ইসলামের ইতিহাসে হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফত এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় অধ্যায়। এ সময়ে সভ্যতার অভিযান যে-ভাবে ও যে-গতিতে পুরাতন জরাজীর্ণ ঘুণেধরা পৃথিবীকে ওলটপালট করে দিয়েছিল তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। যে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছিল রসূলুল্লাহ (সা)-র আমল থেকে তা হজরত আবূ বকর (রা.)-এর খিলাফতের পর হজরত ওমর (রা.)-এর স্কন্ধেই ন্যস্ত হয়। দেশ বিজয়ের সাথে সাথে যে সব নতুন নতুন সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল হজরত ওমর (রা.)-কে সেই সব সমস্যার মুকাবিলা করতে হয়। তিনি ইসলামের মারফত এগুলোর সমাধান খুঁজেছিলেন; আর তার প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন সমাজ কল্যাণে। সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে ইসলামী সমাজ দর্শনের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা না হলেও সেই মধ্যযুগেও যে এক সুষ্ঠু নৈতিক ও সামাজিক বাস্তব সমাজ-ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছিল তা ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। খোলাফায়ে রাশেদা বা প্রথম চার খলিফার সম্বন্ধেও একথা বলা চলে তবে সংগঠনের দিক দিয়ে হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতের ভিতরে পাই এক চমকপ্রদ পৌর ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ইতিহাস। ঐতিহাসিক ওয়েল (Weil) হজরত ওমর (রা.)-কে তাই ‘The Guiding Spirit of Islam’ বলে অভিহিত করেছিলেন। [Arnold: The preaching of Islam. Also Tabariad Macdonald. Encyclopedia of Islam p. 958-9]
সাম্যের সমাজ : হজরতর ওমরের (রা.) শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে দুটি মন্ত্রণা সভা ছিল। সাধারণ সভায় সব সমস্যার সাধারণ আলোচনা করা হত। এখানে জনগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারত। প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিয়োগ, কর্মচ্যুতি ও অন্যান্য বিশেষ সমস্যার ভার এক একটি কমিটির ওপর ছেড়ে দেয়া হত। মফস্বল থেকে মাঝে মাঝে প্রতিনিধিদল এসে দেশের অবস্থা সম্বন্ধে খলিফাকে খবর জানিয়ে যেতেন ও তাঁদের দাবি-দাওয়া পেশ করতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তার নিয়োগের সময় এদেশের অধিবাসীদের মতামত নেয়া হত। কুফা, বসরা ও সিরিয়ার অধিবাসীরা এই মতামত ব্যক্ত করে শাসনকর্তা নিয়োগের ব্যাপারে শরীক হয়েছিলেন। মাঝে মাঝে শাসন বিষয়ে তদন্ত হত। এই ধরনের এক তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় কুফার শাসনকর্তা সাদকে পদচ্যুত করা হয়েছিল। ব্যবসায়ের নিয়ম না জানায় সে-সময় ব্যবসা করা যেতো না। সাধারণ কর্মচারীর বেতন ও খলিফার বেতনে কোনও তারতম্য ছিল না। পরিষদের অনুমতি ব্যতীত এতটুকু জিনিসও খলিফা গ্রহণ করতেন না। নিজের শরীরের ক্ষতস্থানে মধু লাগাবার দরকার হলে পরিষদের অনুমতি নিয়ে তারপর অল্প একটুখানি মধু খলিফা গ্রহণ করেন। খলিফা হজরত ওমর (রা.) সালমান নামে এক বিশিষ্ট সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি খলিফা না বাদশা? সালমান বললেন— যদি জোর জুলুম করে জনসাধারণের কাছ থেকে আপনি টাকা-পয়সা আদায় করেন আর বায়তুল মালের টাকা আত্মসাৎ করেন তবে আপনি বাদশা, নতুবা আপনি খলিফা। [ibid : P. 33]
বিচার ব্যবস্থা : বিচারালয়ে শাসক-শাসিতের একই মর্যাদা ছিলো । উবাই ইবনে কাবের সংগে মোকদ্দমায় খলিফা ওমর (রা.) কাজি জায়েদ বিন ইবনে সাবিতের আদালতে হাজির হয়েছিলেন। কাজি যাতে অবিচার না করেন সে বিষয়ে কঠোর দৃষ্টি রাখা হতো। বিচার খুব সহজলভ্য ছিল। এ জন্য কোন ফি দিতে হত না। উকিল মোক্তার ছিলো না। রাষ্ট্র নিযুক্ত মুফতীরা ‘একতা নামক বিভাগের সাহায্যে জনসাধারণকে আইনের খুঁটিনাটি বিষয় সম্বন্ধে অবহিত করতেন। অমুসলিমের ধর্মেও তমদ্দুনে হাত দেয়া তো দূরের কথা, তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার মত অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে তাদেরকে সরাসরি সাহায্য করা হত। জেরুজালেমের পতনের পর সেখানকার খৃষ্টান অধিবাসীদের কোনও জিনিসেই হাত দেওয়া হয়নি— তাদের বিবেক ও উপাসনার স্বাধীনতাও পুরোপুরিভাবে অটুট রাখা হয়েছিল। ইরাকে শাসনের ব্যাপারে পারসী দলপতিদের ও মিসরের মুকাউকিদের (অমুসলিম) কথা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত। একজন মুসলিম যতি একজন অমুসলিমকে হত্যা করত তার জন্য এতটুকু ক্ষমা ছিল না। হত্যা করার শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডই ছিল তার জন্য বিধান। [[Ameer Ali: The History of Saracens: Macmillan and Co 1951. P. 30.]
অমুসলিমের অধিকার : জেরুজালেমের সন্ধি অমুসলিমদের প্রতি মানবিক উদার ব্যবহারের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বিজিতের প্রতি এই ধরনের সন্ধি-চুক্তি দুনিয়ার ইতিহাসে বড় একটা নেই। এই সন্ধিতে খ্রিষ্টানদের জানমাল, গির্জা, ক্রশ রক্ষিত হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো। চার্চের উপাসনা বন্ধ করে দেয়া যাবে না, ত্রুশ সরানো যাবে না। কোনও চার্চকে আবদ্ধ পরিণত করা যাবে না। তাদের চার্চের জিনিসপত্রও কোন মতেই নষ্ট করা যাবে না। ধর্ম ও বিশ্বাসের ব্যাপারে তাদের ওপর কোন জোর করা চলবে না। তাদের ওপরে কোনও ধরনের অবিচার ও জুলুম করা চলবে না। খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকদের লেখা থেকেই আমরা পেয়েছি যে, তখন খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু খলিফা ওমরকে প্রাচীনকালের দর্শনীয় দালান প্রভৃতি দেখাচ্ছিলেন তখন আসরের নামাযের ওয়াক্ত হয়। তখন তারা ছিলেন কন্সট্যান্টাইনের গির্জার ভেতরে। ধর্মগুরু সেখানেই তাঁকে নামায পড়তে বললেন। কন্সট্যান্টাইনের গির্জায় তাঁর জন্য জায়নামাজের কাপড় বিছানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি এই দুই জায়গার কোথায়ও নামায সমাধা করেননি— আজ যদি আমি এখানে নামায পড়ি, তবে কাল মুসলমানেরা হয়ত এখানে মসজিদ তৈরির দাবি জানাবে।
এইভাবে তিনি অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার পথ সুগম করে গেলেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় যখন হিমস নামক জায়গাটা মুসলিম সৈন্য ছেড়ে আসে তখন সেখানকার অধিবাসীদের কাছ থেকে আদায় করা জিজিয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ অমুসলিমের রক্ষা করার জন্য যে জিজিয়া নেয়া, সে রক্ষণাবেক্ষণ ত আর সম্ভব হলো না। তাই এই পন্থা অনুসরণ করা হল। সিরিয়া থেকে পশ্চাদপসরণের সময়েও সিরিয়া বিজয়ী আবূ ওবায়দা সিরিয়ার অমুসলিমদেরকে সমস্ত জিজিয়া ফিরিয়ে দেন। ভন ক্রেমার (Von Kramer) বলেন— অমুসলিম সম্প্রদায়েরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই ভোগ করতেন। [Bemard Lewis: The Arabs in History (1950) P. 58]
শিক্ষার স্বরূপ : শিক্ষার দিকেও বিশেষ নজর দেয়া হত। ইসলামী ও অনৈসলামী শিক্ষার ভেতরে কোনও পার্থক্য নির্দেশ করা হত না। কুরআন-হাদীসের নীতির মারফত শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভংগি গঠন করে সমস্ত বিষয় অধ্যয়ন করাই ছিল ইসলামী শিক্ষার স্বরূপ। বিজিত দেশগুলিতে ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। বিজিত দেশগুলিতে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে শিক্ষক নিযুক্ত করা হত ও তাদের বেতন বায়তুল মাল থেকেই দেওয়া হত। বেদুইনদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে কুরআন শিক্ষা দেওয়া হত। শিক্ষার তদারক করার জন্য পরিদর্শক নিযুক্ত করা হত। তারা শিক্ষা সম্বন্ধীয় রিপোর্ট পেশ করতেন। আবু আইয়ুব, আবূ দারদা ও হজরত উবাদা (রা.)-এইসব নামজাদা সাহাবার ওপর শিক্ষা সংগঠনের ভার দিয়েছিলেন হজরত ওমর (রা.) নিজে। [Ibid P. 58-59]
