সাহিত্যের মৌলিক উপকরণ হচ্ছে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি। কিন্তু আমি মনে করি যা কিছু লিখে প্রকাশ করা হয় সেটাই সাহিত্য। আবার অনেক কিছু লিখিতভাবে আমরা পাই না তবে সেটা তৈরি বা সৃষ্টি হতে কিন্তু সাহিত্যের ভূমিকা রয়েছে। যেমন নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি যা অভিনীত হয় সেটার কিন্তু আগে স্ক্রিপ্ট লেখা হয়। স্ক্রিপ্ট সুন্দর হলে সেটা সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়। শুধু নাটক-চলচ্ছিত্র নয় আরও অনেক ক্ষেত্রে আগে স্ক্রিপ্ট লেখা হয়। যেমন রেডিও-টেলিভিশনে যে খবর আমরা শুনি ও দেখি সেগুলো কিন্তু আগে লিখে নেয়া হয়। আমরা যে বিজ্ঞাপন দেখি বা শুনি সেখানেও গল্প ভাবনা ও জিঙ্গেল শুরুতে লেখা হয়। পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে যা লেখা হচ্ছে সেগুলো কি সাহিত্য হবে? কেন হবে না বলুন? আনাড়ি বা এলোমেলো লেখা হলে কি আপনি সেগুলো পড়বেন? মিছিলের স্লোগানও কি সাহিত্য? আমি বলি সাহিত্য। যদিও এটা মুখে মুখে ছড়িয়েছে কিন্তু শুরুর ভাবনাটা হয়ত কাউকে বারবার লিখে ঠিক করতে হয়েছে। মুখে মুখে অনেক গান কিন্তু গাওয়া হয়েছে, মায়েরা অনেক গল্প কিন্তু বাচ্চাদের শুনিয়েছেন। যার শুরু বা প্রচলনের কোথাও হয়ত লেখা হয়নি। এরপরও আমি এগুলোকে সাহিত্য বলি। কেননা বনেদি উপকরণের বাইরেও এগুলো মানুষকে প্রভাবিত করেছে। এগুলোর সৃষ্টা বা আবিষ্কারক অবশ্যই সাহিত্যিক মর্যাদা পেতে পারেন। তবে এটা একটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ। কেননা সম্প্রতি একজন গায়ক (বব ডিলান) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এবার আসুন কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের প্রভাব সম্পর্কে একটু ঘেঁটে দেখি। ব্রিটিশ বা সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী কবিতা লিখে কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যে পত্রিকা তার সেই কবিতা ছাপিয়েছিল সেখানে পুলিশ তল্লাশি চালায়। এই ঘটনা ১৯২২ সালের। সেই সময় বিশাল ব্রিটিশ সা¤্রাজ্য ও যে বিপুল তাদের প্রতিপত্তি, নজরুলের এক কবিতা লেখায় তাদের কী এমন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিল? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা হয়ত রাজনীতিবিদদের ভূমিকা দেখে থাকি। কিন্তু নাটের গুরু কি সাহিত্যিকরা নন? সবাই মিলে যখন ব্রিটিশ হটাও আন্দোলন করছিল তার মধ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কিভাবে শুরু হলো? কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালসহ সাহিত্যিকরা পাকিস্তান আন্দোলনের ধারণা দিয়েছিলেন। পাকিস্তান নামের প্রবর্তকও ছিলেন আল্লামা ইকবাল। আবার পাকিস্তান সৃষ্টির ২৩ বছরের মাথায় তা ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের সষ্টি হলো। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ কি এমনই এমনই সৃষ্টি হয়েছিল? বাংলাদেশ কি হঠাৎ করে স্বাধীন হয়েছে? দীর্ঘ ২৩ বছরের ইতিহাস শুরু থেকে ঘাঁটলে দেখা যাবে কবি-সাহিত্যিকরা এ ব্যাপারে আগে থেকেই আওয়াজ তুলেছেন, সোচ্চার হয়েছেন, রসদ জুগিয়েছেন। অনেক উদাহরণের মধ্যে আমরা এখানে শুধু একটি বিষয়ের অবতারণা করব।
১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায়। এই সিনেমার স্লোগান ছিল
‘একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি আন্দোলন
একটি চলচ্চিত্র’
সিনেমাতে যে গানগুলো ছিল,
‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’?
