ইসলামী সঙ্গীতের কোনো সর্বজনবিদিত সংজ্ঞা নেই। তবে সাধারণ চিন্তা অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের (সা) গুনগান, ইসলামী অনুশাসন, চেতনা ও মূল্যবোধআশ্রিত গানগুলোকেই ইসলামী সঙ্গীত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলা ভাষায় ইসলামী গানের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যাই হোক, একজন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আমি এখন পর্যন্ত ইসলামী সঙ্গীত নিয়ে অনেকের প্রশ্ন ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছি। মানুষের সেসব প্রশ্ন এবং বর্তমান সময়ের বিপুল প্রয়োজনকে সামনে রেখে, এ প্রবন্ধটি লিখছি। আশা করি ইসলামী গানের রচয়িতা, সুরকার, শিল্পী এবং অগণিত ভক্ত-শ্রোতা এ থেকে উপকৃত হবেন।
১) হালাল-হারাম দ্বন্দ্ব
ইসলামী সঙ্গীতের সর্বজনীন ও শক্তিশালী হবার পথে প্রথম বাধাটি হলো – বাদ্যযন্ত্রসহ গান হালাল নাকি হারাম, এই দ্বন্দ্বটি। অনেক শতাব্দীর প্রাচীন এই দ্বন্দ্ব আজো কোনো ফলপ্রসূ সমাধানে উপনীত হয়নি। পুরো মুসলিম বিশ্ব এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। একদল মনে করে, বাদ্যযন্ত্রসহ ইসলামে গান করবার কোনো সুযোগ নেই। এটি স্পষ্টত হারাম এবং গর্হিত অপরাধ। তারা সূরা লুকমানের ৬ নম্বর আয়াত ও বুখারী শরীফের একটি হাদীসকে এর রেফারেন্স হিসেবে উপস্থাপন করেন। অন্য দলটি মনে করে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের (সা) শানে মানুষের জযবা বৃদ্ধি ও সুস্থ বিনোদনের লক্ষ্যে বাদ্যযন্ত্রসহ ইসলামী গান হারাম নয়। তারাও অনেক হাদীস ও নবীজীর (সা) জীবন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। ইমাম গাজ্জালী থেকে বর্তমান সময়ের ইউসুফ আল কারযাভী ও তারিক রমাদানের মতো সেরা মুসলিম স্কলারগণ এর পক্ষে শক্ত যুক্তি তুলে ধরেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জ্ঞানের উপর বিশেষজ্ঞ বা স্কলার নই। তবে মুসলিম বিশ্বের এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান হওয়াটা আবশ্যক বলে মনে করি। সময়ের প্রেক্ষিতে ইসলামী জ্ঞানের সমস্ত উৎস বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে ঐক্যমত তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, ইসলামী সঙ্গীতের শিল্পী, সুরকার ও গীতিকারগণ এই দ্বিধার দরুন কুণ্ঠিত মনে, সংকীর্ণ চিন্তা থেকে অগ্রসর হয়ে থাকেন। এর ফলে সূচনা লগ্ন থেকেই গানটি তার জড়তা ও দুর্বলতা থেকে মুক্ত হতে পারে না। এরকম ভয়ার্ত ও শংকিত মনের উদ্ভাবন তাই আশানুরূপ সাফল্যও অর্জন করতে পারে না। দ্বিধাগ্রস্ত হৃদয়ে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ললিতকলার ধারাবাহিক উৎপাদন অসম্ভব।
২) সঙ্গীত সাধনা ও প্রশিক্ষণের অভাব
এটি একটি মারাত্মক রকমের সমস্যা। কারণ ইসলামী সঙ্গীত হোক আর যেকোনো সঙ্গীতই হোক, তা একটি নিরন্তর সাধনার বিষয়। বলা হয়ে থাকে – সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা। আসলেই তাই। গুরুর কাছ থেকে নিষ্ঠা সহকারে তালিম নেয়া ছাড়া সঙ্গীত শিক্ষার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, ইসলামের গানের শিল্পী, সুরকার, গীতিকাররা কেউই নিয়মবদ্ধভাবে সঙ্গীত শিক্ষা করেন না। অথচ শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনে সুর, তাল, লয়, রাগ-রাগিনী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে গান যতটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ও বিশ্বসঙ্গীতের তালিম নেয়াটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে এ কারনেই অন্যসব ইসলামী গানের রচয়িতাদের এতটা পার্থক্য। নজরুল এত বেশি সঙ্গীত শিখেছিলেন যে, তার প্রয়োগ-প্রণালীতেই শিল্পগুণ ঠিকরে বেরোয়। বাকিরা তার থেকে যোজন-যোজন পেছনে। পদার্থ, রসায়ন, আইন, গণিত বা সমাজবিজ্ঞানের মতই সঙ্গীত স্বতন্ত্র্য একটি বিদ্যা, এটা বুঝতে হবে। না শিখে, না জেনে শুধু আল্লাহর দেয়া মেধার উপর ভিত্তি করে গান করাটা মোটেও উচিত নয়।
৩) চিন্তার সংকীর্ণতা
কাজী নজরুল ইসলামের পর ইসলামী গানের বিষয়, ভাব, কথা ও সুরের ক্ষেত্রে কোনো বিপ্লব সাধিত হয়নি। সত্যি বলতে কি, এ বিষয়ে যে পরিমাণ জ্ঞান-গবেষণার প্রয়োজন ছিল, আমরা তার যোগান দিতে পারিনি। আরো সত্য হলো, সাহিত্য, সঙ্গীত, কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, চিত্রশিল্প কোনো কিছুকেই ইসলামী সংস্কৃতির স্পিরিটে শিল্পায়িত করবার প্রয়াস আমরা দেখিনি। চর্চা হয়নি তা নয়, হয়েছে; তবে তা এতোটা অপেশাদারভাবে যে, কালের অন্য শিল্প-সাহিত্যের সাথে তা পাল্লা দিতে পারেনি কোনোদিনই। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো চিন্তার সংকীর্ণতা। কোনো কিছু তৈরি করতে হলে, গ্রহণ করবার মত উদার ও সর্বজনীনতা থাকা চাই। বিশ্ব সাহিত্য ও শিল্পের ভালো দিকগুলো যদি পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমরা গ্রহণ করতে পারতাম, তবে এ রকম দেউলিয়াত্ব তৈরি হতো না। আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে মুখ ফিরাই, কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন হিন্দু। অথচ সেই রবীন্দ্রনাথ বাংলা সঙ্গীতের প্রধান সৈনিক, যিনি গান লিখেই নোবেল জয় করেছেন এবং বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা লালন শাহ থেকে মুখ ফিরাই, কারণ তার আকীদা আমাদের আকীদার সাথে মেলে না। কী অপূর্ব অজুহাত! অথচ লালন বাংলা বাউল সংগীতের শ্রেষ্ঠতম রচয়িতা। একইভাবে ধর্ম ও সংস্কৃতি আলাদা হবার জন্য আমরা বিটলস, ডিপ পার্পল, আইরন মেইডেন, পিংক ফ্লয়েড, জুডাস প্রিস্ট, মেটালিকা, মেগাডেথ, স্করপিয়ন্স, ড্রিম থিয়েটার, স্লেয়ার, এরিক ক্ল্যাপটন, ঈগলস, এপিকা বা অ্যাডেলদের গান সম্পর্কে জানার আগ্রহ পোষণ করি না। অথচ এটা কীভাবে সম্ভব যে, আপনি সাহিত্য রচনা করবেন; কিন্তু শেক্সপিয়র, টলস্টয়, গ্যেটে, চার্লস ডিকেন্স, পাবলো নেরুদা, কাফকা, ইবসেন, চেখভ, মোঁপাসা, দস্তয়ভস্কি বা জুলভার্নকে জানার চেষ্টা করবেন না! আসলে শিল্প-সাহিত্য এবং ললিতকলার কোনো দেশ-কাল-ধর্ম নেই। এটা অবাধ ও স্বাধীন এক পরিসীমা। বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে মহত্তম কারিগরদের রচনা ও উদ্ভাবন থেকে নিজেদের বঞ্চিত রেখে কোনো কল্যাণই আপনি অর্জন করতে পারবেন না। ইসলামী সঙ্গীতের উৎকর্ষ বিধানে, তাই বিশ্বসঙ্গীতের চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান-গবেষণাকে অপরিহার্য় মনে করি।
৪) পেশাদারিত্বের অভাব
আমি সরকারি চাকুরিজীবী হবো, ব্যাংকার হবো, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবো; প্রতি মাসে অগাধ অর্থ পকেটে পুরে নিরাপদে জীবন পার করব। আদর্শ থাকবে, বিপ্লব থাকবে; কিন্তু তার আগে পকেটভর্তি টাকা তো থাকা চাই। সমাজের পুঁজিবাদী ও বস্তুবাদী এই জীবনাদর্শ সব মানুষকেই আজ গ্রাস করেছে। সমাজ এমন এক নৈতিক ভিত্তি হাজির করেছে, যাতে মানুষ নিজেকে অর্থনৈতিক জীব হিসেবেই জ্ঞান করছে। ইহকালীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ-বিলাসের চিন্তা তাকে একপ্রকার বন্দী করে রেখেছে। যারা ইসলামী আদর্শের বুলি আওড়ান, তারাও এই বুর্জোয়া মানসিকতাকে পরিহার করতে পারেননি। ইসলাম থাকুক, সাথে বিশাল ব্যবসা, চমকপ্রদ চাকুরি, হ্যান্ডসাম স্যালারি, ভালো বাড়ি, দামী গাড়িও থাকুক। আসলে ধনী হওয়াটা দোষের নয়, তবে ধনের জন্য সুকুমারবৃত্তি ও শিল্পকলাকে খেদিয়ে বিদায় করাটা দোষের। আমি অনেকজনকে দেখেছি, যারা অনেক ভালো ইসলামী গান গাইতেন, লিখতেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের প্রশ্নে, তারা কেউ ব্যাংকার, কেউ আইনজীবী, কেউ সরকারি চাকুরিজীবী, আবার কেউ ব্যবসায়ী হয়েছেন। দুয়েকজন ছাড়া কেউই সঙ্গীতের জন্য জীবন বাজি রাখতে চাননি। দেশের কতগুলো শিল্পীগোষ্ঠী ইসলামী সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু পেশাদারিত্বের অভাবে তাদের প্রয়াস প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করছে না। অন্তত কিছু মানুষ যদি প্রফেশনালি গান করতে না চায়, তাহলে এই ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। ইসলামী ঘরানার লোকজন চাকুরিজীবী, ব্যাংকার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। অথচ বাম ঘরানার লোকজন সাহিত্য, সঙ্গীত, কবিতা, চিত্রশিল্প, চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি, মিউজিক ভিডিওসহ সকল প্রকার গণমাধ্যমের উপর আধিপত্য করে যাচ্ছে। পেশাদারভাবে এই ক্ষেত্রগুলোতে কাজ না করতে চাইলে কোনোদিনই প্রতিযোগিতায় জেতা যাবে না। কারণ শিল্প ও গণমাধ্যম ইতোমধ্যে বামদের পদানত।
৫) বিষয় বৈচিত্রের ঘাটতি
গানের বিষয়গুলো ঘুরে ফিরে এক জায়গাতেই আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। একজন শ্রমিক, পথশিশু, বৃদ্ধ বাবা, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য প্রেম, এতিম বালক, পরিবেশ দূষণ, মানুষের কর্মস্পৃহা তৈরি, দেশপ্রেম, জীব-জন্তু ও প্রাণীর প্রতি ভালবাসা, মরমী দর্শন, বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক চিন্তা থেকেও গান তৈরি করা যেতে পারে। আবার ইসলামের সোনালী যুগের ইতিহাস, যুদ্ধ, নবী রাসূলগণের সংগ্রাম এবং কোরআন-হাদীসের শিক্ষামূলক ঘটনাগুলো অবলম্বন করেও অনেক ভালো গান হতে পারে।
৬) গীতিকার ও সুরকারদের সীমাবদ্ধতা
আল্লাহ ও রাসূলের শানে গান তৈরি করলেই হলো, তাতে শিল্পমানের আবার কী দরকার – এরকম একটা মানসিকতা এ দেশের ইসলামী সঙ্গীতের গীতিকার ও সুরকারদের মাঝে বিরাজমান। ফলে গানগুলো যে ক্লিশে হয়ে পড়ছে, সেদিকে তারা কদাচিৎই নজর দেন। খেয়াল করলে দেখবেন, সত্তর-আশি দশকের ইসলামী গানের সাথে এ সময়ের ইসলামী গানের মৌলিক কোনো প্রভেদ নেই। সেই একই রকম ঢিমে তেতালা সুর আর নিষ্প্রাণ কথামালার উপর ভর করে চলছে ইসলামী গান। হ্যাঁ, দুয়েকজন সময়ের সাথে তাল মেলাবার চেষ্টা করছেন বটে। তবে সে চেষ্টাটাও মৌলিক নয়; বরং সামি ইউসুফ, মাহেরজেইন, নচিকেতা বা কবীর সুমনের অন্ধ অনুকরণ। কারো কারো ভেতরে এটা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে – মাহেরজেইন ও সামি ইউসুফই ইসলামী গানের শেষ কথা। তাদের মতো করে অ্যারাবিক স্কেলে, এথনিক কম্পোজিশান দাঁড় করালেই ইসলামী গান হয়ে গেল। কিন্তু সত্যি বলছি, সামি ইউসুফ, মাহেরজেইনরাও একটা পর্যায়ে এসে পুনরাবৃত্তির চর্চা করছেন। তাদের সুর ও বিষয়বস্তু একটা বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। নতুন কোনো চিন্তা তারা হাজির করতে পারছেন না। যাই হোক, সেটা তাদের ব্যাপার। আমি গীতিকার ও সুরকারদের বলতে চাই, ইসলাম সর্বাধুনিক ও ডাইনামিক একটি জীবনবিধান। ইসলাম এত বিপুল ও বিশাল যে, তা নিয়ে শিল্পচর্চা করতে গিয়ে আপনাকে কখনও এক জায়গায় আবদ্ধ থাকলে চলবে না। শুধু আল্লাহ তায়ালাকে নিয়ে গান করতে চাইলেও দেখবেন, তাঁর মাঝে এত বিপুলতা আছে যে, জীবনভর আপনি গান তৈরি করে যেতে পারবেন এবং কোনো গানই রিপিটেশান বলে মনে হবে না। এ জন্য আল্লাহ তায়ালাকে নিয়ে আমাদের চিন্তা ও উপলব্ধির জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাঁর অগণিত গুণ, অসংখ্য বৈশিষ্ট্য, সীমাহীন মহিমা! তাহলে আপনি কেন এক জায়গাতেই আবদ্ধ থাকবেন? গীতাঞ্জলীতে দেখবেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্রষ্টাকে কত বিচিত্রভাবে বর্ণনা করে গান তৈরি করেছেন। হয়তো রবীন্দ্রনাথ আর আপনার আকীদা ভিন্ন, কিন্তু তাঁর ভালো দিকগুলো অনুসরণে সমস্যা কোথায়? আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, গত দুই দশকে গোটা বিশ্বের মিউজিকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। লিরিক, কম্পোজিশান, সাউন্ড – সবই বদলে গেছে। এমনকি ভারতে মিথুন, অংকিত তিওয়ারি, জিৎ গাঙ্গুলী, এ আর রহমান, বিশাল শেখর, সাজিদ ওয়াজিদ বা অনুপম রায়রা যে মানের কাজ করছেন, তার সাথে তুলনা করলে ইসলামী সঙ্গীত হাজার মাইল পেছনে পড়ে আছে। আজ অরিজি সিং, কে কে, মোহিত চৌহান বা কোনালের গান সব মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করছে। অথচ আমরা ইসলামের শ্বাশ্বত বাণী নিয়েও তেমন হৃদয়স্পর্শী গান বা সুর তৈরি করতে পারছি না। জাহেলিয়াত এখানেও আমাদের হারিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। নিম্নমানের একঘেয়ে কথা ও সুর এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। অযোগ্যদের দিয়ে শিল্প সম্ভব নয় কোনোকালেই।
৭) শিল্পীর সীমাবদ্ধতা
আগেই বলেছি, সঙ্গীত অত্যন্ত কঠিন, সাধনানির্ভর ও গুরুমুখী বিদ্যা। শুধু আল্লাহর দেয়া কণ্ঠকে পুঁজি করে এগোতে চাইলে এ যুগে টিকে থাকা যাবে না। এখন প্রতিযোগিতা অনেক কঠিন। গায়কীর ক্ষেত্রে ট্যাকটিক্যালি নিখুঁত হতে যতগুলো স্কিল থাকা প্রয়োজন, তা কেবল গুরুর কাছ থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার মাধ্যমেই আয়ত্ব করা সম্ভব। যারা দুদিনের ভেতর স্টার হতে চান তাদের কথা আলাদা। সঙ্গীত শেখার কোনো শর্টকাট মেথড নেই। এটা পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দিয়েই আয়ত্ব করতে হয়। আমি দেখেছি, এই জগতের শিল্পীরা তালে ভীষণ কাঁচা। গাওয়ার সময় সুর ও নোটের প্রচুর হেরফের হয়। গলার রেঞ্জ খুবই ছোট। শুধু কণ্ঠের আবেগ দিয়ে গান করার চেষ্টাটা তাদের মাঝে দেখা যায়। আবেগকে গানের একমাত্র উপাদান প্রতিপন্ন করা মারাত্মক ধরনের ত্রুটি। তাই আশা করি, শিল্পীরা গুরুমুখী হয়ে গান শিখে তবেই গান গাওয়ার চেষ্টা করবেন।
৮) জ্ঞান-গবেষণার ঘাটতি
আগে তো সাহিত্যিক হতে হবে, নইলে ইসলামী সাহিত্যিক হবো কিভাবে? আগে কবি, তারপর ইসলামী কবি। তেমনি আগে সঙ্গীত তারপর ইসলামী সঙ্গীত। কিন্তু আমরা এই মেথড ফলো করি না। এক লাফে মগডালে উঠতে চাই। দুদিনে স্টার হতে চাই। একবার ভাবুন, ইসলাম আর সংস্কৃতি এই দুইটি প্রত্যয় কত বিশাল ও বহুমাত্রিক। এখন এ রকম বিশাল দুইটি প্রত্যয় নিয়ে যদি একযোগ কাজ করতে চান, তাহলে কতোটা প্রজ্ঞাবান, সচেতন ও পারদর্শী হতে হবে ভাবুন! ইসলামী কালচার প্রমোট করতে যারা ফিল্ম তৈরি করবেন, গান বানাবেন, গান গাইবেন বা সাহিত্য রচনা করবেন, তাদের এজন্যই দায়িত্বটা অনেক বেশি। যে শিল্প দিয়ে সাধারণ মানুষকেই জয় করা যায় না, সেই শিল্প দিয়ে মহান আল্লাহকে কী করে সন্তুষ্ট করবেন, একবার ভাবুন! এজন্যই বলছি, সবার উপরে জ্ঞান-গবেষণা ও পড়াশোনা থাকা দরকার অনেক বেশি।
৯) সঙ্গীতের রাজনৈতিকরণ
হুম! এই টার্মটা অদ্ভুত শোনালেও কিছু করার নেই। কারণ, অধিকাংশ ইসলামী সঙ্গীত তৈরিই হয় দলীয় চিন্তা থেকে। যদিও বলা হয়, আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের প্রতিদানের আশায় গান করি; কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই গান তৈরি করা হয় দলের নেতা ও কর্মীদের স্পিরিট ঠিক রাখার আশায়। আরো গভীরভাবে বললে রাজনৈতিক টার্গেট হাসিলের সাপ্লিমেন্ট হিসেবে যেটুকু সুস্থ বিনোদন দরকার সেটুকু সার্ভ করবার দায় পড়ে ইসলামী সঙ্গীতের উপর। নেতা কথা বলবার ফাঁকে, একটা গান হলে যদি জোশ পাওয়া যায়, তো ক্ষতি কী! যে কারণে ইসলামী সঙ্গীত আটকে পড়েছে দলীয় আওতা, ক্ষেত্র ও পরিসীমায়। দলীয় লোকজনই এর শ্রোতা এবং ভোক্তা। চিন্তা করুন, এরকমভাবে পলিটিসাইজড হবার পর, সেই ইসলামী সঙ্গীতের আর কতটুকু প্রাণশক্তি ও শিল্পগুণ অবশিষ্ট থাকতে পারে? কিন্তু সত্য এটাই, ইসলাম কোনো একটি দলের জন্য নয়, আর তার আদর্শ ও সংস্কৃতিও কোনো দলীয় সীমায় আবদ্ধ থাকতে পারে না। সুতরাং ইসলামী সঙ্গীতকেও সর্বজনীন, উদার, গণমুখী করে তুলতে হবে।
উপসংহার
ইসলামী সঙ্গীতের সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি আমি আলাদাভাবে কোনো সমাধান আলোচনা করলাম না। কারণ, প্রতিটি পয়েন্টের সাথে সমাধানের পথও তুলে ধরেছি। তবে এই লেখাই যে উত্তরণের একমাত্র উপায় হবে, তা নয়। আরো অনেকভাবেই সমাধান আসতে পারে। এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপ শুরু হোক, এটাই আমার উদ্দেশ্য। কারণ, ইসলামী সঙ্গীতের পাশাপাশি সমস্ত আর্ট কালচারের জগতে একটা বৈপ্লবিক ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসা জরুরি। ইসলামী সংস্কৃতির সুমহান আলোতে বিশ্বমানবতা আলোকিত হোক, এটাই আমার চাওয়া।