নিজে জীবনে অনেক ইতিহাস পড়ে বুঝলাম, ইতিহাস হলো বড় শিক্ষক। মানুষ কী কী ভালো কাজ করেছে এবং সেটা কারা করেছে, তাদের কী যোগ্যতা ছিল, কোন কোন পরিস্থিতিতে সফল হওয়া যায়, তা ইতিহাস পাঠে জানা যায়। এখানে ব্যক্তিগত একটা বিষয় থাকে যে- সংশ্লিষ্ট মানুষটা কত যোগ্য। আবার পরিস্থিতির একটা ব্যাপার থাকে। অনেক সময় যোগ্য লোকও পরিস্থিতির কারণে অনেক কিছুই করতে পারেন না।
পরিস্থিতি অনুকূল হলে কম যোগ্য লোকও পারেন। এগুলোর ইতিহাস পড়লে আমরা জানতে পারি, যারা বড় কিছু অর্জন করছেন, তাদের কী কী যোগ্যতা ছিল এবং তাদের সময়ের পরিস্থিতিটা কেমন ছিল। তেমনিভাবে মানুষের ব্যর্থতাগুলো জানা যায়। ব্যক্তির দোষের কারণে কী কী বিষয়ে ব্যর্থ হচ্ছেন, আবার পরিস্থিতির কারণে কারা কারা ব্যর্থ হয়েছেন ইতিহাসে তা জানা যায়। কাজেই ইতিহাস একটা বড় শিক্ষক। যেসব বিষয় অবশ্যই পড়তে হবে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে সাহিত্য, আরেকটা ইতিহাস। আরো অনেক কিছু আছে, যেটা পড়তেই হবে। সাহিত্য জীবনের দর্পণ। তা পড়ে একটা সমাজ কেমন ছিল, তা জানা যায়। এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, শরৎচন্দ্র পড়লে আমি শুধু উপন্যাস পড়লাম। তা নয়, ভিন্ন সমাজকেও বুঝতে পারলাম। ওই সময়ের হিন্দুসমাজের দ্বন্দ্বগুলোও বুঝলাম। একই কথা সত্য সবার ক্ষেত্রে। শেকসপিয়র পড়লে আমরা জানতে পারি, ওই সময়ের সাহিত্যের উপজীব্য কী ছিল? সেই সমাজ কেমন ছিল? সেখানে বড় লোকেরা কেমন ছিল? সাধারণ মানুষ কেমন ছিল? কী কী ধরনের প্রশ্ন তাদের সামনে ছিল?
আমাদের ইতিহাস ও সাহিত্য, দুটোই লাগবে। অথচ এ দুটোর চর্চাই ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ধর্মের বিষয়ে পড়াশোনা নেই। ধর্মকে তো ফিলোসফিই বলা যায়। এটাও মানুষ পড়ছে না। সাহিত্য এবং ইতিহাসও কম পড়ছে আগের তুলনায়। তারা পড়ছে বিজনেস। আর অবশ্যই সায়েন্সে বা বিজ্ঞান শিখছে, যে সায়েন্সের মাধ্যমে টেকনোলজি তৈরি করা যাবে; যে সায়েন্সের মাধ্যমে বিশ্বের প্রকৃতি জগতের অনেক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে; যার সূত্র বের করা যায়, কারণগুলো জানা যায়। কিন্তু তার পরও শুধু সায়েন্স আর বিজনেস পড়ে মানুষ হওয়া যায় না। এর দ্বারা রোবট হওয়া যায়। বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ কিন্তু কম-বেশি প্রায় রোবট। হতে পারে, ব্যতিক্রম এখনো আছে বিশেষত এশিয়ার কিছু দেশে। কিংবা যদি বলি মুসলিম ওয়ার্ল্ডের কথা, আফ্রিকার কিছু দেশ; এখনো তারা রোবট হয়ে যায়নি। কিন্তু বাকি বিশ্ব প্রায় রোবট হয়ে গেছে। ইউরোপ প্রায় রোবট হয়ে গেছে। আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া প্রায় রোবট হয়ে গেছে। এই হচ্ছে অবস্থা। আমরা তো রোবট চাই না। তাহলে আমাদের ফিলোসফি বা ধর্ম পড়তে হবে; সাহিত্য ও ইতিহাস পড়তে হবে।
ইতিহাস বিকৃত করা যায় না। ইতিহাসের ওপর কোনো যোগ-বিয়োগ করা যায় না। ইতিহাস হচ্ছে, যা ঘটেছে এবং কারা ঘটিয়েছে তাদের কথা; কী ঘটেছিল এর বর্ণনা। এটা সাহিত্য নয়। এখানে গল্প বানানোর কোনো অবকাশ নেই। ইতিহাস আর সাহিত্য এক নয়। ইতিহাস অবশ্যই সত্য ঘটনাভিত্তিক হতে হবে। এখানে আমাদের পছন্দমতো বাড়িয়ে দিলাম বা কমিয়ে দিলাম- এগুলো চলবে না।
মনে হচ্ছে, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একটা ব্যর্থতা হলো, এখানে সেকুলারিজম থেকে অনেক কিছু আসছে। মানুষ রোবট হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার কারণে। আধুনিক সভ্যতার মূলভিত্তি সেকুলারিজম। এটা ‘এনলাইটেনমেন্ট’ মুভমেন্টের ফল। এই মুভমেন্টের দু’টি কথা ছিল। একটা হলো, খোদায়ী কোনো ব্যাপারে আমরা জড়িত নই এবং সব হচ্ছে ইহজাগতিক ব্যাপার। আরেকটা ব্যাপার ছিল, তাদের ‘র্যাশনালিজম’। অর্থাৎ সব কিছু যুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এখানে ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার নেই এবং রাষ্ট্রের সাথে এগুলোর কোনো যোগাযোগ নেই। এ ধারণা থেকেই একসময় ‘সেকুলারিজম’ শব্দটা জনপ্রিয় হয়। এর ফলেই ক্রমে ক্রমে মানুষের শিক্ষা থেকে ধর্ম বাদ পড়ে গেল। বিশেষ করে পাশ্চাত্যে এটা বাদ পড়ে যায় এবং নৈতিকতার গুরুত্ব কমে যায়। ফলে আর ধর্মীয় বিষয় অধ্যয়নের গুরুত্ব রইল না।
পরবর্তী সময়ে আরো দেখা গেল, তারা এই স্বার্থপরতার মধ্যে বলতে লাগল, টাইম ইজ মানি। তার মানে, সময় অন্য কোনো কাজে নষ্ট করা যাবে না; অর্থোপার্জনের কাজেই ব্যবহার করতে হবে। যা দিতে হবে ‘মানি’র জন্য দিতে হবে। তা-ই যদি হয়, তাহলে আমাকে ব্যবসায় শিখতে হবে বেশি করে; যা অর্থ দেয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা করতে গিয়েই মানুষ বিজনেস সায়েন্সে চলে গেল। পিওর সায়েন্স, টেকনোলজির সাইডে ছিল কিছুটা। কোনোটাই খারাপ না যদি সব কিছু মিলে হতো এবং ধর্ম ও নৈতিকতাকে সাথে নিয়ে যদি করা হতো। কিন্তু ধর্ম বাদ দেয়ার কারণে এগুলো একেবারে একপেশে, একতরফা ও একমুখী হয়ে গেল। এসব কারণেই মানুষ শেষ পর্যন্ত রোবট হয়ে যাচ্ছে; আমাদের ছেলেমেয়েরাও। যখন তরুণ ছেলেমেয়েদের দেখি, মনে হয় না যে, তাদের জীবনে কোনো উচ্চ লক্ষ্য আছে। তাদের সামনে লক্ষ্য হচ্ছে, একটা সুন্দর মেয়েকে কিংবা সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। ঘুরে বেড়াতে হবে, মজা করতে হবে। খাওদাও, ভোগ করে মরে যাও। এর চেয়ে উত্তম কোনো লক্ষ্য শিক্ষাব্যবস্থাও দিচ্ছে না। সায়েন্স, বিজনেসে কোথাও নেই হায়ার মোরাল কোর্স। এটা আছে একমাত্র রিলিজিয়ন অথবা এথিকসে। আর ইতিহাসে কিছু পাওয়া যায়; সাহিত্যে পাওয়া যায়। কাজেই মানুষ রোবট হয়ে গেছে এবং হচ্ছে।
যদি এর থেকে ফিরে আসতে হয়, ধর্মেই ফিরে আসতে হবে। এটা বলে বোঝাচ্ছি না যে, ধর্ম বলতে ইসলাম সবখানেই। অবশ্যই ইসলাম চাই। তার পরও বাস্তববাদী বলেই মনে করি, যেখানে হিন্দু ধর্মই প্রধান, সেখানে হিন্দু ধর্মেই ফিরে আসতে হবে। বৌদ্ধদের বৌদ্ধ ধর্মের দিকেই ফিরে আসতে হবে। খ্রিষ্টানদের ফিরে আসতে হবে খ্রিষ্টান ধর্মের দিকে। কেননা, কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। যদি পরিবর্তন চাই, তাহলে সবখানেই ধর্মের দিকে ফিরে আসতে হবে। কেননা, আমরা মুসলিম বিশ্বে হয়তো করলাম কিছুটা; কিন্তু আমরা তো বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে পারব না। টিকতেও হয়তো পারব না। এ জন্য বিশ্বব্যাপী দরকার একটা আন্দোলন ধর্মে ফিরে যাওয়ার। খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের যদি এ রকম উদ্যোগ থাকে, এটাকে স্বাগত জানাই। তবে বিজেপির মতো হওয়া উচিত নয়, যেখানে মুসলিমবিরোধী একটা চেতনা আছে। বরং এ রকম হতে হবে যে, হিন্দু ধর্মের প্র্যাকটিস তারা পুরোপুরি করবেন। নৈতিক মূল্যবোধ পুরাপুরি নেবেন, আইন থাকলে তাও নেবেন। কিন্তু অন্য ধর্মের লোকেদের তারা মানবাধিকার দেবেন। ইসলামের ক্ষেত্রে একই কথা। এ রকম হওয়া সম্ভব। পোপ বর্তমানে যেসব কথা বলছেন, তা এ রকমই। ব্যাক টু ফ্যামিলি ভ্যালুস, রিজেক্ট সেকুলারিজম- এ রকম কথাই বলছেন তিনি। ইংল্যান্ডের চার্চ অব ক্যান্টারবারি এ কথাই বলছেন।
কারণ, হয়তো বস্তুবাদ, সেকুলারিজম ও নাস্তিকতার প্রভাব তারা বেশি অনুভব করছেন। তার প্রভাব এই রোবটের মতো লোকগুলোর ওপর কতটা পড়বে, যদি মৌলিক শিক্ষা সংশোধন না করা হয়? হ্যাঁ, তারা পারবেন যদি তাদের দাওয়াত খুব বেশি হয়। তাদের সত্যিকার মুভমেন্ট, সেখানে দাওয়াত থাকবে, যেমন আমরা বলি দাওয়াতের কথা। যেমন- ইসলামপন্থীরা যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন, তারা বলে থাকেন আমাদের দাওয়াত দিতে হবে, লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। আমরু বিল মারুফ বা সৎ কাজের আদেশ প্রদান করতে হবে। নেহি আনিল মুনকার অন্যায় কাজে নিষেধ করতে হবে। খ্রিষ্টান ধর্মের তাৎপর্যও এটাই। ইসলামে বলা হয়েছে আমরু বিল মারুফ, কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মে এই মূল কথাটা যে নেই, তা বলা যাবে না। নিশ্চয়ই ঈসা আ: চেয়েছেন, ধর্মের কথা অন্যদের বলো। চার্চের এ ব্যাপারে দায়িত্ব¡ অনেক।
তাদের ভালো লোকদের অনেক দায়িত্ব¡ আছে এটা করার জন্য। গোটা বিশ্বেই ব্যাক টু রিলিজিয়ন, ব্যাক টু মোরালিটি, ব্যাক টু এথিকস- এটা হতে হবে। না হলে মানবজাতির মুক্তি নেই। মানুষ একেবারেই বর্বর, স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে। প্রতারক, বাটপাড় ও লোভী হয়ে যাচ্ছে। জাতির ওপর জাতির অত্যাচার, ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির অত্যাচার, শ্রেণীর ওপর শ্রেণীর অত্যাচার। ‘সব সম্পদই একমাত্র আমেরিকার’- এটা কী করে হলো? এটা তো অত্যাচারেরই অন্য নাম। কাজেই অনেক মৌলিক প্রশ্ন এর সাথে জড়িত। আমাদের দেশে ইতিহাস চর্চা হচ্ছে না, তা বলব না। হচ্ছে এই অর্থে যে, আমরা যে ইতিহাস পড়ি, উপমহাদেশের যে ইতিহাস পড়ি, কম-বেশি কিছু ভালো লেখক আছেন যারা সেটা লিখছেন। তবে কিছু লেখক হয়তো বা বিকৃত করছেন। বেশির ভাগ লেখকই ভালো লিখেছেন। কিন্তু আমাদের ইতিহাসের কোথাও কোথাও যেসব বিকৃতি চলে আসছে, সেসব দূর করতে হবে। এটা করতে হবে একদল সাহসী লোককে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে জন্ম নিয়েছেন, এমন লোক তা করতে পারবেন, আগের লোকেরা পারবেন না।
ইতিহাস আপন গতিতে চলে; এটা এই অর্থে ঠিক যে, কোনো এক ব্যক্তি ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ইতিহাসে কোটি কোটি লোক জড়িত। তাই একটা ছোট গোষ্ঠী এটা বদলাতে পারবে না। রেকর্ডিং ভুল হতে পারে; কিন্তু কেউ না কেউ সেই রেকর্ডিং চ্যালেঞ্জ করবেন। যেমন আওরঙ্গজেব নিয়ে অনেক কথা আছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হিন্দু ঐতিহাসিকেরাই বলছেন, এগুলোর অনেক কিছুই মিথ্যা। মনে করি, ইতিহাস নিজের গতিতে চলে এই অর্থে যে, কোনো এক ব্যক্তি এটাকে বদলাতে পারে না। কারো হাতে এটার নিয়ন্ত্রণ নেই। একটা পার্টিও এটা নিয়ন্ত্রণ করে না। কোটি লোকের যে একটা গতি, কোটি লোকের যে একটা মিলিত চিন্তা, এর প্রতিফলন ঘটবেই।
আমার মনে হয়, ইতিহাস আমাদের পড়ানো হচ্ছে না। এসএসসিতেও ইতিহাস খুব ভালো করে নেই। তাদের বোধ হয় সীমাবদ্ধতাও আছে, এত সাবজেক্ট; কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়াবে। কিন্তু ইতিহাস পড়তে হবে। কিছু হলেও পড়তে হবে। ওপরের দিকে ইতিহাস থাকতে হবে। গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে যে সাবজেক্টই পড়ুক, একটা অংশ ইতিহাসের ওপর পড়া উচিত। শুনেছি, হার্ভার্ডে যে সাবজেক্টেই পড়–ক, ইতিহাস যেহেতু বেসিক একটা নলেজ, এটা পড়তে হবে। এখন আমাদের কোনো কোর্স যদি এক শ’ ত্রিশ ক্রেডিটের হয়, তার মধ্যে আমরা যা পড়াচ্ছি, সবটাই পড়ালাম। কিন্তু অর্ধেক অর্থাৎ ৬৫ ক্রেডিটে পড়ালাম। বাকিটা আমরা দশ সাবজেক্ট পড়ালাম। তাহলে একটা ব্যাপক উপলব্ধি হবে। কিভাবে করতে হবে, কবে হবে, জানি না। কিন্তু করতে হবে। ইতিহাস ও সাহিত্যকে উপেক্ষা করা যাবে না।
ঐতিহাসিকভাবেই মানতে হবে, কালচারের ভিত্তি ধর্মই ছিল। এটা না মানা মানে, বাড়াবাড়ি। হিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্ম প্রাথমিকভাবে। মুসলিমদের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম, আর অন্যরা মাইনর গ্রুপ। খ্রিষ্টানরা তো অনেক পরে এসেছে। বৌদ্ধ ধর্মই বৌদ্ধদের কালচারের ভিত্তি ছিল। পরবর্তী সময়ে একটা কালচার এসেছে পশ্চিমাদের থেকে। সেটা সবাইকে কম-বেশি প্রভাবিত করছে। ড্রেস প্যাটার্নে ভাষায়, বিনোদনে প্রভাব পড়েছে। খেলাধুলায় প্রভাব রাখছে। চিন্তায় হয়তো বা প্রভাব ফেলছে। যেটুকু ভালো এটুকু হয়তো বা বাদ দেয়া যাবে না। কিন্তু যা মন্দ তা গ্রহণ করা উচিত নয়।
তাই আমাদের বর্তমান কালচারে একটা মিশ্রণ ঘটছে। দেশে একটা মিক্সড কালচার সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে, যেন এখানে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম মিশে যায়। অথবা এর কাছাকাছি যেন চলে আসে ধর্ম হিসেবে। এখানে ‘মঙ্গলপ্রদীপ’ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হবে। আর্ট কলেজ বেসিক্যালি হিন্দু থট-ভিত্তিক বা হিন্দু প্র্যাকটিসভিত্তিক হবে। কিন্তু আমি মনে করি, মানুষের মৌলিক পরিচয় হচ্ছে ধর্ম। কুরআনও তাই বলে। আল্লাহ পাক সূরা বাকারায় বলেছেন, ‘লা তামুতুন্না ইল্লা ওয়া আনতুম মুসলিমুন’- তোমরা মৃত্যুবরণ কোরো না, যতক্ষণ না তোমরা মুসলিম হয়েছো।’ অবাক লাগে, আল্লাহ তায়ালা বললেন না যে, আমেরিকান বা পাঞ্জাবি বা ভারতীয় না হয়ে মরো না।
কিংবা বাঙালি না হয়ে মরো না। এটা প্রমাণ করে- রাব্বুল আলামিনের কাছে মূল পরিচয় হচ্ছে মুসলিম পরিচয়। হিন্দু ধর্ম একজন হিন্দুর আসল পরিচয়। এই পরিচয়ের ভিত্তিতে যদি বাংলাদেশে দুটো কালচার থাকে, তাতে সমস্যা নেই। এক রাষ্ট্রে কয়েকটা কালচার থাকতেই পারে। ভারত এক রাষ্ট্র হলেও অন্তত বিশটা ভাষা আছে সে দেশে। কী সমস্যা এতে? যে ভাষা বেশি চলে, সেটা রাষ্ট্রভাষা হলো। ইসলাম যারা মানেন না, মুসলিম আইডেন্টিটির মধ্যে যেকোনো রকম আপস নেই, এটা তারা বুঝতে পারেন না। আমার একাধিক আইডেন্টিটি আছে। আমি কিশোরগঞ্জের মানুষ এবং একই সাথে বাংলাদেশের মানুষ; একই সাথে বাংলাভাষী। এটা মানতে পারছেন না তারা। এখানে তারা মিক্সড আপ করতে চাচ্ছে। অথচ এটা অযথা। কাজেই ভিন্ন কালচারকে মেনে নেয়াই ভালো। কিন্তু একদল সেকুলার ইচ্ছা করে ইসলামকে দুর্বল করার জন্য বাঙালি কালচার এবং বাঙালিত্বকে বড় করে দেখাচ্ছেন। বাঙালিত্বও একটা বিষয়।
কিন্তু এটা মৌলিক নয়। বিশ্বাস যেমন মৌলিক, এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আখিরাতে বিশ্বাস যেমন মৌলিক, কোন ভাষায় কথা বললাম এটা অতটা মৌলিক নয়। বিশ্বাসই মানুষের কার্যকে ও সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই বিশ্বাস আসে ধর্ম থেকে। যে মূল্যবোধ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা আসছে ধর্ম থেকে। আমি কী মাছ খেলাম, এটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। কোন্ দেশের তৈরি সবজি খেলাম, এটা আমার জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। কিন্তু এটাকেই কিছু লোক প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। এ বিষয়টাকে মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ করা দরকার। এটা করছের মূলত তারা, যারা ইসলামকে সহ্য করতে পারছেন না। এটা করছেন যারা নাস্তিক বা নাস্তিকদের কাছাকাছি, তারা। যারা বামপন্থী, যারা না বুঝে মনে করছেন আমাদের আর কিছু করার নেই, এখন ইসলাম বিরোধিতাই আমাদের একমাত্র কাজ।
যেহেতু আমাদের কিছু করার নেই, আমরা কী প্রতিষ্ঠা করব? সোস্যালিজম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়; কমিউনিজম সম্ভব নয়। তাহলে আমরা কাজ নিলাম ইসলামবিরোধিতা করার- এমন মনোভাব। তাদের যে ব্যর্থতা, তারা তা মানতে পারছেন না। তাদের উচিত ছিল ইসলামকে বিচার-বিবেচনা করা। তারপর যদি এটা গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে গ্রহণ করা। কিন্তু সেই বিচার তারা করতে পারছেন না। কারণ অন্ধ বিদ্বেষ দ্বারা তারা পরিচালিত। নিজেদের পরাজয় তারা মানতে পারছেন না।
ইসলাম বলে মুনকার বা মন্দকে গ্রহণ করো না। শিরক আর ফাহেশা গ্রহণ করো না। এই তিনটা জিনিসকে বর্জন করে আমরা অন্য কিছু নিতেও পারি সাবধানতার সাথে; যদিও নেয়া কোনো বিজয়ী জাতির পরিচয় নয়। বিজয়ী জাতি নিজে উদ্ভাবন করে। ভারত থেকে যে কালচারটা আসছে, তার অর্ধেক হচ্ছে শিরকভিত্তিক, আর অর্ধেকটা ওয়েস্টার্ন- এটা মুম্বাই হয়ে আসছে। এই দুটোই মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অবস্থাটা এ রকম যে, ওরা জিততে পারছে না। কিন্তু আমরাও জিততে পারছি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আস্তে আস্তে হলেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসার হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেও দেখছি, ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটছে। এটা চূড়ান্ত পর্যায়ে বিজয়ী হবে।
বামপন্থীদের ভিত্তিটা দুর্বল। পজিটিভ কোনো ভিত্তি নেই। ‘লা ইলাহা’ শুধু চলে না ‘ইল্লাল্লাহু’ ছাড়া। তাদের শুধু লা ইলাহা আছে, লা ইসলাম আছে; কিন্তু এ তার পরিবর্তে কিছু নেই। সেকুলারিজম কোনো পজিটিভ আইডিয়া নয়। এটা বলে, ‘ধর্ম থাকবে না রাষ্ট্রে।’ ডেমোক্র্যাসি ইসলামেও আছে। স্টাইলে সামান্য কিছু বেশি-কম হতে পারে। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে জিতে যাবেন ইসলামপন্থীরা, যদি তারা অনেকটা তিউনিসিয়া ও মিসরের মতো বুদ্ধিমান হন।
মনে হয়, অনেক সময় চলে গেছে। রাসূল সা:-এর পরে চৌদ্দো শ’ বছর চলে গেছে। উনিশ শ’ সাতচল্লিশের পরে এখানে প্রধানত মুসলিম আইডেন্টিটি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একটা অন্ধ জাতীয়তাবাদ চলে এলো। সেটা আমাদের মুসলিমত্ব কমিয়ে দিলো। কমিউনিস্টদের সফলতা হচ্ছে, তারা আমাদের মুসলিমত্ব ভোলাতে ও কমাতে পারছেন। তবে এখন তাদের এই প্রচেষ্টা থমকে গেছে এ কারণে যে, ইসলামিস্টরা আবার কম- বেশি জেগে উঠেছেন। তাদের মধ্যে ছোট হলেও একটা ইন্টেলেকচুয়াল গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই ইন্টারন্যাশনাল ইন্টেলেকচুয়াল গ্রুপের প্রভাব পড়ছে।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার