অকাট্যতা

তানভির আহমেদ |

“যাই হোক, তুমি যতই বুদ্ধিমান হও না কেন – আমার এমন কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর আমাকে এখনও পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নি। তুমিও দিতে পারবে না। আর যারা দিয়েছে তারা আমাকে সন্তষ্ট করতে পারে নি। আমার প্রশ্নগুলোর অকাট্য উত্তর কেউ দিতে পারলে আমি আস্তিক হয়ে যেতাম। তোমাকে বলি শোন…”

“দাঁড়াও দাঁড়াও… এত তাড়াহুড়ো কীসের? আমি তো এসেছি কেবল মেহমানের সাথে দেখা করতে – আরমানের চাচাত ভাই বলে কথা। চল চল, কথা যদি বলতেই হয়, চা খেতে খেতে বলা যাবে।”

আরমান আর ওর ভাই দুইজনেই বিরক্ত হল। যেন ওরা একদমই ধরে নিয়েছিল যে আমি এসব নাস্তিকতা নিয়েই কথা বলতে এসেছি। দুজনের মুখ দেখেই মজা পেলাম। আরমান রেগেছে কারণ ওর আসলে তর সইছে না।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমিই শুরু করলাম, “তুমি বলছ তোমার এমন কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর কেউ দিতে পারে নাই; আর তোমার ধারণা আমিও দিতে পারব না, তাই তো? মানে The absolute question বা questions, ঠিক?”

“হ্যাঁ, আমি তাহলে শুরু করি…”

“তোমার প্রশ্ন আমার শোনা লাগবে না! সেটা তাকদীর বা ভাগ্য নিয়ে নাকি পাত্থর নিয়ে আমার তা জানা লাগবে না। শুধু শুনে যাও। মুসলিমদের পক্ষ থেকে The Absolute Answer বা অকাট্য উত্তরের বৈশিষ্ট্যই এমন… প্রশ্নই শোনার প্রয়োজন নেই।”

মানুষকে মাঝে মাঝে অবাক হতে সময় দিতে হয়, তানাহলে পরবর্তী ঘটনা বা কথায় মনোযোগ কমে যাবার আশাংকা থাকে। তাই একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলাম।

“শুনে রাখ, আমরা আল্লাহ সুবহানাহুর ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করেছি তাঁকে না দেখেই। কোনও প্রমাণ ছাড়াই। আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন কুরআনের শুরুতেই সূরা বাকারাহের ২য় ও ৩য় আয়াতে বলেছেন তাঁর কিতাব তাদেরই পথপ্রদর্শক ‘যারা অদেখা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে’, এর তাৎপর্য হল এই যে, কিছু মানুষ কখনোই বিশ্বাস করবে না। এমনকি তাদেরকে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করে দেখালেও তারা বলবে যে সেটা যাদু ছিল… হেন ছিল, তেন ছিল – কিন্তু বিশ্বাস স্থাপন করবে না। শেষমেশ বিশ্বাস ওই ‘না দেখা বিষয়েই’ গিয়ে পড়বে। আর তাই তুমি বিশ্বাস করবে কি করবে না সেটা তোমার নিয়্যাতের উপরই নির্ভরশীল হবে।

তুমি যদি বিশ্বাস করতে চাও তবে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর না জেনেই করতে হবে, আর বিশ্বাস করতে না চাইলে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জেনেও তুমি বিশ্বাস করবে না। তুমি প্রয়োজনে প্রমাণের অযোগ্য ‘মাল্টিভার্স’ থিউরিতে বিশ্বাস করবে, বিশ্বাস করবে কিছু গোঁড়ামিপূর্ণ মানুষ… মানুষের দেওয়া থিউরিতে… ভাবতেও হাস্যকরা লাগে, এতসব মানবরচিত থিউরির জোড়াতালি আর প্রশ্নের ছড়াছড়ি শুধুমাত্র আল্লাহকে অবিশ্বাস করবার জন্য! এই ধরনের থার্ডক্লাস মানুষেরা আবার জিজ্ঞাসা করে আল্লাহ কেন জাহান্নাম বানালেন!

কিন্তু হ্যাঁ, তার মানে এই না যে ওইসব ফালতু প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। অবশ্যই আছে আর সেগুলো আর কেউ না জানলেও আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঠিকই জানেন!” চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে রেখে দিলাম। আমার কন্ঠ আরও জোরালো হল।

বলতে থাকলাম, “আমাদেরকে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানানো হয় নাই। কারণ আমাদের সেগুলোর প্রয়োজন নাই। ‘আল্লাহ কেন মহাবিশ্ব সৃষ্টি করলেন, কীই বা হতো কিছু না সৃষ্টি করলে? এমনই একটি প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ ফেরেশতাদেরই বলেছিলেন ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’।

সুতরাং আমরা জানি না তো কী হয়েছে, আল্লাহ সুবহানাহু হলেন ‘আল-আলীম’ অর্থাৎ সর্বজ্ঞ The All Knowing, তাঁর জ্ঞানের উপর কোনো জ্ঞান বা প্রশ্ন নেই। তোমাদের প্রশ্ন তো কিছুই না।

আর তুমি যেমন বললে না! ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার। তার মানে তোমার মনে এই ধারণাও আসা স্বাভাবিক যে ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে সৃষ্টিকর্তা থাকবার। তুমি আর তোমার মত সমস্ত নাস্তিকেরাই তাদের বিশ্বাস নিয়ে দোদুল্যমান। আর সেটাই স্বাভাবিক। কারণ আল্লাহ মানুষের ভেতর তাঁকে বিশ্বাসের বিষয়টি ফিতরাতগতভাবে দিয়ে দেন, আর তা অবিকল থাকে যতক্ষণ না মানুষ দুনিয়ার বস্তাপচা তত্ত্ব খেয়ে খেয়ে সেই ফিতরাত নষ্ট করে ফেলে।

আমার কিন্তু কোনোই সন্দেহ নেই যে আল্লাহ রয়েছেন এবং একজনই রয়েছেন। এটি সবচেয়ে বড় সত্য। আর বিশ্বাস কর, তোমার আর তোমার মত নাস্তিকদের সমস্ত প্রশ্নের জবাব আল্লাহ দিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু কিয়ামতের দিনের আগে সেসবের জবাব তোমাদের পাওয়া হবে না। সেদিন তোমাদের কিছুই করার থাকবে না! ভয়ঙ্কর-মজার ব্যাপার কী জান? সেদিন তোমাদের সাথে অবিচারও করা হবে না। এ অবস্থায় মারা গেলে তোমরা সেদিন কী বলে কান্নাকাটি করবে জান? বলবে,‘আমরা নিজেদের সাথে জুলুম করেছি। ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের আরেকটি সুযোগ দিন’ কিন্তু কেউ সেদিন একথা বলবে না যে ‘আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই নি’ বা ‘আমার উপর জুলুম করা হয়েছে’।

না না, আসলে তাও না। আল্লাহ হচ্ছেন আমাদের রব! তিনি তো বাধ্য নন তাঁরই এক নগন্য সৃষ্টির প্রশ্নের উত্তর দিতে! আল্লাহকে অবিশ্বাস করে কোনো বড় কিছু হয়ে যায় নি কেউ। আল্লাহ তাকে উত্তর দিতে বাধ্য। বরং আমরা তাঁর বান্দা! আমরাই না আল্লাহর কাছে বাধ্য! আল্লাহু আকবার! তাই আমার তো মনে হয়, নাস্তিকদেরকে কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই জাহান্নামে ফেলে দেওয়াও হতে পারে। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ যদি তোমাদের প্রশ্নের উত্তর না ই দেন, তখন কী করবে?”

এতক্ষণে দেখলাম ছেলেটার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। কিন্তু আমি থামলাম না।

“তখন তোমরা এটা জানবে যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তিনি আল্লাহ। কিন্তু বান্দা হয়ে তোমার সৃষ্টিকর্তার সাথে দেখা তো দূরের কথা, কথাও বলতে পারবে না। এই মানসিক শাস্তিই তো তোমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। তুমি কি ভেবেছিলে জাহান্নামের আগুনের উত্তাপই সেখানকার সর্বোচ্চ শাস্তি! আর তুমি তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে সেখানে দিব্যি মানসিক শান্তিতে থাকবে! মোটেও না। জাহান্নামকে গড়া হয়েছে শারীরিক মানসিক সবদিক থেকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।

তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তোমাকে জাহান্নামে পাঠানো হবে নাকি না দিয়েই পাঠানো হবে সে বিচার আল্লাহ করবেন। কিন্তু একথাও আমরা জানি যে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন তাঁর জান্নাতি বান্দাদের সাথে সরাসরি দেখা করবেন ও কথা বলবেন। আর এটাই হল জান্নাতিদের সবচেয়ে বড় পাওয়া – তাঁদের রবের সাথে সাক্ষাত, যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাঁকে বান্দারা না দেখেই, কোনো অকাট্য প্রমাণ ব্যতিরেকেই, প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেয়েই বিশ্বাস করেছিল। অথবা হয়ত সে সৃষ্টির মধ্যেই যথেষ্ট প্রমাণ মেনে নিয়েছিল বা প্রশ্নগুলোর জানা উত্তরেই সন্তুষ্ট ছিল – কারণ সে মূলত বিশ্বাস করতে চেয়েছিল।

আমি ভাবলেও শিওরে উঠি যখন নাস্তিকেরা জানবে যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তাদের বিচারও হল। দুনিয়ায় থাকাকালীন ওই ‘না দেখে বিশ্বাস করা’ মানুষগুলো জান্নাতে গিয়ে আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছে অথচ তখন এত ঠাঁটবাট নিয়ে চলা নাস্তিকগুলো এত বিদ্যে আওড়ানোর পরও তাঁদের রবকেই দেখতে পাবে না। একটুখানি বিজ্ঞানের গোঁড়ামিতে একটুখানি বিশ্বাসই আর করা হল না! অথচ বিজ্ঞানের জ্ঞানও আল্লাহর রহমতেই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়েছিল! আফসোস এদের জন্য!”

আমার কণ্ঠ জোরালো হয়ে যাওয়ায় আশেপাশের অনেকেরই অনাকাঙ্ক্ষিত মনোযোগ আকর্ষণ করে ফেলেছি। আরমানের চাচাতো ভাই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। আরমানও ব্যতিক্রম নয়। যদ্দুর মনে পড়ে, এমন কড়াভাবে ও আগে কখনও আমাকে কথা বলতে দেখে নাই হয়ত।

আমি এবার একটু শান্ত হয়ে বললাম, “দেখো, তোমার যদি সত্যিই এমন কোনো প্রশ্ন থাকে যেগুলোর উত্তর তুমি সত্যিই জানতে চাও তাহলে তুমি জান্নাতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহুতা’লাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই পার! সুতরাং তোমারও ওই একটাই পথঃ সিরতল মুস্তাকিম!

তুমি বলেছ তোমার প্রশ্নগুলোর অকাট্য উত্তর কেউ দিতে পারলে তুমি আস্তিক হয়ে যেতে! হাস্যকর। তুমি আস্তিক হও বা না হও তাতে কেবল একজন ছাড়া কারও কোনো লাভক্ষতি নেই, কারও কিছু আসে যায় না। সে একমাত্র মানুষটি হচ্ছ তুমি নিজে। জান্নাত নয়তো জাহান্নাম… পছন্দ তোমার।

এটাই তোমার সমস্ত প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তরঃ কোনো প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ নেই বলেই আমরা মু’মিন অর্থাৎ বিশ্বাসী। অকাট্য প্রমাণ বা সোজা কথায় আল্লাহকে দেখলে পরে তো যে কেউই বিশ্বাস করতো। না দেখে বা অকাট্য প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করাটাই হলপরীক্ষা।

তাই তুমি যে যুক্তিই খোঁজো না কেন কোন সময়েই তা তোমার কাছে বিতর্কের ঊর্ধে যাবে না… যতক্ষণ না তুমি আসলে প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করতে চাও। তাই বলছি তোমার নিয়্যাত ঠিক করে নাও। সমস্ত উত্তর পেয়ে যাবে।”

-বলে উঠে পড়লাম।

আসার আগে বলে আসলাম, “মানুষকে মাঝে মাঝে একা চিন্তা করবার জন্য সময় দিতে হয়। তুমি চালাক হলে বুঝতে পারবে যে এই সময়টাতে শয়তান তোমাকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করবে। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে নিও।”

ওখানে আমি আর তখন দাঁড়াই নি। সালাম দিয়ে চলে এসেছি। শেষবার শুধু দেখলাম বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেটি। আরমানের দিকে খেয়াল করি নি।

আমি ছেলেটিকে তেমন কথাই বলতে দিই নাই। কারণ আমি চেয়েছি ও যেদিন বলবে সেদিন যেন বাকিরা শোনে। কিন্তু তার জন্য আগে শোনানোর প্রয়োজন ছিল। যাই হোক, সেদিন রাতে আরমানের সাথে মসজিদে দেখা হলে ও বলল ওর কাজিন নাকি এরপর তেমন একটা কথাই বলে নাই। মাগরিবের আগেই নাকি চলে গিয়েছিল।

“সুবহানাল্লাহ! ভাল লক্ষণ… ওর জন্য আমাদের দুয়া করা উচিত। এক কাজ করিস, আমার পুরনো ডায়েরিটা ওর সাথে দেখা হলে ওকে দিয়ে দিস। ওহ হো! তোর কাজিনের নামটাই তো জিজ্ঞাসা করা হয় নাই!”

…“সাজিদ”