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’
‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’।
উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তারপরও জহির রায়হান সিনেমাতে আমার সোনার বাংলা গানটি অন্তর্ভুক্ত করেন এবং পরবর্তীতে এই গানটিই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করা হয়। এই সিনেমাতে একটি নবজাতক শিশুর নাম রাখা হয় ‘মুক্তি’। ১৯৭১ এ পাকিস্তান সেনাদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছে তাদেরকে মুক্তি বলেই ডাকা হয়েছিল। সিনেমাটির গল্প একটি পরিবারকে নিয়ে। কিন্তু সেটা প্রতীকী। পারিবারিক গল্পের মাধ্যমে সেই সময়ের স্বৈরশাসক ও শাসন সিনেমাতে তুলে ধরা হয়েছে। সাদা-কালো সিনেমা হলেও এখনও উপভোগ্য। শেষে আপনার চোখে পানি আসবে এবং আপনি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন। সেই সময়ে সিনেমাটির ব্যবসা সফল হয়েছিল। সিনেমাটি এখানে শুধু সিম্বল। সাহিত্যিকরা এভাবেই পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ প্রয়োগ করেছেন।
১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের যায়যায়দিন সংখ্যার মাধ্যমে শফিক রেহমান বাংলাদেশে আমদানি করেন ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’। এই অশ্লীলতার প্রসারে যায়যায়দিনের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
মাওলানা মওদূদী ৩৮ বছর বয়সে ১৯৪১ সালের ২৫ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকে সাংবাদিকতা ও পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। ২৬ বছর বয়সে প্রথম বই প্রকাশ করেন ‘আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ যা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরুর আগেই তিনি ২১ বছর সাহিত্যচর্চা করেন। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে ফাঁসির দন্ড দিয়েছিল একটি বই লেখার কারণে। পরবর্তীতে গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার ফাঁসি কার্যকর করা থেকে পিছু হটে। মিসরে শহীদ হাসান আল বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ উনারাও সাহিত্যচর্চা করেছেন। তাদের সেই তাফসির গ্রন্থ ও ইসলামী লেখনী এখনও ইসলামী আন্দোলনের পথিকদের পথ দেখিয়ে চলেছে। তুরস্কের সাইয়্যেদ বদিউজ্জামান নুরসিও সাহিত্যচর্চা করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের দিকপালদের এগুলো শুধু সাহিত্যচর্চা নয় বরং সাহিত্য আন্দোলন অবশ্যই।
সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য আন্দোলনের মধ্যে আমি পার্থক্য করছি? হ্যাঁ করছি। আমি বলতে চাচ্ছি যা শুধু লিখে যাওয়া হয় সেটা সাহিত্যচর্চা। কিন্তু লেখার পাশাপাশি যা লিখিত হচ্ছে তা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো এবং প্রভাব বিস্তার করা বা সমাজে প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা সেটা হচ্ছে সাহিত্য আন্দোলন। সুতরাং আন্দোলন কথাটির মধ্যে ব্যাপকতা বেশি। দেখুন সাহিত্যচর্চার অন্য নাম ভাষার চর্চা করা। বাংলা ভাষার চর্চা বা সাহিত্যচর্চা কোন আদর্শের মানুষেরা বেশি করেছে বা করছে? আপনি যদি ইসলামী আন্দোলনের একজন হন তাহলে আপনাকে এর উত্তরে হতাশ হতে হবে। আবার বাংলাভাষী মানুষ বা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থান চিন্তা করতে গেলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে সে অর্জনের পেছনে বাংলা ভাষায় ইসলামচর্চা যা সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তার বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। কেন সরকার বা বাতিল শক্তি জিহাদি বই বলে ইসলামী সাহিত্য উদ্ধারের নাটক করে বুঝতে হবে। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা গ্রেফতার হয় ইসলামী সাহিত্যসহ। এটাই পুলিশ প্রশাসন ও মিডিয়ার কাছে সন্ত্রাসী হতে যথেষ্ট! কেন তারা ইসলামী সাহিত্য কাছে থাকলে গ্রেফতার করে? গ্রেফতারের সময় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মত ইসলামী সাহিত্য জব্দ করে?
রাজাকার গালি ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। কিন্তু ‘যুদ্ধাপরাধী’ শব্দটি শুনি নাই। এটা প্রথম ব্যবহৃত হয় বাংলা ব্লগে। বাংলা ভাষায় প্রথম ব্লগ হচ্ছে সামহোয়ারইন ব্লগ যা প্রথম প্রকাশ পায় ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর। প্রতিষ্ঠার পরপরই ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সামহোয়ারইন ব্লগে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার করতে হবে ইত্যাদি জিগির গাওয়া শুরু হয়। ‘ফেসবুক’ এই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ সাইটেও এসবের বিস্তার ঘটে। এই প্রচারণাগুলো এক উন্মাদ তরুণ প্রজন্ম তৈরি করে যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বাতিল হওয়া নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী কথাটি উল্লেখই করেনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী কথাটি উল্লেখ করে। তবে যেটুকু উল্লেখ করেছে তা দেখলে মনে হয় যে তড়িঘড়ি করে কেউ শেষ মুহূর্তে লিখেছে। দেখুন সে অংশটুকু…
(৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা : ৫.১ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ শক্ত হাতে দমন করা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে)
নির্বাচনে জয়ের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার প্রথম অনুভূতি যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় সেখানে সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি এখন নির্বাচিত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন কিনা’? তিনি উত্তরে বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণই এর বিচার করে দিয়েছে’। অর্থাৎ শুরুতে শেখ হাসিনার অন্তত এই ইস্যুতে অত পেনিক ছিল না।
শুধু ব্লগ বা ফেসবুক নয় সেই সাথে মিডিয়ার একটি অংশ এই ইস্যুতে একই সাথে কাজ শুরু করে। বস্তুত কিছু কিছু ব্লগার আবার সাংবাদিক ছিল। তাদেরই একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছিল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সাহেবের নির্বাচন কমিশনের সাথে সাক্ষাৎ শেষে টিভি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে প্রশ্ন করা এবং সিন্ডেকেট নোংরা প্রচারণায় লিপ্ত হওয়া। তিনি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই’। এই ঘটনাটি ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবরে ঘটে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ২৩ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে বাংলা ভাষার প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ ২৪ ডটকম যা চরম শাহবাগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
এখন আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত-শিবির নিয়ে যা কিছু করে তাতে উগ্র প্রচারণার ব্যাকআপ দেয় শাহবাগী ফেসবুক, ব্লগ ও মিডিয়া। আবার বলা যেতে পারে আওয়ামী লীগ যখন যা করতে চায় এই উন্মাদদের দিয়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে নেয়।
আবার শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে তৈরি হয় মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলাম গঠনের শুরুতে ফেসবুক, ব্লগ ও মিডিয়ার একটি বড় ভূমিকা ছিল। নাস্তিক বা শাহবাগীরা ইসলামবিদ্বেষী কাজ করছে এই প্রচার পায় মিডিয়াতে। হেফাজতে ইসলামকে ব্যাকআপ দিতে যেয়ে মাহমুদুর রহমানের আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি সরকার বন্ধ করে দেয়। ভাবছেন আমি যা বলছি সব তো মিডিয়ার ভূমিকা। এখানে সাহিত্য কোথায়? যা লিখিত হয়েছে সেগুলোতো সাহিত্য, তাই না? এটা ছিল এক প্রকার সাহিত্যযুদ্ধ। উভয় পক্ষ চেষ্টা করেছে মানুষকে জানাতে, সচেতন করতে, বিদ্রোহী করে তুলতে এবং সর্বোপরি রাজপথ কাঁপাতে। যে যত সাহিত্যচর্চায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তারা তত দ্রুত ও সুদূরপ্রসারী ফল পেয়েছেন। রাজনীতির ভূমিকা এখানে মুখ্য হলেও সাহিত্যের প্রভাব তৎক্ষণাৎ এবং সুদূরপ্রসারী দুটোই।
আল্লাহর রাসূল সা:-এর সময় ছিল সাহিত্যের জয়জয়কার। সে সময় লেখালেখির চলনের চাইতে মুখে মুখে সাহিত্যচর্চা হতো বেশি। আল কুরআনও এসেছিল উন্নত সাহিত্য মান নিয়ে যা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল সা: সাহিত্যচর্চা করারও নির্দেশ দিয়েছেন এবং দারুণভাবে উৎসাহিত করেছেন। তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও কবিদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ উপহার দিয়েছেন। অন্যরা প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেছেন তারা কবিতার মাধ্যমে তোমাদের সাথে যুদ্ধে শরিক হয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের দু’জনই ছিলেন কবি। একজন হজরত আবু বকর রা: ও অন্য জন হজরত আলী রা:। ইসলামের চার খলিফার তিনজনই ছিলেন কবি। শুধু হজরত উসমান রা: কবি ছিলেন না। আল্লাহর রাসূল সা: সেই সময়ের বিখ্যাত কিছু কবি ও তাদের কাব্যচর্চা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। তার অর্থ হচ্ছে তিনি তাদের কবিতা শুনেছিলেন। হজরত আয়েশা রা: অনেক কবিতা মুখস্থ রেখেছিলেন। আল্লাহর রাসূল সা. তার মুখ থেকেই অবসর সময়ে অনেক কবিতা শুনেছেন। সুতরাং সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য আন্দোলনের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোন দোষ তো নেই। বরং এগুলো ব্যবহারের তাগিদ রয়েছে। মূলত ‘সাহিত্য’ এই শব্দটি নির্দোষ ও নির্মল। ‘সাহিত্য’ কারা চর্চা করেছে এবং কি উদ্দেশ্যে চর্চা করেছে সেটাই মূল বিবেচ্য বিষয়। অর্থাৎ প্রকারন্তে দোষটা আমাদের। কেননা আমরা সাহিত্যচর্চার বিষয়ে দুর্বলতা দেখিয়েছি।
এখন প্রশ্ন করতে পারেন আমরা কিভাবে সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য আন্দোলন করবো? এ বিষয়ে আমরা দুটি পথ বা কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে পারি।
১. সাহিত্য আড্ডা। ২. সাহিত্যের ছোট কাগজ বের করা।
সাহিত্য আড্ডা হচ্ছে একটা আসর বা মজলিশ যেখানে নবীন প্রবীণ সাহিত্যিক ও পাঠক সবাই সাহিত্য নিয়ে আড্ডায় মশগুল হন। প্রত্যেকে তাদের কোন সাহিত্যকর্ম অর্থাৎ গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ পাঠ করে শোনান। প্রবীণ যারা থাকেন তারা পঠিত সাহিত্যের ওপর পর্যালোচনা করেন যা সাহিত্য সমালোচনা নামে পরিচিত। এখানে প্রবীণদের নিকট থেকে নবীনরা অনেক কিছু শিখতে পারেন। এ ছাড়া সকলের সাহিত্যচর্চা হয়, পারস্পরিক যোগাযোগ হয়, চিন্তার ঐক্য ও কর্মের ঐক্য তৈরি হয়।
সাহিত্যের ছোট কাগজ এক পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে কয়েক ফর্মার হতে পারে। দু-একজন ব্যক্তিকে একটু উদ্যোগী হতে হয়। সে বা তারা ছোট পরিসরের কাগজ হলে দশ বারো জনের নিকট থেকে লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে তারপর ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। এটা এতটাই সহজে হতে পারে যে কম্পিউটারে নিজেই কম্পোজ করে প্রিন্ট শেষে ফটোকপি করে ৫০ থেকে ১০০ জনের মাঝে বিতরণ করা যায়। সামর্থ্য থাকলে কয়েক ফর্মার একটি সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রেস থেকেও বের করা যায়। এতে নবীন লেখকরা উৎসাহিত হন। কেননা প্রবীণদের পাশে তার লেখাটি তাকে অবশ্যই অনেক আনন্দ দেয়। তবে ছোট পরিসরে বের করলেও খেয়াল রাখতে হবে যাতে সেটা নির্ভুল হয়। তা নাহলে বরং সেটা বিরক্তির কারণ হবে। আবার যতই ছোট বলি না কেন সেখানে যা কিছু লেখা থাকবে সেটা পাঠকদের মনেও নিশ্চয়ই নাড়া দেবে। উল্লেখ্য দীর্ঘদিন যারা আমাদের সাহিত্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন আমরা তাদের কাছ থেকেও তাদের অভিজ্ঞতা জেনে নিতে পারি। বর্তমান সময়ের চাহিদার আলোকে তাদের পরামর্শকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন কর্মনীতি নিয়েও ভাবতে পারি। আমাদের ভাবনার জগতে নতুন ঢেউ জাগুক, নতুন করে আন্দোলিত হোক আমাদের এই অভিযাত্রা। তাই হতাশা নয়,সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবার পালা। পরিশেষে কবি মোশাররফ হোসেন খানের একটি কবিতার পঙক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই-
পাথরে পারদ জলে, জলে ভাঙ্গে ঢেউ
ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে জানি গড়ে যাবে কেউ
লেখক : সাহিত্য সংগঠক, গবেষক