ইসলাম মানব জীবনের সকল সমস্যার ক্ষেত্রে তিনটি নীতি গ্রহণ করেছে।
এক. ইসলাম মানব জীবনের স্বাভাবিক নিয়মনীতিগুলোকে যতাযথভাবে অক্ষুণ্ন রাখতে চায় এবং যেখানে স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুতি ঘটে, সেখানেই ইসলাম তার মোড় ঘুরিয়ে স্বাভাবিক পথের উপর এনে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।
দুই. ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজ ব্যবস্থায় কেবল বাহ্যিকভাবে কিছু নিয়ম বিধি চালু করে দেয়াই যথেষ্ট নয়। বরঞ্চ ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে নৈতিক চরিত্র গঠন ও মন মানসিকতার সংশোধনের উপর। কারণ এভাবেই মানব প্রবৃত্তির যাবতীয় খারাপ ও মন্দ ভাবধারা শিকড় কেটে দেয়া সম্ভব। বস্তুত এটি ইসলামে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ইসলামের সমাজ সংশোধন ও সংস্কার প্রচেষ্টার ভিত্তি এর উপরই প্রতিষ্ঠিত।
তিন. ইসলামের তৃতীয় মূলনীতি হলো, রাষ্ট্রীয় শক্তি ও আইনের প্রয়োগ কেবলমাত্র সর্বশেষ ও নিরুপায় মুহূর্তেই করা যাবে, তার পূর্বে নয়। ইসলামী শরীয়তের গোটা ব্যবস্তার মধ্যেই এই মূলনীতিটির নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়।
শয়তানের কুচক্রে পড়ে মানুষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব অস্বাভাবিক পন্থা অবলম্বন করেছে সেগুলো সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ইসলাম কেবলমাত্র নৈতিক সংশোধনের এবং যতোটা সম্ভব রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও আইন প্রয়োগ না করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা সাধনায় মানুষ স্বাধীন থাকবে; ‘স্বীয় শ্রম-মেহনতের মাধ্যমে মানুষ যা উপার্জন করবে তার উপর তার স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে’ এবং ‘মানুষের মধ্যে তাদের যোগ্যতা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে পার্থক্য ও তারতম্য করা হবে’ প্রভৃতি দৃষ্টিভংগিকে ইসলাম ততোক্ষণ পর্যন্ত স্বীকৃত প্রদান করে, যতোক্ষণ এগুলো স্বাভাবিকতার মধ্যে অবস্থান করবে। তাছাড়া ইসলাম এগুলোর উপর এমনসব বিধি নিষেধও আরোপ করে, যা সেগুলোকে স্বাভাবিকতার সীমা অতিক্রম করা এবং নিপীড়ন ও অবিচারের হাতিয়ারে পরিণত হওয়অ থেকে বিরত রাখে। [ইসলামী অর্থনীতি, মূল: সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ) অনুবাদক: আব্বাস আলী খান ও আবদুস শহীদ নাসিম]
সম্পদ উপার্জন নীতি : প্রথমে জীবিকা বা সম্পদ উপার্জনের প্রশ্নটিই ধরা যাক। ইসলাম মানুষের এই স্বাভাবিক অধিকারকে স্বীকার করে যে, সে নিজের স্বভাব প্রকৃতির ঝোঁ প্রবণতা এবং সামর্থ ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেই জীবন সামগ্রীর সন্ধান করবে। কিন্তু ইসলাম মানুষকে তার জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে নৈতিক চরিত্র বিনষ্টকারী কিংবা সমাজ ব্যবস্থা বিকৃতকারী কোনো উপায় পন্থা অবলম্বন করার অধিকার দেয়নি। ইসলাম জীবিকা উপার্জনের উপায় পন্থার ক্ষেত্রে হালাল হারামের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ইসলাম বেছে বেছে ক্ষতিকর উপায় পন্থাকে হারাম করেছে। ইসলামী বিধান মতে মদ এবং যাবতীয় মাদকদ্রব্য কেবল হারাম নয়, বরঞ্চ এগুলোর উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় এবং সংরক্ষণও নিষিদ্ধ। যিনা ব্যভিচার, নাজগান এবং এ ধরনের অন্যান্য উপায় পন্থাকেও অর্থোপার্জনের বৈধ পন্থা বলে ইসলাম স্বীকার করেনা। উপার্জনের এমনসব উপায় পন্থাকেও ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে, যেগুলোতে একজনের লাভ বা স্বার্থসিদ্ধি নির্ভর করে অন্যদের কিংবা সমাজের ক্ষতি ও স্বার্থহানির উপর। ঘুষ, চুরি, জুয়া, ঠকবাজি ও প্রতারণামূলক ব্যবসা, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মওজুদ করে রাখা, উপার্জনের উপায় উপকরণের উপর এক বা কতিপয় ব্যক্তির একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করা যাতে অন্যদের উপার্জনের চেষ্টা সাধনার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে প্রভৃতি ধরনের উপায় পন্থা ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাছা ইসলাম বেছে বেছে সেসব ব্যবসায় বাণিজ্য ও কায়কারবারকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, যেগুলো ধরণগত দিক থেকেই বিবাগ [Litigation] সৃষ্টিকারী, কিংবা যেগুলোর লাভ লোকসান নির্ভর করে সম্পূর্ণরূপে ভাগ্য বা ঘটনাচক্রের উপর অথবা যেগুলোতে উভয় পক্ষের স্বার্থ ও অধিকার নির্দিষ্ট করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ব্যবসা বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিবিধান অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, বর্তমানে যেসব পন্থায় মানুষ লক্ষপতি কোটিপতি হচ্ছে, তন্মধ্যে অধিকাংশ পন্থাই এমন, যেগুলোর উপর ইসলাম কঠোর আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ইসলাম উপার্জনের যেসব উপায় পন্থা বৈধ ঘোষণা করে, সেগুলোর পরিসীমার মধ্যে অবস্থান করে কাজ করলে সীমাহীন সম্পদ গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। [ইসলামী অর্থনীতি, অনুবাদক: আব্বাস আলী খান ও আবদুস শহীদ নাসিম]
ইসলামের স্বত্বাধিকার নীতি : কোনো ব্যক্তি বৈধ উপায়ে যে ধন সম্পদ উপার্জন করে তার উপর ইসলাম ব্যক্তির স্বাত্বাধিকার অবশ্যই স্বীকার করে; কিন্তু উপার্জিত ধনসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয় নাই। বরঞ্চ তার উপর বিভিন্নভাবে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। একথা সবারই জানা যে, উপার্জিত ধন সম্পদ ব্যবহার করার তিনটিই মাত্র পন্থা আছে। সেগুলো হলো- এক. খরচ বা ব্যয় করা, দুই. লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করা এবং তিন. মওজুদ করা।
এছাড়া সম্পদ ব্যবহারের এই তিনটি পন্থার উপর ইসলাম যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবার আমি সংক্ষেপে গেুলো তুলে ধরছি-
১. ইসলামে ব্যায়নীতি : ব্যয়ের যেসব পন্থা পদ্ধতি নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত করে কিংবা যেগুলোর দ্বারা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ইসলামে তা সবই নিষিদ্ধ। কেউ জুয়া খেলে নিজের অর্থ সম্পদ উড়াতে পারেনা। মদ্যপান ও ব্যভিচার করার অনুমতি ইসলামে নেই। গান, বাদ্য, নৃত্য এবং বাজে আনন্দ বিহার প্রভৃতিতে কেউ নিজের অর্থকড়ি খরচ করতে পারে না। কোন পুরুষ রেশমের পোশাক এবং সোনার অলংকার ব্যবহার করতে পারবেনা। চিত্র এঁকে দেয়াল সজ্জিত করতে পারবেনা। মোটকথা, ইসলাম ব্যয়ের এমনসব দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে যার মাধ্যমে মানুষ তার প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার কাজে অর্থ ব্যয় করে।
অন্যদিকে ইসলাম অর্থ ব্যয়ের সেইসব পন্থা পদ্ধতিকে বৈধ রেখেছে, যার দ্বারা মানুষ মধ্য ধরনের পবিত্র পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পারে। এভাবে ব্যয় করার পর কিছু থাকলে ইসলাম তা পুণ্য ও সৎকাজে, জনকল্যাণের কাজে এবং সেইসব লোকদের সাহায্যার্থে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করার মতো জীবিকা অর্জনের অসমর্থ। ইসলামে দৃষ্টিতে সর্বোত্তম কর্মনীতি হলো, মানুষ হালাল পথে যা কিছু উপার্জন করবে, তা তার বৈধ ও যুক্তিসংগত প্রয়োজন পূরণার্থে ব্যয় করবে। এরপরও যা কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে তার অভাবগ্রস্তদের দান করবে যাতে তারা তাদের অপরিহার্য প্রয়োজনে তা খরচ করতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যকে ইসলাম মহত্তম চরিত্রের মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করেছে এবং একটি মহান আদর্শ হিসেবে এর প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। সমাজে যখনই ইসলামী নৈতিকতা বিজয়ী হবে, তখন সমাজ জীবনে সেইসব লোকদের সর্বাধিক সম্মনের চোখে দেখা হবে যারা ন্যায় পথে এং সৎপথে তা ব্যয় করে। পক্ষান্তরে যারা অর্থসম্পদ সঞ্চয় ও মওজুদ করে পুঞ্জিভূত করে রাখার চেষ্টা করে, কিংবা উপার্জিত সম্পদের উদ্বৃত্ত অংশকে আরও সম্পদ লাভের কাছে খাটায়- সমাজে তাদের কোনো মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হবে না।
২. অর্থপূজার মূলোচ্ছেদ : কেবল নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে এবং সমাজের নৈতিক প্রভাবও অনুশাসনের দ্বারা অস্বাভাবিক লোভ ও লালসাগ্রস্ত লোকদের অপরাধ প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে। এতোসবের পরও সমাজে এমন লোক অবশিষ্ট থাকতে পারে যারা নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদকে আরো অধিক অর্থোপার্জনের কাজে বিনিয়োগ করতে প্রয়াস পাবে। তাই ইসলাম মানুষের এ প্রবণতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং প্রয়োজনের অধিক অর্থসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতিপয় আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদ সুদের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করাকে ইসলামী আইনে অকাট্যভাবে হারাম করে দেয়া হয়েছে। আপনি যদি কাউকেও নিজের অর্থসম্পদ ঋণ প্রদান করে থাকেন তাহলে, ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ নিজের প্রয়োজন মেটানো জন্যে ব্যয় করুক অথবা জীবিকা উপার্জনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করুক সর্বাবস্থায়ই আপনি কেবল আপনার মূল অর্থ ফেরত পাবারিই অধিকার রাখেন, মূরে চেয়ে বেশী নয়। এমনিভাবে ইসলাম জুলুম ও শোষণমুলক পুঁজিবাদী কর্মনীতির ভিত্তিমূল চূর্ণ করে দিয়েছে এবং সেই বড় হাতিয়ারটিকে সম্পূর্ণ ভোতা করে দিয়েছে যার মাধ্যমে পুঁজির মালিক শুধু তার পুঁজি খাটিয়ে সমাজের সমস্ত অর্থসম্পদ শুষে নিয়ে নিজের কর্য়ত্ত করার সুযোগ পায়। কিন্তু উদ্বৃত্ত অর্থসম্পদের নিজের ব্যবসা, শিল্প, কারিগরী কিংবা অন্যন্য কায়কারবার বিনিয়েগ করা, অথবা অন্যদের কারবারে লাভ লোকসান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে খাটানোর প্রক্রিয়াকে ইসলাম বৈধ ঘোষণা করেছে। আর এ প্রক্রিয়ায় প্রয়োনাতিরিক্ত যে সম্পদ লোকদের হাতে জমা হবে, তার মন্দ প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করার জন্যও ইসলাম আরও কিছু ব্যবস্থা প্রদান করেছে।
৩. সম্পদ বন্টন ও জননিরাপত্তা : ইসলাম প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদ সঞ্চয় ও মওজুদ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলামের দাবী হলো, তোমার কাছে যা কিছু অর্থসম্পদ আছে, তা হয় নিজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ে ব্যয় কর, না হয় কোনো বৈধ কারবারে বিনিয়োগ কর, অথবা অন্যদের দান করে দাও, যাতে তারা তা দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতে পারে। ইসলাম চায় এভাবে সমস্ত অর্থসম্পদ সমাজের মধ্যে অবিরাম আবর্তিত হতে থাকুক। কিন্তু যারা এ কাজ করবেনা, বরঞ্চ অর্থসম্পদ জমা করতে থাকবে, তাদেরকে প্রতিবচর আইন অনুযায়ী সঞ্চিত অর্থ থেকে বার্ষিক ২.৫% ভাগ হারে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। এ অর্থ সেইসব লোকের সাহায্যার্থ ব্যয় করা হবে, যারা জীবিকা উপার্জনের সংগ্রামে অংশ নেবার যোগ্য নয়, কিংবা অংশ নেয়ার পরও নিজের প্রয়োজন মেটাবার মতো উপার্জন থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। ইসলামী পরিভাষায় এ ব্যবস্থার নাম হলো যাকাত। ইসলাম যাকাত আদায় ও বন্টনের যে ব্যবস্থ দিয়েছে তা হলো, যাকাত আদায় করে জনগণের যৌথ কোষাগারে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বায়তুল মালে জমা করা হবে। কোষাগার সেই সমস্ত লোকের প্রয়োজন পূলণের যিম্মাদার হবে, যারাই সাহায্যের মুখাপেক্ষী হবে। মূলতঃ যাকাত সামাজিক বীমার সর্বোত্তম ব্যবস্থা। সামাজিক সাহায্য সহযোগিতার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার অভাবে যেসব অনিষ্ট ও বিপর্য সৃষ্টি হয়, বায়তুল মালের ব্যবস্থা সেগুলোর মূলোচ্ছেদ করে দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে জিনিস মানুষকে সম্পদ সঞ্চয় এবং লাভজনক কাজে বিনিয়েঅগ করতে বাধ্য করে এবং যার ফলে জীবনবীমা প্রভৃতি প্রয়োজন দেখা দেয়, তা হলো সেখানে প্রতিটি মানুষের জীবন কেবল নিজের উপায় উপাদানের উপরই নির্ভরশীল। সে ব্যবস্থায় কিচু সঞ্চয় না করলে বৃদ্ধ অবস্থায় না খেয়ে মরতে হয়। সন্তান সন্তরি জন্যে কিচু না রেখে গেলে তারা দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেও এক টুকরা রুটি জাটাতে পারেনা। কিছু সঞ্চয় না রেখে রোগাক্রান্ত হলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। এ ব্যবস্থায় যদি সঞ্চয় না থাকে আর হঠাৎ যদি ঘর পুড়ে যায়, ব্যবসা লাটে উঠে, কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়, তাহলে আশ্রয় বা সাহায্য পাওয়া বা নির্ভর করার কোনো আশায় থাকে না।
একইভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষ পুঁজিপতিদের ক্রীতাসে পরিণত হতে বাধ্য হয় এবং শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের আরোপিত যাবতীয় অন্যায় শর্ত মেনে নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়, এর কারণও এটাই যে, পুঁজিপতি শ্রমের বিনিময়ে যে মজুরী দেয় তা মেনে না নিলে শ্রমিকদের বিবস্ত্র থাকতে হবে আর অনাহারে ধুকে ধুকে মরতে হবে। পুঁজিপতির ‘দান’ থেকে মুখ ফিরালে শ্রমিকের জন্যে দু’বেলার অন্ন জুটানো সম্ভব হবে না।
আধুনিক কালের মানব জাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে পুঁজিবাদের আরো এক দুষ্ট অভিশাপ। একদিকে দারিদ্র আর ক্ষুধার জ্বালায় ধুকে ধুকে মরছে লক্ষ কোটি দরিদ্র অনাহারী মানুষ, আর অপরদিকে জমির অঢেল উৎপন্ন ফসল আর কারখানার উৎপাদিত বিপুল পণ্যসামগ্রীর ভাণ্ডার স্তূপকৃত হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু দরিদ্র লোকদের পক্ষে তা ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না, ক্রয় করার ক্ষমতা তাদের নেই। এমনকি লক্ষ লক্ষ মন গম সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, অথচ অনাহারী মানুষের ভাগ্যে একুঠো খাবর জুটছেনা। এ অভিশাপের প্রধান কারণ এই যে, সাহায্যের মুখাপেক্ষী মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাবার মতো কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। যদি এই দরিদ্র লোকদের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টি করা হতো, তবে শিল্প, বাণিজ্য এবং কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে মানুষের দক্ষতা ও নৈপূণ্য আরো অধিক বিকশিত হতো।
ইসলাম যাকাত এবং বায়তুলমালের মাধ্যমে এ ধরনের সকল অনিষ্টের মূলোচ্ছেদ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল প্রতিটি মুহূর্ত একজন সাহায্যকারী বন্ধুর মতো প্রত্যেক মানুষের পাশে অবস্থান করে। ভবিষ্যতের চিন্তায় চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজন হলে যে কোনো লোক বায়তুল মালে গিয়ে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে পারে। এ অবস্থায় ব্যাংক ডিপোজিট এবং বীমা পলিসির আর কি প্রয়োজন থাকতে পারে? হতে পারে আপনি শিশুসন্তান রেখে ইহকাল ত্যাগ করছেন। কিন্তু দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আপনি নিশ্চিন্তে পরপারে পাড়ি জমান। আপনার পরে আপনার সন্তানদের সকল দায়িত্ব বহন করবে বায়তুলমাল। রোগগ্রস্ততা, বৃদ্ধাবস্থা, আসমানী এবং যমীনী বিপদ, মোটকথা, বর্বাবস্থায় বায়তুলমাল আপনার সার্বক্ষণিক সাহায্যকারী. যার উপর নির্দ্বিধায় নির্ভর করতে পারেন। পুঁজিপতির যে কোনো অন্যায় শর্ত মেনে নিয়ে আপনাকে তার কাজ করতে বাধ্য হতে হবে না। বায়তুলমালের বর্তমানে আপনার ক্ষুধার্ত থাকা, বিবস্ত্র থাকা এবং নিরুপায় হবার কোনো ভয় নাই। তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল এমনব্যক্তিকেই প্রয়োজনীয় জীবনসামগ্রী ক্রয় করার যোগ্য বানিয়ে দেয়, যারা অর্থ উপার্জনের সম্পূর্ণ অযোগ্য, কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে কম উপার্জন করে থাকে। এভাবেই পণ্য উৎপাদন ও বন্টনের মধ্যে পারস্পরিক সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই কোনো দেশের দেউলিয়াত্বকে অন্যদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার জন্যে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ানো এবং অবশেষে গ্রহলোক পর্যন্ত দৌড়াবার কোনো প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকবেনা।
কিছু কিছু ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত হয়ে পড়া অর্থসম্পদ সমাজে ছড়িয়ে দেবার জন্যে ইসলাম যাকাত ছাড়াও অন্য যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তা হলো উত্তরাধিকার আইন। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য আইনের প্রবণতা হলো, কোন ব্যক্তি সারাজীবন ধরে যতো অর্থসম্পদ পুঞ্জিভূত করেছে, তার মৃত্যুর পরও তাকে একইভাবে পুঞ্জিভূত রোখা। পক্ষান্তরে ইসলাম, কোনো ব্যক্তি সারাজীবন গুণে গুণে যে অর্থসম্পদ পুঞ্জিভূত করেছে, তার মৃত্যুর পর তা অন্যদের মধ্যে বিলি বন্টন করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। ইসলামী আইনে পুত্র কন্যা, বাবা মা, স্ত্রী, ভাইবোন- এরা সবাই এক ব্যক্তির উত্তরাধিকার এবং তার রেখে যাওয়া সম্পদ একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম বিধি অনুযায়ী এদের মধ্যে বণ্টিত হওয়া জরুরী। কোনো নিকটাত্মীয় বর্তমান না থাকলে দূর আত্মীয়ের সন্ধান করা হবে এবং সম্পদ তাদের মধ্যে বিলি করা হবে। নিকটের বা দূরের কোনো আত্মীয় যদি বর্তমান না থাকে তবে পালকপুত্র গ্রহণ করে তাকে সম্পদের একচ্ছত্র মালিক বানিয়ে দেবার অধিকার ইসলাম কাউকে প্রদান করে না। কেউ যদি কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয় না রেখে মারা যায়, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজই তার সমস্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী। তার পুঞ্জিভূত করে রেখে যাওয়া সমস্ত অর্থসম্পদ জাতীয় কোষাগার বায়তুলমালে জমা করা হবে। এভাবে কোনো ব্যক্তি যদি বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থম্পদও পুঞ্জিভূত করে, তার মুত্যুর পর দুই তিন পুরুষ সময়কালের মধ্যেই তা বহু ছোট ছোট ভাগে খন্ড বিখন্ড ও বিভক্ত হয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। এমনি করে সম্পদের প্রতিটি পুঞ্জিভূত ভাণ্ডার বিস্তৃত ও বিকেন্দ্রীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে ঘরে ঘরে।
[ইসলামী অর্থনীতি, অনুবাদক: আব্বাস আলী খান ও আবদুস শহীদ নাসিম]