন্স, টাইট প্যান্ট এবং পোশাক-পরিচ্ছদে বেশি ফ্যাশন করতাম। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে এসব পোশাক যে বেমানান তা উপলব্ধি করলাম। খুব কষ্ট করে পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করি। আগে সবসময় শরীর নিয়ে গর্ব করতাম এবং লোকজন আমার দিকে যাতে তাকিয়ে থাকে সে ধরনের পোশাক পরতাম। কিন্তু এখন হিজাব পরা শুরু করেছি। এ ছাড়া ঢিলাঢালা চলনসই লম্বা পোশাক পরিধান করি।
সারা বোকার
আমেরিকান সারা বোকার একজন সাবেক অভিনেত্রী, মডেল। তিনি ফ্লোরিডা রাজ্যের মিয়ামির সাগরতীরে বসবাস করতেন। বিকিনি পরা ছেড়ে দিয়ে তিনি এখন নেকাব পরছেন। তিনি বলেন, মুসলিম হওয়ার আগে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে আমি বিকিনি পরতাম কিন্তু হিজাব পরে এখন আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃত মূল্য পেয়ে স্বাধীনতা ভোগ করছি এবং মানবিক মূল্য পাচ্ছি। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বিকিনি পরে সমুদ্রতীরে ভ্রমণ আর চাকচিক্যময় পশ্চিমা জীবনধারা উপভোগ করা সম্ভব কিন্তু প্রকৃত শান্তি পাওয়া সম্ভব নয়। উপলব্ধি করেছি নারীদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার রক্ষায় নেকাব পরা জরুরি। আমি মনে করি, আজ নারীদের স্বাধীনতার নতুন প্রতীক হচ্ছে নেকাব। যেসব নারী ইসলামী ভদ্রতা হিজাব উপেক্ষা করে পাশ্চাত্যের কুরুচিপূর্ণ পোশাকে সজ্জিত হচ্ছেন, জানেন না কী হারাচ্ছেন তারা।
পরিশেষে বলা যায়, দিকে দিকে বিভ্রান্ত, নিগৃহীত ও অধিকারহারা মানুষের জন্য একমাত্র আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল হলো ইসলাম। শান্তি, পরিতৃপ্তি, অধিকার ও মুক্তির জন্য আল কুরআনই মানবতার একমাত্র গ্যারান্টি। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রতিটি জনপদ থেকে যারা প্রতিনিয়ত ইসলাম ও কুরআনের বিজ্ঞানময়তা ও মহানতা উপলব্ধি করে ইসলামের অনুপম আদর্শে বিমোহিত হচ্ছেন তাদের কাছ থেকে আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা। ইসলামের সন্ধান পেতে তাদের সীমাহীন পেরেশানি, ঈমান আনার ক্ষেত্রে তাদের অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা আমাদেরকে শিহরিত করে। নওমুসলিম এসব ভাই-বোনদের জীবন হয়ে ওঠে বাস্তব দায়ী ইলাল্লাহর জীবন। যে জীবন প্রেরণা জোগায় দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে।
আমরা আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করি, “হে আমাদের রব, হেদায়েত প্রদানের পর আমাদের অন্তরকে আর বক্র করে দিও না…।”
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক