জাফর আহমাদ |
ইসলাম ও ঈমান মানুষের আশা-আকাক্সাকে উৎসাহিত করে। পান্তরে নিরাশা ও হতাশাকে করে নিরুৎসাহিত। প্রকৃতপে যিনি আল্লাহকে প্রভু, রাসূল সা:কে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় নেতা ও ইসলামকে দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে তার কি কোনো হতাশা থাকতে পারে? না, কখনো না, হতাশা-নিরাশা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সব পাপ মা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি মাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা জুমার : ৫৩)। মূলত হতাশা ও নিরাশা হলো শয়তানের বৈশিষ্ট্য। শয়তানের এক নাম ইবলিশ, যার অর্থ হলো ‘নিরাশ’ বা ‘হতাশ’। মানুষ সৃষ্টির পরপরই আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, আদমকে সিজদা করো। কিন্তু সে অহঙ্কারবশত সেই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকৃতি জানাল। তার মধ্যে বর্ণবাদের অহঙ্কার জেগে উঠল। সে যুক্তি পেশ করে বলল, আমি আগুনের তৈরী; পান্তরে আদম মাটির তৈরী, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমি তাকে সিজদা করতে পারি না। তার এই অন্ধ যুক্তি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বিধায় সে হতাশা বা নিরাশার গভীর খাদে নিপ্তি হলো। এ জন্য তার এক নাম ইবলিশ, অর্থাৎ হতাশ বা নিরাশ হওয়ার কারণে তার নাম ইবলিশ। সে আল্লাহর লানতে নিপতিত হয়ে সেখান থেকে বহিষ্কৃত হলো। সে হতাশাগ্রস্ত ও তিগ্রস্তদের প্রধান জীব। সে তার আসল পরিচয় গোপন করে বন্ধু বা হিতাকাক্সী সেজে হজরত আদম আ:কে কুপরামর্শ দেয়ার কারণে সে তার নাম শয়তান অর্থ ‘প্রচ্ছন্ন শক্তি’ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করল। প্রচ্ছন্ন রূপ ধারণ করেই সে মানুষকে ধোঁকা দেয়। সে আসল রূপ বা সত্য কথা বলে মুমিনদের ধোঁকা দিতে পারে না। যেই বিষয়ে সে মানুষকে ধোঁকায় ফেলে, সেটি মানুষের সামনে সুন্দর, চাকচিক্য ও মোহনীয় আকারে উপস্থাপন করে থাকে। যার কারণে মানুষ সাময়িক সেই রূপের পেছনে দৌড়াতে থাকে।
পান্তরে আদম আ: ও তার স্ত্রী যখন নিজেদের ত্রুটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেন, তখন তারা নিরাশ না হয়ে করুণার আধার গাফুরুর রাহিম মহান রবের মার জন্য আশাবাদী হয়ে ওঠেন। আল্লাহর প্রতি মজবুত ঈমান ও পূর্ণ তাওয়াক্কুল থাকার কারণে তাদের মধ্যে এ আশা জেগে ওঠে যে, তাদের প্রভু তাদেরকে মা করে দেবেন। ফলে তারা বলতে লাগলেন, ‘প্রভু হে! আমরা তো নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলেছি। এখন যদি তুমি আমাদের মা ও দয়া না করো, তাহলে তো আমরা তিগ্রস্ত বা ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।’ (সূরা আরাফ : ২৩)। তাদের প্রভু তাদেরকে নিরাশ করেননি, বরং তাদের তাওবা কবুল করে তাদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সে দিন আদম আ: যদি তাঁর প্রভুর ব্যাপারে আশাবাদী না হয়ে শয়তানের মতো হতাশ হতেন, তাহলে তাঁর ব্যাপারেও আল্লাহর সিদ্ধান্ত হয়তো বা ভিন্ন হতো। হজরত আদম আ:-এর দোয়ায় আমরা দেখেছি, তিনি বলেছেন, তাহলে তো আমরা তিগ্রস্ত বা ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।’ এখানে তিগ্রস্ত বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এখানে তিগ্রস্ত বলতে হতাশাগ্রস্ত ইবলিশ ও তার অনুসারীদেরকেই বোঝানো হয়েছে। সুতরাং ‘হতাশা বা নিরাশা’ শয়তানের বৈশিষ্ট্য। আর ‘আশা’ হলো নবী-রাসূল ও আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্তদের বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ার যত আম্বিয়ায়ে কেরাম এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই দুনিয়াজোড়া বিপদকে মাথায় নিয়েও তাঁদের পথে অটল রয়েছেন। হতাশা কখনো তাঁদের পথরোধ করে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ তাঁরা জানতেন যে, আল্লাহর মহানত্বের সামনে এ ধরনের আপদ-মসিবত একেবারেই তুচ্ছ। হিজরতের সময় হজরত আবুবকর সিদ্দিক রা:-এর কথার জবাবে আল্লাহর রাসূল সা: বলেছিলেন, “আমরা দু’জন মাত্র নই, বরং আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন।” মানুষ যত বড় ত্রুটি-বিচ্যুতিই করুক, আল্লাহ গাফুরুর রাহিমের সামনে তা সামান্য। তিনি পাহাড়সম ত্রুটিও মাফ করে দিতে পারেন। দুনিয়ার সামান্য সম্পদ পাওয়ার জন্য আমরা যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই, না পেলে হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হই, আল্লাহর কাছে তা খুবই সামান্য ব্যাপার। সুতরাং ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে, মাল-সামান ও ইজ্জত-আব্রু এবং অন্যান্য বস্তুগত বা অবস্তুগত জিনিস না পেলে হতাশ হওয়া মানে আল্লাহর মহানত্ব, গাফুরুর রাহিম ও মহান দাতার গুণগুলোকে অস্বীকার বা খাটো করার শামিল।
আশার মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে। আশার কারণে মানুষ কাজ করে, কথা বলে, পথ চলে। আশা মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তির চাকাকে সচল রাখে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে আশা না থাকলে মানুষ অসামাজিক এক আজব জীবে পরিণত হয়। আশা সফলতার মূল চাবিকাঠি। মনে রাখা প্রয়োজন, আশা ঈমানের সাথেও সংশ্লিষ্ট। তাওয়াক্কুলের প্রবল বিশ্বাস ছাড়া মানুষ আশা করতে পারে না। অর্থাৎ আশা তাওয়াক্কুল থেকে আর তাওয়াক্কুল করা যায় তখনই যখন ঈমান প্রবল হয়।
নিরাশা বা হতাশা এমন এক তিকর বদ গুণ, যা মানুষের সর্বপ্রকার যোগ্যতাকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। শারীরিকভাবে মানুষের জীবনীশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনের কর্মক্ষেত্রে নেমে আসে ঢিলেমি। সামনে চলার পথকে করে রুদ্ধ। হতাশা সফলতার প্রধান শত্রু। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা কখনো সফলতার মুখ দেখতে পায় না। পৃথিবীর সফল মানুষ কখনো হতাশাকে তাদের কাছে ভিড়তে দেয়নি। হতাশা মানুষের মনোভাবকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, সব বিষয়ে ইতিবাচকতাকে পরিহার করে নেতিবাচকতার পথে চলতে থাকে। অর্থাৎ নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ ধরনের ব্যক্তিরা সাধারণত নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। এ ধরনের ব্যক্তিরা সাধারণত নেতিবাচকতাকে প্রচ্ছন্ন-অপ্রচ্ছন্ন দু’ভাবে প্রকাশ করে থাকে। যেমন- একটি ভালো কাজের প্রতি সব মানুষ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, কিন্তু একমাত্র ওই ব্যক্তি যে হতাশা রোগে আক্রান্ত, সে তার মনোভাব এমনভাবে প্রকাশ করবে যে, প্রাথমিকভাবে বোঝা যাবে না সে নেতিবাচক নাকি ইতিবাচক। গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সে প্রচ্ছন্নভাবে নেতিবাচক মতই ব্যক্ত করেছে। হতাশাগ্রস্তরা নিজে কোনো সফলতার মুখ তো দেখতে পায়ই না, অধিকন্তু সে অন্যের সফলতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
হতাশা আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের বেলায়ও অবহেলা প্রকাশ করতে বাধ্য করে। এমনকি একপর্যায়ে নিজের বিফলতা বা ব্যর্থতার জন্য আল্লাহকে দোষারোপ করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। সে মনে করে ওই সফলতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চেয়ে সে-ই যথোপযুক্ত ছিল। তাকে না দিয়ে অন্যায় করা হয়েছে। ফলে সে তার পারিপার্শ্বিক সব কিছুকেই দোষারোপ করতে থাকে এবং সবার সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং সামাজিকভাবে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আল্লাহ রহমতের ব্যাপারে তার মধ্যে সংশয় দানা বেঁধে ওঠে। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। হতাশা ক্ষতি ছাড়া কোনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।
হতাশা নামক এই ঘাতককে দূর করার জন্য প্রথমত, আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বেশি বেশি করে কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করতে হবে। কারণ আল কুরআনে আশার কথাই বেশি বেশি বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সূরা বাকারা : ১৫৩)। দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সফলতা ফরজ ও নফল নামাজের ভেতরে নিহিত রয়েছে। রাসূল সা: কর্তৃক নির্ধারিত ব্যবস্থাপত্র হলো, যেকোনো জটিলতা থেকে উদ্ধার ও আল্লাহর নিয়ামতে ভূষিত হওয়ার জন্য নামাজে নিবিষ্ট হয়ে যাও। কাক্সিত বস্তুটি হুবহু লাভ না হলেও মানসিক প্রশান্তির সাথে সাথে অজ্ঞাতসারে অন্য কোনো উপায়ে এমন সফলতা নেমে আসবে, যার আশাও সে কোনো দিন করেনি এবং এমন আশা করা তার স্বপ্নের বিষয় ছিল অথবা প্রাপ্ত বস্তুটির ব্যাপারে সে নিজেকে অযোগ্য মনে করত।
ধৈর্য হতাশা রোগের একটি কার্যকরী প্রতিষেধক। ধৈর্য সফলতার সিঁড়ি। সর্বপ্রকার বিপদ অপসারণের জন্য এক মহৌষধ। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালার প থেকে সবর অপো উত্তম ও ব্যাপক দান কাউকে দেয়া হয়নি।’ (মিশকাত)। ধৈর্য মানুষের মধ্যে কতগুলো ব্যতিক্রমধর্মী গুণ সৃষ্টি করে। সুসময়ের জন্য অপো করা ধৈর্যশীলদের একটি বিশেষ গুণ এবং এটি একটি ইবাদতও বটে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘সুসময়ের জন্য অপো করা সর্বোত্তম ইবাদত। (মিশকাত)। মুমিন বান্দারা কোনো কিছু না পেলে অপো করে, ধৈর্যধারণ করে, কোনো প্রকার হা-হুতাশ করে না, কোনো অভিযোগ উত্থাপন করে না। বরং আল্লাহর কাছে নীরবে তার কথা বলে শান্তি ও স্বস্তি লাভ করে এবং শিগগিরই কাক্সিত বস্তুটি লাভ করে। কাক্সিত বস্তুটি লাভ না হলেও কোনো পরোয়া নেই। উভয় অবস্থায় প্রশান্তি লাভ করে। হজরত সুহাইব রা: বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। নিঃসন্দেহে তার প্রতিটি অবস্থাই উত্তম। মুমিন ছাড়া এমনটি আর কারো ভাগ্যে জোটে না। তাহলে আনন্দ অর্জিত হলে সে আল্লাহর শোকর আদায় করে। এটি তার জন্য উত্তম। আর কষ্ট হলে সে ধৈর্যধারণ করে। এটিও তার জন্য উত্তম।’ (মুসলিম)। বরং যারা কষ্টে ঘাবড়ে যায়, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আপত্তি-অভিযোগ উত্থাপন করে, তাদের সফলতা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। হতাশা যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে তখন এক দিকে আল্লাহর নাফরমান বান্দায় পরিণত হয়, অন্য দিকে তার শারীরিক ও মানসিক বিকৃতি ঘটে। এ বিকৃতি থেকে বাঁচার জন্য হতাশাকে অবশ্যই নিজে থেকে দূর করতে হবে। কল্যাণের পথে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহর ওপর ভরসা করার যোগ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার