মক্কার জীবনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শত্রু ছিল পৌত্তলিকরা। কারণ, মক্কার অধিকাংশ অধিবাসীই ছিল পৌত্তলিক। ওরা নিজেদেরকে দীনে-ইবরাহীম তথা হযরত ইসমাঈলের আ. বংশধর এবং ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করতো।
মদীনায় আসার পর মোকাবেলা শুরু হলো প্রধানত: ইহুদীদের সাথে। মদীনার ইহুদীরা ছিল জনসংখ্যায় অনেক, বিদ্বান ও ধনাঢ্য! এদের মধ্যে অনেক বড় বড় আলেম ছিলেন। তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় কিতাবাদী পাঠ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, আখেরী নবীর আবির্ভাবকাল সমাগত এবং প্রবল সম্ভাবনা যে, প্রত্যাশিত নবী ইয়াসরাব ভূমিতেই হিজরত করে আসবেন। অনেক সাধু-সন্ত ব্যক্তি অন্য দেশ থেকে মদীনায় এসে বসবাস করতেও শুরু করেছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সত্য সত্যই যখন আল্লাহর নবী আসলেন, তখন তাঁকে সরল মনে মেনে নিতে তারা ব্যর্থ হলো। জাতিগত অহমিকাই তাদের জন্য সত্য মেনে নেওয়ার পথে কাল হলো! ইহুদীদের বড় বড় পন্ডিত এবং সাধু-সন্তরা আসতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মত-বিনিময় করতেন। কিন্তু একই কথা বলে সরে যেতেন যে, প্রতিশ্রম্নত নবী আসার কথা হযরত ইসহাকের (আ.) বংশধারায়, আর বর্তমান এই নবীর জন্ম হয়েছে হযরত ইসমাঈলের (আ.) বংশধারায়। এটা আমরা ইসরাঈল-সন্তানরা মেনে নিতে পারি না। নবুওত হচ্ছে হযরত ইসহাকের আওলাদদেরই হক। উল্লেখ্য যে, ইসহাকের জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন ইয়াকুব (আ.), আর তাঁরই আর এক নাম ছিল ইসরাঈল। এর নাম অনুসরণ করেই ইহুদীরা নিজেদেরকে ‘বনী-ইসরাঈল’ বলে অভিহিত করে থাকে।
মদীনায় হিজরত করে আসার পর থেকেই আমাদের প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ইহুদী পন্ডিতদের নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, কখনও কথা কাটাকাটি বা বাহাস-বিতর্ক অব্যাহত ছিল। তর্কে টিকতে না পেরে ওরা হযরত নবী করীম সা.কে গালিগালাজ করতো। ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো। আবার অনেক সময় নানা জটিল প্রশ্নও করে বসতো। ওদের ধারণা ছিল, এসব ধর্মীয় তত্ত্বকথার জ্ঞান কেবলমাত্র তাদেরই জানা আছে। মক্কার পৌত্তলিকদের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী অক্ষর জ্ঞানহীন ‘উম্মী’ নবীর পক্ষে এসব তত্ত্বকথার জবাব দেওয়া সম্ভব হবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওদের নানা প্রশ্নবানে বিব্রত হতেন। ওদের শত্রুতা ও মুনাফেকীর কারণে মনে কষ্ট পেতেন। কিন্তু মন খারাপ করতেন না। পরম ধৈর্যের সাথে ওদের সব প্রশ্নের জবাব দিতেন। তাঁর জ্ঞানের উৎস ছিল স্বয়ং আল্লাহর আরশ-মুয়াল্লা! যে কোন জটিল প্রশ্নের জবাব হযরত জিবরাঈল তাৎক্ষণিকভাবে এসে বলে দিতেন। ফলে তত্ত্বজ্ঞানের গর্বে গর্বিত ইহুদী পন্ডিতদের হতাশ হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকতো না।
ইহুদীদের নানা অবান্তর বক্তব্যের জবাবে এক পর্যায়ে আল্লাহপাক এরশাদ করলেন- ‘তোমরাই সেই শ্রেষ্ঠ মানব সমাজ, যাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে মানব জাতির পথ প্রদর্শনের লক্ষ্য নিয়ে। তোমরা মানুষের মধ্যে মহত্ত্বের শিক্ষা বিস্তার করবে এবং অন্যায় পথ থেকে মানুষদেরে বিরত রাখবে। আল্লাহর উপর কিভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, সে পথও তোমরাই দেখাবে।
প্রাচীন গ্রন্থধারীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারতো, তবে নিঃসন্দেহে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো! ওদের কিছু সংখ্যকের মনে ঈমানের আলো রয়েছে, তবে এদের অধিকাংশই পাপাচারি। এরা সাময়িক একটু বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া আপনার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। যদি এরা আপনার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে আসে, তবে পিঠ দেখিয়ে পলায়ন ছাড়া ওদের আর কোন গত্যন্তর থাকবে না। এরা কারো নিকট থেকে কোন সাহায্যও পাবে না। জিলস্নতি এবং যাযাবর জীবন এদের ভাগ্যলিপি করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ যদি কখনও ওদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন না করেন বা অন্য কোন মানব সমাজের সাহায্য-সহানুভূতি যদি ওরা না পায় তবে ওদের উত্তরণের পথ থাকবে না। এদের ভাগ্যলিপি করে দেওয়া হয়েছে অভিশপ্ত ও অস্থিতিশীল জীবন। এই দশা এদের এ জন্য হয়েছে যে, এরা কুফুরির পথ বেছে নিয়েছে এবং নবীগণকে পর্যন্ত অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। এভাবেই এরা পাপে লিপ্ত এবং সীমালঙ্ঘন করেছে। (সূরা আলে-ইমরান-১১০-১১২)
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগে-ভাগে জানিয়ে দেওয়ার পরও প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। ওদের বুঝাতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু ওদের হঠকারী মনোবৃত্তির কোনই পরিবর্তন হতো না। একবার ইহুদী পন্ডিতদের একটি দল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে বলতে লাগলো, আমরা আজ কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছি। যদি এই প্রশ্নগুলির যথার্থ জবাব দিতে পারেন তবে আমরা আপনার ধর্মমত নিয়ে বিবেচনা করে দেখবো।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যদি তোমাদের প্রশ্নের জবাব যথার্থ হয় তবে আমার দ্বীন তোমরা মেনে নিবে কিনা, তা আগে বল!
ওরা বললো, আমরা আল্লাহর নামে শপথ করছি যে, যদি আপনার জবাব যথার্থ হয় তবে আমরা অবশ্যই আপনার কথা মেনে নিব; আল্লাহর নামে শপথ করলাম!
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের প্রশ্নগুলি কি তা উত্থাপন করতে পার।
এরা প্রথম প্রশ্ন করলো, বলুন তো, পিতার বীর্য থেকে সন্তানের জন্ম হয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের চেহারা-ছূরত ও গাত্রবর্ণ পিতার মতো না হয়ে মায়ের মত হয় কেন?
নবীজী সা. বললেন, সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে পিতা এবং মাতা উভয়ের শুক্র কার্যকর থাকে। পিতৃবীর্য সাদা এবং গাঢ় হয় আর মাতৃবীর্য পাতলা ও বাদামী বর্ণের হয়। যার শুক্র প্রবল থাকে সন্তান সাধারণত: তারই অবয়ব ও গাত্রবর্ণের হয়ে থাকে।
প্রথম প্রশ্নটির জবাব শুনে পন্ডিতেরা মুগ্ধ হলেন। বললেন, আল্লাহর কসম! এমনটিই হয়ে থাকে।
ওরা দ্বিতীয় প্রশ্ন উত্থাপন করে বললেন- বলুন তো, আপনার নিদ্রা কেমন হয়?
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন, তোমাদের তো নবীগণের নিদ্রা সম্পর্কে জানা থাকার কথা! তবুও শুন! আমার দু’চোখ নিদ্রিত হয়, কিন্তু অন্তর জাগ্রত থাকে।
ওরা বললেন, নবীগণের নিদ্রার স্বরূপ এমনটিই হয়ে থাকে। একথাটাও আমরা আল্লাহর শপথ করেই বলতে পারি!
এরপর এরা জানতে চাইলেন যে, বলুন তো, আল্লাহর নবী হযরত ইয়াকুব কোন কোন হালাল বস্ত্ত নিজের জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন?
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন, তোমাদের অবশ্যই জানা আছে যে, হযরত ইয়াকুবের আ. সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাদ্য ছিল উটের দুধ এবং গোশত। একবার তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহর মেহেরবানীতে আরোগ্য লাভ করেন। এরপর তিনি আল্লাহর শোকর আদায় করার লক্ষক্ষ্য তাঁর এই প্রিয় দুটি খাদ্য পরিত্যাগ করেন।
ইহুদী পন্ডিতগণ স্বীকার করলেন যে, হযরত ইয়াকুবের পক্ষে উটের গোশত এবং দুধ খাওয়া নিষিদ্ধ করার এটাই কারণ ছিল।
পন্ডিতগণ বললেন, আল্লাহর কসম, তিনি সাক্ষী; বিষয়টা এরূপই ছিল। এরপর পন্ডিতেরা শেষ প্রশ্নটি উত্থাপন করলেন। বললেন, বলুন তো, ‘রুহ’ কি? রুহ বলতে আপনি কি বুঝাতে চান?
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহপাক রুহ সম্পর্কে আমাদিগকে দু’টি জ্ঞান দিয়েছেন। প্রথমত: রুহ একান্তভাবেই আল্লাহ তায়ালার একটি নির্দেশ, যা মানুষ এবং জীব-জগতের সবার মধ্যেই আল্লাহপাক রেখেছেন। এর প্রকৃত হাকীকত মানুষের বোধগম্যতার মধ্যে রাখা হয়নি।
দ্বিতীয়ত: ‘রুহ’ বলতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ওহীর জ্ঞান নিয়ে পৃথিবীতে যিনি আগমন করেন সেই ফেরেশতা জিবরাঈলকেও রুহ বা রুহুল-কুদ্দুস বলা হয়েছে। ‘রুহুল-কুদ্দুস’ নামে অভিহিত এই সম্মানিত ফেরেশতাই আমার নিকট ওহী নিয়ে আগমন করে থাকেন।
এই জবাব শুনে পন্ডিতগণ বললেন, আল্লাহ সাক্ষী, আপনার এই উত্তরও যথার্থ! এতে বিন্দুমাত্রও এদিক সেদিক নাই।
অতঃপর ইহুদীরা বলতে লাগলো, আপনি ফেরেশতা জিবরাঈলের কথা বলছেন? ইনি তো আমাদের চিহ্নিত শত্রু। ইনিই আমাদের কওমের নিকট বার বার আযাব নিয়ে নাযিল হয়েছেন। সুতরাং আমরা আপনার দ্বীন কি করে কবুল করি?
ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের জবাবও আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন। কিন্তু ইহুদীরা ছিল হঠকারী জাতি। এরা কোন যুক্তির ধার ধারতো না। শেষ পর্যন্ত গজবের পর গজব দিয়েই আল্লাহ ওদের শায়েস্তা করেছেন। মদীনার ইহুদীদের ভাগ্যেও সেই পরিণামই ঘটেছিল। এই সোনার দেশটি থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, সম্পাদক-মাসিক মদীনা