ইসলামের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য ব্যবস্থা ছিল। নবী (সাঃ) তো মক্কা থেকে মদীনা পৌঁছে ছোট্ট যে রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করলেন, তা প্রথমে ‘সিটিস্টেট’ হলেও পরবর্তীতে বিশাল রূপ নেয়। মদীনায় তখন ইহুদীরাও বসবাস করত। নবী (সাঃ) তাদেরও ডাক দেন এই রাষ্ট্রের পরিচালনায়। তবে প্রথম প্রথম তারা সহযোগিতা প্রদর্শন করলেও পরবর্তীতে নবী (সাঃ)-এর শত্রুদের সঙ্গে যোগাযোগ, ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের কারণে সমস্যার সৃস্টি হয়, আর তার ফলে তদানীন্তন রাষ্ট্র যা করে তাই নবী (সাঃ) করেছিলেন। এতে নবী (সাঃ) কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রাণদন্ড হয়েছিল, আর খয়বরের ইহুদীদের পরাজিত করে শৃক্মখলায় আনা হয়। নবী (সাঃ) বেশ চেষ্টা করেছিলেন ইহুদীদেরকে নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু ইহুদীরা হযরত ঈশা (আঃ)-এর সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করেছিল রোমানদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে, মদীনা ও আশেপাশের ইহুদীরাও তেমনি করে নবী (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মক্কার অমুসলমানদের সঙ্গে মিলে।
মদীনা সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল নবী (সাঃ)-এর সৎ প্রচেষ্টার রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। এছাড়াও মুসলমানদের সামনে অমুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আব্দুল্লাহ মামুন আরিফ আল মান্নান তার লেখা ‘‘ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের ভুল ধারণা’’ বইয়ে এসব নিয়ে চমৎকার বর্ণনা এনেছেন। আমরা তার কিছু অংশ এখন পেশ করব।
মদীনা সনদ
রাষ্ট্রের শান্তি ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠার জন্য হযরত নবী করিম (সাঃ) মদীনার খৃস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক সম্প্রদায়, প্রস্তর পূজকদের নিয়ে একটি সনদ প্রস্তুত করেছিলেন। এটাই মদীনা সনদ নামে খ্যাত।
সনদটি নিম্নরূপ-
১. মদীনার ইহুদী, খৃস্টান, পৌত্তলিক, মুসলমান সকলেই এক দেশবাসী।
২. সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না।
৩. হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) বিনানুমতিতে কারো সাথে কেউ যুদ্ধ করবে না।
৪. নিজেদের মধ্যে কোন বিরোধ উপস্থিত হলে আল্লাহপাক এবং তাঁর রাসূলের (সাঃ) মীমাংসার উপর সকলকেই নির্ভর করতে হবে।
৫. বাইরের কোন সম্প্রদায়ের সাথে গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না।
৬. বাইরের শত্রুদ্বারা মদীনা যেন আক্রান্ত না হয় সেদিকে সকলকেই লক্ষ্য রাখতে হবে।
৭. যদি কেউ মদীনা আক্রমণ করে সকলকেই মিলিতভাবে শত্রুকে বাধা দিতে হবে।
৮. যুদ্ধকালের ব্যয়ভার সকলকেই বহন করতে হবে।
৯. কেহ বিদ্রোহ করলে বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তাকে সমুচিত শাস্তি দিতে হবে।
১০. এই সনদ যারা ভঙ্গ করবে তাদের উপর আল্লাহ্তায়ালার অভিসম্পাত।
অমুসলমানের কাছে সাহায্য চাওয়া
মুসলিম অমুসলিমের কাছে দ্বীনী ব্যাপারাধি ছাড়া চিকিৎসা, শিল্প, কৃষি প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতে সাহায্য চাইতে পারে, তাতে কোন দোষ নেই। শাসন কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ মানুষ সকলের জন্যেই এ অনুমতি রয়েছে। তবে একথা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ যেমন এ সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদের স্বনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা একান্তই কর্তব্য।
নবী করীম (সাঃ) নিজে অমুসলিমের কাছ থেকে বিভিন্ন কাজে ও ক্ষেত্রে মজুরির বিনিময়ে সাহায্য নিয়েছেন, কাজ করিয়েছেন। হিজরত করার সময় পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে তিনি মক্কার মুশরিক আব্দুল্লাহ ইবনে আরীকতের সাহায্য গ্রহণ করেছেন। আলেমগণ বলেন, কেউ কাফির হলে যে কোন বিষয়েই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না, এমন কথা জরুরী নয়। মদীনার পথে মক্কা ত্যাগ করার মত কাজে পথ দেখিয়ে সাহায্য করার জন্যে একজন মুশরিকের সাহায্য গ্রহণ করায় এ পর্যায়ের সব দ্বিধা-দ্বনদ্ব সহজেই দূর হয়ে যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, মুসলমানের নেতার পক্ষে অমুসলিমের কাছে সাহায্য চাওয়া-বিশেষ করে আহলি কিতাবের লোকদের কাছে-সম্পূর্ণ জায়েয বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধে এদের শরীক করা ও বিজয় লাভ হলে ‘মুসলমানদের ন্যায় তাদেরও গনিমতের অংশ দেয়ায়ও নাজায়েয কিছুই নেই। জুহরী বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (সাঃ) যুদ্ধে ইয়াহুদীদের সাহায্য নিয়েছেন ও মুসলমানদের ন্যায় তাদেরও গনিমতের মাল দিয়েছেন। হুনাইন যুদ্ধে ছওয়ান ইবনে উমাইয়া মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও রাসূলে করীম (সাঃ)-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করেছেন।
তবে শর্ত এই যে, যে অমুসলিমের সাহায্য গ্রহণ করা হবে, মুসলমানদের ব্যাপারে তার ভাল মত ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। যদি তাদের বিশ্বাস করা না যায়, তাহলে অবশ্য সাহায্য গ্রহণ জায়েয হবে না। কেননা বিশ্বাস অযোগ্য মুসলমানের সাহায্য গ্রহণেই যখন নিষিদ্ধ, তখন বিশ্বাস অযোগ্য কাফিরের সাহায্য গ্রহণের তো কোন প্রশ্নই ওঠে না।
মুসলিম অমুসলিমকে হাদিয়া তোহফা দিতে পারে, তাঁর দেয়া হাদিয়া তোহফা গ্রহণও করতে পারে। নবী করীম (সাঃ) অমুসলিম রাজা-বাদশাহের দেয়া হাদিয়া-তোহফা কবুল করেছেন। এ পর্যায়ে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হয়েছে। নবী-বেগম হযরত উম্মে সালমা (রা.) কে নবী করীম (সাঃ) বরেছিলেন :
‘আমি নাজ্জাশী বাদশাকে রেমশী চাদর ইত্যাদি তোহফা পাঠিয়েছিলাম।’
বস্তুত : ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসেবেই মর্যাদা দেয়, সম্মান করে। তাহলে আহলি কিতাব, যিম্মী ও চুক্তিবদ্ধ কোন মানুষের সাথে অনুরূপ মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার ও আচরণ অবলম্বিত হবে না কেন?
যিম্মী
ইসলামী রাষ্ট্রের ছায়াতলে যে সব অমুসলিম বাস করে, তাদের জন্যে ইসলাম বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মুসলিম পরিভাষায় তাদের বলা হয় ‘যিম্মী’। ‘যিম্মী’ শব্দের অর্থ ‘চুক্তি’-ওয়াদা। এ শব্দটি জানিয়ে দেয় যে, এদের জন্যে আল্লাহ্র এবং তা রাসূলের একটা ওয়াদা রয়েছে। মুসলিম জামায়াত সে ওয়াদা পালনে বাধ্য। আর তা হচ্ছে এই যে, তারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারবে।
আধুনিক ব্যাখ্যায় এরা ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী-নাগরিক। প্রথম দিন থেকেই মুসলিম সমাজ এ সময় পর্যন্ত এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমদের জন্যে যে অধিকার, অমুসলিমদের জন্যেও সেই অধিকার। তাদের যা দায়-দায়িত্ব এদেরও দায়-দায়িত্ব তাই। তবে শুধু আকিদা, বিশ্বাস ও দ্বীন সংক্রান্ত ব্যাপারাদিতে তাদের সাথে কোন মিল বা সামঞ্জস্য নেই। কেননা ইসলাম তাদেরকে তাদের দ্বীন ধর্মের উপর বহাল থাকার পূর্ণ আযাদী দিয়েছে।
যিম্মীদের সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) খুব কড়া ভাষায়, মুসলমানদের নসীহত করেছেন এবং সেই নসীহতের বিরোধিতা বা লঙ্ঘন হলে আল্লাহ্র অসন্তোষ অবধারিত বলে জানিয়েছেন। হাদীসে নবী করীমের কথা উদ্ধৃত হয়েছে :
‘যে লোক কোন যিম্মীকে কষ্ট বা জ্বালা-যন্ত্রণা দিল, সে যেন আমাকে কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণা দিল। আর যে লোক আমাকে জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট দিল, সে মহান আল্লাহকে কষ্ট দিল।’
‘যে লোক কোন যিম্মীকে কষ্ট দিল, আমি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী। আর আমি যার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী, তার বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি মামলা লড়ব।’ (আবু দাউস)।
‘যে লোক কোন চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তির উপর জুলুম করবে কিংবা তার হক নষ্ট করবে অথবা শক্তি-সামর্থ্যের অধিক বোঝা তার উপর চাপাবে কিংবা তার ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া তার কোন জিনিস নিয়ে নেবে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে মামলা লড়ব।’
রাসূলে করীম (সাঃ)-এর খলিফাগণ এ সব অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার আদায় ও মর্যাদা রক্ষায় সব সময় সচেতন-সতর্ক থাকতেন। ইসলামের ফিকাহবিদগণ মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এ সব অধিকার ও মর্যাদার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
মালিকী মাযহাবের ফিকাহবিদ শিহাবুদ্দীন আল-কিরাফী বলেছেন : যিম্মীদের সাথে কৃত চুক্তি আমাদের উপর তাদের কতিপয় অধিকার ওয়াজিব করে দিয়েছে। কেননা তারা আমাদের প্রতিবেশী হয়ে আমাদের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার অধীন এসে গেছে। আল্লাহ, রাসূল ও দ্বীন ইসলাম তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে। কাজেই যে লোক তাদের উপর কোন রকমের বাড়াবাড়ি করবে সামান্য মাত্রায় হলেও তা আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং দ্বীন-ইসলামের দেয়া নিরাপত্তা বিনষ্ট করার অপরাধে অপরাধী হবে। তাদের খারাপ কথা বলা, তাদের মধ্যে থেকে কারো গীবত করা বা তাদের কোন রূপ কষ্ট জ্বালা দেয়া অথবা এ ধরনের কাজে সহযোগিতা করা ইত্যাদি সব এ নিরাপত্তা বিনষ্টের দিক।
যাহেরী মাযহাবের ফিকাহবিদ ইবনে হাজম বলেছেন : যেসব লোক যিম্মী, তাদের উপর যদি কেউ আক্রমণ করতে আসে, তাহলে তাদের পক্ষ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করার জন্যে অগ্রসর হওয়া ও তাদের জন্যে মৃত্যুবরণ করা আমাদের কর্তব্য। তাহলেই আমরা আল্লাহ ও রাসূলের নিরাপত্তা দেয়া লোকদের সংরক্ষণ করতে পারব। কেন না এ রূপ অবস্থায় তাদের অসহায় ও সহজ শিকার হতে দেয়া নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব পালনের পক্ষে বড্ড ক্ষতিকারক হবে।