এডিটর’স নোট:
সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া সোনার বাংলাদেশ ব্লগে গত ২২ এপ্রিল, ২০১২-তে লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় সামান্য পরিমার্জন করেপাঠকদের জন্য পুনরায় প্রকাশিত হলো।
ইসলামপন্থীরা, বিশেষ করে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের বিশেষজ্ঞরা নারীর যৌনতা বিষয়ক কোনো ম্যটেরিয়্যাল পেলে পরিশুদ্ধি ও নিন্দার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুঃখিত, কাউকে হেয় বা আহত করার জন্য এটি বলিনি। এটি আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ। যৌনতা বিষয়ে দৃশ্যমান এই অতিসংবেদনশীলতা দেখে ভাবতে থাকি, বাম/নাস্তিকরা কেন আমাদের মতো ইসলামিস্টদেরকে ‘সেক্সিস্ট’ বলে গালি দেয়!
যৌনতা বিষয়ে কনসার্নড হওয়াটা নিতান্তই স্বাভাবিক। কোরআন শরীফেও এসব বিষয়ে সাবলীলভাবে প্রত্যক্ষ অর্থবোধক শব্দাবলি ব্যবহৃত হয়েছে। তাই প্রসঙ্গক্রমে সেসব নিয়ে কথা বলা বা আলোচনা করার মধ্যে দোষের কিছু নাই। সমস্যা বা আপত্তির বিষয় হলো অনাকাঙ্খিত বা অননুমোদিত যৌনতা বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে এক ধরনের বিকৃত যৌন চর্চা করার প্রবণতা।
আসলে যৌনতা নিয়ে আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এক ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা বা ধারা ঐতিহ্যের নামে প্রভাব বিস্তার করে আছে। আমার দৃষ্টিতে ক্বওমী ও সরকারী মাদ্রাসা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগসমূহ হলো প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রচলিত ইসলামী সংগঠনগুলো হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ্য সিলেবাস কোরআন-হাদীস ভিত্তিক হলেও পরষ্পর হতে ভিন্নমুখী। কিন্তু কিছু বিষয়ে এই সবগুলো প্রতিষ্ঠানের অভিন্ন, অপ্রকাশ্য বা হিডেন সিলেবাস রয়েছে। যৌনতা বিষয়ে অতি সংবেদনশীলতার নামে নারী-বিরোধী নীতির ব্যাপারে ইনারা সবাই স্পষ্টতই একমত। উনাদের নারী বিষয়ক বক্তব্য কী হবে তা মুখস্ত বলে দেয়া যায়!
যৌনতা হলো খারাপ, অন্তত ক্ষতিকর! তাই এ কাজ যত কম করা যায়, যত দমন করা যায়, যত দমিয়ে রাখা বা ঠেকানো যায়- ততই ভালো! যৌনতা হলো মেয়েদের প্রথম বৈশিষ্ট্য! মুসলিম নারীর প্রথম (এবং একমাত্র?) দায়িত্ব হলো নৈতিক পবিত্রতা তথা যৌন অবদমন! নিজেকে বাঁচানো!- এ-ই হলো ইসলামিস্টদের যৌনতা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গী, আমার অভিজ্ঞতায়।
এ জন্য দেখি প্রায় সকল পর্দানশীন নারী এমন আচরণ করেন যাতে মনে হয় উনারা পুরুষমাত্রকেই সম্ভাব্য রেপিস্ট, অন্ততপক্ষে পটেনশিয়াল পার্টনার মনে করেন। এ ধরনের সদা-সতর্ক তথা অতি সংবেদনশীল নারীদেরকে ইসলামিস্ট পুরুষরা বেশ পছন্দ করেন। তাঁদের আলোচনার এটিই মূল সূর।
অনেক আগে কৃষণ চন্দরের একটা ছোট গল্প পড়েছিলাম- ‘কাচরা বাবা’। অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সাধু বাবা সামাজিক অভিযান চালাচ্ছেন। ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝাচ্ছেন । অশ্লীল বই-পুস্তক পোড়াচ্ছেন। একবার এ রকমের এক অগ্নি-উৎসবে তার এক তরুণ শিষ্য এক নারীর স্নানের দৃশ্য সম্বলিত একটা বই দেখে সেটি হস্তগত করার খুব লোভ করলো। সে পোড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বইটা খুঁজছে। কোনো হদিস পাচ্ছে না। হঠাৎ সে দেখলো সাঁই বাবার ঝোলার মধ্যে কিছু একটা ঝুলছে। ঠিক যেন সে বইটার মতো সাইজ …!
খ্রীস্টানরা রোববারে গীর্জায় গিয়ে সমবেত প্রার্থনার আগে একটা ছোট রুমে গিয়ে পাদ্রীর কাছে গত সপ্তাহে নিজ কৃত গুনাহের বর্ণনা দেয়। এ রকমের এক কনফেশানে এক লোক বলছে, ফাদার, আমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি! আমি পতিতার কাছে গিয়েছি! তখন পাদ্রী জিজ্ঞাসা করছেন, তুমি কোন্ পতিতার কাছে গিয়েছো? অমুকের কাছে? না। অমুকের কাছে? না। অমুকের কাছে? না। অতঃপর পাদ্রী বললেন, যাও, বেঞ্চে গিয়ে বস। প্রার্থনা শেষে গীর্জা থেকে বের হওয়ার সময় সে লোক ভাবল, যাক, আরো কয়েক জনের সন্ধান পাওয়া গেল… !
আমাদের ছাত্রজীবনে একজন শ্রদ্ধেয় ভাই বলেছিলেন- দেখেন, ম্যাডাম কতটুকু বেপর্দা বা মেয়েটি কতটুকু বেপর্দা, এটি দেখতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি পর্দা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। আমার এক ভাগ্নি বললো, মামা, একটা ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করে। কী করবো? তাকে বললাম, তুমি যদি ছেলেটাকে আসলেই অপছন্দ করো, তাহলে তাকে যে তুমি পছন্দ করো না, সেটিও তুমি তাকে বলবে না। কারণ, না বলাটাও এক ধরনের বলা, যা ‘হ্যাঁ’ হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়!
উল্টাপাল্টা, খারাপ মেয়েরা বা মেয়েদের যে খারাপ দিক সেসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মধ্যে বিষয়টা উপভোগ করার এক ধরনের অবচেতন পর্যায়ের [বিকৃত!] আনন্দ ও সুখ আছে। যৌনতা জীবনের অংশ। এ ব্যাপারে সহনশীলতা থাকা দরকার। অবদমন অবাঞ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্যের বল্গাহীন ভোগবাদীতা আর প্রাচ্যের অযৌক্তিক অবদমন- এ দুই চরমপন্থার মধ্যবর্তী ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের গড়ে তুলতে হবে।