মানব স্বাধীনতার বিকাশ : সেই মধ্যযুগেও ইসলাম মানব স্বাধীনতার এমন এক অনুপম চিত্রের বাস্তবরূপ দেখিয়েছিল যা আজকের দুনিয়াতেও পুরোপুরি পাওয়া কঠিন। নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত বহু জাতিকে ইসলাম মুক্তির মশাল হাতে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এর ফলে এমন এক সুসংহত সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেখানে প্রত্যেকের পক্ষেই তার কার্যদক্ষতা দেখিয়ে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করার পূর্ণ সুযোগ ছিল। এই জন্যই সিরিয়ার অধিবাসী, মিসরের কপট উত্তর আফ্রিকার খৃষ্টান ‘বাববার’ ও প্যালেস্টাইনের ‘সামারীয়গণ’ মুসলিম সেনাদেরকে অভ্যর্থনা করেছিল। ইসলামের দেয়া মানবিক সাম্য ও সুবিচারের ভাবটুকু সে যুগের শাসকরা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন।
মিসর বিজয়ী উমরাও খলিফাকে তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছিলেন, কিভাবে মিসরের চাষীরা পিঁপড়ার মত সারাদিন খাটছে, মালিকের বেতের ঘা সহ্য করছে, কিন্তু ফসলের সমান ভাগ ভোগ করতে মুগিরা তার পাশেই বসেছিলেন; এবং এতে উপস্থিত সকলে বিস্ময় প্রকাশ করলে, তিনি বলেন— কেউ পূজা পাবার জন্য উপরে সিংহাসনে বসবে আর কেউ নিচে মাথা নীচু করে বসবে আমাদের ভেতরে এ রেওয়াজ নেই। আবার সিরিয়ার দরবারে মুয়াজকে যখন সুদৃশ্য কার্পেটে বসতে দেওয়া হলো, তিনি সেখানে বসলেন না । আর বললেন— গরীবদের লুট করে যে কার্পেট তৈরি হয়েছে, সেখানে আমি বসতে চাই না। জেরুজালেমের সন্ধির সময় খলিফাকে তাঁর ছেঁড়া কাপড় ছেড়ে ভাল কাপড় পরতে অনেকে অনুরোধ করে। খলিফা জবাব দেন— একজন মুসলিমের সম্মান পোশাকের ওপর নির্ভর করে না। [Sir William Muir: Annals of Early Caliphate. P. 227]
অনাগত সমাজের জন্যে পথনির্দেশ : কাজেই ইসলামের সামাজিক রূপায়ণ শুরু হয়েও নানা কারণে তার পরিপূর্ণ বিতরণ সম্ভব হল না। এর জন্যে আরও বেশি সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু খলিফা ওমর (রা.)-এর ভাগ্যে তা জোটেনি। ইসলামের নীতিগুলি এমনও সমানভাবে রয়েছে, যে সব কারণে সে সময় তার সর্বাঙ্গীন রূপায়ণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি- সেগুলিরই দিকে খেয়াল রেখে আধুনিক জ্ঞান, সামাজিক পরিবেশ ও প্রয়োজনের পরিপূরক হিসাবে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে আজ এগিয়ে যেতে হবে। মুসলিম হিসাবে ও বুদ্ধিজীবী মানুষ হিসাবে এটা আমাদের কর্তব্য। যারা বুদ্ধির দোহাই পাড়েন— তাদেরকেও আমরা ইসলামের সমাজ নীতিগুলি হজরত ওমরের খেলাফতের পরিপ্রেক্ষিতে পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। এখানে তারা নিশ্চিতভাবে অনাগত সমাজের জীবন গঠনের আশার আলো দেখতে পাবেন। [Saeedi-at Vol. III. P. 304]
[সূত্র : ওমর ফারুক ও ইসলামী সমাজ, লেখক : হাসান জামান, প্রকাশনায় : ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে]